Select Page

পাস করেনি ‘পাষাণ’

পাস করেনি ‘পাষাণ’

পাষাণ
পরিচালনা : সৈকত নাসির
অভিনয়ে: ওম, বিদ্যা সিনহা মিম, মিশা সওদাগর, বিপাশা কবির, সাদেক বাচ্চু, শাহেদ আলী, ইলোরা গহর, মিজু আহমেদ, চিকন আলী, শিমুল খান, শামিম, নাদের চৌধুরী ও তানভীর তনু।
রেটিং : ১.৫/ ৫

৩৫ দিন পর প্রেক্ষাগৃহে নতুন বাংলা ছবি মুক্তি। স্বাভাবিকভাবেই সব কাজ ফেলে মুক্তির প্রথম দিনই ‘পাষাণ’ দেখতে গিয়েছিলাম। আর দশটা ছবি থেকে এ ছবিটি নিয়ে প্রত্যাশা সামান্য বেশি ছিল। কারণ ‘পাষাণ’ পরিচালনা করেছেন ‘দেশা-দ্য লিডার’ খ্যাত সৈকত নাসির; প্রথম ছবির জন্য যিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নিয়েছিলেন।

আজকাল বেশিরভাগ ছবি দেখেই নিজেকে প্রতারিত মনে হয়। দক্ষিণ ভারত কিংবা কোরিয়ান ছবির বাংলাদেশি সংস্করণ দেখে মন ভরেনা। বিশ্বাস ছিল, ‘পাষাণ’-এর গল্প, চিত্রনাট্য যেহেতু সৈকত নাসিরের, এ ছবিটি অন্তত নকল হবে না। সত্যিই তাই।

‘পাষাণ’ দেখার পর আমি অন্য কোনো দেশি কিংবা বিদেশি ছবির সঙ্গে হুবুহু মিল খুঁজে পাইনি। অর্থাৎ মৌলিক ছবির কাতারে অনায়াসে শামিল করা যায় ‘পাষাণ’কে। কিন্তু কেমন হলো এই মৌলিক ছবিটি? ছবি দেখা শেষ করে কি দর্শক এ ছবির কোনো সংলাপ বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবে? বাড়ি পৌঁছুবার পর এ ছবির এমন কোনো চরিত্র কি আছে, যা ঘুমুতে দেবে না? দুঃখজনক হলেও সত্যি, সব ক’টি প্রশ্নের উত্তরই নেতিবাচক।

i

‘পাষাণ’-এর গল্প রনিকে নিয়ে। ভাগ্য দোষে পরিস্থিতির চাপে খুলনার কিশোর রনির নিজ বাবাকে হত্যা করা এবং পরবর্তীতে একজন ভাড়াটে খুনী হওয়া নিয়ে ছবির গল্প। গল্পের শুরুটা অর্থাৎ রনির ছোটবেলার গল্প দেখতে বেশ লাগছিল। শিশুশিল্পীরা বেশ সাবলীল অভিনয় করে মুগ্ধ করেছে। তাছাড়া নির্মাতার আধুনিক চিত্রায়ণও চোখ এড়িয়ে যায়নি।

তবে গল্প যতই এগিয়ে গেছে, ততই ‘পাষাণ’ ছবির নামের স্বার্থকতা খুঁজেছি। পাইনি। নিজ বাবার হত্যাকারী রনি কেন অপরাধ জগতের অধিপতি হতে চান, কারণটি স্পষ্ট নয়। এমন যদি হতো, অপরাধ জগতের সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো কারণে বাবার প্রতি ছোটবেলায় রনির ঘৃণা জন্মেছিল, তাও মেনে নেয়া যেতো। রনি কেন এমন বসের অধীনে কাজ করতে চায়, যার কোনো বস থাকা যাবে না? সে কারণটিও খুব শক্ত নয়। ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়া বন্ধু দিয়া (বিদ্যা সিনহা মিম)-এর সঙ্গে বড়বেলায় পরিচয় পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু প্রণয়, পরিণয়-কোনো কিছুই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি।

বলা হয়েছে-রনি সাধারণ মানুষের চেয়েও অনেক বেশি বুদ্ধিমান। যদি তাই সত্যি হতো, নিজের বাবা (শাহেদ আলী) কেন পর নারীর দিকে আকৃষ্ট হয়েছিল (ইলোরা গহর), সেটি এত বছর পর সেই নারীর কাছ থেকেই শুনতে হতো না। তাছাড়া এত বছর পর সেই নারী এমন কি জানালেন যে, রনি নিজের বাবার দোষ ভুলতে শুরু করলেন? তাছাড়া দিয়ার গায়ে কে কিংবা কারা এবং কেন গুলি করলো, পরবর্তীতে লামিয়ার (বিপাশা কবির) কাছ থেকে শুনতে হতো না। গল্প এবং চিত্রনাট্য দেখে রনিকে বেশ আবেগী যুবক মনে হয়েছে। পাষাণ মনে হয়নি। পাষাণ হবার যতটুকু চেষ্টা ছিল, বেশিরভাগই ছিল বেশ কৃত্রিম।

