ফরহাদ মজহারের ‘পাঠ: বেদের মেয়ে জোস্না’
বেদের মেয়ে জোস্না ছবিটি প্রথমে মফস্বলে মুক্তি পেয়েছিল। ছবিটি মেলা দর্শক টানছে এই খবর যখন কাগজে দেখেছি তখনই নামটা খেয়াল করি। বেদের মেয়ের নাম ‘জ্যোৎস্না’ নয়–জোস্না’–এটা লক্ষ্য করে মজা পেয়েছিলাম। ‘জ্যোৎস্না’ শব্দের অপভ্রংশ এক্ষেত্রে খণ্ড-ত (ৎ) ত্যাগ করে সহজ ও লৌকিক উচ্চারণের পথ ধরেছে। মূল শব্দে খণ্ড-ত (ৎ) ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। শব্দের প্রাচীনতা, বিশুদ্ধতা ও সংস্কৃত ব্যুৎপত্তির গর্ভ বা স্বকীয়তা এই খণ্ড-ত-য়ের মধ্যে ধৃত। লৌকিক উচ্চারণে তার লোপ একটা গ্রামীণ দ্যোতনার সৃষ্টি করে, ফলে নামের মধ্যে একটা কৃষক বালিকার মুখচ্ছবি তড়পায়। জ্যোৎস্না শব্দের আভিধানিক মানে ইন্দুদ্যুতি বা চাঁদের কিরণ, এটা অবশ্য যে কেউই জানেন। কিন্তু তিনি যে ব্রহ্মার শরীর থেকে উৎপন্ন এবং গন্ধর্বগণের পত্নী এটা সবার জানার কথা নয়। খণ্ড-ত(ৎ) চ্যুতির আগৌরব ‘জোস্না’কে এই সকল শরীফ কিংবদন্তির ওজন থেকে হালকা করেছে। ফলে বেদের মেয়ে হতে তার বাধা হয়নি। শব্দের বৃত্তান্ত খুঁজে এসব বের করা অনর্থক নয়, কারণ ওর সূত্র ধরে এগুলোয় এমন সব চিহ্ন আবিষ্কার করা সম্ভব, যা ছবিটির বিচার করতে আমাদের কাজে লাগে, ওতে সামাজিক অবচেতনার নানান ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার হদিস মেলে, যার সম্পর্কে আমাদের পোশাকি সচেতনতা হামেশাই বেখেয়াল। যেমন, খুব গভীরে না গিয়েও জ্যোৎস্না নামের অপভ্রংশিত রূপান্তরের সরাসরি তাৎপর্যটা অন্তত খেয়াল করা যায়।
যে ‘জোস্না’ একেবারেই একটি গ্রাম্য সাধারণ, সহজ এবং স্বতঃস্ফূর্ত–যার কোনো আভিজাত্যমূলক অতীত নেই, উৎপত্তি নেই কিংবা উৎস নেই।ফলে বেদের মেয়ে জোস্নানামটা আমার ভালো লেগেছিল। আমি আরো মজা পেয়েছি এই ভেবে যে, জ্যোৎস্নার পরিচিত ভ্রংশ রূপটা এখানে ব্যবহৃত হয়নি। অর্থাৎ নামটা ‘জোছনা’ হয়নি। যেমনটি আছে রবিবাবুর গানে: যথা, ‘জোছনা কেমন ফুটেছে’ ইত্যাদি। পদ্যমূলক বাবু সংস্কৃতির পথে ‘জোস্না’ যে যায়নি তাতে আমি খুশি। কারণ তাহলে সর্দিলাগা গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া কোনো এক উন্নাসিক মধ্যবিত্তের বিবাহযোগ্য কন্যার কথা মনে পড়ে যেত। তখন রবীন্দ্র সঙ্গীতের ব্রাহ্ম গাম্ভীর্য থেকে জোস্নাকে কিছুতেই উদ্ধার করা যেত না। ‘জোছনা’র চেয়ে ‘জোস্না’ কটমটে অশিক্ষিত গদ্যপ্রধান এবং গ্রাম্য। সে কারণে মধ্যবিত্তের রসবোধ ও ইন্দ্রিয়বৃত্তিরও বিরোধী। লক্ষণীয় ‘জোস্না’য় জিহ্বাকাতর ‘ছ’ নেই, যা মূর্ধা বা স্পর্শাতীত তালুকে স্পর্শ করতে ব্যাকুল, কিন্তু যা পর্যবসিত হয় কেবলি ব্যর্থতায়। কারণ প্রশ্বাসকে এই ‘ছ’ উচ্চারণের সময় নির্গত করতে হয় আলতোভাবে, অনেকটা জিহ্বার আগা দিয়ে ধরে ধরে। মধ্যবিত্ত এতে একটা কামজ বা সেকচুয়াল পরিতৃপ্তি লাভ করে। ‘জোস্না’ নামের মজা হচ্ছে, ওখানে যে, এখন ‘ছ’ উচ্চারণ করা মধ্যবিত্ত ও সুশিক্ষিত আদব আমাদের বেদের মেয়ের নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে শেখার প্রয়োজন পড়বে না। আমার হসন্তযুক্ত দন্ত্য ‘স’ মধ্যবিত্তের পাতিবুর্জোয়া সংস্কৃতির গালে একটা, একটা কষে থাপ্পড় মারে, কিন্তু মধ্যবিত্ত টের পায় না যে সে থাপ্পড়টা খাচ্ছে। এবং খাচ্ছে কৃষকের দোফসলি হাতের, লোম-ওঠা কামাড়খালি চাপড়, সেটাও মধ্যবিত্ত তার সাংস্কৃতিক নির্বুদ্ধিতার জন্য বুঝতে পারে না। সেটাই সবচেয়ে মজার। ‘জোস্না’র হসন্ত যুক্ত দন্ত্য ‘স’-এর তুলনা হয় না।
নাম দেখেই আমার এসব মনে হয়েছিল। এর সঙ্গে ছবির কোনো সম্পর্ক আছে কি নেই সেটা পরের কথা। একটি ছবির নামকরণের মধ্যে সেটা কার ছবি কাদের জন্য ছবি, কিসের ছবি, প্রভৃতি আঁচ করা যায়। আমিও আঁচ করার চেষ্টা করেছি মাত্র। নামেই টের পাওয়া যায় যে, ‘জোস্না’ একদিকে রাজকীয় আভিজাত্য থেকে চ্যুত, তার অতীত খুঁজে বের করা সম্ভব, কিন্তু তার সামাজিক পরিচয়ের সঙ্গে অপভ্রংশিত পাতিবুর্জোয়া শহুরে মধ্যবিত্তের বিপরীত মেরুর চৈতন্যকে ধারণ করে। গ্রাম্য অকৃত্রিম, সহজ, স্বতঃস্ফূর্ত কৃষকের সরল সংস্কৃতির চাঁচাছোলা আবেগ জোস্না নামের মধ্যে ধৃত। ছবির কথা এখনো বলছি না, নাম নিয়েই এতো কথা বলা যায়; আরো যেতো, কিন্তু আমি ছবির প্রসঙ্গে যেতে চাই।
ছবির প্রসঙ্গে যাবার আগে ছবিটা কেন আমি দেখেছি তার ব্যাখ্যা দেয়া জরুরি বোধ করছি। আগেই বাতিল স্রেফ ‘জোস্না’ নামের মাহাত্ম্যে তাড়িত হয়ে দেখতে যাইনি, যদিও নাম নিয়ে ইতোমধ্যেই আমি বেশ কয়েক লাইন খরচ করে ফেলেছি। ছবিটি মফস্বলে মুক্তি পাবার পর একে কেন্দ্র করে নানা গল্প খবর কাগজে ছাপা হতে শুরু করে। সন্দেহ নেই ছবিটির তুমুল জনপ্রিয়তা এই সকল খবরের পশ্চাৎকারণ। একটি খবর তো অনেকের হৃদয়কে টোকা দিয়েছিল। পাড়াগাঁয়ে এক বউ ছবিটি দেখতে কাতর হয়ে বার বার তার স্বামীকে অনুরোধ-উপরোধ জানিয়েছিল স্বামী যেন তাকে ছবিটি দেখাতে নিয়ে যায়। কিন্তু স্বামী নেয়নি। বউটি জোস্নাকে দেখতে না নিয়ে যাবার অবহেলায় এতোই অভিমানাহত হয়েছিল যে, সে আত্মহত্যা করে মরে। এই আত্মহননকারী অভিমান অনেকের বুকেই বেজেছিল। আমারও।
আরেক মহিলার কথা শুনেছি, ময়মনসিংহে বাড়ি, বেদের মেয়ে জোস্নাতিনি নাকি ষোলোবার দেখেছেন। দেখা যাচ্ছে মহিলাদের মধ্যে ছবিটি তুমুল আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে পেরেছে। এর আগে কোনো ছবি গাঁয়ের মেয়েদের প্রাণের শেকড় এতো জোরে টেনে ধরতে পারেনি।
একটি খবরে দেখলাম এই সকল ঘটনাকে ফালতু গুজব বলে উড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এক মফস্বলেই ছবিটি পাঁচ কোটি টাকা কামিয়েছে সেটাও নাকি ফন্দি করে বাজারে ছাড়া হয়েছে। উদ্দেশ্য, ছবিটির অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তার গুজব ফেঁদে দর্শকদের মধ্যে একটা কৌতূহল সৃষ্টি করা। বেদের মেয়ে জোস্নার যাঁরা বেপারি তাঁরা যদি কাজটি করেও থাকেন তাহলে খুব মন্দ করেননি বলা যায়, কারণ কৌতূহল আসলেই সৃষ্টি হয়েছে। তবে বিচক্ষণরা জানেন যে, সব ছবিতেই এই প্রকার কৌতূহল জাগিয়ে তোলা যায় না। ছবির মধ্যে তাহলে কিছু অতিরিক্ত ব্যাপার আছে, যাতে এই প্রকার কৌতূহল সৃষ্টি হয়। সেটা কী? সেটার উত্তর কিন্তু খবরে পাইনি। সে যাই হোক, ছবিটির প্রবল দর্শক সমাগম আমি নিজেই দেখেছি এবং টাঙ্গাইলে একটি গ্রামে কাজ করতে গিয়ে গাঁয়ের মেয়েদের মুখে ছবিটির কথা শুনে বুঝেছি ছবিটি যথার্থই জনপ্রিয় হয়েছে।
কিন্তু আমি কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য ছবিটি দেখতে যাইনি। জীবনে বহু বিষয়ে আমাদের কৌতূহল জাগে এবং তা যে সদা নিবৃত্ত করতেই হবে তার কোনো কথা নেই। বেদের মেয়ে জোস্নাকে সচক্ষে দেখার কৌতূহল আমার অবদমিত থাকলে আমার কোথাও কিছু ক্ষতি হতো না।
যে ব্যাপারটা আমাকে ছবিটি দেখিয়ে ছেড়েছে তা হচ্ছে ছবিটির বিরুদ্ধে তীব্র সব সমালোচনা। প্রায় সবাই একবাক্যে বলেছেন, ছবিটি কুরুচিপূর্ণ–একটা সামাজিক বিবৃতির অভিব্যক্তি। এই কথা বলার জন্য দুটো বিখ্যাত সাপ্তাহিক সিনেমাটির ওপর প্রচ্ছদ কাহিনীও ছেপেছে। যাঁরা ছবিটিকে বিকৃত রুচির বলেছেন তাঁরা অনেকেই আমার শ্রদ্ধেয় এবং বন্ধুস্থানীয় এবং আমি তাঁদের মতামতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে থাকি। অনেকে দীর্ঘদিন ধরে আর্ট ফিল্মের আন্দোলন করেছেন, তাঁরা ছবি বোঝেন এবং আর যাই হোক, আমার মতো তাঁরা কেউই সিনেমার বিষয়ে আকাট মূর্খ নন। কিন্তু আমার খালি মনে হয়েছে, ছবিটি যদি এতোই কুরুচিপূর্ণ হয় তাহলে গায়ে পড়ে ছবিটির বিরুদ্ধে এতো লেখালেখির দরকার কী?
কুরুচিপূর্ণ ছবি অথচ জনগণ হুমড়ি খেয়ে পড়ে ছবিটি দেখছে, এটা অসম্ভব নয় কিন্তু ভাবতে কষ্ট লাগে। বিশেষত, যখন জনগণ, মানে সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক ও নিম্নবিত্ত জনগণ। কুরুচির আতঙ্কে আমিও আক্রান্ত হয়েছি এটা স্বীকার করা ভালো। আমার মনে সত্যি সত্যিই প্রশ্ন জেগেছে, আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক ও নিম্নবিত্ত জনগণের রুচি কি আসলেই বিকৃত? রুচির নিশ্চয়ই শ্রেণীভেদ আছে, তাহলে কৃষক আর নিম্নবিত্তের রুচিটাই বা কী আর আমাদের রুচিটাই বা কাদের? এটা বেশ বড় মাপের প্রশ্ন। কিন্তু এই প্রশ্নটির সামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য এতো সুদূরপ্রসারী যে, বেদের মেয়ে জোস্নাকে আর উপেক্ষা করা সম্ভব হলো না। দেখতে হলো।
মার্কসের বরাতে কতিপয় মন্তব্য
ছবিতে যারা টাকা খাটান তাঁরা শিল্পচর্চার তাগিদ থেকে টাকা খাটান না। সিনেমাশিল্পে শিল্পরসবোধ খাটে না, খাটে পুঁজি এবং তার সাফল্যটাও অতএব শিল্পরসবোধের মাত্রা দিয়ে নির্ণীত হয় না, নির্ণীত হয় মুনাফা দিয়ে। ব্যবসায়ীরাই সিনেমাশিল্পে টাকা খাটাচ্ছেন এবং টাকা বানাচ্ছেন। এটা স্রেফ মুনাফা কামাবার জায়গা, এতটুকুন মার্কসবাদ সিনেমা সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনায় আমাদের দেশে এসেছে, লক্ষ্য করা যায়। তবে এতটুকুন বোঝার জন্য মার্কসের দ্বারস্থ হবার দরকার নেই। কাণ্ডজ্ঞান থেকেও কথাগুলো বলা যায়। যাঁরা শিল্প-সংস্কৃতির সমালোচক তাঁরা নিজেদের প্রগতিশীল দেখতে ভাবতে পছন্দ করেন বেশি। তাঁরা এই পুঁজি ও মুনাফার কথা তুলে এমন একটা পণ্ডিতির ভাব করেন, যাতে মনে হয় মুনাফাকারী সংস্কৃতি সম্পর্কে এটাই বুঝি শেষ কথা। বুঝিবা সাংস্কৃতিক বিষয়ে গভীরতর ব্যবচ্ছেদের দরকার নেই, অর্থনীতির দু’একখানা আপ্তবাক্য উচ্চারণ করলেই সংস্কৃতির বিচার সারে।
এটা সত্যি যে পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে সবকিছুই তৈরি হয় পণ্য হিশেবে, বাজারে বিক্রির জন্যে। সিনেমা মোটেও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু উৎপাদিত সামগ্রী পণ্য হয়ে ওঠার একটি প্রধান শর্ত হচ্ছে তার উপযোগিতা মূল্য। পণ্যকে কোনো না কোনো দরকার মেটাতেই হবে। সে দরকারের উৎপত্তি মার্কসের ভাষায় হতে পারে ‘পেটের আঁত থেকে অথবা কল্পনা থেকে’ (মার্কস: ১২৫)। তাহলে সিনেমা যিনি বানান তিনি কেবল তখনই মুনাফা উসুল করতে পারেন, যদি তা তাঁর দর্শকদের প্রয়োজন মেটায়। কৃষক ও নিম্নবিত্তের আঁতের জ্বালা সিনেমা মেটায় না, কিন্তু তার কল্পনার জগতের অবচেতনা, ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষাকে সিনেমা স্পর্শ করে ও নিবৃত্ত করে এবং এই স্পর্শ ও নিবৃত্ত করার ক্ষমতাই সিনেমার উপযোগিতা মূল্য, এই শর্তটা পূরণ করেই সিনেমা পণ্য হয়ে ওঠে। মুনাফা কামায়।
তাহলে একটি সিনেমা যে শ্রেণীর কাছে জনপ্রিয়, সেই সিনেমায় সে শ্রেণীর ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা-ক্ষোভ-বিদ্রোহ-প্রতিবাদের প্রতিফলন থাকে। নইলে গাঁটের পয়সা খরচ করে কেউ সিনেমা দেখতে যেত না। গরিব কৃষক ও নিম্নবিত্তের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি আরো প্রাসঙ্গিক। পেটের জন্য তার পয়সা খরচ করা অনেক বেশি স্বাভাবিক। কুরুচি কেনার জন্য পয়সা খরচ সে তুলনায় খুবই অস্বাভাবিক। কারণ তার সর্বাঙ্গগ্রাসী আঁতের মোচড় কুরুচির মোচড়ের চেয়ে অনেক অনেক বেশি।
মার্কসের এই অতি প্রাথমিক বক্তব্য ধরে শুরু করলেও দেখা যায় যে, দর্শকের ইচ্ছা আকাক্সক্ষা ও কল্পনার একটা খতিয়ান না নিয়ে সিনেমার বিশ্লেষণ শুরুই করা যায় না। যদি দর্শক অবদমিত যৌনাকাক্সক্ষার পরিতৃপ্তির জন্যও কোনো একটি সিনেমা দেখে, তবুও জানা চাই এই আকাক্সক্ষার চরিত্র কেমন? বা এই অবদমিত আকাক্সক্ষাটা কংক্রিট অর্থে কী? কীসের আকাক্সক্ষা? কার আকাক্সক্ষা? কোন শ্রেণীর আকাক্সক্ষা? কোন সময়ের আকাঙ্ক্ষা? ইত্যাদি।
একটা উদাহরণ বলি। এটা আশ্চর্যজনকভাবে লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশের মতো অনগ্রসর, ও কৃষিপ্রধান দেশগুলোতে সিনেমার নায়িকা মোটা আর স্বাস্থ্যবতী হয়, যা পশ্চিমের সম্পূর্ণ বিপরীত। পশ্চিমের ধনী দেশগুলোতে নায়িকাকে হতে হয় স্লিম, পলকা গা আর অনিবার্যভাবেই চাপা ভাঙা। বিশেষত মাজা হাতের বেড়ের মধ্যে না থাকলে পশ্চিমের কোনো নায়িকা পুরুষ দর্শকের মন কাড়তে সক্ষম হয় না। যৌনতার প্রতীক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে এটা তাদের এক নম্বর গুণ। কিন্তু আমাদের নায়িকার মেদবাহুল্য যৌনতার ভিন্ন সংজ্ঞা খাড়া করে। আমাদের কৃষক ও নিম্নবিত্ত দর্শক প্রতিনিয়ত অপুষ্টি ও অনাহারে থাকেন বলেই কি সৌন্দর্যের সংজ্ঞা এখানে মোটা ও স্বাস্থ্যবতী হওয়া? আর অতি আহার ও অতি পুষ্টির জন্য পশ্চিমে তার উল্টা?
