পুরোনো গ্রামোফোন
চৈত্রের দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে পিঠ। কুকুরের পিঠে রোঁয়া ওঠার মতো সবুজ মাঠ খিলখিল করে হাসছে এবং ধানী জমিতে ফাটলে ফাটলে বয়ে যাচ্ছে বাতাস। আর রোদ যেন আরও উজ্জ্বল সবুজ করে তুলেছে গাছেদের। তাদের ফাঁক-ফোঁকরে নাচছে কয়েকটা চড়ুই। দুয়েকটি ঘুঘু, একজোড়া শালিক। বাবুই পাখিদের দেখি না বহুদিন। এমনকি দোয়েলও। তবুও এসব দিনে মাছরাঙাদের অহংকারি ওড়ে যাওয়া মনে পড়ে আর মনে পড়ে অখিল বন্ধু ঘোষকে।
কবেকার সেই আত্মভোলা শিল্পী অখিল বন্ধু ঘোষ বিচার দিয়েছিলেন দয়ালকে। যে বাঁশি তাঁকে গুম করেছিল, খুন করেছিল তার ফাঁসি চেয়েছিলেন তিনি। বাঁশি তবে এতটাই নির্দয়! নির্দয় তো বটে। নইলে শচীন দেব বর্মণ কী আর গাইতেন, ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই/সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি/সে যে দিন-দুপুরে চুরি করে/রাত্রিরেতে কথা নাই/ডাকাতিয়া বাঁশি…’
বাঁশি ডাকাতও বটে। কেবল ‘রঘু ডাকাত’ই নয়; সে চোর এবং জোচ্চুরও। দিন-দুপুরে বাঁশি বাজিয়েই না শ্রীকৃষ্ণ উতলা করেছিল সর্বেশ্বেরী রাধার মন। ষোলো হাজার গোপীর হৃদয় চুরি করা কি অতই সোজা ছিল যশোদা পুত্রের! যদি না থাকতো বাঁশি? উহাই তো চন্দনা মজুমদারের ‘কালার বাঁশি’।
বাঁশি— নামক যন্ত্রটি না থাকলে গ্রাম-বাংলার রূপ যেন আরেকটু অবগুন্ঠণে রয়ে যেতো। হরিৎ তেঁতুলের ছায়াঢাকা মাঠে ধেনু চরাতে চরাতে পায়ে ঘুঙুর পরে, বাঁশি বাজিয়েই না রাখাল বালিকা-বধূদের আপাদমস্তক রূপকে আরও তীব্র করে তুলেছিল। হাজার হাজার বছর ধরে বাজছে বাঁশের বাঁশরী। কোথাও গিয়ে তা হয়েছে স্যাক্সোফোন, ক্লারিনেট বা ট্রাম্পেট। কিংবা ব্যাক-পাইপ।
তবুও আজ বলি, পুরোনো দিনের মতো পুরোনো গানের মতো পুরোনো সেই বাঁশিও আজ হারালো কোথায়? সে কি এখনও ঢেউ তুলতে পারে কর্পোরেট সময়ে আবেগশূন্য হতে বসা মানুষের মনে? শচীন কর্তার বাঁশির বাঁশে ঘুণ ধরেনি। ঘুণ ধরেছে আমাদের জীর্ণ-রগ্ন মনে। শহরে কোনো রিশকাওয়ালা আচম্বিতে প্যাডেল মারতে মারতে সুর তুলে বসলে বাঁশিতে আমাদের ভ্রু কুঁচকে যায়। অবশ্য অবাক হওয়া চোখের সংখ্যাই বেশি।
নাগরিক হতে গিয়ে দিনদিন আমাদের হৃদয় জটিল হয়েছে। উৎপলকুমার বসুর ভাষায়, ‘দেখেছি পাহাড়। দেখে জটিল হয়েছি’— মতোন। এই ‘জটিল’ শব্দ যখন এলো তখন কানে বেজে ওঠল একটি নাম। জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। নামখানা বড় অদ্ভুতুড়ে হলেও স্বভাবে ও গানে কিন্তু উনি স্রোতোস্বিনী। কখনও কলকল কখনও শান্ত-চুপচাপ জলচলার ন্যায় তাঁর কণ্ঠে বয়ে যেতো সুর। সেই জল একদিন নিজের চোখেই দেখতে পেয়েছিলেন জটিলেশ্বর। তাই তো অমন দরাজ ও বেদনার ভাবে গেয়ে ওঠেছিলেন, ‘বধুয়া আমার চোখে জল এনেছে হায় বিনা কারণে।’
জটিলেশ্বরের অমন সুরেলা ও সরল কণ্ঠ তো হবেই। সতীনাথ মুখোপাধ্যায় থেকে যে টানা দশটি বছর তালিম নিয়েছিলেন উনি! সতীনাথের ছাত্র হওয়া কি অত সোজা?
