Select Page

প্রিন্স মাহমুদ: নব্বইয়ের প্রজন্মের মহানায়ক

প্রিন্স মাহমুদ: নব্বইয়ের প্রজন্মের মহানায়ক

প্রিন্স মাহমুদ এই নামটি মনে পড়লেই আমার সমবয়সী বাংলা গান পাগল শ্রোতাদের মনটা উথাল পাথাল করে উঠে। মনে পড়ে যায় হৃদয়ে হাহাকার জাগানিয়া অনেক অনেক অসাধারণ গান। মনের ভেতর বাংলা ব্যান্ড সংগীতের জীবন্ত অনেক কিংবদন্তী, সেরাদের অনেক গান মনে পড়ে যায়।

‘প্রিন্স মাহমুদ’ নামটা’র সাথে সেই ৯০ দশকের শ্রোতাদের এক অদ্ভুত বোঝাপড়া যারা আজো অডিও সিডির গায়ে ‘’প্রিন্স মাহমুদের সুরে’’ লিখাটা দেখতে পেলেই আর কিছু খুঁজে বেড়ায় না। শিল্পী কে / কারা ,গীতিকার কে/ কারা সেই প্রশ্নটি হয়ে যায় অবান্তর। কারণ ‘প্রিন্স মাহমুদ’কে ভক্তরা আজ নতুন করে চিনে না , প্রিন্সকে চিনেন তাঁরা গত ২৪ বছর ধরে। যে প্রিন্স মাহমুদ ছিলেন ব্যান্ড এর একজন গিটারিস্ট ও শিল্পী হিসেবে সেই প্রিন্স মাহমুদ গিটারিস্ট ও ভোকাল এর তকমা মুছে দিয়ে হয়ে গেছেন শ্রোতা নন্দিত এক অসাধারন গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক। গীতিকার,সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক প্রিন্স মাহমুদ আজ শ্রোতা ও ভক্তদের কাছে এক জীবন্ত কিংবদন্তী।

৯০ দশকের শুরুতে যখন ব্যান্ড সংগীতের জোয়ার সেই জোয়ারে যুক্ত হয়েছিল ‘দ্যা ব্লুজ’ নামের একটি ব্যান্ড যেখানেই আমাদের সাথে প্রথম পরিচয় হয় একজন প্রিন্স মাহমুদের । সেই ‘ব্লুজ’ ব্যান্ডে প্রিন্স মাহমুদ এর কাছ থেকে আমরা পেয়েছিলাম ‘অন্ধকারে মাটির ঘরে ‘ , ‘ও বন্ধু’ , ‘ সুনীল আকাশ’ এর মতো কিছু দারুন গান । এরপর প্রিন্স মাহমুদ কে পাই ‘ফ্রম ওয়েস্ট ‘ ব্যান্ডে যেখানে আগের চেয়ে আরও উজ্জ্বল আরও দারুন । ‘নোভা’ ব্যান্ড এরপর রাজাকার যুদ্ধঅপরাধীদের ঘৃণা জানিয়ে ব্যঙ্গ করা ‘সব রাজাকার ভাইসা যাইবো বঙ্গোপসাগরে’ গানটি পাই প্রিন্স মাহমুদ এর কণ্ঠে । সেই অ্যালবামে আরও ছিল ‘ বেলা শেষে ফিরে এসে পাইনি তোমায়’, ‘সে কেমন মেয়ে’ , আমার প্রথম সেই কলেজ জীবন’ , ‘এই বুকেতে কার কথা শুনতে পাও’ , ‘পথে যেতে ছায়া হয়ে’ এমন সব দারুন কিছু গান যা আজো শ্রোতারা গুনগুন করে । এরপর প্রিন্স মাহমুদ চুপ হয়ে গেলেন । ‘ফ্রম ওয়েস্ট’ ব্যান্ডের আর কোন অ্যালবাম পাইনি ,পাইনি প্রিন্স মাহমুদ এর কোন গান।

