প্রজন্ম তৈরির ব্যর্থতায় ঢালিউড
আজকের ঢালিউড নিয়ে এই যে এত অতৃপ্তি এর পেছনে কারণ অনেকের কাছে অন্তত একটা করে পাওয়া যাবে। সবগুলো কারণ জড়ো করলে অনেক হয়ে যাবে। ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ থেকে কিছু কথা সবার সাথে শেয়ার করা দরকার এর মধ্যে অনেকের সাথে মিলে যেতে পারে কাকতালীয়ভাবে।
বর্তমান ঢালিউডের বড় আকারের একটা ব্যর্থতার জন্য দায় কার? দায় আসলে ঢালিউডের নিজেরই। অনেকে হয়তো বলবেন সরাসরি দোষারোপ করাটা ঠিক হচ্ছে কিনা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাস্তবটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখালে সরাসরি বলাটাই মঙ্গলের। আজকের ঢালিউডের খারাপ অবস্থার জন্য এর আগের প্রজন্মের ঢালিউড অনেকাংশে দায়ী।
আশির দশকের শেষার্ধ্ব থেকেই যদি ধরি বাণিজ্যিকভাবে ঢালিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি রমরমা অবস্থায় ছিল অন্তত নব্বই দশকের শেষ পর্যন্ত। এক দশক রাজত্ব করেছিল বাণিজ্যিক ছবির ব্যবসা। তখন খেয়াল করলে দেখবেন পরিপূর্ণ একটা মেকানিজম ছিল ইন্ডাস্ট্রিতে এবং সেটার আকার ছিল এমন – দক্ষ পরিচালক, দক্ষ প্রযোজক, দক্ষ অভিনয়শিল্পী, দক্ষ ক্যামেরাম্যান, দক্ষ চিত্রনাট্যকার, গুণী গীতিকার-সুরকার-কণ্ঠশিল্পী, দক্ষ চলচ্চিত্র পত্রিকা, দক্ষ প্রচারণা (যেমন – দৈনিক আজকের কাগজ, দৈনিক ইত্তেফাক, চিপাসস), পর্যাপ্ত সিনেমাহল।
এই পুরোপুরি মেকানিজমটা একসাথে collapse করেছে বর্তমান প্রজন্মে। পরিচালকরা ছবি করে গেছেন, প্রযোজকরা টাকা লগ্নি করে গেছেন, অভিনয়শিল্পীরা অভিনয় করে গেছেন, বাদবাকি যাদের কথা বলা হলো তাঁরাও তাঁদের কাজ করে গেছেন। পুরো সেই ইউনিটটা তাঁদের ভালো সময়টাকে জাস্ট উপভোগ করে গেছেন পাশাপাশি দর্শককেও পয়সা উসুল ছবি উপহার দিয়ে গেছেন, তাদের সন্তুষ্ট করেছেন। কিন্তু শূন্যস্থানটা তাঁরা রেখে গেছেন ঠিকই। আজ থেকে ত্রিশ বছর পর যখন ঐ ভালো সময়টা আর থাকবে না বা পুরনো যারা এত সাফল্য পেয়েছেন তারা যখন থাকবেন না তাদের বিকল্প তৈরি করতে হবে কিনা সে চিন্তা সেই প্রজন্ম করে যান নি। যদি যেতেন তাহলে সেই আমলের পরিচালকদের মতো বাণিজ্যিক ছবির ভাষা ঠিক রাখা ছবি আজও নির্মিত হত। তখনকার দশজন নামকরা পরিচালক আজকের দিনের জন্য আরো দশজন পরিচালক দিয়ে যান নি, তখনকার সফল দশজন প্রযোজক আজকের দিনের জন্য আরো দশজন প্রযোজক দিয়ে যান নি, সেদিনের পর্দা কাঁপানো অভিনয়শিল্পীদের মতো আরো অভিনয়শিল্পী এ সময়ের জন্য তৈরি করা হয় নি, সেদিনের জীবনমুখী-কালজয়ী-জনপ্রিয় গান তৈরি করা গীতিকার ও সুরকাররা আজকের দিনের জন্য তাঁদের উত্তরাধিকার রেখে যান নি, চলচ্চিত্র প্রচারণার জন্য তখনকার শক্তিশালী মিডিয়া আজকের জন্য তাদের উত্তরাধিকার রেখে যায় নি, সিনেমাহল মালিকদের দৌরাত্ম্য আর প্রযোজকের ন্যায্য টাকা না দেয়ার কালচারকে সমঅধিকারের সিস্টেমে আনা হয় নি। তো পুরো সিস্টেমটা একসাথে collapse করবে না তো কি হবে!
