পাঠশালা : শিক্ষণীয় শিশুতোষ স্বপ্ন-বাস্তব
সমাজ পরিবর্তন খুব লং টার্ম প্রসেস, সমাজ উপস্থাপন ধারাবাহিকভাবে দেখানোর জিনিস। সমাজ উপস্থাপনটা আগে জরুরি। আপনি সমস্যা তুলে না ধরলে সমাধান কোনোভাবেই আনতে পারবেন না কিংবা জনমত গঠন করতে পারবেন না। চলচ্চিত্র সমাজ উপস্থাপনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। সমাজ উপস্থাপনের মতো অনেক বিষয়ের মধ্যে শিশুদের বাস্তবতা উপস্থাপনের প্রয়োজন অনেক বেশি। ‘পাঠশালা‘ শিশুদের পৃথিবীকে জানার ও অনুভব করার শিক্ষামূলক ছবি। যৌথভাবে ছবির পরিচালক ফয়সাল রদ্দি ও আসিফ আসলাম।
শিশুতোষ ছবি বাংলাদেশে যথেষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, পুরস্কার, দূরত্ব, লিলিপুটরা বড় হবে, আকাশ কত দূরে’ অন্যতম। ছবি নির্মাণের স্বতন্ত্র প্লট থেকে ছবিগুলো নির্মিত হয়েছে। সামাজিক সমস্যার মধ্যে এনে দর্শককে মাঠ পর্যায়ের শিশুদের একটা সুনির্দিষ্ট গল্প তুলে ধরেছে ‘পাঠশালা’ ছবিটি। তা হচ্ছে ঝরে পড়া শিশুর শিশুশ্রমে যোগ দেয়া পাশাপাশি পড়ার স্বপ্ন পুষে রাখা এবং বাস্তব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়া। এর মধ্য দিয়ে দর্শকের কাছে জিজ্ঞাসা রাখা হয়েছে এ ধরনের শিশুদের জন্য সমাজের মানুষের বা প্রতিষ্ঠানের কি কি করণীয় আছে।
‘পাঠশালা’ ছবির ন্যারেটিভ এত নির্দিষ্ট করা যে এর গল্পে ঢুকতে দর্শকের কোনো সমস্যা হবে না এবং চরিত্রগুলোর চিত্রণ বুঝতেও বেগ পেতে হবে না। ন্যারেটিভ অনুযায়ী বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে ছবিটিকে –
* মানিকের পরিচয়
* মানিকের ঝরে পড়া
* তার স্বপ্ন
* তার সঙ্গ
* স্বনির্ভর হওয়া
* মানিকের বন্ধুত্ব
* তার রিয়েলিটি ও ফ্যান্টাসি
* স্কুলকে সাধনা ও সিদ্ধিতে পরিণত করা
এগুলো স্তরেরে স্তরে ছবির গল্পকে দর্শকের সাথে রিলেট করে।
‘পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই
একসাথে খেলি আর পাঠশালে যাই’
কবি বন্দে আলী মিয়ার এ কালজয়ী কবিতাটি সামাজিক সমতার কথা বলে। ‘পাড়া’ বলতে আপনি এখানে সমাজ ধরতে পারেন কারণ একজন বা একটি বাড়ি মিলিয়ে পাড়া তো হয় না। সবার সম্পর্ককে ভাই ভাই বলা হয়েছে। পাঠশালাতে ভ্রাতৃত্ববোধ মনের মধ্যে রেখেই যেতে হবে সবাই সমানভাবে শিখবে বলে। ‘পাঠশালা’ ছবির মানিক প্রথমত পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পরে আর পড়তে পারেনি ঝরে গেছে। ঝরে যাওয়ার পর তার শিশুশ্রম শুরু হয়েছে। পাঠশালার স্বপ্ন তার মন থেকে মুছে যায়নি। তার স্বপ্নকে আরো বড় জায়গা থেকে দেখার জন্য মায়ের মুখের বাণীটি তার কাছে অনুপ্রেরণা ছিল-‘শেখনের ইচ্ছা থাকলে পুরা দুনিয়াডাই একটা স্কুল।’ তার মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছে এ কথাটাই। তাই কাজ ও পড়ার মধ্যে একটা ভারসাম্য আনতে পেরেছে। সুনির্মল বসু-র ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর / সবার আমি ছাত্র’ লাইনটিও এর সাথে জুড়ে দেয়া যায় সাপ্লিমেন্টারি হিসেবে। তাছাড়া জেফারের গানটিও তাই মিন করে-‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা তোর / সবার কাছে শিখিস।’ গানের ভাষার মধ্যে ‘তোর’ ভাষাগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে আপন করে বলতে ‘তুই’ সম্বোধন করা হয়েছে। মানিকের জীবনে এরপর সত্যিকার অর্থেই ‘শেখন প্রক্রিয়া’-টা দেখা গেছে পজেটিভ বা নেগেটিভ যেকোনোভাবেই। কালুর সাথে তার মেলামেশা এবং শিশু অপরাধের সিন্ডিকেটের সাথে পরিচয় হওয়া এগুলো ছিল ছবির সমাজ উপস্থাপনের দৃশ্যায়ন। ‘এই শহরে বড় হইতে গেলে শর্টকার্ট ছাড়া গতি নাই’ সংলাপে কালু চরিত্রের আলাদা গল্প থাকে তবে তা সমাজের জন্য নেগেটিভ। মানিকের মাধ্যমে নির্মাতা এই মেসেজটাও দিয়েছেন নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে খারাপ পথটা থেকে নিজেকে রক্ষা করা এবং মানিক তা পেরেছে। পারার পেছনে তার স্কুলে যাবার স্বপ্নটাই শক্তি ছিল।
ইমাজিনেশন বা ফ্যান্টাসি যাই বলি স্টোরি টেলিং-এ মানিকের অংশটিতে প্যারালালি ছিল সাথে রিয়েলিটির সংযোগ। সে তার শিশুশ্রমের ব্যস্ততার মধ্যেই ফ্যান্টাসিতে চলে যেত স্কুলে। স্কুলড্রেস পরে নায়কোচিত আনন্দে আয়নার সামনে পরখ করে নিজেকে। বন্ধুকে জাদু দেখানোর সময় তাকেও ফ্যান্টাসিতে নিয়ে যেত অ্যানিমেশনের ছোট্ট জগতে। ফ্যান্টাসিকে রিয়েলিটিতে আনতে স্কুলে যাবার সাফল্যটা সে অন্যভাবে আনে। নির্মাতার ভালো আইডিয়া ছিল মানিকের স্কুলে যাবার সাফল্যের গল্পটাকে দেখানোর পেছনে। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার কিছু সমস্যাও এসূত্রে এসেছে ছবিতে স্পেশালি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের চরিত্রে।
ভাষার ব্যবহারে বেশ ভালো দক্ষতা দেখিয়েছে নির্মাতা। ‘শর্টকার্ট, মাছ, টিকটিকি’ এগুলো ছিল সিম্বলিক ল্যাংগুয়েজ। পকেটমারাকে ‘মাছ’ ধরা আর পুলিশকে ‘টিকটিকি’ বলার ভাষাটা ছিন্নমূল ঝরে পড়া বাস্তবের শিকার শিশুদের নিজস্ব ভাষা। এটাকে ব্যবহার করাটা দরকার ছিল। জাতীয় সংসদের সামনে যে টোকাইরা বিভিন্নভাবে অ্যাকটিভ থাকে ভিড় দেখলে তাদের ল্যাংগুয়েজ প্যাটার্ন ফলো করলেও বোঝা যায় এই বিষয়টি। ‘বস রনেজ্ঞাবি লাখে’ উল্টোদিকে ‘সব বিজ্ঞানের খেলা’ সংলাপটিও ভাষাকে নিয়ে নতুন কোনো আমেজে শিশুদের বিনোদন দেয়ার উপাদান ছিল।
হাবিব আরিন্দা টোকাই নাট্যদলের শিল্পী হিসেবে পেশাদার অভিনয় করেছে। নতুন একজন শিশুশিল্পী পেল ইন্ডাস্ট্রি তাকে কাজে লাগানো যাবে। কালু চরিত্রের ছেলেটির নিজস্বতা থাকলেও ডায়লগ ডেলিভারি স্লো ছিল। হাবিবের বন্ধু চরিত্রের ইমা খুবই স্বতঃস্ফূর্ত। ফারহানা মিঠু-র প্রধান শিক্ষকের অভিনয় স্ট্রং। কাজী শাহির হুদা রুমি অসাধারণ। সবগুলো গানই ছিল পরিস্থিতি এবং কনটেন্ট অনুযায়ী পারফেক্ট।
‘সব মানিকের জন্য স্কুল চাই’ এবং ‘শেখনের ইচ্ছা থাকলে পুরা দুনিয়াডাই একটা স্কুল’ এই দুটি শ্লোগান ছবিটির জন্য বিশেষ কিছু ছিল। ওয়ার্ড অফ মাউথের মধ্যে লং টার্ম কিছু অ্যাসপেক্টও থাকে। যদি দর্শক ‘পাঠশালা’ ছবিকে মনে রাখে এই দুটি শ্লোগানের জন্য মনে রাখবে। অবশ্যই শিশুতোষ শিক্ষার গুরুত্বে social consciousness-এর অংশ হয়ে থাকবে শ্লোগান দুটি। ক্যামেরায় রূপসী বাংলার প্রাকৃতিক আবহের পাশাপাশি একটা সুন্দর শহরও এসেছে দেখার মতো।
‘পাঠশালা’-কে ন্যাচারালিটি রেখে নির্মিত একটি শিক্ষামূলক শিশুতোষ ছবির তালিকায় সচেতন দর্শক রাখবে। একটা দৃষ্টিনন্দন গাছের নিচে সাইকেল, ব্ল্যাকবোর্ড হেলে রেখে ছাত্রকে শিক্ষক প্রকৃতির মাঝে পড়াচ্ছেন এই প্রাকৃতিক পাঠশালার স্মৃতিও দর্শক মনে রাখবে। আর শেষকথা যা না বললেই নয়, এদেশের চলচ্চিত্রের বাস্তবতায় ‘পাঠশালা’ বাণিজ্যিক সাফল্যে ও প্রদর্শনে পিছিয়ে থাকলেও মনের দিক থেকে হৃদয়ে থেকে যাবে।