নব্বইয়ের শুরুর দিকে বাংলা ব্যান্ড মিউজিকে ব্যান্ড মিক্সড বা মিশ্র অ্যালবামের প্রচলন শুরু করেন আর্কের দলনেতা আশিকুজ্জামান টুলু (জনপ্রিয় ব্যান্ড চাইমেরও প্রতিষ্ঠাতা দলনেতা ছিলেন। পরবর্তীতে চাইম ছেড়ে দিয়ে গড়ে তোলেন ব্যান্ড “আর্ক” এবং পরবর্তীতে “আর্ক” চরম শ্রোতাপ্রিয়তা পায়)। আশিকুজ্জামান টুলুর সুরবিন্যাস, সঙ্গীতায়োজন ও পরিকল্পনায় প্রকাশিত হয় বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের ইতিহাসে প্রথম ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম “Stars”। “Stars” এর সফল ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে আশিকুজ্জামান টুলুর সুরবিন্যাস ও সঙ্গিতায়োজনে প্রকাশিত হয় “Stars 2″। সে-ই শুরু ব্যান্ড ও সলো অ্যালবামের পাশাপাশি জনপ্রিয় আরেক ধারার যার নাম “ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম”। এই ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম যখন শুরু হয় তখন বিদেশি জনপ্রিয় কিছু গানের অনুকরনে ‘যন্ত্রণা’ নামে একটি ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবামে দেখা পাই প্রিন্স মাহমুদের। এরপর ‘ রকস্টারস’ নামের মৌলিক গানের ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবামে পাই যার কাণ্ডারি ছিলেন এই প্রিন্স মাহমুদ। ‘রকস্টারস’ অ্যালবামের ১০টি গানের কথা ও সুর ছিল প্রিন্স মাহমুদের।

এভাবেই চলছিল। কিন্তু ১৯৯৪/৯৫ সালে ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবামের জোয়ারে হঠাৎ করে ‘শক্তি’ নামের একটি অ্যালবাম বাজারে ঝড় তোলে । শ্রোতারা লক্ষ্য করে দেখলো ‘শক্তি’ অ্যালবামের পেছনে আমাদের সেই চেনা প্রিন্স মাহমুদ যেন অচেনাভাবে দেখা দিলো। এ যেন অন্যরকম এক প্রিন্স মাহমুদকে দেখলো শ্রোতারা। আজম খান, আইয়ুব বাচ্চু, নকিব খান, জেমস, বাবনা, ফজল পার্থ’র মতো সেরা ব্যান্ডের সেরা সেরা কণ্ঠগুলোকে একত্রে করে কি অসাধারন এক সৃষ্টি করলেন যাতে সব শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে গেলো। চমৎকার সব পরিবেশনা সমস্ত অ্যালবাম জুড়ে। প্রতিটি গানের কথা সুর ও সঙ্গীতায়োজনে নান্দনিকতার ছোয়া স্পষ্ট। এরপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি। সেই প্রথম অ্যালবাম থেকেই করেছেন নিজের মনের মত গান। গানের কথা সুর ও সঙ্গীতায়োজন ছিল বরাবরই নান্দনিকতায় ভরপুর। অ্যালবামের ১২ টি গানের মাঝে ৮টি গানের সুর ও সঙ্গীত ছিল প্রিন্স মাহমুদের যার সবগুলোই ছিল দুর্দান্ত।