এবার আসা যাক প্রজন্ম তৈরি কি আসলেই করা যায়! এর জন্য পাশের দেশের দিকে তাকালে উত্তরটা পাওয়া যাবে। নব্বই দশকে বলিউডে যে প্রজন্ম ছিল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি চালানোর জন্য তারা কিন্তু তাদের প্রজন্ম তৈরি করে গেছে তাই আজকেও তাদের দারুণ অবস্থান। তারা পরিচালক-প্রযোজক-অভিনয়শিল্পী-মিডিয়া সবকিছুই একসাথে তৈরি করে দিয়ে গেছে জাস্ট তারা সময়ের সাথে আপগ্রেড হয়েছে। আমাদের এখনকার কোনো অভিনয়শিল্পীর যদি অভিনয়ের সমস্যা থাকে তো কোর্স করার জন্য ভারতে যায়। তার মানে ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি কিন্তু আর্টিস্ট তৈরির প্রফেশনাল প্ল্যাটফর্ম চালু রেখেছে আগে থেকেই তাই তাদের মেকানিজম পুরোপুরি ফিট আছে। আমাদেরটাও ঠিক থাকত যদি আমরা সিরিয়াস থাকতাম। আমাদের এখানে পরিচালক তৈরির কাজ করা যেত একটা বেড়ে ওঠা প্রজন্মের কাজের প্রতিযোগিতা করে, প্রযোজক তৈরি করা যেত বাণিজ্যিক ছবির ভাষা ঠিক রেখে ছবি বানানো পরিচালকদের দিয়ে, অভিনয়শিল্পী তৈরি করা যেত জেলায় জেলায় অভিনয় সম্পর্কিত কোর্স করার ব্যবস্থা করে তাহলে আজকের দিনে নায়ক-নায়িকা-খলনায়ক-কমেডিয়ান-বাবা মার চরিত্র করা সব অভিনয়শিল্পীই পাওয়া যেত।
আমরা নির্দিষ্ট একটা সময়ের জন্য ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ আয়োজন করে সেটা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কেন করেছিলাম? কারণ তখন তো ইন্ডাস্ট্রিতে সব ধরণের শিল্পীই ছিল কোনো আকাল ছিল না তাই। ভবিষ্যৎ চিন্তা না করার কারণে আজকে আকাল তৈরি হয়েছে। সোজা কথায়-‘যেমন কর্ম তেমন ফল।’ নব্বইতে ‘দীপু নাম্বার টু, দুখাই’ মুক্তির পরে ‘চিপাসস’ (চিত্রালী পাঠক সম্পাদক সম্মেলন) আয়োজন করত মত বিনিময় সভার। কত চমৎকার উদ্যোগ ছিল নতুন ছবি মুক্তির পরে সেটা নিয়ে মত বিনিময় করার। দৈনিক ইত্তেফাক, আজকের কাগজ তাদের একটা করে পেজই বরাদ্দ রাখত প্রতি সপ্তাহের/মাসের মুক্তি প্রতীক্ষিত ছবির বিজ্ঞাপন ছাপানোর জন্য। সেগুলোর ধারাবাহিক ব্যবসায়িক রিপোর্টও ছাপা হত। বছর শেষে সালতামামি দেয়া হত। কোথায় আজ সেসব প্র্যাকটিস! একসাথে সব শেষ হয়েছে। পুরো মেকানিজমটাকে এর আগের প্রজন্মই তৈরি করতে পারত এসব চালু রেখে কিন্তু রাখে নি। তাই আজকে এত এত সমস্যা। যেহেতু কোয়ালিটি নেই তাই কোয়ানটিটির দাপট স্বাভাবিকভাবেই বেশি হয়ে গেছে, কোয়ালিটির থেকে ভিউয়ের ক্যালকুলেশন বেশি হয়ে গেছে, অভিনয় পারাদের থেকে অভিনয় না পারাদের রাজত্ব বেশি হয়ে গেছে, ভালোর থেকে মন্দর রাজত্ব বেশি হয়ে গেছে।
গত দশ বছরে কয়টা গান আপনি বলতে পারবেন যেগুলো আপনার মনপ্রাণ ছুঁয়েছে? আপনি একা একা গুনগুন করেন এমন গান কয়টা পাবেন?