অপরদিকে হাতের বেড়ের মধ্যে মাজা পেয়ে যাওয়ার মধ্যে নারীকে খেলনার মতো ব্যবহার করার আকাক্সক্ষা নগ্নভাবে ব্যক্ত। নারী হচ্ছে পুতুল, যাকে উল্টেপাল্টে ব্যবহার করা যায়। এই সৌন্দর্যবোধ নারীর ব্যক্তিসত্তার চূড়ান্ত অস্বীকৃতি। পশ্চিমে নারী সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে এই ব্যক্তিসত্তাহীন জায়গায় নিক্ষিপ্ত হয়েছে। সে নিক্ষেপ এতো গভীর যে, মাজা পুরুষের হাতের বেড়ের মধ্যে রাখা এখন নারীদেরও সাধনার বিষয় হিশেবে পরিগণিত।
কিন্তু বাংলাদেশে পরিস্থিতি এ পর্যায়ে নেই। তার মানে এই নয় যে, আমাদের নারীরা ভালো আছেন। এতটুকুই কেবল বলতে চাচ্ছি যে, যৌনতা ও কামের উপলব্ধির ক্ষেত্রে প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে কি দেশে দেশে সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে। বড়ো কথা, কাম ও যৌনতারও শ্রেণীভেদ আছে এবং একটি দেশের বৈষয়িক বিকাশের সঙ্গে অবদমিত ইন্দ্রিয়াকাক্সক্ষার যোগসাজশ অলঙ্ঘনীয়।
বলা বাহুল্য বেদের মেয়ে জোস্না সম্বন্ধেও এই সকল কথা প্রযোজ্য। আমার প্রগতিশীল বন্ধুদের বলি, অঞ্জু ঘোষের নর্তন কুর্দন আর যৌনতাই যদি এ ছবিতে তারা দেখে থাকেন তবে ঠিক এই ধরনের যৌনতা আমাদের কৃষক ও নিম্নবিত্তের মধ্যে গড়ে উঠল কেন, তার একটা ব্যাখ্যা খাড়া করার কর্তব্য তবুও থেকে যায়। ছবিটি দেখতে গিয়ে আমি অনে¦ষণ করেছি। কারণ সিনেমা পণ্য হলেই তার এই সকল সামাজিক ও আত্মিক তাৎপর্য খাটো হয়ে যায় না। জনপ্রিয়তার কারণে বরং তা বাড়ে। অতএব বেদের মেয়ে জোস্না ছবিটি স্রেফ ছবি হিশেবে কেমন সে মন্তব্যের চেয়েও ছবিটিকে বিচার ও বুঝতে পারার চেষ্টা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যদি আমরা বুঝি তাহলে কৃষক ও নিম্নবিত্ত জনগণের চৈতন্যকে অনুধাবনের ক্ষেত্রে আমরা এক কদম আগুয়ান হতে পারব বলে আমার বিশ্বাস।
গল্পটি ঘটেছে এক কাল্পনিক বঙ্গরাজ্যে–বাংলাদেশে!
বেদের মেয়ে জোস্নার গল্পটা ঘটেছে এক কাল্পনিক বঙ্গরাজ্যে। ছবিটি শুরু হয় এক করুণ পরিবেশে। দেখা যায় এক তরুণ পিতার আহাজারি, তিনি শোকাহত। তার একমাত্র শিশুকন্যা সর্পদংশনে মৃত। কলার ভেলায় শীতলক্ষ্যা নদীতে তাকে ভাসিয়ে দেয়া হচ্ছে। সাপে কাটা দেহ কলার ভেলায় ভাসিয়ে দেয়ার রীতি এ দেশে বহু প্রাচীন দিন থেকে প্রচলিত। নদীতে ভেসে যাওয়া দেহ কোনো প্রাজ্ঞ ওঝা হয়ত কূলে টেনে এনে আবার বিষ ঝেড়ে মৃতকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে সেই আশায় এই রীতি।
তো জোস্না এসে ভিড়ল এক আটকুঁড়ে বেদে দম্পতির কাছে। ভেলার সঙ্গে একখানি চিঠি ছিল, বেদে দম্পতি সে চিঠিতে জানতে পারলেন যে, এই শিশু বালিকার নাম জোস্না। জোস্নাকে তারা তাদের নাতি হিশেবে বড়ো করে তুললেন। বেদে হিসেবে জোস্না পারঙ্গম হয়ে উঠল ক্রমে ক্রমে।
একদিন বঙ্গরাজ বাড়িতে সাপ খেলা দেখিয়ে ফেরার পথে জোস্না উজিরপুত্রের কামুক বাসনার শিকার হলো, আর রাজকুমার আনোয়ার তাকে সেই কামুক হামলা থেকে বাঁচিয়ে মন জয় করে নিলো। এই আক্রমণ ও উদ্ধার পর্বের নাটক চলবার কালে জোস্নার রূপ রাজকুমারের হৃদয় জয় করে নেয়, রাজকুমারও জোস্নার প্রাণে গাঁথা হয়ে যায়। এরপর থেকে রসিয়ে উভয়ের প্রেম চলতে থাকে, আর ভিলেনের হামলা ও আবশ্যিক প্রতিরোধও নাটকীয়ভাবে অব্যাহত থাকে।
অপরদিকে উজির চক্রান্ত করেছিল বঙ্গরাজের রাজ্য হাতিয়ে নিজের কব্জায় তুলে নেবার। উজির চান মেয়ে তারার সঙ্গে রাজকুমারের বিয়ে হোক, বাবার প্রণোদনায় উজির কন্যা তারা লেগে রইল রাজকুমার আনোয়ারের পেছনে।
রাজকুমারের বন্ধু হচ্ছে সেনাপতির ছেলে রাজ্জাক। সে কারণে উজিরপুত্র ক্ষুব্ধ। কারণ সেনাপতির ছেলের চেয়ে উজিরপুত্র স্ট্যাটাসের দিক থেকে বড়ো, এই সামন্ত নিকাশ কাহিনীর আরেকটি পশ্চাৎভূমি তৈরি করে। অপরদিকে আবার রাজ্জাক ভালোবাসে তারাকে। কিন্তু তারা রাজ্জাকের প্রেমকে ধৃষ্টতা মনে করে। কারণ তারা হচ্ছে গিয়ে উজিরের কন্যা আর রাজ্জাক কিনা এক ক্ষুদ্র সেনাপতির পুত্র। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রেই সামন্তীয় হিশাব-নিকাশ প্রেমের নতুন সংঘাত সৃষ্টি করে।
আর আনোয়ার এই সব হিসাব-নিকাশের বাইরে বেদের মেয়ের প্রেমে মাতোয়ারা। কিন্তু এই অসঙ্গত প্রেম চলতে পারে না। জোস্নাও বুঝতে পারে রাজকুমারকে পাওয়া সম্ভব নয়। ফলে তাদের দেখাশোনায় একটা ছেদ পড়ে।
এই সময় ঘটল সেই নাটকীয় ঘটনা। এক সাপ দংশন করলো রাজকুমারকে। কোনো ওঝাই রাজকুমারকে বাঁচাতে এগিয়ে আসলো না। কারণ যে এ সাপের বিষ তুলতে যাবে মুখে রক্ত উঠে মরবে। মরবার ঝুঁকি কোনো ওঝাই নিতে রাজি হলো না। ঝুঁকি নিলো জোস্না তার দাদি বেদেনির নিষেধ সত্ত্বেও। জোস্না দাদিকে বলল, যদি সাপ রাজকুমারের পায়ের দংশনক্ষত থেকে বিষ তুলে নিজেই সেই দূষিত রক্তের বিষে মরে তাহলে সে বেঁচে যাবে।
বেজে উঠল জোস্নার সাথে মরণবীণ। এই সেই মুহূর্ত, যখন দর্শক নিঃশ্বাস বন্ধ করে সেকেন্ড গুনতে থাকে। জোস্নার মুখে রক্ত উঠে আসে, জোস্নার প্রাণের আশঙ্কায় দর্শক আতঙ্কিত হয়, কিন্তু জোস্না মরে না। সাপ নিজের বিষ নিজে তুলে মরে যায়।
বঙ্গরাজা জোস্নাকে বললেন, তাঁর একমাত্র পুত্রের প্রাণ রক্ষার জন্য সে যা পুরস্কার চায় তাই দেয়া হবে। প্রতিশ্রুতি পেয়ে জোস্না চাইল রাজকুমারকে। পুরো চলচ্চিত্রটির নাটকীয় মর্মের শাঁসটা জোস্না ও বঙ্গরাজার ডায়ালগে বিধৃত হয়ে আছে। বঙ্গরাজা জোস্নার এই চাওয়াকে ধৃষ্টতা মনে করলেন এবং জোস্না তার দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে বলে তিরস্কার করলেন। তারপর গলাধাক্কা দিয়ে কপাল ফাটিয়ে জোস্নাকে রাজসভা থেকে তাড়িয়ে দিলেন।
জোস্নার যুক্তি সোজা। আমি নিজের প্রাণ বাজি রেখে রাজকুমারকে বাঁচিয়েছি অতএব রাজকুমার আমার। রক্তাক্ত জোস্না রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করার সময় তার কপালের রক্তে রাজপ্রাসাদের মেঝে রঙিন করে দিয়ে বলল, যে গরিবের প্রতি ঘৃণায় বঙ্গরাজা তার প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ করেছেন, সেই গরিবের রক্তে এই প্রাসাদকে সে কলঙ্কিত করে দিয়ে যাচ্ছে।
রাজকুমার সুস্থ হয়ে সব শোনার পর পাগলের মতো জোস্নার খোঁজে বেরুল এবং তাকে বিয়ে করে রাজপ্রাসাদে ফিরল। ফিরে এসে পিতাপুত্রের বচসা তুঙ্গে উঠল। নিজের অহংকার রক্ষার রাগ এতই অসহনশীল মাত্রায় গিয়ে ঠেকল যে, রাজা নিজের পুত্রকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করে অবিলম্বে কোতল করার নির্দেশ দিলেন। বঙ্গরাজের অভিযোগ, তার পুত্র বেদের মেয়ের মতো ছোট জাতের মেয়েকে রাজপ্রাসাদে তুলে তাদের আভিজাত্যকে ক্ষুণ্ন করেছে। কিন্তু জল্লাদ রাজকুমারকে যখন হত্যা করতে যাবে বঙ্গরানি তখন জল্লাদকে অনুরোধ করলেন রাজকুমারকে যেন ছেড়ে দেয়া হয়। তিনি রাজকুমার ও জোস্নাকে অন্যত্র নির্বাসনে পালিয়ে যেতে উপদেশ দিলেন। জোস্না নিজের হাত কেটে জল্লাদের দা রঞ্জিত করে দিলো। এতে রাজকুমারের প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে প্রমাণ করা গেল।
নির্বাসনে রাজকুমার কাঠ কেটে ঘরে আনে, জোস্না রাঁধে বাড়ে। এদিকে উজির পুত্র সেই যে জোস্নার পেছনে লেগেছে তো লেগেছেই। সে জোস্নাকে খুঁজতে খুঁজতে এসে পেয়ে যায় এবং রাজকুমারকে দেখে অবাক হয়, কারণ তার মৃত্যু হয়েছে বলেই সে জানে। সেই এলাকার জমিদারের বাড়িতে প্রহরীকে হত্যা করে রক্তাক্ত খঞ্জর রাজকুমারের কুঁড়েঘরের পাশের কাঠের গাদায় উজিরপুত্র লুকিয়ে রাখে। রাজকুমার প্রহরীকে খুনের দায়ে ধরা পড়ে এবং জমিদারের কারাগারে চাবুক খেয়ে বন্দি হয়।
ওদিকে রাজকুমারের দোস্ত রাজ্জাকের কাছে ফাঁস হয়ে যায় যে রাজকুমার মরেনি, বেঁচে আছে। রাজকুমারকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে বঙ্গরাজা নিজেও শোকে কাতর হয়ে পড়েন। রাজকুমারের দোস্ত সেনাপতিপুত্র রাজ্জাককে তিনি রাজ্যভার দিয়ে অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। এতে রাজকুমারের মা বাধ্য হয়ে রাজ্জাককে জানান যে রাজকুমার আসলে মরেনি, বেঁচে আছেন, অতএব রাজ্জাকের উচিত রাজকুমারকে খুঁজে এনে তার হাতেই রাজ্যভার সোপর্দ করা।
উজির ঘটনার এই নতুন মোড়ে বিচলিত বোধ করে, বঙ্গরাজ্য তার নিজের হাতে কব্জা করার চক্রান্ত বুঝি ফসকে যায়। উজির ও উজিরপত্নী এবার তাদের কন্যা তারাকে বলল সে যেন সেনাপতিপুত্র রাজ্জাককে প্রেম করে বাগিয়ে নেয়, কারণ রাজ্জাকই এখন রাজকুমারের অনুপস্থিতিতে রাজা হতে যাচ্ছে।
কিন্তু আশ্চর্য যে, তারা প্রতিবাদ করে। রাজ্য ও সম্পদের লোভে তার বাবা-মা তাকে যেভাবে ব্যবহার করছে তাতে তার নিজের প্রতি ঘৃণা জন্মে এবং সে আত্মহত্যা করতে গাছে দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়ে। কিন্তু নাটকীয়ভাবে সেখানে রাজ্জাকের আবির্ভাব ঘটে ও ফাঁসির দড়ি তলোয়ার দিয়ে কেটে রাজ্জাক তারাকে বাঁচায়। রাজ্জাকের প্রেমের নিষ্ঠায় তারা অভিভূত হয় ও স্বতঃস্ফূর্তভাবেই রাজ্জাকের প্রেমে পড়ে। এই নাটকীয় ভাবান্তরের মধ্য দিয়ে উজিরকন্যা তারা বুঝতে পারে রাজ্জাক তাকে আসলেই ভালোবাসে এবং সেও রাজ্জাককে ভালোবাসে। আভিজাত্যের ওপর প্রেমের সাম্য জয়লাভ করে। উভয়েই এখন উজিরের চক্রান্তের হাত থেকে রাজ্য রক্ষার জন্য সংকল্পবদ্ধ হয়।
রাজকুমারের খোঁজে পুরুষ সেজে তারা যে পরগণায় রাজকুমার বনবাসে কাল কাটাচ্ছে সেখানকার জমিদার বাড়িতে গিয়ে ওঠে। জমিদার ছিলেন রাজ্জাকের মামা। তিনি নিঃসন্তান। পুরুষবেশী তারা হয় তার সন্তানতুল্য। সেই জমিদারের কারাগারেই রাজকুমার ছিলেন বন্দি।
তারা অতএব রাজকুমারকে কারাগারেই পেয়ে যায় এবং রাজ্জাককে খবর পাঠায়। খবর বঙ্গরাজার কানে ওঠে। পুত্র জীবিত আছে শুনে বঙ্গরাজা উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন এবং সন্তানের উদ্ধারের জন্য ছোটেন। ইতোমধ্যে খুনের মামলায় রাজকুমারের বিচার শুরু হয়ে যায়।