‘শক্তি’ এই একটি মাত্র অ্যালবাম দিয়েই বাংলা ব্যান্ড মিউজিকে নিজের স্থান পাকাপোক্ত করে নিয়েছিলেন। সেই সাথে তৈরী করে নিলেন এক বিশাল নান্দনিক শ্রোতা গোষ্ঠীর। যারা প্রিন্স মাহমুদের প্রথম অ্যালবাম ‘শক্তি’ শুনে নান্দনিকতায় মেতে উঠেছিলেন, সেই সব শ্রোতাদের উচ্ছাস ও আস্থাকে আরো বাড়িয়ে দিয়ে প্রকাশ পায় দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘ওরা ১১ জন’। ৪ টি গান লিখার পাশাপাশি এই অ্যালবামের ১০ টি গানের সুর ছিল প্রিন্স মাহমুদের । যা ‘শক্তি’ অ্যালবামের মতো আবারো সুপারহিট। এই অ্যালবামে নতুন এলেন চন্দন (উইনিং), টিপু (অবসকিউর), খালিদ (চাইম) ও বিপ্লব (প্রমিথিউস) । আবারো আইয়ুব বাচ্চুর গান হিট সাথে হিট হলো তুমি ‘যেন আমি করেছি ক্ষমা’ ( চন্দন) , ‘এখন তুমি সুখে নেই’ (ফজল), ‘ হাত বাড়ালেই বন্ধু হবো ‘ (টিপু), ‘কিভাবে কাঁদাবে ‘ (খালিদ) এবং গুরু আজম খানের ‘অশ্রুলিখা’ গানগুলো। যা ছিল রীতিমতো ভয়াবহ দারুন কিছু। শ্রোতারা বুঝে গেলো ‘প্রিন্স মাহমুদ’ মানেই দারুন কিছু গান ।আশিকুজ্জামান টুলু ভাই, আশরাফ বাবু ভাইদের মতো প্রিন্স মাহমুদ হয়ে গেলেন শ্রোতাদের আস্থার প্রতীক । আর তাইতো অডিও ক্যাসেটের গায়ে ‘প্রিন্স মাহমুদের সুরে’ এই কথাটি লিখা হয়ে গেলো দারুন সুন্দর গানের একটি ‘ব্র্যান্ড’ এর নাম। ক্যাসেটের প্রচ্ছদে শ্রোতারা ‘প্রিন্স মাহমুদের সুরে’ লিখা দেখতে পেলে আর কিছুই খুঁজতো না, খোঁজার প্রয়োজনও ছিল না। এভাবেই অডিও ইন্ডাস্ট্রি, শ্রোতাদের কাছে তথা বাংলা গানের উত্তরনে গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক প্রিন্স মাহমুদ হয়ে গেলেন খুব প্রিয় একটি নাম, খুব আস্থার একটি নাম। হারিয়ে গেলো ব্যান্ডের ‘গিটারিস্ট’ ও ‘ভোকালিস্ট’ প্রিন্স মাহমুদ। শ্রোতাদের তাতে অভিযোগ নেই কারন প্রিন্স মাহমুদকে যেভাবেই পাচ্ছি না কেন দারুন কিছু তো পাচ্ছি এটাই বড় পাওয়া । নতুন প্রিন্স মাহমুদ তো আরও উজ্জ্বল , আরও দুর্দান্ত তাই শ্রোতারা সঙ্গীত পরিচালক প্রিন্স মাহমুদকেই বেশি বেশি পেতে চাইলো।

‘ওরা ১১ জন’ এরপর শুধুই কি ব্যান্ড সঙ্গীতে প্রিন্স মাহমুদ দারুন? না, উত্তরটা শ্রোতারা পেয়ে গেলেন আধুনিক গানের শিল্পী তপন চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ, খালিদ হাসান মিলু, আগুন কে নিয়ে ‘জয় পরাজয়’ অ্যালবাম দিয়ে। ‘’প্রিন্স মাহমুদ হেরে গলার ড্রামস গিটারের কিছু ব্যান্ড গানই করতে পারে — আধুনিক গান প্রিন্স মাহমুদ’’’ কে দিয়ে সম্ভব নয় বলে যারা প্রিন্স মাহমুদের সমালোচনায় মুখর ছিলেন, তাদের মুখ বন্ধ করতেই আসে ‘জয় পরাজয় ‘ যা ছিল ব্যান্ড সংগীতের প্রিন্স মাহমুদ এর অন্য আরেক মুগ্ধতার প্রমান।