কয়জন পরিচালকের নাম বলতে পারবেন যারা আপনাকে এক নামে চেনার জন্য ওয়ার্ড অফ মাউথ টাইপের ছবি দিতে পেরেছে!
কয়জন গীতিকার-সুরকার পাবেন যারা আপনাকে লিরিক মনে রাখতে বা সুরের জাদুতে আচ্ছন্ন করাতে পেরেছেন!
এমন কোনো দৃশ্য কি মনে করতে পারেন যেটা দেখে চোখ জুড়িয়েছে বা বহুদিন মনে রাখতে পারবেন!
কয়টা সংলাপ মনে রাখতে পেরেছেন যে সংলাপগুলো শুনলেই চোখের সামনে ছবির দৃশ্য বা অভিনয়শিল্পীদের অভিনয় চোখে ভাসে!
কয়জন নায়ক-নায়িকা পাবেন যারা আপনার এক্সপেক্টেশন লেভেলকে এমনভাবে ছুঁয়েছে যে আপনি তাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন!
হিসাবটা কষে দেখুন হতাশাই মিলবে।
ভারতীয় যে টলিউডি বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি একসময় আমাদের কাছে কমার্শিয়াল ছবি বানানো শিখেছিল তারাই পরবর্তীকালে ডমিনেট করেছে বা ক্ষেত্রবিশেষে আজও করে যাচ্ছে কৌশলে। কই আমরা কি তাদের কাছ থেকে কৌশল শিখতে পেরেছি! যদি পারতাম তাহলে আজকে ইন্ডাস্ট্রিতে অখাদ্য কোনো ছবি থাকত না, মানসম্মত ছবি সংখ্যায় কম হলেও সেটাই থাকত।
যা বলা হলো এতক্ষণ বসে বসে হিসাব মেলান। আমাদের বর্তমান ইন্ডাস্ট্রির দুর্যোগের জন্য আগের ভরপুর থাকা ইন্ডাস্ট্রির দূরদর্শিতা না থাকাটাই সবচেয়ে বড় কারণ। তারা আজকের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জন্য যদি পুরো প্যাকেজের একটা মেকানিজম রেখে যেত তাহলে ওটার উপর ভর করেই একুশ শতকের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়িয়ে যেত। কিন্তু অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে একুশ শতকের ইন্ডাস্ট্রি প্রযুক্তির সুবিধায় এগিয়ে থেকেও ৩৫ মিলিমিটারের লাল পর্দাওয়ালা ছবির থেকেও যোজন যোজন পিছিয়ে।
আজকের ঢালিউড যতটুকুই উন্নতি করবে সামনে যদি পরের প্রজন্মকে তৈরি করে দিয়ে যেতে না পারে তাহলে এ ইন্ডাস্ট্রির কপালে ফুলস্টপ পড়া কোনো ব্যাপারই না। অতঃপর সাধু সাবধান।