পাগলা বাবুল : যে সিনেমা আজও অপরিহার্য
দেশটা কেমন চলছে?
সরকার দলীয়রা বলবে-‘খুব ভালো চলছে। বিরোধী দল বলবে-‘আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে। সাধারণ জনগণ যা বলতে চায় সেটা বলতে পারবে না। জনগণ সবচেয়ে অসহায়, তাদের কাজ দেশে যাই হোক শুধু দেখে যেতে হবে।
কাজী হায়াৎ তাঁর বাণিজ্যিক সিনেমা নির্মাণের ক্যারিয়ারকে সমৃদ্ধ করেছেন রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়ার মাধ্যমে। তাঁর এ সিনেমাগুলো ছিল প্রতিবাদের ভাষা। সে ভাষার প্লট থাকত সমাজের চলমান নানা সমস্যা যার মধ্যে রাজনীতি প্রধান উপাদান।
এরিস্টটল বলেছেন-‘মানুষ রাজনৈতিক জীব। ‘যে রাজনীতি করে না সেও ঐ রাজনীতির আওতায় পড়ে যায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। সিনেমার নায়ক মাসুদ শেখ রাজনীতি করতে চায়নি, চেয়েছিল পড়াশোনা করতে। কিন্তু সে রাজনীতিতে পড়ে গেল পরিস্থিতির চাপে। রাজপথে রাজনৈতিক মিছিলে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে।তারপর অবধারিত মারধর। নেতা রাজিব তাকে দেখতে আসে। তখন মাসুদ শেখ সব সত্য না বলে পাগলামি করে। ঐ পাগলামি থেকেই ‘পাগলা বাবুল’ নাম দাঁড়ায়। এর আগে কলেজের গভর্নিং বডির কাজী হায়াৎকে ভুলক্রমে বোমা মারার পর কাজী হায়াৎ মারা যায় আর তার মেয়ে কাঞ্চি অন্ধ হয়। মাসুদ শেখ বাধ্য হয়ে রাজনীাতিতে প্রবেশ করে। বস্তির মধ্যে আধিপত্য অনেকের জন্য মঙ্গলজনক হয়। দিলদার-নাসরিনরা তাকে দেখে শান্তিতে থাকতে পারে। মাসুদ বিপদে পড়লে বস্তিবাসীদের অনেকেই তাকে আশ্রয় দিতে চায় না। এর মাধ্যমে মানুষ যে স্বার্থপর এটা বোঝা যায়। রাজিবের সুবিধাবাদী আচরণের কারণে মাসুদ শেখ বাধার মুখে পড়ে।যে হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিল একদিন সে হাতই কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য।
কাজী হায়াৎ তাঁর সেইসব সিনেমার ভাষায় ও নির্মাণে পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র এ তিন আবহ আনতেন। মাস্টারমেকার বলে কথা।তিনি ‘পাগলা বাবুল’-কে প্রতিবাদের ভাষা করার আগে পরিবার থেকে সামাজিক যুদ্ধটা দেখান। মাসুদ শেখকে টিউশনি করে তাদের সংসারের একটা বড় খরচ চালাতে হয়। তার মু্খে যখন শোনা যায়-‘মাগো, গরিব হলে টিউশনি করতে হয়’ তখন এটা কোনো সাধারণ সংলাপ হয় না। দেশের আপামর গরিব লোকের সাংসারিক বাস্তবতা হয়ে যায়।কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অনেক ছেলেমেয়ে এ বাস্তবতার মধ্যে আজও দিন পার করে। ব্যঙ্গাত্মক ভাষা অসৎ রাজনীতিবিদদের মুখোশ তুলে ধরা যায় না।সিনেমায় রাজিবের অসৎ রাজনীতিবিদের চেহারাকে প্রতিবাদী ভাষায় পরিবার থেকেই তুলে ধরা হয়েছে। রাজিবের স্ত্রী ডলি জহুর পদে পদে প্রতিবাদ করে তার কাজের। অন্যদিকে রাজিবের মেয়েও ব্যঙ্গ করে বাবাকে। মাসুদ শেখকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগানোর জন্য ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করার সময় রাজিব বলে-‘এই মালা আর গলায় মানায় না। ‘তখন রাজিবের মেয়ে বলে-‘বাবা, আরো একটা গলায় মানায়। কোরবাণীর পশুর গলায়।’খুবই সূক্ষ্ম এ বক্তব্য। কাজী হায়াৎ যে সাহসী বক্তব্য দিতে পরোয়া করতেন না সেটা পরিষ্কার বোঝা যায়। মাসুদ শেখ ক্যাডার হলেও আস্থা রেখেছে জনগণের উপর। এটাও কাজী হায়াতের রাজনৈতিক সচেতনতা। যে গণতন্ত্রের কথা বইয়ের পাতায় বা আব্রাহাম লিংকনের ‘by the people and for the people’ -এ শুনি সে গণতন্ত্রের চর্চা আজকের রাষ্ট্রে হয় না।