‘জয় পরাজয়’ অ্যালবামের পর প্রিন্স মাহমুদ এলেন ‘ক্ষমা’ অ্যালবাম নিয়ে । এবারও শ্রোতারা বিস্মিত কারন এই ক্ষমা অ্যালবামের মাধ্যমেই প্রিন্স মাহমুদের কথা ও সুরে প্রথম বারের মত গান করেন মাকসুদুল হক (মাকসুদ ও ফিডব্যাক ), খালিদ(চাইম), চন্দন(উইনিং) ও টিপু(অবসকিউর)। শুধু ‘ফিডব্যাক’ এর মাকসুদুল হক নয় আর্কের সাথে কাজ করার সুযোগ তৈরী হয় মূলত এই অ্যালবামের মাধ্যমেই। আর্কের দলনেতা শক্তিমান গীতিকার ও সুরকার আশিকুজ্জামান টুলু এই প্রথম বারের মত কন্ঠ দেয় প্রিন্স মাহমুদের কথা ও সুরে এবং সেই সাথে বাংলা ব্যান্ড মিউজিকে সংযোজিত হয় আরেক অনবদ্য সঙ্গীতের। এছাড়াও এই অ্যালবামে আরো ছিলেন গুরু আজম খান(উচ্চারণ), বাবনা(ওয়ারফেইজ), ফজল(নোভা), পলাশ(অরবিট), বগি(রেঁনেসা), পার্থ(সোলস) ও ইকবাল আসিফ। বেশ কিছু গান তুমুল শ্রোতাপ্রিয়তা পায় তারমধ্যে উল্লেখযোগ্যঃ ‘অশ্রু মুছে তুমি তাকাবে/মনকে আলোকিত করবে/তোমার অশ্রু আমায় দুর্বল করে দেয়/আবার দেখা হবে/এখনি শেষ দেখা নয়/আবার কথা হবে/এখনি শেষ কথা নয়’— আবার দেখা হবে/খালিদ(চাইম), ‘কেন মন নিয়ে এত দাও যন্ত্রনা/কেন ক্ষমা দিয়ে ভুল তুমি ঢাকলে না/কেন আধাঁরে এই জীবনে কাছে আসবে না’ — ক্ষমা(মন নিয়ে যন্ত্রনা)/মাকসুদুল হক এবং টিপুর ‘চাঁদ জাগা এই রাতে/দুচোখের বরষায় ভিজে/ভাবছি তোমায়/জেগে জেগে রাত/তুমিও কি ভাবছো আমায়’ গানগুলো তুমুল শ্রোতাপ্রিয়তা পায়। এছাড়া চন্দনের ‘ছোটো ছোটো কিছু কিছু ভুল’, বাবনার ‘কোথায় হারালে’, ইকবাল আসিফের ‘ভাঙ্গা হৃদয়’ যেকোন শ্রোতা হৃদয় বিমোহিত করবে খুব সহজেই। প্রতিটি গানের কথা সুর ও সঙ্গীতায়োজনে নান্দনিক সৃষ্টিশীলতার ছোঁয়া পাবেন অজান্তে নিভৃতেই।