বিচার করতে বসেন কাজি। এখানেই হঠাৎ জানা যায়, এই কাজি আসলে জোস্নার বাবা। বঙ্গরাজা তার ভগ্নিপতি। জোস্না নদীর ধারে কাজিকে এর আগেই দেখেছিল এবং সেখানে তাদের পরিচয় হয়। কিন্তু কাজি বুঝতে পারেনি এ তারই মেয়ে জোস্না। জোস্নাও বোঝেনি তবু জোস্না তাকে বাবা ডাকে, কারণ কন্যাহারা পিতার বেদনা তাকে আপ্লুত করে।
কাজির বিচারালয়ে ছবির সকল কুশীলব একত্রিত হয়। বঙ্গরাজাও ছুটে আসেন কাজির দরবারে। উজিরপুত্রের কারসাজি উজিরপুত্রের মুখেই প্রমাণিত হয়। প্রমাণিত হয় যে বন্দি আসলে বঙ্গরাজার পুত্র, যদিও পুত্র পিতার প্রতি তীব্র অভিমানে সে পরিচয় দিতে অনিচ্ছুক ছিল এবং অবশেষে এটাও প্রমাণিত হয় বেদের মেয়ে জোস্না আসলে বেদের মেয়ে নয়, সে কাজির মেয়ে। এর ফলে জোস্নাকে বৌ হিসেবে স্বীকার করে নিতে বঙ্গরাজার আভিজাত্যে আর বাধে না। পুত্র ও পুত্রবধূকে রাজা বরণ করে নেন।
আমি সংক্ষিপ্তভাবে পুরো কাহিনীটি বলতে বাধ্য হলাম এ কারণে যে, যারা ছবিটি দেখেননি তাদেরকে কাহিনীটি বলার দরকার ছিল। তাছাড়া এরপর আমি যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করব তার জন্য কাহিনীটি আগেই বলে নেয়া জরুরি। যারা ছবিটি দেখেছেন তাদেরকেও ফের মনে করিয়ে দেবার দরকারে আরেক দফা কাহিনীটি বলা ছাড়া উপায় ছিল না।
প্রথমেই সরল যে প্রশ্নটা আমি করতে চাই তা হলো এই গল্পের কোথায় কুরুচি বা সামাজিক বিকৃতি? আমি তন্ন তন্ন খুঁজেও কূল করতে পারিনি। গল্পের কংকালটাই আমি কেবল বলেছি, কারণ আসলে কাহিনীর সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি মাত্রা আছে। সে মাত্রা অনেকের চোখে ধরা নাও পড়তে পারে। সে প্রসঙ্গে আসব। কিন্তু যারা কেবল গল্পের কাঠামো খুঁজে ছবিটি বিচার করেছেন তাদের আমি ভাবতে অনুরোধ করি, এই সাধারণ কাহিনীর মধ্যে তারা কি আসলেই বিকৃতি দেখতে পাচ্ছেন? আমি দ্বন্দ্ব সংঘাত ও নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ একটি চমৎকার কাহিনীর কাঠামো দেখে বরং বিস্মিত হয়েছি।
অনেকে আজকাল দেখছি ‘ফোকফ্যান্টাসি’ শব্দটি ব্যবহার করছেন। এই অদ্ভুত শব্দটির মানে যে কী আমি জানি না এবং অন্য কোনো ছবির মধ্যে থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু বেদের মেয়ে জোস্নার মধ্যে আমি এক কণা ফ্যান্টাসি দেখিনি। একজন রাজকুমারের সঙ্গে একটি বেদের মেয়ের প্রেম হওয়াটা হয়তো অসম্ভব কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। হতেই পারে। যদি বিকৃতি অর্থে অস্বাভাবিক বুঝি আমরা তাহলে বেদের মেয়ে জোস্নার ঘটনা অস্বাভাবিক নয়।
তাছাড়া লোকায়ত বিশ্বাস আর ফ্যান্টাসি এক কথা নয়। গ্রামীণ জনগণের বিশ্বাস বা ঐতিহ্যাতীত ধারণা ফ্যান্টাসি নামক উৎকল্পনা নয়। কালনাগিনীর ছোবলে মৃত মানুষের বিষ কালনাগিনী নিজের মুখে তুলে নেয় কি না সেটা নিয়ে তর্ক করা যায় এবং তা মিথ্যা হলে প্রমাণ করে দেখিয়েও দেয়া যায়। কিন্তু এটা লোকায়তিক বিশ্বাস। এটা ফ্যান্টাসি নয়। এই ফারাকটা অবশ্যই খেয়াল রাখা দরকার।
ফ্যান্টাসি কী বস্তু তার উদাহরণ দেয়ার জন্য একটা তাগিদবোধ করছি। শব্দটি ইংরেজি, যার মানে সোজা কথায় বাঁধনহীন কল্পনা, আপনার অবদমিত বাসনা প্রক্ষেপ। এর অর্থ কিন্তু আজগুবি নয়, অথচ অনেককে দেখেছি শব্দটি আজগুবি শব্দের প্রতিশব্দ হিশেবে ব্যবহার করতে। ল্যাটিন আমেরিকার আধুনিক সাহিত্যে ফ্যান্টাসির বিপুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। শক্তিশালী লেখকরা প্রায়ই তাদের গল্পে ও উপন্যাসে ফ্যান্টাসি ব্যবহার করেন যা কল্পনার সীমান্তকে এমন জায়গায় স্পর্শ করে, যেখানে বাস্তব আর অলৌকিকতা অভিন্ন হয়ে যায়। এক্ষেত্রে গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেজের পারদর্শিতা কিংবদন্তির মতো। সম্প্রতি তার একটা ছবিতে ফ্যান্টাসির ব্যবহার দেখে অবাক হয়েছি। কারণ সাধারণ ভাষায় আমরা যাকে আজগুবি বলি মার্কেজ তাকেও ব্যবহার করতে ছাড়েননি। ফ্যান্টাসি ও আজগুবির সমীকরণ আমাদের দেশে অতি প্রবল, মার্কেজের ছবিটি এই সমীকরণের মধ্যে পড়ে বলে উদাহরণ হিশেবে সম্ভবত ভালো। ছবির চিত্রনাট্যটা মার্কেজের নিজের হাতেই লেখা। গল্পটা অনেকটা এরকম : এক মডেল মেয়ে ধর্ষিত হয় কিন্তু ধর্ষণ তার মধ্যে এক বিপরীত কামবোধের জন্ম দেয়, যা তাকে নিয়ে গিয়ে পৌঁছায় এই ফ্যান্টাসির জগতে। দর্শকের কাছে সে জগৎটাকে মনে হয় খুবই বাস্তব। ধর্ষিতা নারী এরপর থেকে তার ধর্ষণকারীকে খোঁজে। ধর্ষণকারীর ঘাম ও নিঃশ্বাসের মধ্যে যে জান্তবতা ছিল তা তাকে অবচেতনে তাড়ায়, সে এক অদ্ভুত আকর্ষণ বোধ করে।
বলা উচিত বিজ্ঞাপন ও মডেলিং-এর সাধনা হচ্ছে আমাদের কামার্ততার বিচিত্র গ্রন্থিগুলোকে তাতানো। যার পরিণতি পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদনের হরেক পণ্যের বাজার বৃদ্ধি। আমাদের কামার্ততা শেষমেশ চরিতার্থ হয় পণ্যের ভোগে। বিজ্ঞাপন ও মডেলিং সে হিশেবে আমাদের ওপর পুঁজির ধর্ষণ যা আমরা শেষাবধি (উপভোগ) করি।
ধর্ষিতা মডেলকন্যা ধর্ষণকারীর খোঁজে সহায়তা প্রার্থনা করে সালামান্দারের। সালামান্দার এই ছবিতে একটি মানুষ চরিত্র। আসলে সালামান্দার একটি সরীসৃপজাতীয় জন্তু এবং ধারণা করা হয়ে থাকে যে, জন্তুটি বাস করে আগুনে। প্রেমের আগুন সালামান্দারের মধ্যে এতো বেশি যে, সত্যি সত্যিই তার শরীরে আপনাতেই আগুন ধরে, যা দেখে দর্শকদের মোটেও অবাক লাগে না ইত্যাদি। ছবিটির নাম, ইউ আর দি ওয়ান আই অ্যাম লুকিং ফর (তুমিই সেই যাকে আমি খুঁজছি)। যারা ফ্যান্টাসি কী বুঝতে চান তাদেরকে আমি এই ছবিটি দেখতে অনুরোধ করি।
সেই বিচারে বেদের মেয়ে জোস্নায় আমি ফ্যান্টাসি বা আজগুবি কিছু দেখিনি। একজন সাধারণ কৃষক ও নিম্নবিত্তের চোখে বেদের মেয়ে জোস্নার কোনো ঘটনাই আজগুবি তো নয়ই, ফ্যান্টাসিও মনে হবে না। ঘটনা যা ঘটেছে তার মধ্যে কোনো অতিকল্পনা আছে, সেটা তাদের অবিশ্বাস্য মনে হবে না। কারণ পুরো ঘটনাই তাদের কাছে একটি স্বাভাবিক গল্প হিশেবেই আবির্ভূত হবে। লোককাহিনীর চেনা ও পরিচিত পরিপ্রেক্ষিতের সীমা এখানে এক সেন্টিমিটারও লংঘিত হয়নি। বলা বাহুল্য লোককাহিনী মানেই ফ্যান্টাসি নয়। কিন্তু ‘শিক্ষিত’ বা ‘আধুনিকমনস্ক’ মধ্যবিত্তের চোখে এ সকল কাহিনী ফ্যান্টাসি মনে হবে। এই শ্রেণী সাধারণত তার নিজের সমাজ ও সংস্কৃতির কোনো খোঁজখবর রাখে না বা রাখার প্রয়োজন বোধ করে না। গ্রামীণ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের চেতনার বস্তুগত ও সাংস্কৃতিক ভিত্তিটা যে আসলে কী সে সর্ম্পকে এই শ্রেণীর মধ্যে আজতক কোনো গভীর অনুসন্ধিৎসা চোখে পড়েনি। অপরদিকে উন্নত দেশের দিকে তাকিয়ে যে মন ও মানসিকতার চর্চা এই শ্রেণী করে তা পর্যবসিত হয় নেহাতই অনুকরণে। কারণ সেসব তার বোধ ও অভিজ্ঞতার বাইরের জিনিস। সে আসলে বুঝতে পারে না নিজের একটা মনগড়া ‘আধুনিকতা’ নিয়ে বুক চিতিয়ে সমাজে পণ্ডিতি করে বেড়াচ্ছে। বলা যায়, সে না ঘরকা না ঘাটকা।
বেদের মেয়ে জোস্নার কাহিনী পুরনো একটি যাত্রার বলে শুনেছি। জসীমউদ্দীনেরও নাকি একই কাহিনী অবলম্বনে একটি কাব্যগাথা আছে। এ দুটোর কোনোটিরই দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। যদি সত্যি সত্যিই তাই হয় তাহলে দেখা যাচ্ছে, এই কাহিনীটির একটি সর্বজনীন জনপ্রিয়তা সব সময়ই ছিল। তাহলে অন্তত কাহিনীর ক্ষেত্রে কোনো বিকৃত মানসিকতার অভিযোগ ছবিটির বিরুদ্ধে খাটে না। কিন্তু আমি আগেই বলেছি কাহিনীটি কংকাল মাত্র। এই কংকালকে আশ্রয় করে ছবিটির মধ্যে আরো গভীরতর ও ভিন্ন মাত্রার বক্তব্য আছে, সেই বক্তব্যের মধ্যে ছবিটির জনপ্রিয়তার শেকড় নিহিত বলে আমার মনে হয়েছে।
ছবিটি আকৃষ্ট করেছে কৃষকদের… কৃষকসুলভ চৈতন্যের যারা ধারক
ছবিটি সম্পর্কে প্রথমেই যে কথা বলা দরকার তা হলো ছবিটি আকৃষ্ট করেছে ‘কৃষক’দের। কৃষক বলতে আমি সরাসরি যারা কৃষিকাজ করেন তাদেরকেই কেবল বোঝাচ্ছি না। বোঝাচ্ছি তাদেরকেও, কৃষকসুলভ চৈতন্যের যারা ধারক। অর্থনৈতিক দিক থেকে কৃষকের নানা স্তর আছে। যারা কেবল কৃষিকাজ করেন কৃষকদের মধ্যে তারা একটা স্তর মাত্র। গ্রামের কৃষি অর্থনীতির সঙ্গে নানান সূত্রে যারা জড়িত, শহর ও শিল্পায়নের বেগ বা আবেগ যে চৈতন্যে এখনো দানা বাঁধেনি কিন্তু কৃষকসুলভ বুর্জোয়া আকাক্সক্ষা স্ফূরণ যে চৈতন্যে কমবেশি অংকুরিত হচ্ছে, লেনিনের সূত্র ধরে আমি এই আলোচনার সুবিধার্থে তাদের কৃষক বলছি। এক্ষেত্রে ‘গ্রামীণ পেটিবুর্জোয়া’ শব্দটি হয়তো আরো যুৎসই হতো। তবে ‘কৃষক’ শব্দটির মধ্যে সে দ্যোতনা এসে যায় বলেই আমার বিশ্বাস।
আমি মোটামুটি লক্ষ্য করতে চেষ্টা করেছি ছবিটি কারা দেখছেন। পরিসংখ্যান দেবার মতো খোঁজ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবুও মফস্বল শহরে আমি দেখেছি হাটে বা মিউনিসিপ্যালিটির বাজারে আলু, ধান বা সবজি বেচার পর গেরস্ত কৃষক ছবি দেখতে সিনেমা হলে ঢুকেছে। গ্রামের গরিবদেরকেও দেখেছি, যারা ভূমিহীন এবং সত্যি সত্যি গরিব, ভাঙা ছাতির আড়ালে পর্দা বাঁচিয়ে প্রিয় স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন বেদের মেয়ে জোস্না দেখতে। আণ্ডা বিক্রি করে সিনেমার টিকেট কিনেছে টুপি পরা অতি সরল উৎসাহী গ্রামের মানুষ, দুই হাতে তার কিশোরী মেয়ে ও বালক পুত্র। তবে কৃষির সঙ্গে জড়িত ছোট ব্যবসায়ী, কারিগর, মুদি দোকানদার প্রভৃতি নানা ধরনের পেটি বুর্জোয়ার সংখ্যাই সম্ভবত ছিল বেশি।