এই যে এখন লিখতে বসলাম, আর কী কাকতালীয়! আকাশ ছেয়ে গেছে মেঘে। দমকা হাওয়ায় ভেসে ভেসে আসছে বৃষ্টির নির্মেদ গন্ধ। এহেন মুহূর্তে ‘এমন ঘণঘোর বরিষায়’ না হয় বাদই দিলাম, এমন বাঙালি কি পাওয়া যাবে যে কভু শুনেনি ‘আকাশ এত মেঘলা/যেও নাকো একলা/এখনই নামবে অন্ধকার?’
সতীনাথের কণ্ঠের ভেতর দিয়ে যেন কেঁপে কেঁপে ওঠে বরষা। বহুকাল আগে যখন সান্ত্রীরা মস্ত পাখায় মোঘল বাদশাহদের হাওয়া দিতেন তেমনি ধীর-চঞ্চলতায় গাইতেন তিনি। আমার তো তাই মনে হয়। কতজনের কত কী মনে হতে পারে! কেউ হয়তো বলবেন, কামার যেমন তপ্ত লোহায় হাঁপরে বাতাস দেয় তেমনটাই হলেন সতীনাথ। অনেকে বলবেন, উনি তো আ¤্রমুকুলের দম্ভচূর্ণ হাওয়া।
তেমনই এক ঝোড়ো হাওয়ার নাম হেমন্ত। হেমন্ত মুখার্জি। উনাকে নিয়ে বলার সাহস আপাতত আমার নেই। একটা শব্দ জুড়ে দেওয়া যায় উনার নামের পাশে— বাংলা গানের স¤্রাট। না হলে কি ওভাবে ‘ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা’ গাওয়া যায়?
এই গানের কথা যখন এলো তখন আরেক কিংবদন্তির কথা বলা যাক— সলিল চৌধুরী। কতটা প্রেম, ভালোবাসা, দরদ ও দখল থাকলে সুর করা যায় অমন এক গানের! কবীর সুমনের পোস্টার গান ‘তোমাকে চাই’ শোনেনি এমন বাংলা গানপ্রেমী শ্রোতা খুব কম পাওয়া যাবে। এবার একটু গুনগুন করে গাওয়া যাক, ‘সলিল চৌধুরীর ফেলে আসা গানে/চৌরাশিয়ার বাঁশি মুখরিত প্রাণে/ভুলে যাওয়া হিমাংশু দত্ত’র সুরে/সেই কবেকার অনুরোধের আসরে।’
এই গানে আরেকজন বাঙালি সুরকারকে স্মরণ করেছেন কবীর সুমন। হিমাংশু দত্ত— যাঁকে বলা হয় বাংলা আধুনিক গানের জনক। এমন মন্তব্য স্বয়ং সলিল চৌধুরীর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও অতুল প্রসাদ সেনদের মতো মহারথীদের প্রভাববিস্তারী বাংলা সঙ্গীত জাদুতেও যিনি হারিয়ে যাননি আজও। হারিয়ে যাননি শ্যামল মিত্রও। বাংলা আধুনিক গানের আরেক রাজা তিনি। ‘ঐ আঁকাবাঁকা যে পথ যায় সুদুরে’ সেই পথে তিনি হেঁটে বেড়িয়েছেন বাংলা গানে।
ছোটবেলায় আমার প্রিয় শিল্পী ছিলেন ভুপেন হাজারিকা। আহা! কী এক পাহাড়ি ঝরনার ন্যায় কণ্ঠ ছিল তাঁর! যেন এক গভীর নিঃসঙ্গ ভ্রমণ। ‘মানুষ মানুষের জন্য’, ‘সাগর সঙ্গমে’ থেকে ‘ও গঙ্গা তুমি বইছো কেন?’— তাঁর এমন কোনো গান নেই যা না শোনে এড়িয়ে যাবেন। ভুপেন হাজারিকার গানে প্রতিবাদ, প্রশ্ন, প্রেম যেন একসঙ্গে মিশে গেছে গঙ্গায়। বলা যায়, আজকের সময়ে তাঁর অন্যতম উত্তরসূরি— নচিকেতা।