অ্যালবাম এর পর ক্ষমা’র পরপরই প্রকাশ করেন ৪র্থ অ্যালবাম ‘ঘৃণা’। এবার এই অ্যালবামে যোগ দেন আর্কের ভোকাল দুর্দান্ত হাসান ।চমৎকার সব পরিবেশনার মধ্যে যে কয়েকটি গানের কথা উল্লেখ না করলেই নয়ঃ ‘শুণ্য’-মাকসুদ, ‘ভালবাসতে হবেই’-হাসান, ‘নীরা’-খালিদ, ‘অভিমানিনী’-টুলু, ‘একা হয়ে যাই’-বাবনা, ‘তুমি আর কারো নও’-চন্দন, ‘অভিমানে’-পার্থ সহ সবকটি গান। ………এভাবেই দুর্দান্ত গতিতে অডিও ইন্ডাস্ট্রি তথা বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতে একের পর এক ঝড় তোলা অ্যালবাম দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন একজন গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক প্রিন্স মাহমুদ। শ্রোতারা ততদিনে প্রিন্স মাহমুদ বলতে পাগলপারা হয়ে গেছে ।

এর পরপরই প্রিন্স মাহমুদের সুরে বের হয় আধুনিক গানের শিল্পীদের নিয়ে অ্যালবাম ‘ব্যবধান’। ‘ব্যবধান’ অ্যালবামে ছিলেন কুমার বিশ্বজিৎ, খালিদ হাসান মিলু, শুভ্র দেব , পলাশ । ব্যবধান অ্যালবামের শুভ দেবের কণ্ঠে ‘ যদি তুমি জানতে ‘ , ‘আমার সমাধির পর ফুল দিতে ‘ ও পলাশের ‘ কোন কোন সময় আমি ‘ গানগুলো ছিল এক কথায় মাস্টারপিস । ব্যবধানের পরপর প্রকাশিত হয় প্রিন্স মাহমুদের সর্বাধিক জনপ্রিয় ধারার অ্যালবাম ‘শেষ দেখা’। আগের সমস্ত অ্যালবাম দিয়ে যাদের গ্রহণযোগ্যতা মিলেনি তারাও হুমড়ি খেয়ে পড়ে এই অ্যালবাম নিয়ে। শুধুই তাই নয় — যারা বাংলা ব্যান্ড মিউজিক নিয়ে দোটানায় ছিলেনঃ ব্যান্ড সঙ্গীত শুনবেন কি শুনবেন না তারা সমস্ত দ্বিধা ছুড়ে ফেলে লুফে নেয় ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম ‘শেষ দেখা’। আর প্রিন্স মাহমুদও ঢেলে দিয়েছে দীপ্তপ্রতিভার সবটুকু নান্দনিক ছাঁপ। প্রতিটি শিল্পীর কন্ঠোপযোগী শ্রেষ্ঠ গানগুলো তৈরী করেছেন সব শ্রেণীর শ্রোতা-ভক্তকুলের জন্য। এই অ্যালবাম প্রিন্স মাহমুদের অতিতের সমস্ত অর্জন’কে ছাপিয়ে জ্যোতির দ্যুতি আরো বেশী ছড়িয়েছে আপন মহিমায়। এই অ্যালবামে ছিল তুমুল শ্রোতাপ্রিয়তা পাওয়া জনপ্রিয় গানঃ শেষ দেখা-এবি, হতেও পারে এই গান শেষ গান-জেমস, এত কষ্ট কেন ভালবাসায়-হাসান, প্রতিরাতই নির্ঘুম রাত-শাফিন, আকাশনীলা-খালিদ, জীবনের শেষ কটা দিন-গুরু আজম খান, সময় আর কাটে না-পার্থ (কথাঃ আশরাফ বাবু, সুরঃ পার্থ) সহ আরো বেশ কিছু গান। এই অ্যালবামের আগে শাফিন আহমেদ অন্য কোন মিক্সড অ্যালবামে গান করেননি। অন্যদিকে আর্কের বাইরে হাসান’কে জনপ্রিয় করতে প্রিন্স মাহমুদের অবদান অনস্বীকার্য। হাসানের করা ‘এত কষ্ট কেন ভালবাসায়’ ঐ সময়ের মানুষের মুখে মুখে বেড়াতো, জেমসের ‘বন্ধু ভেঙ্গে ফেলো এই কারাগার/খুলে দাও সে হৃদয়ে প্রণয়ের দ্বার/হতেও পারে এই দেখা শেষ দেখা/হতেও পারে এই গান শেষ গান’ কিংবা পার্থর ‘সময় আর কাটে না’ এখনও গান পাগল মানুষগুলো নিয়মিত শোনেন। এভাবেই প্রিন্স মাহমুদের এখনও ‘দুচোখে বন্যা , ‘দাগ থেকে যায়’ , ‘স্রোত’ , ‘দেয়াল’ , ‘পিয়ানো’ , ‘চিঠির উত্তর দিও’ , ‘হারজিৎ’ , ‘মেহেদী রাঙা হাত’ সহ একের পর এক তুমুল জনপ্রিয় অ্যালবাম প্রকাশ করে শ্রোতাদের মাঝে, বাংলা ব্যান্ড সংগীতের মাঝে চিরদিনের জন্য ঠাই করে নিলেন । প্রিন্স মাহমুদ নিজেকে নিয়ে গেলেন অন্য এক উচ্চতায়।