ঢাকা শহরে, লক্ষ্য করেছি, নিম্নবিত্তদের মধ্যে যারা দীর্ঘদিন এই শহরে বাস করছেন, ছবিটি তাদের কাছে তেমন জনপ্রিয় হয়নি, যেমনটি হয়েছে সদ্য শহরে আসা মানুষটির–গাঁয়ের গন্ধ যার গা থেকে এখনো যায়নি। এ রকম শহুরে হয়ে যাওয়া একজন রিকশাচালককে জিজ্ঞাসা করে দেখেছি ছবিটি তার তেমন ভালো লাগেনি, তবে ছবিটি তার দেখা আছে। অথচ ফরিদপুরের একজন রিকশাচালককে ছবিটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করায় সে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সিনেমার গল্পটি ডায়ালগসহ আমাকে ক্লান্তিহীন বলেছে। তার উৎসাহ দেখে গন্তব্যে পৌঁছার পরও অন্তত বিশ মিনিট ধরে তার কাহিনী বলা শুনতে হয়েছে। সে শহরে এসেছে দশ কি এগারো মাস আগে। আদমজি বা তেজগাঁওয়ের শ্রমিকদের তেমন আদিখ্যেতা নেই। কিন্তু অনিবার্যভাবেই গার্মেন্টসের মেয়ে শ্রমিকরা পয়সা ও সময়ের কূল করতে পারলেও ছবিটি দেখেছেন।
তাহলে কোথায় যেন ছবিটি গ্রাম ও শহরের একটা পার্থক্য ঘটাতে পেরেছে। একে মূর্তভাবে চিহ্নিত করার তাত্ত্বিক মুশকিলটা পাশে থুয়ে মোটা দাগে যদি ছবিটির রসপিপাসু শ্রেণীকে আমি ব্যাপ্ত অর্থে কৃষক বলি আশা করি পাঠক আমার সঙ্গে ধৈর্য ধরবেন। আমি এটা অন্তত স্পষ্ট বুঝেছি যে, শহরের আবেগ ও সংস্কৃতির সঙ্গে অভ্যস্ত ধনী, মধ্যবিত্ত বা শিক্ষিত সম্প্রদায়ের তো প্রশ্নই ওঠে না, এমনকি শহুরে শ্রমিকদের কাছেও ছবিটি তেমন গ্রহণযোগ্য হয়নি। কিন্তু হয়েছে গ্রামে–কৃষকসুলভ গ্রামীণ চৈতন্যকে ছবিটি নাড়া দিয়েছে। এটা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে।
অস্পষ্ট মজা কল্পনার থাবা এড়িয়ে পালাতে পারে না
ঘটনাটি ঘটেছে বঙ্গরাজ্যে। বঙ্গরাজ্য নামের মধ্যে বাংলাদেশ নামের ইশারা আছে। ফলে দর্শককে নামের প্রতীকী ইঙ্গিত ধরতে বেগ পেতে হয় না। বঙ্গরাজ্য ও বাংলাদেশের মধ্যে মিল খুঁজে পাবার জন্য আধুনিক বুদ্ধির দরকার পড়ে না, ফলে কৃষক চৈতন্যের কাছেও প্রতীকী ইশারার মজা ধরা পড়ে। কিন্তু কাহিনীটি বঙ্গরাজ্যের এবং এটি একটি লোককাহিনীর ‘কাল্পনিক’ রাজ্য। অতএব কৃষক ও নিম্নবিত্ত জনগণের চাষীসুলভ বুদ্ধি সিনেমার সঙ্গে সঙ্গে ভান করে যে, আদতে কল্পিত বঙ্গরাজ্যের ঘটনাই বুঝি তারা দেখছেন। এই ভানের মধ্যে এক অর্বাচীন আমোদ আছে, যা তাকে শুরু থেকেই তাতায়। এই ভানে মেতে সাধারণ জনের সরল বুদ্ধি নিজের খুশি বোধ করে, প্রতীকের মানে খুঁজে পাবার কারণে নিজের বুদ্ধির ওপর তার বিশ্বাস বাড়ে। ছবিটির অস্পষ্ট মজা ফলে তার কল্পনার থাবা এড়িয়ে পালাতে পারে না।
জোস্না, আনোয়ার, রাজ্জাক তারা ইত্যাদি নাম কৃষক মনের পরিচয়। কিন্তু ভিন্নভাবে এ সকল নাম লোককাহিনীর মতো নয়। রহিম বাদশা-রূপবানকন্যা, গাজীকালু-চম্পাবতী, সয়ফুলমূলক-বদিউজ্জামান, বেহুলা-লখিন্দর প্রভৃতির নামের সঙ্গে এই সকল নামের এমন এক গভীর অমিল রয়েছে যে, এই নামগুলো যে লোককাহিনীর নয় কৃষকমন তার সহজ বুদ্ধিতে অনায়াসেই অনুধাবন করতেই পারে।
অপরদিকে এই নামগুলো সম্প্রতিকালের নাম। নামগুলো অতি আধুনিক নয়, আবার প্রাচীন বা গ্রাম্যও নয়। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। গত কয়েক দশকে কৃষকের মধ্যে আকাক্সক্ষা ও চিন্তা-চেতনার যে রূপান্তর ঘটছে, এই নামগুলো কি তারই অভিব্যক্তি? শহরের আধুনিক বুর্জোয়া শ্রেণী বা মধ্যবিত্ত সাধারণত এই নামগুলোকে গ্রাম্যতায় দুষ্ট ও পুরনো মনে করে। নাজনীন, ইসমত, ইশতিয়াক নামের মধ্যে যে স্মার্টময় চটপটে জৌলুস আছে জোস্না, রাজ্জাক, আনোয়ারের মধ্যে তা নেই। আবার তারা করিম, রহিম, ছমিরন, আছিয়ার মতো অতি গ্রামীণ বা প্রাচীনও নয়।
স্বীকার করি, নামগুলো সিনেমাওয়ালাদের দেয়া। কিন্তু নামগুলোর গ্রহণযোগ্যতা দেখে মনে হয় এর সঙ্গে কৃষকের নয়া চৈতন্য সমান্তরাল। এই নামগুলো শহুরে নয়, কিন্তু প্রাচীনও নয়। নয়া চৈতন্যসম্পন্ন কৃষকমন এই নামগুলোকে কাছের মনে করে এবং কাহিনীর মধ্যে নিজ শ্রেণীর চিহ্ন পরিদৃশ্যমান দেখতে পায়।
ছবিটি শুরু হবার পরপরই দর্শক টের পেতে শুরু করে যে, ছবির বিষয় ও পরিপ্রেক্ষিত বর্তমানকে নিয়ে, কোনো অতীত বা কাল্পনিক বিষয় নিয়ে নয়। যে অভিজ্ঞতা-আবেগ-ইচ্ছা সংকল্প ঐতিহাসিকভাবে অতিক্রম করে এলে আমরা ছবিতে ব্যক্ত অভিজ্ঞতা-আবেগ-ইচ্ছা-সংকল্পকে অতীত ভাবতে পারতাম তা বাংলাদেশের জনগণ এখনো অতিক্রম করেনি। ফলে ছবিটির মধ্যে বর্তমান যারপরনাই বিদ্যমান। কালবোধের এক বিচিত্র বর্তমানতা ছবিটি সঞ্চার করতে সক্ষম। এই উপলব্ধিগত কাল ছবিটিকে দর্শকদের কাছে নিয়ে আসে। এরপর ছবিটি কৃষকমনকে তার অবচেতনের মধ্যে অতীত দিয়ে যেতে থাকে। কৃষক তার ইচ্ছা-সংকল্প-আবেগের প্রতিধ্বনি অবচেতনে ছবিটির মধ্যে পেয়ে যায়।
বেদের মেয়ে জোস্না কৃষক চৈতন্যের বেশ কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত স্তরকে স্পর্শ করেছে বলে আমার মনে হয়েছে। আলাদা আলাদা শিরোনামে তাদের আলোচনা অধিক আরামের হবে।
মৌলিক সংঘাত কিংবা সংগ্রামের মর্মশাঁস
ছবিতে মৌলিক সংঘাতটা বেদের মেয়ে জোস্নার সঙ্গে বঙ্গরাজার। জোস্না অনেকবারই তার ডায়ালগে বলে যে, সে গরিব এবং বেদেপাড়ায় আমরা সত্যি সত্যিই গরিব অধিবাসীদেরকে দেখি। অতএব আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় সে গরিবের প্রতিনিধি।
তাহলে রাজা কি বড়লোকদের প্রতিনিধি? গরিবের নিপীড়ক, শোষক বা অত্যাচারী শ্রেণীর প্রতিভূ? আশ্চর্য যে, আমরা মোটেও রাজাকে একজন নিপীড়ক, শোষক বা অত্যাচারী ভূমিকায় দেখি না। বরং শুরু থেকেই তাকে প্রজার হিতাকাক্সক্ষী হিসেবে দেখানো হয়। তার রাজ্যে প্রজাদের নিপীড়ন হয়েছে এমন কোনো ঘটনা জানিয়ে বা দেখিয়ে বা সে ধরনের কোনো টেনশন সৃষ্টি করে ছবিটি শুরু হয়নি। তবে জোস্না যখন রাজকুমারকে দাবি করে বসল, তার ফলাফল হিশেবে আমরা বেদে বস্তি জ্বলে যেতে দেখেছি। কিন্তু সেটা গরিবের ওপর বড়োলোকের আক্রমণ নয়। বরং জোস্না বঙ্গরাজার ভাষায় দুর্বলতার সুযোগ নিতে গিয়েছে বলেই এই শাস্তি। এমনকি বস্তি জ্বালাবার ক্ষেত্রে উজিরের শয়তানিটাই বরং আমাদের চোখে পড়ে, বঙ্গরাজের ভূমিকা এক্ষেত্রে গৌণ।
মৌলিক সংঘাতটা তাহলে মোটেও গরিবের সঙ্গে বড়লোকের কিংবা প্রজার সঙ্গে রাজার নয়। অর্থাৎ শ্রেণীসংগ্রামের যে ঠিসুং ঠিসুং ভাল্গার চেহারা সচরাচর আমরা হিন্দি ও বাংলাদেশী ছবিতে দেখি, এখানে তা সম্পূর্ণ গৌণ ব্যাপার। অপরদিকে মৌলিক সংঘাত এমনকি নিপীড়কের সঙ্গে নিপীড়িতেরও নয়। অত্যাচারীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে জোস্না লড়েনি। ছবিটির কোথাও শ্রেণীসংগ্রামের এই সকল পরিচিত রূপের ইঙ্গিত নেই।
অথচ একটি গভীরতর সংঘাতের পাটাতনের ওপর ছবিটা দাঁড়ানো। সে সংঘাতটার মর্ম তুলে ধরার জন্য ছবিটির সবচেয়ে জনপ্রিয় অংশ থেকে হুবহু তুলে দেয়ার লোভ আমি সামলাতে পারছি না।
আমি লক্ষ্য করেছি যারা ছবিটি বার বার দেখেছেন তারা ছবিটির ঠিক এই অংশটির আকর্ষণে বার বার পয়সা দিয়ে টিকেট কিনেছেন। এই অংশ মানুষের মনকে, বিশেষভাবে মেয়েদের হৃদয়কে কী পরিমাণ আলোড়িত করেছে তার একটা উদাহরণ দিয়ে আমি প্রসঙ্গে ফিরব।
আমি ও আমার সহকর্মীরা বস্তির শিশু ও কিশোরদের নিয়ে একটি স্কুল চালাই। ওদের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে একটি কিশোরী বালিকা এই অংশটিই অপরূপ অভিনয় করে দেখালো। সে নিজেই একবার রাজা নিজেই একবার জোস্না। এই মাইকের সামনে গিয়ে রাজার ডায়ালগ বলে আর অন্য মাইকের সামনে গিয়ে জোস্নার। এই কিশোরী বালিকা স্বভাবে খুবই হাসিখুশি ও উচ্ছল। এই নাট্যাংশে অভিনয়ের আগে সে মঞ্চে গান ও কবিতা আবৃত্তি করে গেছে। একবারও পা কাঁপেনি বা সে নার্ভাস হয়নি। অর্থাৎ মঞ্চে উঠে ভীতু হবার মতো বালিকা সে নয়।
কিন্তু বেদের মেয়ে জোস্নার এই বিশেষ অংশ অভিনয়ের সময় তার গলা ধরে এলো, চোখ থেকে দর দর করে জল গড়াতে শুরু করল। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে এক অনির্বচনীয় আবেগ তার বালিকাময় হৃৎপিণ্ডের শিরা-উপশিরা টেনে ধরেছে। বেদের মেয়ে জোস্নার এই বিশেষ অংশ অতএব আরো গভীর পর্যালোচনার চোখ দিয়ে আমি দেখেছি। সে অংশটা এরকম [পাঠকের সুবিধার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ডায়ালগগুলো বাঁকা হরফে ছাপা হলো]।
[সর্পদংশিত রাজকুমারের মৃতদেহ পড়ে আছে। একের পর এক বেদেরা এসে সাপের বিষ নামানোর ক্ষেত্রে তাদের অক্ষমতা প্রকাশ করে চলে যাচ্ছে।]
বেদে–জোস্না ছাড়া এই মরণবীণ আর কেউ বাজাতে পারবে না।
দাদি–অসম্ভব, এই বীণ জোস্না বাজাবে না, এই বীণ যে বাজাবে তার গলা দিয়ে রক্ত বের হয়ে মারাও যেতে পারে।
রাজা–তাহলে কি আমার বংশের একমাত্র প্রদীপ নিভে যাবে? মা জোস্না, তুমিই পারো আমার আনোয়ারকে ভালো করতে। আমি সবার সামনে কথা দিচ্ছি তুমি যা চাবে তাই পাবে।
রানি–মা জোস্না, তুমি আমার মেয়ের মতন, আমিও তোমাকে কথা দিচ্ছি, তুমি যা চাবে তাই পাবে।
জোস্না–আমি কথা দিচ্ছি আমার জীবন বাজি রেখে আমি রাজকুমারকে বাঁচাবো।
দাদি–না জোস্না আমি তোকে মরতে দিবো না।
জোস্না–ভয় পেও না দাদি। মরণবীণ বাজিয়ে গলা দিয়ে যদি রক্ত বের হয়, আর সেই রক্ত যদি সাপ খেয়ে ফেলে তাহলে আমি বেঁচে যাবো।
রাজা–তোমরা সবাই সরে দাঁড়াও।
জোস্না–প্রথমে বন্দনা করিলাম নাম পদ্মার, তারপর বন্দনা করি মা মনসার, দোহাই লাগে কালনাগিনী দোহাই লাগে তোরে, বাতাস হয়ে আসবি মরণবীণের সুরে।
[তারপর বীণ বাজানো শুরু হলো। জোস্নার মুখে উঠে এলো রক্ত এবং সাপ রাজকুমারের পা থেকে বিষাক্ত রক্ত খেয়ে মরে গেল। রাজপুত্র ভালো হয়ে উঠলেন, কিন্তু রক্তাক্ত জোস্না পড়ে রইল রাজদরবারের মেঝেতে]
দাদি–আপনারা শাহজাদাকে ভিতরে নিয়ে যান, এই তুই কি করলিরে? এ তুই কী করলি বোন? তাড়াতাড়ি পানি লইয়া আসেন।
জোস্না–রাজকুমার কোথায়?
দাদি–রাজকুমারকে অন্দরমহলে নিয়া গেছে। রাজকুমার ভালো হইয়া যাইবো।
রানি–মা জোস্না কেমন আছো?
জোস্না–ভালো, রাজকুমার কেমন আছে?
রানি–ভালো, এখনো জ্ঞান ফিরে নাই।
জোস্না–আগামীকাল সূর্য ওঠার আগে যেন কক্ষ থেকে না বের হয়, তাহলে ওর বিপদ হবে।
জোস্না–দাদি!
দাদি–জোস্না!
[এ সময় রাজা সামনে এসে দাঁড়ালেন]
রাজা– [জোস্নার দাদিকে] বল তুমি কী চাও?