ভুপেন হাজারিকার গান খুব পছন্দ করতেন আমার বাবা। অবশ্য তাঁর প্রিয় ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত। খুব ছোটবেলায় ইন্দ্রানী সেন, সাগর সেন, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, সাদী মহম্মদ— নামগুলোর সঙ্গে তখন পরিচয়। আমার অবশ্য রবীন্দ্রসঙ্গীত ভালো লাগে সুচিত্রা মিত্র, দেবব্রত বিশ্বাস ও কবীর সুমনের কণ্ঠে।
কিশোর কুমারের কথা কি বলেছি? না বললে লেখাটা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। কয়েকদিন ধরে টানা কিশোর কুমারের গান শুনছিলাম। বিশেষ করে ‘আকাশ কেন ডাকে’ এবং এর হিন্দী ভার্সন ‘ইয়ে শাম মাস্তানি’। অতি আগ্রহে উনার উইকিতে দিয়ে দেখি দারুণ ও আশ্চর্যজনক এক তথ্য! কিশোর বাবুর জন্ম ৪ আগস্ট, ভোর ৪ ঘটিকায়। তিনি বাবা-মায়ের চতুর্থ সন্তান। বিয়ে করেছেন ৪ বার। অভিনয় করেছেন ৪টি বাংলা চলচ্চিত্রে। এই ধরনের তথ্যে আমার বরাবর আগ্রহ। মিল খুঁজে পাওয়া জিনিসে আমি আশ্চর্য হই।
বন্ধু-বান্ধবদের আড্ডায় ‘কফি হাউজের সেই আড্ডা’ গানটা শুনেনি বা গায়নি এমন কেউ কি আছে? এমন চিরসবুজ গান বাংলা গানের জগতে আর কোনটায় বা আছে? মান্না দে’র অবশ্য কোন গানটা চিরসবুজ নয়? ‘সবাই তো সুখি হতে চাই’ থেকে ‘দ্বীপ ছিল শিখা ছিল’— কখনও কি পুরোনো হওয়ার মতো?
সময় গড়িয়ে যাবে। তরুণেরা বৃদ্ধ হবে। প্রজন্মের চাহিদা পূরণের নাম দিয়ে পুরোনো গানগুলো রিমেক হবে, বাজার হবে। প্রযুক্তি বসবে গলায়। তারপরও কখনও কি পুরোনো হবে আব্দুল জব্বারের ‘তুমি কি দেখেছো কভু’ গানটি? জীবনের প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া এমন গান কি এখন হয়? কিংবা আব্দুল আলীমের ‘এই যে দুনিয়া কিসেরও লাগিয়া’?
মনে করুন, একদিন টাইম মেশিনে চড়ে গ্রামোফোন বা ফিতা ক্যাসেটের সময়ে ফিরে গেছেন। বাজছে ক্যাসেটের দুই পাশে দুই লোকসঙ্গীত কিংবদন্তি আব্বাস উদ্দীন ও আব্দুল আলীমের গান। ভাবুন তো কেমন হবে! কল্পনা ও স্বপ্ন দেখার দ্বার বন্ধ হলে বয়স বেড়ে যায় মানুষের। বয়স বাড়লে নস্টালজিক হয়ে ওঠে মন। আর তখন রথীন্দ্রনাথ রায়ের কণ্ঠে শুনতে ইচ্ছে করে ‘সবাই বলে বয়স বাড়ে, আমি বলি কমে রে…।’