উদ্দীপ্ত প্রতিভার সৃষ্টিশীল নান্দনিকতায় প্রিন্স মাহমুদ বরাবরই ছিলেন অন্য সবার শীর্ষে। ব্যান্ড শিল্পীদের ছাড়াও করেছেন আধুনিক ও সলো শিল্পীদের গান। ‘এক মুঠো জ্যোছনা’ নামে পুরো একটা অ্যালবাম করেছেন জনপ্রিয় শিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ-এর। আধুনিক গানের আরেক দিকপাল এন্ড্রু কিশোরের জন্য করেছেন ‘গাঁয়েন’ নামে একক অ্যালবাম। এছাড়াও করেছেন এন্ড্রু কিশোর ও আতিক হাসানকে নিয়ে ডুয়েট অ্যালবাম ‘পদ্ম পাতার জল’ ও ‘দুই দিনের মেলা’ নামে দুটি অ্যালবাম সহ আরো অনেক সলো ও মিক্সড অ্যালবাম। শুধুই ব্যান্ড মিউজিক নিয়ে আবদ্ধ হয়ে থাকেন নি তিনি। মেধা ও নান্দনিক মননশীলতার জ্যোতি ছড়িয়ে দিয়েছেন ব্যান্ড, পপ ও আধুনিক গানে। এবং প্রিন্স মাহমুদের সেই জ্যোতি শুধুই ছড়িয়ে পড়েনি চারপাশ জুড়ে, উপরন্তু সেই সাথেও আলোকিত করেছেন প্রতিটি শাখা। ……এভাবেই ব্যান্ড মিক্সড, আধুনিক মিক্সড, একক সব ধরনের অ্যালবামেই প্রিন্স মাহমুদ প্রমান করেছেন তাঁর প্রতিভা আর নিজেকে নিয়ে গেছেন কিংবদন্তীদের উচ্চতায় । বাংলা গানপাগল শ্রোতাদের কাছে, বাংলা ব্যান্ড ও আধুনিক গানে প্রিন্স মাহমুদ এক জীবন্ত কিংবদন্তীর নাম । প্রিন্স মাহমুদ কে নিয়ে লিখতে গেলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখা যাবে তবুও ‘প্রিন্স মাহমুদ’ কে সম্পূর্ণ প্রকাশ করতে পারবো না। বুঝাতে পারবো না প্রিন্স মাহমুদ বাংলা গানকে কতটা সমৃদ্ধ করেছেন।