দাদি–আমার চাইবার কিছুই নাই, যে জীবন বাজি রেখে রাজকুমারকে ভালো করেছে তারই শুধু চাওয়ার অধিকার আছে।
রাজা–বলো মা জোস্না তুমি কী চাও।
রানি–বলো মা জোস্না, তুমি নির্ভয়ে বলো কী চাও।
[রাজা-রানির অভয় পেয়ে জোস্না গানে গানে তার কথা শুরু করল। এই সেই গান যা দর্শকদের অভিভূত করে রাখে]
কী ধন আমি চাইবো রাজা গো
ও রাজা আপনারো দরবারে গো॥
যাহা চাইবো তাহাই দিবেন গো
ও রাজা, বলিয়াছেন আপনি গো॥
টাকা পয়সা চাই না আমি গো
ও রাজা চাই না ধনসম্পত্তি গো॥
চাইবো আমি আপনার কাছে গো
ও রাজা চাই যে রাজকুমারকে গো॥
রাজা– [অসম্ভব ক্রুদ্ধ] অসম্ভব, তোমার এই চাওয়া আমি পূর্ণ করতে পারবো না।
জোস্না–কেন রাজা, আপনি তো বলেছেন আমি যা চাইবো তাই দিবেন।
রাজা–তোমার এই অসম্ভব চাওয়া আমি কিছুতেই পূর্ণ করতে পারবো না। তুমি অন্য কিছু চাইতে পারো।
জোস্না–আমার আর কিছুই চাইবার নাই।
রাজা–তুমি আমার ছেলেকে বাঁচিয়েছো, সেই জন্য আমি তোমার কাছে ঋণী। আর সেই ঋণের চাওয়াটা কি এতো বেশি যে, আমার ছেলেকে দিয়ে তা পূর্ণ করতে হবে। তুমি অন্য কিছু চাইতে পারো। ধন-সম্পত্তি, রাজ্যের এই অংশ–এর যে কোনো একটা তুমি চাইতে পারো।
জোস্না–ধনসম্পত্তি আমার দরকার নাই।
উজির–দরকার না থাকারই কথা। তোমরা ছোট জাত। ধন-সম্পত্তি রাখবে কোথায়? আর রাজকুমারকে চাইলে সব তো তোমার হবে। চক্রান্তটা চমৎকার।
জোস্না–উজির সাহেব, আমরা গরিব। গরিবেরা কখনো চক্রান্ত করতে জানে না।
উজির পুত্র–গুস্তাকি মাফ হয় জাঁহাপনা। আমার অবাক লাগছে সামান্য বেদের মেয়ে হয়ে অবাস্তব গালাগালি করে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
জোস্না–আমারও ভাবতে অবাক লাগছে তোমার মতন লম্পট চরিত্রের লোক কী করে রাজদরবারে ঢুকতে পারে।
রাজা–খামোশ, আমার দরবারে দাঁড়িয়ে আমার মন্ত্রীকে গাল দিবার সাহস কোথায় পেয়েছো?
জোস্না–সাহস তো আপনিই দিয়েছেন জাঁহাপনা।
রাজা–সেই সাহস এখন দুঃসাহস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর একবার ওই কথা উচ্চারণ করলে পুরস্কার তো দূরের কথা, তিরস্কার করে ঘাড় ধরে বের করে দিবো, সামান্য বেদের ঘরে জন্ম নিয়ে তুমি রাজকুমারকে চাও।
জোস্না–তাহলে আপনিই বা কথা দিয়েছিলেন কেন?
রাজা–আমার ছেলেকে ধ্বংস করেছে সাপ, আর আমাকে ধ্বংস করতে চাও তুমি। আমি তোমার চালাকি বুঝতে পেরেছি। তুমি পুরস্কার চাও না, তুমি আমার সরলতার সুযোগ নিতে চাও। কিন্তু মনে রেখো বঙ্গরাজ কখনো সরলতার সুযোগ গ্রহণকারীকে প্রশ্রয় দেয় না।
জোস্না–তাহলে আপনিও শুনে রাখুন জাঁহাপনা, বঙ্গরাজ উপকারীর উপকার স্বীকার করে না।
রাজা–খামোশ বেদকন্যা, তুমি আমার সাথে তর্ক করছো, তুমি জানো তোমাকে আমি তিরস্কার করে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারি?
জোস্না–রাজার দরবারে যদি অপরাধী হয়, তাহলে শাস্তি দেন স্বয়ং রাজা। কিন্তু রাজা যদি অপরাধী হয়, তাহলে শাস্তি দেন স্বয়ং খোদা।
রাজা–বেদকন্যা খামোশ, একে এখনি প্রাসাদ থেকে বের করে দাও।
জোস্না–খবরদার, কেউ আমার গায়ে হাত দেবে না। [জোস্না নিজেই বেরিয়ে যেতে থাকে] জাঁহাপনা, এখন যাকে ছোট জাতের বলে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে বলেছেন, আপনার পুত্রের জীবন রক্ষার্থে তার হাত ধরেই কেঁদেছিলেন, তখন কোথায় ছিল আপনার এই অহংকার, কোথায় ছিল এই আত্মমর্যাদা? সত্যি যদি আমি শাহাজাদাকে ভালো করে থাকি, তাহলে আমি এর পুরস্কার পাবোই।
রাজা–সেই পুরস্কার পাওয়ার আগে তুমিই তার পুরস্কার আগে নিয়ে যাও। উজির সাহেব!
উজির–আদেশ করুন জাঁহাপনা।
রাজা–এই মুহূর্তে একে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দাও।
জোস্না–দাদি, আলমপনা শেষ পর্যন্ত গলাধাক্কা দিতে দ্বিধাবোধ করলো না। আমরা গরিব, ছোট জাত আর আপনি রাজা, আপনার আমার অনেক পার্থক্য। কিন্তু চেয়ে দেখুন, চেয়ে দেখুন আলমপনা, এই রক্তের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কি না, চেয়ে দেখুন। আপনার ধন-সম্পত্তির লোভে আমি রাজকুমারকে ভালো করি নাই। আমি তাকে ভালোবাসি তাই নিজের জীবন বাজি রেখে মরণবীণ হাতে নিয়েছি। আমার গলা দিয়ে রক্ত বের করেছি, তার পুরস্কারস্বরূপ আমি আমার কপালের রক্ত ঝরিয়েছি। এই কি আপনার অঙ্গীকার? এই কি আপনার পুরস্কার? আমার কপালের রক্তই যদি আমার পুরস্কার হয়ে থাকে, তাহলে এই পুরস্কার রাজকুমারের জন্য আপনার দরবারে মুছে দিয়ে গেলাম। সত্যিই যদি আমি ভালোবেসে থাকি তাহলে এই রক্তই রাজকুমারকে আমার কাছে নিয়ে যাবে। আপনারা কেউ তাকে ঠেকাতে পারবেন না। কেউ না …।
দেখা যাচ্ছে, জোস্নার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংঘাতটা এখানে মুখ্য। এ অধিকার ব্যক্তির অধিকার। জোস্নার মধ্যে দর্শকরা এক ব্যক্তিসত্তার দৃঢ় ও সাফ সাফ অভিপ্রকাশ দেখে। তার জড়তাহীন ব্যক্তিত্ববান স্পষ্ট উচ্চারণ এক অনির্বচনীয় সত্তার উপস্থিতি আমাদের টের পাইয়ে দেয়। তার এই ব্যক্তিসত্তা দর্শকদের টানে, আপ্লুত করে এবং যেহেতু এই ব্যক্তিসত্তা দর্শকদের মধ্যে ক্রিয়াশীল, ফলে চৈতন্যের মূলে যে শেকড় তার গোড়াসুদ্ধ টান পড়ে।
কিন্তু বেদের মেয়ে জোস্নায় এই অধিকার বা ব্যক্তিসত্তা প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটার আসল মানে আরো খোলাসা করে বোঝা দরকার। যে দিকটা আমার কাছে অবাক লেগেছে তা হলো ব্যক্তিসত্তা সম্পন্ন জোস্না রাজার সঙ্গে প্রেমের স্বীকৃতির জন্য লড়ছে না। লড়ছে তার ব্যক্তিসত্তার প্রতিষ্ঠার জন্য এবং দুটো এক কথা নয়। যদি জোস্না কেবল প্রেমের স্বীকৃতির জন্য লড়ত তাহলে সংগ্রামটা শহরের পেটিবুর্জোয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উন্নাসিক আবেগ ও চৌহদ্দির মধ্যেই থেকে যেত। বুর্জোয়া শ্রেণী এই স্বীকৃতি দিতে মোটেও নীতিগতভাবে নারাজ নয়। ব্যক্তির প্রেম করার অধিকার আছে এবং সেক্ষেত্রে বড়লোক/ছোটলোক, রাজা/প্রজা, ধনী/গরিবের ভেদাভেদ বুর্জোয়া ব্যক্তিতন্ত্র অস্বীকার করে না। সামন্তীয় ধ্যান-ধারণার তুলনায় বুর্জোয়া ব্যক্তি তপ্ত, সে কারণে প্রগতিশীল। ছবিটিতে যদি এতটুকুন বুর্জোয়া ব্যক্তিতন্ত্রের গৌরব থাকত তবুও তাকে প্রশংসা করতে হতো আমাদের। কিন্তু বেদের মেয়ে জোস্নায় লড়াইটা আরো একধাপ এগিয়ে গিয়ে অভিব্যক্ত হয়েছে। সেটা বিস্ময়কর।
জোস্না খুবই জানে এবং খুবই বোঝে যে, রাজার ছেলের সঙ্গে প্রেম করার পরিণতি ইতিবাচক ফলাফলে শেষ হতে পারে না। এটা একটা অসম প্রেম। দশটা হিন্দি ছবির মতো প্রেমের মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠার ইতরোচিত লড়াই বেদের মেয়ে জোস্নায় আশ্চর্যজনকভাবে অনুপস্থিত। যখনই তার বেদে দাদি ও বেদে দাদা এই অসম প্রেম সম্পর্কে জোস্নাকে বোঝালো জোস্না তারপর থেকেই রাজকুমারের আশা ত্যাগ করল। সে রাজকুমারকেও বলল যে, রাজার ছেলের সঙ্গে বেদের মেয়ের প্রেম হয় না। কিন্তু রাজকুমার পীড়াপীড়ি করল সেই প্রেমের অধিকারের জোরে, বুর্জোয়া ব্যক্তিতন্ত্রের যুক্তিগুলো দিয়ে। যেমন, তারা দুজন দুজনকে ভালোবাসে সেটাই বড়ো কথা ইত্যাদি। শুধু ভালোবাসার মধ্যে অধিকার যে জন্মায় না বেদের মেয়ের সেই সত্য বুঝতে কষ্ট হলো না। এটা বড়ো জোর দুটো প্রাণের ইচ্ছার আকুতি হতে পারে। কিন্তু এই প্রেমেরও স্বীকৃতি লাভের পথে জোস্না যেতে পারত। কিন্তু প্রেমের সামাজিক ‘স্বীকৃতি’ লাভের পথ থুয়ে জোস্না ধরল রাজকুমারকে ‘অর্জন’ করবার পথ। কারণ অর্জনের মধ্যেই সে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে এটুকু খেয়াল করলেই কীভাবে জোস্না নিজেকে প্রতিষ্ঠা করছে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
প্রথমত জোস্না নিজের প্রাণ বাজি রেখে রাজকুমারকে বাঁচিয়েছে। যখন সকল ওঝা আর বেদে রাজকুমারকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে অস্বীকার করছে, মৃত্যুর ভয়ে পিছপা হয়েছে, জোস্না সেক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে। পুত্রের প্রাণ ফিরে পাবার জন্য রাজা আকুল হয়ে জোস্নাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, সে যদি রাজকুমারকে বাঁচাতে পারে তাহলে সে যা চায় রাজা তাকে তাই দেবেন। এই প্রতিশ্র“ত চুক্তির ভিত্তিতে জোস্নার হাতে ‘মরণবীণ’ বেজে উঠল। রাজার কাছ থেকে প্রেমের স্বীকৃতি চাইলো না জোস্না। নিজের শ্রমের মধ্য দিয়ে সম্পত্তি অর্জনের পথ ধরল সাহসের সঙ্গে।
রাজকুমারকে প্রাণে বাঁচাবার পর রাজা যখন জোস্না কী চায় শুধালেন, বেদের মেয়ে চেয়ে বসল রাজকুমারকে। এই সেই উত্তুঙ্গ মুহূর্ত যখন সারা সিনেমা হল নিশ্বাস বন্ধ করে চুপ করে থাকে। জোস্নার প্রেমে ও সাহসে থ মেরে যায়। আলপিন পড়বার শব্দও কানে আসে এবং মেয়েরা গোপনে কাঁদতে থাকে। দুঃখে নয় আনন্দে, কারণ প্রেমিককে অর্জন করবার এক ব্যক্তিত্ববান পথ লক্ষ্য করে তারা শিহরণ বোধ করে। ‘যাহাই চাইব তাহাই দিবেন গো, ও রাজা বলিয়াছেন আপনি গো..’ গানটি ছবির পর্দা থেকে বর্শার মতো ছুটে এসে বুকে বাজে। তদুপরি রাজার কাছে হাত তুলে রাজকুমারের চেয়ে জোস্না এক অপরূপ সলজ্জ ভঙ্গি করে, যা মেয়েসুলভ নয় কিন্তু অব্যর্থভাবে যা দর্শকদের মধ্যে কামসঞ্চার করতে সক্ষম হয় অথচ অর্জনাকাক্সক্ষী নারী দুঃসাহস যেখানে যারপরনাই ব্যক্ত। সব মিলে একই নয়া অনুভূতি ভোঁতা ইন্দ্রিয়ের ব্যক্তিকেও আক্রান্ত করে।
এখন প্রতিশ্রুত চুক্তি অনুযায়ী জোস্নাকে রাজকুমার দান করতে রাজা বাধ্য। কারণ তিনি ন্যায়পরায়ণ রাজা, নিজের চুক্তি নিজে ভঙ্গ করবেন এটা হতে পারে না। কিন্তু তিনি বললেন জোস্না তার ‘দুর্বলতা’র সুযোগ নিচ্ছে। অর্থাৎ ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির যে পারস্পরিক প্রতিশ্র“তি বা চুক্তি, তার সম্পাদন ও বাস্তবায়নকে রাজা ‘দুর্বলতা’ হিসেবে ব্যাখ্যা করলেন। এখানে জোস্নার বিদ্রোহের শুরু। চুক্তি যা হয়েছে চুক্তির শর্তের মধ্যেই তা ব্যক্ত। উভয়ের ব্যক্তিত্বকে স্বীকার করেই কেবল তা সম্পাদিত হতে পারে। ‘দুর্বলতার’ যুক্তি এখানে খাটে না। চুক্তির বরখেলাপের বিরুদ্ধে জোস্নার বিদ্রোহ করা ছাড়া উপায় ছিল না। কারণ চুক্তির প্রতিষ্ঠার মধ্যেই কেবল সে নিজের ব্যক্তিসত্তার উত্থান নিশ্চিত করতে পারে।
দ্বিতীয়ত রাজপুত্র মূলত ছিল মৃত–মৃত মানে রাজপুত্র অপ্রাণীবাচক প্রাকৃতিক সত্তার অধিক কিছু নয়। যার সঙ্গে পাথর কিংবা শুকনো কাঠের তুলনা চলে। এই প্রাকৃতিক সত্তার মধ্যে রূপান্তর ঘটিয়ে তার মধ্যে প্রাণসঞ্চার করেছে জোস্না। ফলে জোস্না রাজপুত্রের স্রষ্টা, তার দৈহিক পরিশ্রম থেকে রাজপুত্রের সৃষ্টি। সে পরিশ্রমের ফলে তার মুখ থেকে রক্ত উঠে এসেছে। এই সৃষ্টির সঙ্গে শ্রমিকতার প্রতিতুলনা চলে। রাজপুত্র জোস্নার শ্রমের ফসল। যদি তাই হয় রাজপুত্র তাহলে জোস্নার। নিজের রক্ত-ঘাম-পরিশ্রম দিয়েই সে রাজপুত্রকে অর্জন করে নিয়েছে। এই অর্জনে যেন কোনো খাদ না থাকে তার জন্য জল্লাদের হাত থেকে রাজকুমারকে বাঁচাবার জন্য জোস্না রানিমা’র হাত কেটে রক্ত দিতে বাধা দিয়েছে, নিজেই নিজের হাত কেটে জল্লাদের দা’য়ে রক্ত মেখে দিয়েছে। এই অর্জনবোধের চেতনা জোস্নার মধ্যে পুরোমাত্রায় বিদ্যমান। সে অর্জনের অধিকার থেকেও রাজা তাকে বঞ্চিত করছেন, জোস্নার বিদ্রোহ এই বঞ্চনারও বিরুদ্ধেও।