সৈকত নাসির ‘দেশা-দ্য লিডার’ ছবিতে যতটুকু সম্ভাবনা দেখিয়েছিলেন, ‘পাষাণ’ ছবিতে বানিজ্যিকগত দিক দিয়ে তার উত্তরণ হয়েছে বলা যায়। তবে এটি সুস্পষ্ট, আমজনতার জন্য উপযোগী করে নির্মাণ করতে গিয়ে নিজের মেধাকে অনেকটাই নামিয়ে কাহিনী ও চিত্রনাট্য লিখেছেন তিনি। তাছাড়া এ ধরনের গল্প আরো দুই বছর আগে মুক্তি পেলে হয়তো ভালো লাগতো। কারণ ছবির নির্মাণে সৈকত নাসির যে আধুনিকতা দেখানোর চেষ্টা করেছেন, তা ইতিমধ্যেই অনেক ছবিতে আমরা দেখে ফেলেছি। এমন কোনো সংলাপ (দেলোয়ার হোসেন দিল) পাইনি, যা মন ছুঁয়ে গেছে। যদিও ছবির এরিয়াল শটগুলো বিশেষ করে মংলা বন্দরের দৃশ্যগুলো অসাধারণ ছিল। একটি ব্যাপারে কৃতিত্ব দিতেই হয়, আর দশটা গড়পড়তা ছবি থেকে এ ছবির চিত্রগ্রহণ (সাইফুল শাহীন), সম্পাদনা (তৌহিদ হোসেন চৌধুরী), শিল্প নির্দেশনা বেশ ভালো হয়েছে। অ্যাকশন (রাজেশ কান্নান) ভালো।

ক্রোমার কাজ বেশ দুর্বল ছিল। বিয়ে বাড়ি থেকে বাসে চড়ার দৃশ্যগুলোতে ক্রোমার কাজ কার্টুন ছবির মত লেগেছে। তাছাড়া বাংলাদেশ পুলিশের যে গাড়ি বার বার দেখানো হয়েছে, তা ছিল অবিশ্বাস্য। আরো কিছু ক্ষেত্রে ‘পাষাণ’ হতাশ করেছে। যেমন : পোশাক পরিকল্পনা। দিয়া (মিম) একজন সাংবাদিক হবার পরও যেসব প্যান্ট পড়ে লুকিয়ে অপরাধজগতের মানুষদের কার্যক্রম ধারণ করতে চান, তা এক কথায় হাস্যকর। তারপরও সৈকত নাসিরের এই নতুন ছবিটিকে দেখে অন্তত বস্তাপচা, অখাদ্য কিংবা সেকেলে উপাধি দেয়া যাবে না। আমি বিশ্বাস করি, সৈকত নাসিরের পক্ষে ‘এ ক্লাস’ মূলধারার বানিজ্যিক ছবি উপহার দেয়া সম্ভব। দরকার শুধু সময়োপযোগী চিত্রনাট্য ও যথাসময়ে চলচ্চিত্রের মুক্তি।

‘পাষাণ’ নায়ক কেন্দ্রিক ছবি। ওমের ওপর গল্প। অগ্নি টু, অঙ্গার, হিরো ৪২০ থেকে এ ছবিতে ওমের অভিনয়ে উত্তরণ হয়েছে। ওমকে লম্বা, কোঁকড়া চুলে (বিশেষ করে শিরোনাম গানে) বেশ নায়কোচিত লেগেছে। অভিনয়, নাচ, অ্যাকশনে ওমের চেষ্টা ছিল। ওমের চরিত্রে যদি তিনি নিজেই ডাবিং করে থাকেন অথবা অন্য কেউ যদি ডাবিং করেন, খেয়াল রাখতে হবে ভয়েস মড্যুলেশনের ব্যাপারটি।

বিদ্যা সিনহা মিমকে যেমন কিছু ক্ষেত্রে উচ্চারণের বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। ‘বুঝেছি’ শব্দটি বরাবরই মিম ‘বুজেছি’ বলেন। চ, ছ, জ, ঝ-এই চারটি অক্ষরে মীমের ঝামেলা হয়। মিম দেখতে অনিন্দ্য সুন্দরী। এমন সুন্দরী অভিনেত্রী বাংলাদেশে কম আছে, আর ওপার বাংলাতে তো নেই-ই। অথচ একের পর এক ছবিতে মীমের অপব্যবহার করছি আমরা। দুলাভাই জিন্দাবাদ, আমি নেতা হবো এবং পাষাণ-দেখার পর প্রশ্ন জেগেছে মনে, মিম সঠিক চলচ্চিত্র নির্বাচন করতে পারছেন না নাকি আমরা মিমকে সঠিক চলচ্চিত্র, চরিত্র দিচ্ছি না? দিয়া চরিত্রে মীমের ‘কমেডি’ অভিনয় বেশ কৃত্রিম মনে হয়েছে। বসের সাথে কর্মীর ঠিক একই রকম চরিত্র আমরা শুভশ্রীকে করতে দেখেছি ‘নবাব’ ছবিতে। তাছাড়া সায়নী ঘোষ (কানামাছি), ফারদীন খান (নো এন্ট্রি), জন আব্রাহাম ও অক্ষয় কুমার (গরম মসলা) প্রায় একই ধরনের কমেডি করেছেন অফিসের বসের সাথে। মীমের অভিনয় এ ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। এ ক্ষেত্রেও আমি বলবো, দিয়া চরিত্রে মিমকে নির্বাচন সঠিক ছিলনা। তবে ‘ও রানী’ গানে মিমকে দেখতে লাস্যময়ী সুন্দরী লেগেছে।