প্রেম , বিরহ, ক্ষোভ, স্মৃতিচারণ, শুভ কামনা, দেশাত্মবোধ থেকে শুরু করে ‘মা’ ও ‘বাবা’ র মতো প্রতিটা মানুষের প্রিয় মানুষ নিয়েও গান উপহার দিয়ে গেছেন প্রিন্স মাহমুদ। আজো বাংলা গানে কাউকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে গেলে প্রথমেই মনে পড়ে প্রিন্স মাহমুদের লিখা ও সুর করা এবং বাংলা ব্যান্ড সংগীতের কিংবদন্তী শাফিন আহমেদ এর কণ্ঠে ‘আজ জন্মদিন তোমার ‘ গানটি । প্রিয় ‘মা’ ও ‘বাবা’ কে মনে পড়লে মনেপড়ে যায় জেমস এর কণ্ঠের ‘মা’ ও ‘বাবা’ গান দুটো যা প্রিন্স মাহমুদ এর । বাংলা ব্যান্ড সংগীতের সৃষ্টি শ্রেষ্ঠ দেশাত্মবোধক গানের কথা মনে হলে মনে পড়ে জেমস এর কণ্ঠে ‘ বাংলাদেশ ‘ গানটি এরকম গান আর কেউ দিতে পারেনি যেখানে ভাসানি, বঙ্গবন্ধু, জিয়া সবাই আছেন । যে গানে বাদ পড়েনি বাংলাদেশের গর্ব করা কেউ। আজম খান , আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, মাকসুদ, আশিকুজ্জামান টুলু, নকিব খান , ফজল , চন্দন, টিপু, বাবনা, হাসান, বিপ্লব, পার্থ, খালিদ, তপন চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ, খালিদ হাসান মিলু , জুয়েল , এন্দ্রু কিশোর কোন সেরা মানুষটির কণ্ঠে প্রিন্স মাহমুদ এর গান নেই বলতে পারবেন? এতো সেরাদের নিয়ে কাজ করেও সেরাদের ছায়ায় হারিয়ে যাননি প্রিন্স মাহমুদ। বরং নিজের দ্যুতি আরও ছড়িয়েছেন আর সেরাদের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর পেছনে অবদানও রেখেছেন।

রিন্স মাহমুদ এখনও গান করেন তবে আগের মতো বেশি বেশি পাওয়া যায়না যা নিয়ে তাঁর ভক্তদের মাঝে অভিমান, অভিযোগ আছে । তাঁর ভক্তরা তাঁকে আবারো চায় সেই বাচ্চু, মাকসুদ, টুলু , হাসান এর মতো বাংলা ব্যান্ড সংগীতের সেরাদের কণ্ঠে। তাদের কণ্ঠেই যেন প্রিন্স মাহমুদ শ্রোতাদের কাছে আলাদা অন্যরকম। এই যুগের রুমি, মেহরাব , এলিটা , মাহাদি, কণা , ন্যান্সি কেউই বাদ যায়নি প্রিন্স মাহমুদ এর লিখা ,সুর করা সেরা গান থেকে। ক্লোজআপ ওয়ান খ্যাত রুমি, মাহাদির জনপ্রিয়তার পেছনে ‘মাটি ‘ ও ‘বরুনা’ গানটির অবদান অনস্বীকার্য। এই হলো প্রিন্স মাহমুদ । সর্বশেষ প্রকাশিত এই প্রজন্মের শিল্পীদের নিয়ে ‘কেয়া পাতার নৌকো’ অ্যালবামে আবারো প্রমান করেছেন প্রিন্স মাহমুদ এখনও ফুরিয়ে যায়নি । এখনও এই ইন্ডাস্ট্রি, শিল্পী ,শ্রোতাদের দেয়ার অনেক কিচু বাকী আছে । প্রিন্স মাহমুদ এর লিখা, সুর করা গান নিয়ে বাংলা গানের শ্রোতারা লালন , হাসন, রবিন্দ্রনাথ, নজরুল এর মতো আলাদা ভাবে ভবিষ্যতে যদি ‘প্রিন্স মাহমুদ সঙ্গীত ‘ বা ‘যুবরাজের গান’ নামের নতুন একটি ধারা শুরু করে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কেউ প্রতিবাদ করবে না। কারন সত্যিই তো প্রিন্স মাহমুদ বাংলা গানের আলাদা একটি রুপ , আলাদা একটি সুন্দরের নাম যিনি শুধু নামে ‘প্রিন্স/ যুবরাজ’ নন কাজেও ‘যুবরাজ’ এর মতোই যে কিংবদন্তী প্রিন্স মাহমুদ’কে বারবার মনে করতেই হবে, মনে করতে আপনি বাধ্য।