তৃতীয়ত রাজা আভিজাত্য ও সম্মানহানির ভয়ে রাজকুমারের সঙ্গে জোস্নার বিয়েতে সম্মতি দিচ্ছিলেন না, তার বিরুদ্ধেও জোস্না বিদ্রোহী। রাজার এই রাজকীয় আভিজাত্য সাধারণের বা জোস্নার ভাষায় ‘গরিব’দের ব্যক্তিসত্তাকে অস্বীকার করে। এই আভিজাত্যের বিরুদ্ধে জোস্না নিজের ক্রোধ প্রকাশ করবার অন্য এক তাপর্যময় পথ বেছে নেয়।
সে গরিবের রক্ত দিয়ে আভিজাত্যের রাজ প্রসাদ কলংকিত করে দিয়ে আসে।
রক্ত কেন? এখানেও জোস্নার বিদ্রোহ প্রকাশের ধরনটা দর্শকদের চৈতন্যের আসল জায়গায় আঘাত করে। কারণ আভিজাত্যের অহংকারটা রক্তের পার্থক্য দিয়ে নির্ণীত হয়। রাজকীয়তা বা বংশমর্যাদা রক্ত দ্বারা নির্ণীত। এই অহংকারের ফাঁপা দিকটা জোস্না তাই নিজের রক্ত প্রাসাদের মেঝেতে লেপে দিয়ে প্রমাণ করে যায়। এবং রাজাকে বলে, তুলনা করুন রাজা আপনাদের রক্ত আর আমাদের রক্তে কোনো পার্থক্য আছে কি না। কৃষক চৈতন্য এই ডায়ালগে দারুণ উত্তেজিত বোধ করে এবং তুমুল করতালি ও শিসে সিনেমা হল মুখরিত হয়ে যায়।
তাহলে দেখা যাচ্ছে তিনটি বিষয়ের জন্য লড়ছে : (১) প্রতিশ্রুত চুক্তির প্রতিষ্ঠার জন্য (২) নিজ শ্রমের ফসল বা উৎপন্নের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এবং (৩) রক্তভিত্তিক বংশমর্যাদা ও আভিজাত্যের অন্তঃসারশূন্যতার বিরুদ্ধে এবং সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সঙ্গে মানুষের অভেদ প্রতিষ্ঠার জন্য। এই তিনটে বিষয়ের মধ্যে এক ও তিন নম্বর সরাসরি বুর্জোয়া অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। এই দুই ক্ষেত্রে জোস্না বুর্জোয়া অধিকারের মর্মশাঁসকে আশ্রয় করেই বিদ্রোহ প্রকাশ করেছে। সে তার প্রেমের স্বীকৃতি ভিক্ষা করছে না বঙ্গরাজার কাছে। সে চাইছে তার ব্যক্তির প্রতিষ্ঠা, চুক্তি করার মধ্য দিয়ে বঙ্গরাজা জোস্নার যে ব্যক্তিসত্তাকে স্বীকার করে নিয়েছে সে সত্তার প্রতিষ্ঠা চায় জোস্না। কোনো করুণা ভিক্ষা নয়, কোনো দয়া নয়, এমনকি ধন-সম্পত্তি বা রাজত্ব নয়। সে রাজকুমারকে নিজের সম্পত্তি হিসেবে অর্জন করেছে, ফলে সম্পত্তির মালিক হিসেবে নিজের প্রতিষ্ঠা কায়েম করবার জন্য বেদের মেয়ের বিদ্রোহ। এক্ষেত্রে জোস্না আমুণ্ডুনখাগ্র বুর্জোয়া চৈতন্যের ধারক–বুর্জোয়া চৈতন্যের প্রতিভূ। গ্রামের বিকাশমান কৃষক বুর্জোয়া শ্রেণীর সে প্রতিনিধি। বেদের মেয়ে জোস্নায় শ্রেণীসংগ্রামের মর্মশাঁসটা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে দ্রুত বিকাশমান বুর্জোয়া চৈতন্যের গোড়া স্পর্শ করে। সকল প্রতীকী অস্পষ্টতা সত্ত্বেও কৃষকের দৃষ্টি এড়াতে পারে না। কৃষকের বুর্জোয়া চৈতন্য জোস্নার মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করে উল্লাস বোধ করে। নিজেকে খুঁজে পায়।
এই বুর্জোয়া চৈতন্যের জয়জয়কার ছবির সর্বত্র। সেনাপতির পুত্র রাজ্জাককে উজির কন্যা তারা এক সময় প্রত্যাখ্যান করে। এখানে রক্তমর্যাদায় নয়, রাজকীয় স্তর বা পদমর্যাদার দিক থেকে উজির কন্যা তারার পরিবারের চেয়ে রাজ্জাকের সেনাপতি পরিবার নিচে। কিন্তু এক সময় তারা নিজেই সে বাধাকে ভেঙে রাজ্জাককে ভালোবাসে। মানবীয় সম্পর্ক এক্ষেত্রে পদমর্যাদার ঊর্ধ্বে উঠে যায়।
অপরদিকে আবার কাজির বিচারালয়ে কাজির মুখে আমরা বুর্জোয়া আইনের ভাষ্য শুনি। এই আইনের চোখে রাজা-প্রজা প্রত্যেকেই সমান। কাজি এই অতিপরিচিত বুর্জোয়া নীতিটা আমাদের শোনান। কাঠগড়ায় রাজকুমার হত্যার আসামি। কিন্তু রাজকুমার হওয়া সত্ত্বেও তার ক্ষমতা নেই আইনের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার। সে যে নির্দোষ সেটা প্রমাণ করেই কেবল রাজকুমার খালাস পেতে পারে। এমনকি কাজি যখন জানলেন যে আসামি জোস্নার স্বামী–যে জোস্নাকে শীতলক্ষ্যায় ভাসিয়ে দেয়া তার সর্পদংশিত মেয়ের মতোই তিনি ভালোবেসেছেন–তখনও আইনের কারণে তিনি সদয় হতে পারলেন না।
কিন্তু এক ও তিন নম্বরে ব্যক্ত বুর্জোয়া অধিকারের যে মর্ম, দুই নম্বরে তা ভিন্ন মনে হয়। কারণ এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি শ্রমের ওপর শ্রমিকের বা শ্রমদাতার দাবি তোলা হচ্ছে। এই দাবির সঙ্গে অনেকেই শ্রমিক শ্রেণীর আকাক্সক্ষার সাযুজ্য খুঁজবেন। কিন্তু ব্যাপারটা কি আসলে তাই?
নিজের জমিতে নিজে কাজ করে এমন একজন জমির মালিক কৃষকের কথা ধরা যাক। সে দেখে জমিতে শ্রম দিয়ে সেই শ্রমের ফসল সে ঘরে তুলতে পারছে। জমি যে তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি, এই সত্যটা সে সামনাসামনি দেখে না, সেটা খাড়া থাকে তার পেছনে–দৃষ্টির আড়ালে। ফসল নিজের ঘরে তোলার পেছনে জমিতে তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকাটাই যে প্রধান শর্ত, এটা তার কাছে স্পষ্ট নয়। কারণ উৎপাদনের উপায় থেকে বিচ্ছিন্ন না হবার কারণে উৎপাদনের উপায়ের ওপর ব্যক্তিগত সম্পত্তি কায়েম থাকার মাজেজা বা তাৎপর্য সে ধরতে পারে না। জমির সে মালিক এবং সে কারণে জমির ফসলেরও সে মালিক এই দিকটির চেয়েও সে যে নিজ হাতে লাঙল আর ঈষের ফলা মাটিতে হেনে শস্য ফলিয়েছে সেই সত্যটাই তার প্রাণে জ্বলজ্বল করে বেশি। শ্রমের মাধ্যমেই ফসলের ওপর নিজের অধিকার সে কায়েম হচ্ছে দেখতে পায়। এটাই তার কাছে প্রধান সত্য হয়ে ওঠে।
কিন্তু শ্রমিকের বেলায় ব্যাপারটি সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম। শ্রমিক হচ্ছে ভূমি থেকে অর্থাৎ উৎপাদনের উপায় থেকে বিচ্ছিন্ন। সে দেখে যে একদিকে বুর্জোয়া শ্রেণী তার ব্যক্তিসত্তাকে এক ধরনের প্রহসনমূলক স্বীকৃতি দেয়। সেটা এই অর্থে যে, নিজের শ্রমের সে ব্যক্তিগত মালিক অর্থাৎ ওটা তার সম্পত্তি। সে সম্পত্তি সে কাকে বিক্রি করবে না করবে সেটা শ্রমিকের একান্তই নিজস্ব ব্যাপার। যদিও শ্রম বিক্রি করা ছাড়া শ্রমিকের বেঁচে থাকার আর কোনো উপায় নেই। অপরদিকে তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকে উৎপাদনের উপায়–ব্যক্তিগত সম্পত্তির পুঁজিতান্ত্রিক উপস্থিতি। একদিকে শ্রম অপরদিকে উৎপাদনের উপায়–এই দ্বিবিভাগে দ্বিখণ্ডিত ব্যক্তিগত সম্পত্তির যে ঐতিহাসিক রূপ শ্রমিক পরিদৃশ্যমান দেখতে পায় আর তার নিষ্পেষণ সে হাড়ে হাড়ে টের পায় তার সঙ্গে কৃষকের অভিজ্ঞতা ও চৈতন্যের কোনো তুলনা চলে না। সচেতন শ্রমিক অনায়াসেই বোঝে শ্রমের ওপর তার অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটা এখানে মোটেও মুখ্য নয়। অর্থাৎ যে উৎপাদন সম্পর্কে শ্রমিককে শ্রমিক আর পুঁজির মালিককে পুঁজির মালিক করে রাখে সেই সম্পর্কটাকেই ভাঙতে হবে মূলসুদ্ধ। এটাই হলো আসল কাজ। কিন্তু খুদে উৎপাদক বা পেটিবুর্জোয়া কৃষক তার অভিজ্ঞতার জের হিশেবে শ্রমের ফসলের ওপর শ্রমিকতার অধিকার প্রতিষ্ঠার কথাটা স্বাভাবিকভাবেই তুলে বসে। ওর মধ্যে তার বুর্জোয়া অধিকার কায়েম বা মালিকানা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাই ব্যক্ত বেশি। সে দেখে এসেছে যা কিছুই তার নিজের শ্রমে উৎপন্ন সে-সবের সে মালিক। উৎপাদনের উপায়ের মালিকানা আর উৎপন্ন দ্রব্যের ওপর মালিকানা যে দুটো আলাদা জিনিস এবং উৎপাদনের উপায়ের ওপর মালিকানা কায়েম না থাকলে উৎপন্ন দ্রব্যে যে মালিকানা কায়েম হয় না এটা সে বুঝতে পারে না। ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিকশিত বুর্জোয়া রূপটার রহস্য সে ধরতে পারে না। উৎপন্ন দ্রব্যের ওপর শ্রমিকতার অধিকার কায়েম থাকাকে সে বুর্জোয়া অর্থেই ন্যায়সঙ্গত মনে করে।
শ্রমিক শ্রেণীর কাছে ন্যায়সঙ্গত কথাটার আসলে কোনো মানে হয় না। এমনকি ন্যায়সঙ্গত মজুরির প্রশ্নটাও অবান্তর এবং একে অস্বীকার করে নিলে পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার কোনো বড়ো ধরনের হেরফের হয় না। বুর্জোয়া শ্রেণী এ কারণে বলে যে, শ্রমিকের শ্রমশক্তির যে বাজার দাম সেই ন্যায়সঙ্গত মূল্যেই শ্রমিককে মজুরি দেয়া যেতে পারে। পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার ভিত্তি এতে একদমই দুর্বল হবে না। মার্কস এ কারণে পুঁজি গ্রন্থে শ্রমিক তার শ্রম যে বাজারে দামে বিকাতে পারত সেই দাম ধরেই তার বিশ্লেষণ হাজির করেছেন। মার্কস ধরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন বাড়তি মূল্যটা শ্রমশক্তি কেনার সময় শ্রমিককে কম মজুরি দেয়ার ওপর নির্ভর করে না। অতি ন্যায়সঙ্গত দামেই বাজার থেকে শ্রম কেনা যায়। শ্রমিককে তার শ্রমশক্তির দাম কেনার সময় ঠকিয়ে বাড়তি মূল্য কমাবার দরকার পড়ে না পুঁজিপতি শ্রেণীর। বাড়তি মূল্যটা উৎপাদিত হয় খোদ উৎপাদনের সময়। সামাজিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লাভটাও যায় পুঁজিপতিদের পকেটে। মার্কস প্রমাণ করতে চেয়েছেন উৎপাদনের উপায়ের ওপর থেকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উৎখাত ছাড়া শ্রমিকের মুক্তির মীমাংসা হতে পারে না। সচেতন শ্রমিক এই বিষয়টি বুঝতে পারে।
তাহলে নিজের শ্রমের ফসলের ওপর শ্রমদানকারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিটা কৃষকসুলভ দাবি, সুনির্দিষ্টভাবে জমির মালিক বুর্জোয়া ও পেটিবুর্জোয়া কৃষকের দাবি। গ্রামাঞ্চলে এই কৃষকের চেতনার প্রাধান্য থাকাটাই স্বাভাবিক। যদিও এ বিষয়ে আরো খোঁজখবর নিয়ে নিশ্চিত হবার প্রয়োজন আছে। তবে গ্রাম সম্পর্কে আমার যে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাতে আমি কমবেশি নিশ্চিত যে, আমাদের সমাজের বুর্জোয়া চেতনাসম্পন্ন কৃষকের আকাক্সক্ষার সঙ্গে শ্রমের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি খুবই সঙ্গতিপূর্ণ। বুর্জোয়া ব্যক্তিতান্ত্রিক অধিকার কৃষক সাধারণত ব্যাপ্ত অর্থে প্রয়োগ করতে উন্মুখ থাকে। শহুরে বুর্জোয়া শ্রেণী ও পেটিবুর্জোয়া মধ্যবিত্তের চেয়েও এই কৃষক সে কারণে অনেক অনেক বেশি বিপ্লবী, অনেক বেশি গণতন্ত্রকামী, অনেক বেশি স্পষ্ট ও জোস্নার মতো সিধা, সোজা ও দ্রোহী।
অতএব এটা সম্ভবত আমি স্পষ্ট করতে পেরেছি যে, জোস্নার লড়াইয়ের মর্মশাঁসের মধ্যে প্রাক-বুর্জোয়া শৃঙ্খল ও আভিজাত্যের নিপীড়নের বিরুদ্ধে বুর্জোয়া অধিকার সচেতন কৃষকের আকাক্সক্ষা ব্যক্ত। এই লড়াইয়ের মধ্যে এই শ্রেণী নিজের লড়াইটাকেও শনাক্ত করতে পারে। এই সংগ্রাম তার কাছে পরিচিত মনে হয়। ফলে জোস্নার ডায়লগে হর্ষ ও উল্লাস বোধ করে ও বিপুলভাবে জোস্নার পক্ষে দাঁড়ায়।
নারীবাদী মর্ম
মেয়েদের কাছে বেদের মেয়ে জোস্না ছবিটির জনপ্রিয়তার কারণ এর নারীবাদী মর্ম। খুব সহজ সরল ও সিধা চোখে দেখলেও এই মর্মের উপরি দিক কারুরই চোখ এড়াবার কথা নয় এবং সেখান থেকে নারীবাদী মর্মের গভীরতার দিকগুলোতে প্রবেশ করা সহজ। আমি তালিকা করে উপরি দিকগুলোর কথা বলছি।
এক: বেদের মেয়ে জোস্না অন্তত একটি ক্ষেত্রে যে কাউকেই বিস্মিত করবে তা হলো ছবিতে একটি নারী চরিত্র নেই, যা কুটিল বা খারাপ। উজিরকন্যা তারাকে রাজকুমার আনোয়ারের মন জয় করবার জন্য তার পিতা চাপ সৃষ্টি করছে, আমরা দেখি। কিন্তু তবুও তারাকে জোস্নার বিরুদ্ধে হিংসুক নারীর চরিত্রে অভিনয় করতে হয়নি। এটা বেশ বিস্ময়কর।
দুই: তারাকে আমরা দেখি পুরুষ বেশে। রাজ্জাকের সঙ্গে পরামর্শ করে সে পুরুষ বেশে বেরিয়েছে রাজকুমার আনোয়ারকে খুঁজতে। এই কাজটা রাজ্জাকই কিন্তু করতে পারত, কারণ এটা পুরুষালি কাজ, পুরুষতান্ত্রিক শ্রমবিভাগের লজিক অনুযায়ী সেটাই ছিল স্বাভাবিক। অপরদিকে আমরা লক্ষ্য করি, সেনাপতিপুত্র রাজ্জাক বরং তারার তুলনায় অনেক বেশি মেয়েলি। তারাকে একপক্ষীয়ভাবে দীর্ঘদিন নীরবে ভালোবেসে যাবার মধ্যে যে অসহায় অপেক্ষা আছে, নারীসুলভ ধৈর্যের সঙ্গেই তা তুলনীয়।
