পূর্ণিমার অালোয়
বন্ধুমহলে পূর্ণিমাকে নিয়ে বাজি ধরেছিলাম। বাজিটা টিকে যাবে তা ভেবে বাজিটা ধরিনি কিন্তু।তারপরেও টিকে গেছে।বন্ধুদের সাথে গ্রামের খাড়ি নদীর পুলে বসে এক সন্ধ্যা তুমুল তর্ক হয়ে গেল সেবার। ১৯৯৮ সালের এক সন্ধ্যায় ‘এ জীবন তোমার আমার’ সিনেমাটি দেখে বন্ধুদের বললাম ‘মেয়েটা কী সুন্দরী দেখেছিস! এ মেয়ে অনেকদূর যাবে। ‘এই ‘অনেকদূর’ শব্দটাকে বন্ধুরা মানতে চাইল না।এক বন্ধু বলল ‘তুই বললেই হবে নাকিরে?’ বললাম ‘আমার মনটা বলে মেয়েটা অনেকদূর যাবে।’
সেই ‘অনেকদূর’-এর সূত্রে এক পূর্ণিমা তার নামের মতোই ভরা পূর্ণিমায় অালো ছড়াতে ভুল করেনি।তার সময়ের সব প্রথম সারির নায়ক যেমন রিয়াজ, মান্না, আমিন খান, ফেরদৌস, শাকিল খান, শাকিব খান তাদের সাথে সিনেমা করেছে।মেয়েটা থেমে থাকেনি।নিজের চরিত্রকে পুরো স্পেস দিয়ে নিজের প্রতিভাকে বের করে অানত সে।সবার ক্যারিয়ারে যে ঝুলিটা থাকে সেটা পূর্ণিমার ক্ষেত্রেও আর খালি থাকল না।সেখানে উর্বর শস্যই ফললো।
পূর্ণিমার সময়টা ছিল প্রতিযোগিতার। এমনিতেই তার চেয়ে সিনিয়র সব শিল্পীদের সাথে তাকে তাল মেলাতে হয়েছে। তাল ঠিকই ছিল। বাণিজ্যিক সিনেমা করতে গিয়ে তার অভিনয়ে বাণিজ্যিক সিনোমার শরীরী ভাষাই ফুটে উঠত আবার এক্সপেরিমেন্ট করা যায় যে সিনেমাগুলোতে সেগুলোতেও তাকে অন্যরকম প্রতিভাবান মনে হল। অালোটা তাই দুদিকেই ছড়াল।
‘এ জীবন তোমার আমার’ ছবিঘরে দেখার সময় একটা সিকোয়েন্সে সবার চোখ অাটকে গেল। রিয়াজের সাথে এক কোমর পানিতে পূর্ণিমা। চিঠি দিয়েছিল রিয়াজ কিন্তু কিচ্ছু লেখা ছিল না। পূর্ণিমা বলছিল ‘অনেক অাশা নিয়ে একটা চিঠি খোলার পরে যখন দেখি কিছুই লেখা নেই তখন কেমন লাগে বলোতো’। মনে আছে দর্শক সব শিস ও করতালি দিতে লাগল। ‘নিঃশ্বাসে তুমি বিশ্বাসে তুমি’ দেখতে গিয়ে অবাক করা কান্ডটা দেখলাম। কান্ড হচ্ছে সিনেমায় শাবনূরের মতো অসাধারণ শিল্পী থাকার পরেও পূর্ণিমার দিকে সবার অাগ্রহ ছিল বেশি। ঘটনা বুঝতে দেরি হয়নি। পূর্ণিমাকে তখনই যে দর্শক ভালোমত গ্রহণ করা শুরু করেছে প্রমাণটা পেলাম। তারপর সিনেমা দেখতে দেখতে মন বলল এইতো ঢালিউডে আর একটা ‘অসাধারণ’ কেউ এল বলে। রিয়াজ যখন পূর্ণিমাকে দেখাশোনা করতে থাকে অজান্তে তাকে ভালোবাসে।কিন্তু রিয়াজের ভালোবাসা শাবনূরকে জানার পর পূর্ণিমা রিয়াজকে বলে তার প্রতি ভালোবাসার মৃদুমধু ক্ষণগুলোর কথা। ‘কেন, তুমি বলোনি একশো একটা গোলাপের মাঝে অামার জন্য এনেছ একটা লাল গোলাপ?’ পূর্ণিমার মুখের এ সংলাপ অনেকদিন আমাদের বন্ধুমহলে মুখরিত ছিল। শেষ সিকোয়েন্সে বিদেশ যাবার আগে রিয়াজকে শাবনূরের হাতে দিয়ে বলা সংলাপগুলো অসাধারণ ‘আমার ভালোবাসাকে তোমার হাতে দিয়ে গেলাম। আমি জোর করে ধরে রাখতে পারতাম।তোমার ক্ষমতা ছিল না ঠেকানোর’। তখন পূর্ণিমাকে শাবনূরের মতো জাঁদরেল অভিনেত্রীর পাশে বেশ পারদর্শী লেগেছে।