এক নজরে প্রিন্স মাহমুদের অ্যালবাম: যন্ত্রণা, রকস্টারস, শক্তি, ওরা ১১ জন, জয় পরাজয়, ক্ষমা, ঘৃণা, ব্যবধান, দূর থেকে ভালবেসে যাব – কামাল আহমেদ (ডিজিটাল), শেষ দেখা, এখনও দু’চোখে বন্যা, দাগ থেকে যায়, স্রোত, দেয়াল দুই হৃদয়ের মাঝে, প্রিয় বন্ধুকে –  ভ্যালেন্টাইন স্পেশাল, হারজিৎ, পিয়ানো, চিঠির উত্তর দিও, তাল – হাসান, মেহেদী রাঙ্গা হাত, ছুটি (এবি, হাসান, জেমস), হীরা চুনি পান্না (আসিফ, সুমন, আতাহার টিটু), এক মুঠো জোছনা – কুমার বিশ্বজিৎ, কিশোর কিশোরী  (বাপ্পা, কানিজ সুবর্না), ১২ মাস (এবি, হাসান, জেমস, মাকসুদ), এক টুকরো চাঁদ – খালিদ, গায়েঁন – এন্ড্রু কিশোর, ও পুতুল আমার পুতুল – আরিফ, দহন শুধু তোমার জন্য (এবি, হাসান, জেমস, বিপ্লব), পিয়ানো (এবি, জেমস), সারেগামা (হাসান, জেমস), পদ্ম পাতার জল (এন্ড্রু কিশোর, আতিক হাসান), দেশে ভালবাসা নাই (এবি, জেমস), হ্যালো কষ্ট – হাসান, প্রতারণা (এবি, জেমস), মাটি (এবি, জেমস), দেনা পাওনা (এবি, জেমস, হাসান), বাজনা (এবি, জেমস, বিল্পব), ভালোবাসা মানে দুঃখ – হাসান, আড্ডা (মেহরাব, রুমী), দেবী, বন্দনা – মাহাদী, হাটি (কুমার বিশ্বজিৎ, ফাহমিদা নবী), ঘুমাও – খালিদ, বোকা – ক্লোজাআপ ওয়ান তারকাদের নিয়ে, প্রিন্স মাহমুদের গান (প্রিন্স মাহমুদ, পলাশ, মেহরাব, ফাহমিদা নবী), নির্বাচিতা ও কেয়া পাতার নৌকো।

প্রিন্স মাহমুদের লেখা উল্লেখযোগ্য গান: সে কেমন মেয়ে , এই বুকেতে, ক্ষমা, সুখে নেই , মাটির দেহ , অনন্যা, মন নিয়ে যন্ত্রণা, আবার দেখা হবে, চাঁদ জাগা এই রাতে, ভাঙ্গা হৃদয়, ছোট ছোট ভুল, চল পালাই , শুন্য, ভালোবাসতে হবে, নীরা, হারায়, অভিমানিনী, প্রিয় কবিতা ,কতদিন দেখিনি দু চোখ, মা, প্রশ্ন, কোন কারনেই , শেষ দেখা, জন্মদিন তোমার, বাবা , বাংলাদেশ, প্রতিদান চায়না, দেবদাস , এক নদী যমুনা …আরও অনেক অনেক গান।

জনপ্রিয় কিছু গানের লিংক পাওয়া যাবে ফেসবুক পোস্টের শেষ দিকে।


Leave a reply