অতএব শ্রমবিভাগ ও চেতনার একটা অদলবদল লক্ষ্য করা যায় তারা আর রাজ্জাকের মধ্যে।
তিন: তারার মধ্যে আপনকার নারীসত্তার প্রতি তীব্র সচেতনতা আমাদের চমকে দেয়। তার পিতা যখন তাকে রাজ্জাকের সঙ্গে সম্পর্ক পাতবার জন্য পীড়াপীড়ি করল, তারা বুঝতে পারল সে পিতা কর্তৃক ব্যবহৃত হচ্ছে। সে আনোয়ারকে ভালোবেসেছিল, এ ব্যাপারে তার নিজের মধ্যে কোনো খাদ ছিল না। তখনও সে যে ব্যবহৃত হচ্ছে সে বোধ তার জাগেনি। যখনি জাগল নিজের নারীসত্তার অপমানে ও অবমাননায় সে ফাঁসিতে ঝুলে মরতে চলল। পিতার প্রতি অভিমানে পিতার কারণে সৃষ্ট শরীর ত্যাগ করে সে তার ব্যক্তিসত্তার গৌরবকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইল। পিতার বিরুদ্ধে কন্যার এই প্রকার বিদ্রোহ, সত্যি বলতে কী, নারীবাদিতার দিক থেকে খুবই অর্থপূর্ণ। জোস্নার পাশাপাশি তারাকেও সে কারণে ম্লান মনে হয়নি। একটি গুরুত্বপূর্ণ নারীচরিত্র হিশেবে দর্শকদের কাছেও তারা হাজির থাকতে পেরেছে।
অপরদিকে জোস্না নারী কিন্তু তার আত্মপ্রতিষ্ঠার চেতনা মোটেও নারীমূলক নয়। রাজকুমারকে চাওয়ার পেছনে একটা যে ঔদ্ধত্য ও নিলাজ ভঙ্গি আছে, তার মধ্যে আমরা ব্যক্তিত্ববান সাহস দেখি, মেয়েলিপনা নয়। ছবিতে শ্রমবিভাগ ও চেতনার এই অদলবদল মূলত যুগ যুগ ধরে নিপীড়িত নারীসত্তার উত্থানের পথগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে। বোধহয় বিপুল গ্রামীণ নারীকে জোস্না এ কারণেই আকর্ষণ করতে পেরেছে। আমি একটি পত্রিকায় পড়েছি যে নায়িকা অঞ্জু ঘোষ বলছেন, নারীরা আমার ছবি দেখে না এই বদনাম আমার আগে ছিল, কিন্তু বেদের মেয়ে জোস্না তা ঘুচেছে।
চার: পুরো কাহিনীতে রাজকুমার মূল ঘটনার উপলক্ষ মাত্র, উপলক্ষের অধিক কোনো তাৎপর্য রাজকুমার বহন করে না। জোস্নাই ঘটনার মূল চালিকাশক্তি, আসল চরিত্র। পুরুষ চরিত্রের গৌণতা আর নারী চরিত্রের কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন পুরো ছবিতে নারীর এমন এক রূপ পরিদৃশ্যমান করে তুলেছে, যাতে বেশ বিস্মিত হতে হয়। প্রথাগত বাংলা ছবির খোঁয়াড়ে ছবিটি সে কারণে মোটেও বাঁধা পড়ে না।
পাঁচ : নিজের পিতার প্রতি অভিমানবশত রাজকুমার কাজির দরবারে দাঁড়িয়ে পিতার পরিচয়ে পরিচিত হতে চাইছিল না। সে সময় তার একটি বাক্য হঠাৎ কানে এসে বাজে। রাজকুমার জোস্নাকে কাতর স্বরে নিষেধ করছে যেন জোস্না তার পরিচয় প্রকাশ না করে। কারণ, রাজকুমার বলে, ‘জোস্না, আমি তোমার স্বামী এটাই আমার একমাত্র পরিচয়।’ একজন পুরুষ স্ত্রীর পরিচয়ে পরিচিত হতে চাইছে এটা বেশ লাগে। আন্দাজ করি, নারীদের কাছে রাজকুমারের এই আকাক্সক্ষা অসামান্য লাগবে।
এই দিকগুলোকে আমি বলি উপরি দিক অর্থাৎ এই দিকগুলো সহজেই যে কারুরই চোখে পড়ার কথা এবং এসবের নারীবাদী মর্ম সাধারণ দর্শকের পক্ষেও অনুধাবন কঠিন নয়। এসবের বাইরেও ছবিটির আরো গভীরতর মাত্রা আছে। সেটা বলি।
নিজের প্রাণ বাজি রেখে রাজকুমারকে অর্জন করবার প্রতীকী তাৎপর্য শ্রমিকতার দিক থেকে আমরা ব্যাখ্যা করেছি। কিন্তু নারীর দিক থেকে যদি আমরা দেখি তাহলে ওর মধ্যে আরেকটি ভিন্ন ব্যঞ্জনা লক্ষ্য করা যায়। জোস্না তার প্রেমিককে পাবার জন্য লড়ছে। রাজার কাছে রাজকুমাকে চাইবার মধ্যে তার যে দৃপ্ত, সরল ও সাহসী ভঙ্গি তা নারীর সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলে। পুরুষ যখন নারীকে চায় তার মধ্যে সচরাচর পুরুষতান্ত্রিক দখলের উগ্রাকাক্সক্ষা নিহিত থাকে, তার ফলে সে চাওয়া অতি চেনা যৌনতার উদ্রেক করে কেবল। অতি প্রেমিক পুরুষও যখন তার প্রেমিকাকে পেতে চায় তখনও মনে হয় এই চাওয়া চর দখলের মতোই নারীর শরীর দখলের অধিক কিছু নয়। প্রেমের এই দখলদার মডেলকেই আমরা আদর্শ হিশেবে গ্রহণ করেছি। এটাই প্রেম হিসেবে আমাদের মস্তিষ্কে গেঁথে আছে।
কিন্তু নারী যখন পুরুষকে দখল করতে চায়? নারী যখন আত্মস্থ করতে চায় তার প্রেমিকের শরীর? ঝগড়া করে প্রেমিকের পিতার সঙ্গে? পুত্রের শরীরের ওপর পিতার দখলদারি উৎখাত করে সে শরীর দখল করতে চায় নিজে? তখন? পুরুষতন্ত্রের এই উল্টা পিঠকে কী বলে তখন আমরা ব্যাখ্যা করব? একে তো আমরা চিনি না। একে তো এর আগে কখনো আমরা দেখিনি?
পিতার বিরুদ্ধে পুত্রের বিদ্রোহ সম্পর্কে মনোবিকলন তত্ত্বের গুরু সিগমুন্ড ফ্রয়েড [ফ্রয়েড : ১৯৫১] আমাদের অবহিত করেছেন। এই বিদ্রোহের মধ্যে পিতাকে উৎখাত করে পিতার নিয়ন্ত্রণাধীন সকল নারীকে হাতের মুঠোয় পাবার পুরুষালি বাসনা নিহিত রয়েছে। ফ্রয়েডের ব্যাখ্যা তত্ত্ব হিশেবে আমাদের কাছে কতটুকু গ্রহণযোগ্য সে প্রশ্নে প্রবেশ না করে ফ্রয়েডকে একটি কারণে প্রশংসা না করে উপায় নেই যে, তিনি লিঙ্গবান পুরুষের পুরুষতান্ত্রিক অহং সম্পর্কে আমাদের সচেতন করেছেন। পিতার বিরুদ্ধে পুত্রদের এই বিদ্রোহের প্রতীকী তাৎপর্য সম্পর্কে ইশারা করতে গিয়ে নর্মান ও ব্রাউন [ব্রাউন : ১৯৬৬] সতেরো শ’ শতকের ইংল্যান্ডের পটভূমি টেনে এনেছিলেন। সে সময় ইংল্যান্ডের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রূপান্তরের কাল। পিতা হচ্ছেন নিরংকুশ রাজার (Absolute Monarch) প্রতীক। আর নারীরা হচ্ছেন তার সম্পত্তি। এই রাজকীয় স্বৈরতন্ত্রের উৎখাতের জন্য পুত্রেরা পরস্পরের সঙ্গে পিতার বিরুদ্ধে ‘চক্রান্তে’ লিপ্ত হয় এবং এই চক্রান্তের দরকারে তাদের মধ্যে নতুন ধরনের সম্পর্কের উৎপত্তি ঘটে। এরই পরিণতি হচ্ছে ‘সামাজিক চুক্তি’–সকল ভ্রাতাদের জন্য ‘সমানাধিকার’ যে চুক্তির ভিত্তি। পিতাকে উৎখাত করে নারীদের ওপর দখল কায়েম করার চক্রান্ত সফল করবার জন্য ভ্রাতাদের মধ্যে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা জরুরি ছিল। নর্মান ও ব্রাউন বলতে চেয়েছেন, সিগমুন্ড ফ্রয়েড আসলে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মর্মশাঁসটাই ইতিহাসের অতীতে প্রক্ষেপ করেছেন–সতেরো শতকের ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক বাস্তবতার যা প্রতিচ্ছবি।
নারীর ওপর দখল কায়েমের জন্য পিতার বিরুদ্ধে পুত্রদের চক্রান্ত ও বিদ্রোহের প্রতীকী তাৎপর্য আমাদের ধরিয়ে দিয়ে নর্মান ও ব্রাউন আমাদের বেশ উপকার করেছেন। প্রেম, কাম ও যৌনতার সংঘর্ষ ও সংঘাত ও তার কারণে সৃষ্ট প্রতীক ও উপকল্পের মানেটা রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে কীভাবে অর্থোদ্ধার করতে হবে তার একটা চাবি আমরা তার দরুন হাতের কাছে পাই।
বলা বাহুল্য পিতার বিরুদ্ধে পুত্রদের চক্রান্ত ও বিদ্রোহের উপকল্পের সঙ্গে বেদের মেয়ে জোস্নাসরাসরি সমান্তরাল নয়। এই উপকল্পের যে সাধারণ দ্যোতনা আমাদের উপকারে আসে তা হলো রাজার বিরুদ্ধে কিম্বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পুত্রদের বা পুরুষদের যে কোনো বিদ্রোহই আসলে নারী ও প্রকৃতির ওপর নিজেদের পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য কায়েম করার ‘চক্রান্ত’। ‘সকল মানুষ সমান’ এই স্লোগানকে ভিত্তি করেই এই ‘চক্রান্ত’ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পরিণতি লাভ করতে পারে। কিন্তু ‘সকল মানুষ সমান’ মানে ‘সকল ভ্রাতারা সমান’ বা সাম্য কেবল পুরুষদের মধ্যেই। নারী ও প্রকৃতির ওপর ব্যক্তিগত সম্পত্তি কায়েমের জন্য সাম্য। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের যদি আরো গভীর মানের দিকে যাই যেমন, সকল মানুষ সর্বাভৌম বা ‘ব্যক্তি সার্বভৌম’–তবুও এই ব্যক্তি কেবল ভ্রাতারাই–বোনেরা নয়। পুরুষরাই সার্বভৌম, নারী নয়। কারণ পিতার বিরুদ্ধে এটা বোনদের বা কন্যাদের বিদ্রোহ নয়। পিতার একচেটিয়া অধিকার থেকে নারী ও প্রকৃতি ভ্রাতাদের সমান ভোগ্যে পর্যবসিত হলে ইতিহাস এক কদম হয়ত অগ্রসর হয়, কিন্তু সেটা যে নারীর ইতিহাস নয় সেটা এই উপকল্পের দ্যোতনা থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি।
কীভাবে তাহলে বেদের মেয়ে জোস্নাকে ব্যাখ্যা করব, যখন দেখি এই বিদ্রোহ রাজার বিরুদ্ধে নারীর–যে রাজা পুত্রের শরীরকে নিজের দখলে রাখতে চাইছে, যে পুত্র তার রাজকীয় সম্পত্তির অধিক কিছু নয়। এক্ষেত্রে পুত্র পিতার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। জোস্না পুত্রের শরীরের ওপর পিতার দখল উৎখাত করতে চাইছে। কেন এই লড়াই? কারণ জোস্না জানে রাজকুমারের শরীর–রাজপ্রাসাদে সর্পদংশিত হয়ে যে শরীর নিষ্প্রাণ, মৃত, নিরর্থক। সে শরীরকে পাবার জন্যই জোস্না তার মরণবীণ বাজায়। তার সমগ্র শরীর দিয়ে সে সেটা বাজাতে চেষ্টা করে। কারণ রাজকুমারের শরীরের ওপর দখল কায়েম একটা ‘শারীরিক’ ব্যাপার। রাজার ক্ষমতার বিরুদ্ধে জোস্নার কিম্বা পিতার স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে কন্যাদের লড়াই এটা। শারীরিক সংঘর্ষ–কারণ এ হচ্ছে শক্তির পরীক্ষা। নিজের প্রেমিকের ওপর, প্রকৃতির ওপর সারা দুনিয়ার ওপর নারী কি পারবে তার ক্ষমতা কায়েম করতে? সে কি পারবে স্বৈরতান্ত্রিক পিতার কবল থেকে পুরুষতন্ত্রের কব্জা থেকে তার আকাঙ্ক্ষার বস্তুকে উদ্ধার করতে? এবং তার ওপর নিজ সম্পত্তির ছাপ দিয়ে দিতে যাতে পুরুষ বলে, ‘জোস্না, আমি তোমার স্বামী এটাই আমার একমাত্র পরিচয়?’
এই বলার মধ্যে ‘স্বামী’ শব্দটি তার লিঙ্গ পুরোপুরি হারায়। আমরা সঙ্গে সঙ্গে বুঝি ‘স্বামী’ শব্দটি এখানে নেহাতই একটা শব্দ, রাজকুমার আসলে ‘স্বামী’ নয়। সে জোস্নার সম্পত্তি, যে সম্পত্তি জোস্না নিজে লড়ে অর্জন করে নিয়েছে। নারী যখন এই লড়াইয়ে জেতে তৎক্ষণাৎ পুরুষের লিঙ্গচ্ছেদ ঘটে, নারীর স্বামী হয়ে থাকা ছাড়া অন্য কোনো গৌরবজনক সামাজিক ভূমিকার কথা সে ভাবতে পারে না।
জোস্না এই প্রশ্নগুলো তুলেছে। আমি দাবি করি না সাধারণ দর্শকদের মধ্যে এই প্রশ্নগুলো আমি যেভাবে পেশ করছি সেভাবেই উঠেছে। দর্শকরা বিশ্লেষক নন। একটি ছবি ভালো লাগার পশ্চাৎকারণ সম্পর্কে বলাও তাদের পক্ষে অসম্ভব। আম খেতে যে স্বাদ ভোগ করি আমরা, সে স্বাদ বিশ্লেষণ করতে গেলে রসায়নবিদের দ্বারস্থ হতে হয় আমাদের। তিনি তখন দেখিয়ে দেন আমে এক বিশেষ ধরণের এলডিহাইড উপাদান আছে, যার সঙ্গে আমের স্বাদ সম্পৃক্ত। আমি যে বিশ্লেষণের দিকে ইঙ্গিত করছি, তার সঙ্গে অনেকেই একমত হবেন মনে করি না। তাদের সম্ভাব্য মতপার্থক্য মনে রেখে আমি জোরের সঙ্গে কেবল একটি ব্যাপার দাবি করব তা হলো বেদের মেয়ে জোস্নার নারীবাদী মর্ম আকর্ষণীয়, ফলে দর্শকদের মধ্যে তার ছাপটা পড়তে দেরি হয়নি। দর্শকরা জোস্নাকে চিনতে পেরেছেন বলেই আমার বিশ্বাস। অন্তত নারীরা তো বটেই।
এবার আরেকটি প্রসঙ্গে আসি। নারীর সঙ্গে সাপের প্রতীকী সম্পর্ক খুবই পুরনো। কামে, যৌনতায় বা রিরংসায় নারী সদাই বুঝি ফণা হানছে চতুর্দিকে, নিজের বিষজ্বালা জুড়াবার জন্য। নারীর এই প্রতীকী রূপের সঙ্গে যোগ করা হয় সাপিনীর কুটিলতা–ঠাণ্ডা হিম সরীসৃপের প্রতিহিংসাসহ নানান বদগুণ। বেদেনি রূপটাই সে কারণে নারীর জন্য সবচেয়ে স্বাভাবিক রূপ। নারী ও সাপ এই উভয় ধরনের সরীসৃপ বেদেনির মধ্যে যে ঐক্যে আবির্ভূত হয় তা বিষময় নারী ধারণার সমান্তরাল। নারীর এই যে পুরুষতান্ত্রিক উপকল্পনা নির্মিত হয়েছে একে ভাঙবার পথ কী?