২০০৩ এর শীতের মৌসুমী হাওয়া যখন দারুণভাবে গায়ে কাঁপন ধরাচ্ছিল কে জানত ‘মনের মাঝে তুমি’ সিনেমাটাও কাঁপন ধরাবে সবার মনে। যা ভেবেছিলাম তার একবর্ণও মিথ্যে হয়নি। ছেলেবুড়ো সবার মুখে ঘুরেফিরে ঐ একই গান ‘প্রেমি ও প্রেমি’। বাপরে বাপ হাটে, মাঠে, বাজারে, চায়ের দোকানে, বিয়ের বাড়িতে, স্কুল-কলেজ গোয়িং ছেলেমেয়ে কে গায়নি এ গান তাই বলুন! ‘আকাশছোঁয়া স্বপ্ন অাশা’ গানে টলিউডের যীশুর সাথে পূর্ণিমার নাচ দেখার মতো ছিল।’মনের মাঝে তুমি টাইটেল ট্র্যাকে রিয়াজের সাথে পূর্ণিমার নাচকে বলতে হয় জাস্ট ওয়াও। একটা ভরা জোয়ার দেখলাম রিয়াজ-পূর্ণিমার ঐ সিনেমার রোমান্সে যার ভাটাটা আজও পড়েনি। ‘হৃদয়ের কথা, অাকাশছোঁয়া ভালোবাসা’ এ দুটো সমানভাবেই রিয়াজ-পূর্ণিমা জুটিকে ঢালিউডে টিকিয়ে দিল অবধারিতভাবেই। ‘কে আমি, জামাই শ্বশুর, লাল দরিয়া, মনে রেখ আমায়, তোমাকেই খুঁজছি,মায়ের সম্মান’ সবগুলোই রিয়াজ-পূর্ণিমাকে প্রতিষ্ঠা দিল জুটির সাফল্যে।
ফেরদৌসের সাথে ‘মধু-পূর্ণিমা’ রোমান্টিক ফোক সিনেমার চমৎকার সংযোজন। মান্নার সাথে ‘বাপবেটার লড়াই, মনের সাথে যুদ্ধ’ দেখার মতো সিনেমা। নিজেকে ঝালিয়ে নিতেও কম করেনি পূর্ণিমা।এক একটা ‘সুভা, শাস্তি, মেঘের পরে মেঘ, রাক্ষুসী, মেঘলা আকাশ’ তাকে নতুনভাবে সক্ষম করে তুলল। ‘সুভা’-র কথা কী-ই বা বলব! যে মেয়ের এক্সপ্রেশন দেখে মনে হয় সে তো সত্যিই রবিঠাকুরের সুভাষিণী হয়েও ভাষাহীন। তাকে জীবন্ত বোবা মনে হয়।শাকিব খানের সাথে নদীর তীরে তার রোমান্স বা শাকিবের বোঝানো কথাগুলো বোবারা যেমনি করে বুঝতে অভ্যস্ত সেভাবেই বোঝার চেষ্টাটা করে। ‘শাস্তি’-র চন্দরা স্বামীর দেয়া মিথ্যে খুনি পরিচয় নিয়ে বাঁচতে না চাওয়া একটা অসহায় বধূ যার শেষ চাওয়াটা জানতে চাইলে সে বলে ‘মরণ’।
‘মেঘের পরে মেঘ’ এত কঠিন ছিল যে পূর্ণিমা চ্যালেন্জ নিয়েই কাজটা করেছে। বৃদ্ধা পূর্ণিমা তার ছেলে শাকিলকে বাবা রিয়াজের গল্প শোনায় ডায়েরির স্টোরি টেলিং এ। গল্পে ঢুকে বোকা রিয়াজের বৌ হিশেবে পূর্ণিমা আর মুক্তিযুদ্ধের বোকা রিয়াজের রাজাকারের পরিণতিতে মৃত্যু হওয়ার পর ম্যাচিউর রিয়াজ আসে একই রকম দেখতে সে সুবাদে।