বিপাশা কবির তুলনায় অভিনয় করবার সুযোগ পেয়েছেন। ‘খাস জমিন’-এর তুলনায় এ ছবিতে তার অভিনয়, অভিব্যক্তি ভালো। তবে সংলাপ প্রক্ষেপণের সময় ওষ্ঠ এবং মুখশ্রীর ব্যবহারে আরো যতœশীল হতে হবে। ‘পাষাণ’ ছবি থেকে অবশ্য বিপাশাই সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছেন। কারণ ছবির শিরোনাম গানটি তিনি পেয়েছেন। আর এ গানে মন উজাড় করে নেচেছেনও। গানের কোরিওগ্রাফি, লোকেশন, পোষাক, ঐশীর কণ্ঠ, ওম-বিপাশার রসায়ন সবকিছুই ছিল দর্শকের জন্য ‘পয়সা উসুল’ অভিজ্ঞতা। মঞ্চে নাচবার জন্য একটি গান পেয়েছেন বিপাশা কবির।

মিশা সওদাগর এ ছবিতে অপরাধ জগতের অধিপতি আসলাম তালুকদার বাদশাহ চরিত্রে অভিনয় করেছেন। বরাবরের মত এ ছবিতেও তাকে উচ্চকিত অভিনয় করতে হয়েছে। নতুনত্ব কিছু পাইনি। তবে সুঅভিনেতা মিশা মানিয়ে গেছেন তার চরিত্রে। যদিও প্রত্যাশা রয়েছে, সামনের ছবিগুলোতে মিশা সওদাগর অভিনীত চরিত্রে এবং তার অভিনয়ে চমক থাকবে। নতুন কিছু থাকবে।

‘পাষাণ’ ছবিতে আরো অনেক গুণী অভিনেতা আছেন। তবে প্রায় সবাই অনুল্লেখযৌগ্য চরিত্রে কাজ করেছেন বলে মন ছুঁয়ে যেতে পারেননি। শাহেদ আলী যতটুকু কাজ করেছেন, বেশ ভালো। তাকে চলচ্চিত্রে নিয়মিত ব্যবহার করা উচিত। বয়সের কারণে ইলোরা গহর তার চরিত্রে একদমই বেমানান। হাস্যকরও লেগেছে। সাদেক বাচ্চু, প্রয়াত মিজু আহমেদ, আমির সিরাজী, নাদের চৌধুরী, শিমুল খান, চিকন আলী, শামিম, তানভীর তনু-সবাই আছেন ছবিতে। তবে কারো চরিত্রায়ণই সঠিকভাবে লেখা হয়নি। যে কারণে কারো অভিনয়ই মনে দাগ কাটতে পারেনি।

‘পাষাণ’ ছবিতে গান রয়েছে মাত্র তিনটি। অ্যাকশন ছবিতে গান কম থাকার বিষয়টি, সাহসী সিদ্ধান্ত। এটিকে সাধুবাদ জানাই। ছবির শিরোনাম গানটি নিয়ে আগেই বলেছি। তবে মূল নায়িকা হবার পরও মিম এ ছবিতে মাত্র একটি গান পেয়েছেন, বিষয়টি অপ্রত্যাশিত। তাও সুরপ্রধান কোনো প্রেমের গান পাননি তিনি। ‘ও রানী’ গানটি দেখতে ভালো লেগেছে। ‘বেবি’ গানে মেঘলার নাচ ও লেমিসের গাওয়া গান তেমন কোনো আবেদন তৈরি করতে পারেনি। তবে আবহ সংগীত (ইমন সাহা) ও নৃত্য পরিচালনা (বব, হাবিব) প্রশংসার দাবীদার। সব মিলিয়ে ‘পাষাণ’-দেখে পাষাণের মত করেই বলতে হচ্ছে, পাস করেনি ‘পাষাণ’। দেখতে আকর্ষণীয় মনে হলেও এ গল্পে ‘আত্মা’ নেই। মন ছুঁয়ে যাওয়ার অনেক উপাদান নেই।

*রিভিউটি সমকালের ২৯ মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত।


Leave a reply