ক্লাসরুমে গণতন্ত্রের ক্লাস করায় শিক্ষক কিন্তু ক্লাসের বাইরে কলেজ ক্যাম্পাসে সরকারি ক্যাডারের রাজত্ব চলে। এ সিনেমার প্রথম দৃশ্য তাই ক্লাসরুম থেকেই শুরু।কাজী হায়াৎ জানেন সিনেমাকে কীভাবে সমাজের দর্পণ বানাতে হয়। ভন্ড নেতা রাতিন যখন ফাঁকা বাড়িতে কাঞ্চিকে একা পেয়ে ধর্ষণ করতে চেয়েছিল মাসুদের হাতে ধরা পড়ে।জনগণের সামনে এনে বিচার চাইলে জনগণ মৃত্যুদণ্ড দেয়। মাসুদ গুলি করে মেরে ফেলে রাতিনকে। রাজিবকেও শেষ দৃশ্যে জনগণের হাতে তুলে দেয়। জনগণ মেরে ফেলে ভন্ড নেতাকে। জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস এ বিশ্বাস নির্মাতার ছিল।
আজকাল চলতে ফিরতে অলিতে-গলিতে দেখা যায় রাজনৈতিক পোস্টার। লেখা থাকে, অমুক নেতার নিঃশর্ত মুক্তি চাই।সিনেমাটিতে মাসুদ শেখ ওরফে পাগলা বাবুল পুলিশের হাতে ধরা পড়লে প্ল্যাকার্ডে ভরে যায় যেগুলোতে লেখা থাকে-‘যুবনেতা পাগলা বাবুলের নিঃশর্ত মুক্তি চাই।’ একদম বাস্তব চিত্র।
সিনেমার বাণিজ্যিক স্বার্থে গল্পে অন্যান্য বিষয়কে এনেছেন কাজী হায়াৎ। মাসুদ শেখের মা রাশেদা চৌধুরী মারা যায় ছেলের পথের দিকে তাকিয়ে। ছেলে যে ক্যাডার হয়েছে তা জানে না।দিলদার-নাসরিন জুটির বিহারী স্টাইলে কথা বলা এবং ভালোবাসার দারুণ সস্পর্ক দেখানো আলাদা আনন্দের জায়গা। মাসুদের সাথে অন্তরার প্রেমের অংশটি সেভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না কারণ প্রথম প্রেমটা ছিল কাঞ্চি। কাঞ্চিকে একটা চোখ দান করে মাসুদ। তার চোখ বোমার আঘাতে নষ্ট হয়েছিল সে অপরাধবোধ থেকে চোখ দেয়। কাঞ্চির বিয়ে হয় শাহিন আলমের সাথে। এ গল্পগুলো মূলগল্পকে সাপোর্ট করেছে একটা পরিণতির দিকে যেতে।
আজকের বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-রাজনীতি কোন পর্যায়ে আছে সেটি সবারই জানা। সরকারি-বিরোধী দলের কাদা ছোঁড়াছুড়িও সবারই জানা। সু্বিধাবাদী ভন্ড নেতারা ছাত্রদের কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে। একই অবস্থা তখন যেমন ছিল আজকেও আছে। এ অপরিহার্য অবস্থা দেশের জনগণ জানে, বোঝে কিন্তু থাকতে হয় মুখ বুজে। যাদের প্রতিবাদের ভাষা অাছে, সাহস অাছে তারা বসে থাকে না। সে ভাষা বা সাহস কাজী হায়াৎ-এর ছিল। তিনি দেখাতে চান ‘পাগলা বাবুল’-দের দরকার যুগে যুগে ঠিক ঐ গীতার শ্লোকের মতো-‘ধর্মসংস্থাপনার্থায়া সম্ভবামি যুগে যুগে।’
আজকের ঢালিউডে সামান্য রাজনৈতিক বক্তব্য থাকলেই সেন্সর করা হয় গোড়া থেকে বক্তব্যটা ছেঁটে ফেলার জন্য। ‘রানা প্লাজা’ সিনেমাটি শেষ পর্যন্ত প্রদর্শনের অনুপযুক্ত বলে দোহাই দিয়ে নিষিদ্ধ করা হল। ‘দেশা দ্য লিডার’ সিনেমার লাস্ট সিকোয়েন্সে রাজনৈতিক ভন্ডামির বিরুদ্ধে বক্তব্যকে কাট করা হয় যার জন্য আকস্মিক শেষ হয় সিনেমাটি যেখানে শেষ হওয়ার কথা নয়।অথচ নিকট অতীতে নব্বই দশকের সিনেমা ‘পাগলা বাবুল’ কত জ্বলন্ত বাস্তবকে দেখিয়ে রাজনৈতিক প্রতিবাদে open language ব্যবহার করা হয়েছে। ভাবতেও অবাক লাগে তখন কোন লেভেলের সিনেমা হত! চেতনায় সবাই যায় এগিয়ে আর আমরা থাকি পিছিয়ে সম্ভবত পেছানোতেই আনন্দ আমাদের!
রাজনৈতিক সব সুবিধা, অন্যায়ের প্রাণকেন্দ্র শহর। তাই মাসুদ শেখের মুখে কাজী হায়াৎ গুঁজে দেন অসাধারণ এ সংলাপ যে সংলাপ আজও অপরিহার্য-‘ইস! গ্রামের মানুষগুলো কী বোকা! শহরে কতকিছু ঘটে তারা কিছুই জানে না। তারা মনে করে দেশটা ভালোই চলছে।’
পাগলা বাবুল ছবিটি দেখুন ইউটিউবে:
https://www.youtube.com/watch?v=9iBSZV-Vkv0
পোস্টার কৃতজ্ঞতা : সানোয়ার সানু