কিন্তু বাস্তবতা পিছু ছাড়ে না। এই রিয়াজও পড়ে যায় ভিলেজ পলিটিক্সে। খোঁজ নিলে জানা যায় বোকা রিয়াজের রাজাকার পরিচয়ে এই রিয়াজ দোষী হয়ে যায় ভুলবশত। শেষরক্ষা হয় না। তাই গাছে ঝুলিয়ে মারা হয়। পূর্ণিমা রিয়াজের বদলে যাওয়া দেখেই অবাক হয় কিভাবে একটা লোক এত বোকা থেকে পাল্টে গেল। বৃদ্ধা পূর্ণিমা শেষ সিকোয়েন্সে রিয়াজকে ফাঁসি দেয়া গাছের দিকে তাকায় যখন সেটা ছিল অনবদ্য। ‘রাক্ষুসী’ তে পূর্ণিমা ফেরদৌসের সঙ্গে প্রেম করে তার সংসারে অশান্তি করে। টাফ ছিল কাজটা। নিম্নবর্গীয় চরিত্র করতে খাটতে হয়েছে।পূর্ণিমা নিজেকে প্রমাণ করতে তার সেরা সাধনাটাই করেছে বাণিজ্যিক ও সাহিত্যনির্ভর এক্সপেরিমেন্টে।
পূর্ণিমার গান দেখতে বসলে তার মুখের দিকে তাকিয়েই বড় একটা সময় পার হয়। এত ইনোসেন্ট আর ফ্রেশ লুক কমই আছে। ‘নিঃশ্বাসে তুুমি বিশ্বাসে তুমি’-র সাড়াজাগানো গানটি ‘জীবনে মরণে তুমি আমারই’ দেখে ছেলেপেলেরা পূর্ণিমার গ্ল্যামার আর আবেদন দেখে থ হবার যোগাড়। ‘মনের মাঝে তুমি’-র গানগুলো এত এত আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা পেল যে আজ সেসব ক্লাসিক। ‘আকাশছোঁয়া স্বপ্ন আশা’ গানে যীশুর সাথে পূর্ণিমার নাচ মুগ্ধ করে।রিয়াজের সাথে ‘প্রেমি ও প্রেমি, মনের মাঝে তুমি, চুপি চুপি কিছু কথা’ এ তিনটি গান একেবারে বাঁধাই করে রাখা প্রিয় জিনিস যেন। ‘চুপি চুপি কিছু কথা’ গানে আয়নার মধ্যে রিয়াজকে চুপি চুপি দেখার সময় এক্সপ্রেশনগুলো জাস্ট ওয়াও। ‘হৃদয়ের কথা’-র ‘ভালোবাসব বাসব রে বন্ধু’ এ গান ইউটিউবে কদিন আগেও সর্বোচ্চবার দেখা গান ছিল। ঐ সিনেমার ‘তোমার কারণে আমি উচ্ছল’ এবং ‘যায় দিন’ মনে রাখার মতো গান।’লাল দরিয়া’ সিনেমার ‘সে আমার ভালোবাসার অায়না’ গানটি অত্যন্ত শ্রুতিমধুর। রেডিওতে সেসময় খুব বাজাত। ‘সুভা’-র ‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী’ শাকিব-পূর্ণিমা জুটির বেস্ট গান। ‘আমার সকল দুখের প্রদীপ’ রবীন্দ্রসঙ্গীতটিকে বেদনার আবহে ফুটিয়ে তুলতে পূর্ণিমার স্যাড এক্সপ্রেশনগুলো শুধু খেয়াল করে দেখুন টের পাবেন সে বড় আর্টিস্ট। ‘মেঘের পরে মেঘ’ সিনেমার ‘ভালোবাসি সকালে’ গানটি যে কোনো প্রেমিক মনকে হরণ করবে। ‘বাপবেটার লড়াই’ সিনেমায় মান্নার সাথে ‘কখনো কি চেয়েছিলে জানতে’ অন্যতম সেরা। ‘ছায়াছবি’ নামে যে সিনেমাটি আটকে আছে সেটার ‘দ্বিতীয় ভালোবাসা, পথ, মন যা বলে বলুক, টাইটেল ট্র্যাক’ চারটা গানে পূর্ণিমাকে দেখুন, তাকে ঢালিউডে আজও কতটা দরকার ভাবতে বাধ্য হবেন।
বন্ধুমহলে বাজি ধরে ভুল করিনি।যে ভরা পূর্ণিমা দেখেছিলাম একদা তার আলো ম্লান ছিল না, স্নিগ্ধই ছিল। স্নিগ্ধতা আজো আছে। আজো পূর্ণিমা আলো নিয়ে আছে, শুধু আলোর প্রত্যাশীরা হাতটা বাড়ালেই কাজের কাজটি হয়।
পূর্ণিমার অালো আরো পেতে চাই
আপনারাও চান নিশ্চয়ই ..