মানুষের ওপর ভূতের আছর হয় বলে আমরা জানি। কারো ওপর ভূত ভর করলে সেটা দেখা যায় না। কিন্তু তবুও ভূতকে মনে করা হয় দৈর্ঘ প্রস্থ সম্পন্ন একটি জন্তু। এই জন্তুই বুঝিবা ভূতে পাওয়া ব্যক্তির ঘাড়ে চড়ে বসেছে। এই চড়ে বসাটার উপকল্পীয় সত্যতা মানুষের মাথায় এতো প্রবলভাবে বিরাজ করে যে, ভূত তাড়াতে হলে উপকল্পীয় নাটকের আশ্রয় নিতে হয়। এমন কিছু প্রতীকী আচরণ করতে হয় যেন ভূত সত্যি সত্যিই অস্তিত্বমান একটা সত্তা। যেমন ভূতে পাওয়া লোককে কষে পেটানো হয় এবং বিশ্বাস করা হয় যে, যাকে পেটানো হচ্ছে সে ঠিক এই ভূতে পাওয়া মানুষটি নয়–ভূত স্বয়ং। গ্রামে দেখেছি পুরনো চাল মশলা পেষার পাটায় সর্বশক্তিসহ পেষা হচ্ছে ভূত তাড়াবার জন্য। ওর পেছনে সেই উপকাল্পনিক বিশ্বাস কাজ করে যে, শিলনুড়ির তলে ভূতকেই আসলে পেষা হচ্ছে। অর্থাৎ ভূত যেহেতু উপকাল্পনিক প্রতীক, তার হাত থেকে নিস্তার পাবার পথটাও উপকাল্পনিক হতে বাধ্য। ভূত তাড়াবার কর্মটি বাস্তবিক, কিন্তু তা উপকল্পনারই বাস্তবায়ন।
নারী ও সাপের প্রতীকী সাযুজ্যের যে পুরুষতান্ত্রিক ভূত আমাদের চেতনায় বদ্ধমূল, তার হত্যাটাও সাঙ্গ করতে হয় প্রতীকী কায়দায়। জোস্না রাজকুমারকে অর্জনের যে পথ ধরে তার প্রক্রিয়ায় সাপেরও মৃত্যু ঘটে। সাপকে মরতে হবে, কারণ সাপ সেই অপপ্রতীক যা পুরুষতন্ত্রের উপকল্পনা থেকে সৃষ্ট। সঙ্গে সঙ্গে জোস্নার মুখ থেকে যে রক্ত নির্গত হয় সে রক্তও দূষিত রক্ত। কারণ পুরুষতন্ত্রের উপকল্পনায় নারীর সঙ্গে সাপের যে সাযুজ্য ও সহবাস তার ফলাফল থেকে উৎপাদিত হয়েছে এই দোষ। নারীকে তাই এই দোষ থেকে মুক্ত হয়ে ওঠা চাই। দূষিত রক্ত বের করে দেয়া চাই সাপকে হত্যা করার প্রক্রিয়ায়। সাপের মৃত্যু অতএব প্রতীকী অর্থে পুরুষতন্ত্রের অভিশাপ থেকে নারীর মুক্তি।
যদি সাপ নিজের বিষ আর দূষিত রক্ত খেয়ে মরে তাহলে আমি বেঁচে উঠবো–জোস্নার এই বক্তব্য আসলে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত সকল নারীর বক্তব্য : নিজের বিষ নিজে তুলে বা খেয়ে সাপ মরে যাক কিংবা সাপ নামক উপকল্পনা নিহত হবার সময় তার সকল ঐতিহাসিক নোংরা নিজেই খেয়ে মরুক–তার নিজের আবর্জনা নিজে সাফ করুক, কেবল তখনই নারী জেগে উঠতে সক্ষম হবে। নইলে মৃত্যু হোক নারীর। এ লড়াইয়ে নারীর বিশুদ্ধরূপ পুরুষতন্ত্রের সকল আবর্জনা ত্যাগ করেই কেবল জাগ্রত হতে পারে, নইলে মৃত্যু তার জন্য অবধারিত। বেদের মেয়ে জোস্নায় ইতিহাসের কাঁধের ওপর থেকে পুরুষতন্ত্রের ভূত নামাবার প্রতীকী নাটকটা সত্যি সত্যি অভিনীত হতে দেখে আমি নিশ্চিত হয়েছি কেন এই ছবিটি নারীর অবচেতনকে এতো গভীরভাবে স্পর্শ করে। আমার ধারণা, আমি ছবিটি বুঝতে ভুল করিনি।
সাপের মৃত্যুর পর জোস্না আর সাপের খেলা দেখাবার ভূমিকায় থাকে না। কারণ সে আর তখন বেদেনি নয়। সে মুক্ত, স্বাধীন, বিশুদ্ধ। ছবিটি দেখার সময় আমি সাপের মৃত্যুর নাটকটি অভিনীত হবার পর থেকে নিঃশ্বাস বন্ধ করে সন্ত্রস্ত ছিলাম এই ভয়ে যে, যদি জোস্নাকে আবার বেদেনি হিশাবে দেখতে হয়। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম, আমাদের অবচেতন সত্যি সত্যিই তার গভীরতর লজিকগুলো অনুসরণ করে। চিত্রপরিচালক বা কাহিনীকার সে সম্পর্কে সচেতন থাকেন বা না থাকেন তাতে কিছু আসে যায় না। জোস্না যদি আবার বেদেনি হিশেবে ফিরত তাহলে নারী দর্শকরা অন্তত তাদের অবচেতনে খটকা বোধ করতেন। কারণ তা তখন তাদের অবচেতন লজিকের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতো না। ছবিটি তখন এতো নারী দর্শক টানত কি না আমার সন্দেহ হয়।
জোস্নার বুর্জোয়া স্বীকৃতি ও বুর্জোয়া-সামন্তের বৈবাহিক বন্ধন
বুর্জোয়া কৃষক চৈতন্যের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার অভিব্যক্তিগুলো বেদের মেয়ে জোস্নায় কীভাবে প্রতীকায়িত হয়েছে তার একটা হদিস আমরা এতক্ষণ নিতে চেষ্টা করেছি। উল্লেখ দরকার, নারীবাদিতা কিম্বা পুরুষতান্ত্রিক সম্পর্কের বিলোপ গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষারই অন্তর্ভুক্ত একটি দাবি। কারণ এ দাবির লক্ষ্য নারীকে ব্যক্তি হিশেবে প্রতিষ্ঠা, পুরুষের মতো তার সার্বভৌম সত্তার রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বীকৃতি।
বুর্জোয়া কৃষক-চৈতন্য প্রাক-বুর্জোয়া আভিজাত্যমূলক চৈতন্যের বিরুদ্ধে বা আরো পরিচিত ভাষায় বললে সামন্ত চৈতন্যের বিরুদ্ধে লড়ে, আমরা দেখেছি। সে লড়াই প্রতীকী হলেও–শিল্পে-সাহিত্যে-সিনেমায়-ইঙ্গিতে বা ইশারায় অনুষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও–লড়াকু চৈতন্যের কাছে তা গোপন থাকে না। ইশারার মানে খুঁজে পেয়ে সে হর্ষবোধ করে। এখন, আমরা একটু বুঝতে চাইব, এ লড়াইয়ের পরিণতিটা কীভাবে শেষ হয়। অর্থাৎ বেদের মেয়ে জোস্নায় কীভাবে শেষ হয়েছে। প্রথমে ছবির শেষে কাজির দরবারে সকল প্রধান চরিত্রের মধ্যে যে ডায়লগগুলো হয়েছে তা উদ্ধৃত করছি, যাতে পাঠক আমার বিশ্লেষণ সহজে ধরতে পারেন–
তারা: [রাজকুমারকে কাজির বিচারালয়ে কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান দেখে] রাজকুমার!
রাজকুমার: যে জমিদার ধরে এনে অপমান করে, বিনা দ্বিধায় চাবুক মারে সে জমিদারের গায়ে–
কাজী: তুমি আমার সামনে উচ্চস্বরে কথা বলছো। জানো এটা বিচারালয়?
রাজকুমার: সত্যিই যদি এটা বিচারালয় হয়ে থাকে আর সত্যিই যদি আপনি ন্যায়বিচারক হয়ে থাকেন, তাহলে করুন তার বিচার যে আমাকে একটা মিথ্যা ষড়যন্ত্র জালে আটকিয়ে একটি মেয়েকে আমার জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।
কাজি সাহেব: কে, সে?
রাজকুমার: আমার স্ত্রী।
জোস্না: ওগো, তুমি এখানে কেন? কে তোমাকে ধরে এনেছে?
রাজকুমার: জোস্না, ওরা আমাকে খুনের দায়ে ধরে এনেছে।
জোস্না: না তুমি খুন করতে পারো না। সব মিথ্যা, সব মিথ্যা।
রাজকুমার: জোস্না।
জোস্না: রাজকুমার!
জোস্না: [কাজির প্রতি] বাবা!
কাজি: জোস্না, আমি বিচারক, এখানে বাবা-মেয়ের কোনো পরিচয় নেই। বিচারের কাঠগড়া বড় নিষ্ঠুর মা।
জোস্না: সবচেয়ে বড় নিষ্ঠুর তোমরা, তা না হলে একজন পিতা তার সন্তানের মায়া-মমতা ত্যাগ করে তাকে হত্যা করার নির্দেশ দেয়? তোমাদের বিচার যদি এতোই নিষ্ঠুর হয় তাহলে পিতা হয়েছিলে কেন? বলো বাবা, বলো বাবা?
কাজি: জোস্না এটা বিচারালয়, এখানে আবেগের কোনো দাম নেই। তুমি যদি উপযুক্ত প্রমাণ না দিতে পারো, তাহলে তোমার স্বামীর আগামীকাল সূর্য ওঠার আগে ফাঁসি হয়ে যেতে পারে।
জোস্না: না বাবা, না, এতো নিষ্ঠুর বিচার তুমি কোরো না। আমি অনেক ত্যাগের বিনিময়ে ওকে পেয়েছি। তোমার হারানো মেয়ের কসম লাগে। ওকে তুমি আমার কাছ থেকে কেড়ে নিও না! বাবা, ওকে তুমি আমার বুক থেকে কেড়ে নিও না!
কাজি: জোস্না আমি আইনের রক্ষক। আইনেই আমার পরিচয়, সেই পরিচয় আমি তোমার চোখের পানিতে মুছে ফেলতে পারবো না জোস্না।
জোস্না: বাবা, তুমি যাকে আজ ফাঁসি দিতে যাচ্ছ, তার পরিচয় আমি আর গোপন করতে পারছি না।
রাজকুমার: না জোস্না, আমার কসম লাগে, তুমি আমার পরিচয় দিও না। আমার কোনো পরিচয় নেই, আমি তোমার স্বামী এটাই আমার বড় পরিচয়।
উজিরপুত্র: কাজি সাহেব, এইসব কী হচ্ছে? ওরা আপনাকে ফাঁকি দিচ্ছে। ওকে বন্দি করুন, আর আপনি খুনিকে ফাঁসি দেওয়ার আদেশ দিন।
তারা: জানেন উনি কে, কী তার পরিচয়? আজ আমি সব বলে দিবো।
রাজকুমার: না তারা, না, আমি কারো পরিচয় নিয়ে বাঁচতে চাই না।
তারা: তোমার কোনো কথাই শুনবো না রাজকুমার।
কাজি: কে রাজকুমার?
তারা: উনি বঙ্গরাজের পুত্র আনোয়ার।
কাজি: মিথ্যে কথা। বঙ্গরাজ আমার ভগ্নীপতি, তুমি আমাকে ধোঁকা দিচ্ছো যুবক।
তারা: আমি যুবক নই, কাজি সাহেব, আমি একজন মেয়েমানুষ [তারা তার পুরুষ বেশ খুলে ফেলে]।
কাজি: কে তুমি?
তারা: আমি বঙ্গরাজ্যের উজিরকন্যা তারাবানু। বঙ্গরাজ রাজকুমারকে খতম করতে বলেছিল কিন্তু খতম করার আগেই রানিমা’র কৌশলে রাজকুমার বেঁচে যায়।
কাজি: না, তোমাদের এই কাহিনী আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। [বঙ্গরাজার প্রবেশ]
রাজা: আমিও না বুঝে আমার একমাত্র ছেলেকে খতম করার আদেশ দিয়েছিলাম। ভাগ্যের জোরে আজ তাকে ফিরে পেয়েছি।
কাজি: তুমি ফিরে পেলেও আমি তাকে মুক্তি দিতে পারছি না।
রানি: এ কী বলছেন ভাইজান, না, না, আমরা ছেলে খুন করতে পারে না। ও নির্দোষ, ওকে ছেড়ে দাও।
কাজি: বিচারের কাঠগড়ায় সে খুনি।
জোস্না: না সে ডাকাত আমি বিশ্বাস করি না। যে জীবনের সব সুখ, শান্তি বিসর্জন দিয়ে একটি গরিব মেয়ের হাত ধরে বনবাসে আসতে পারে, সে খুনি হতে পারে না। যে ব্যক্তি নিজের ক্ষুধা নিবারণ করার জন্য বন থেকে কাঠ কেটে বাজারে বিক্রি করে, সে খুনি হতে পারে না। সে ডাকাত হতে পারে না, বাবা!
কাজি: তোমার কথাগুলি বিশ্বাস করতে পারছি না কেননা তোমাদের কুটিরে এই রক্তমাখা ছুরি আর এই গহনাগুলি পাওয়া গেছে।
জোস্না: সব মিথ্যা। এইগুলি নিশ্চয় কোনো লোক চালাকি করে লুকিয়ে রেখেছে। বাবা, আমি না তোমার মেয়ে?
কাজি: তোমার পুত্র হলেও, বঙ্গরাজ, আমার বিচারালয়ে সে একজন খুনি।
রানি: এই সব মিথ্যে ও জঘন্য কাজ সে করতে পারে না।
কাজি: সে একজন খুনি।
রাজা: ভাইজান, আপনি শুধু এই পরগণার বিচারক আর আমি সমস্ত রাজ্যের বিচারক। আইন আমার হাতেও আছে।
কাজি: আছেই তো। কিন্তু তোমার আইন তোমার অভিজাত্য। তা না হলে সামান্য এই বেদের মেয়েকে বিয়ে করার অপরাধে তুমি রাজকুমারকে হত্যার আদেশ দিতে না। আইন রাজা, বাদশা, গরিব, ধনী সকলের জন্য সমান, আইনের রক্ষক হয়ে আমি তাকে ছেড়ে দিতে পারি না। নির্দোষ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত তাকে কিছুতেই মুক্তি দিতে পারি না। [এমন সময় উজিরপুত্রকে ধরে নিয়ে আসা হলো]
কাজি: কে, ও?
রাজ্জাক: বল তোর কথা।
উজিরপুত্র: আমি জোস্নাকে পাওয়ার জন্য নাপিতের বেশে বনে বনে ঘুরেছিলাম। আমি জমিদারের পাহারাদারকে খুন করেছিলাম আর রাজকুমারকে জেলে দিবার জন্য কুটিরের সামনে এইগুলি রেখে এসেছিলাম।
কাজি: [উজিরপুত্রের সহযোগী ভাঁড়কে] তুমি কে?
ভাঁড়: ওস্তাদ আর আমি এর শিরোমণি, আচ্ছা সত্য কথা কইছি, দেখেন মাফ করে দেওয়া যায়নি।
কাজি: ওকেও বন্দি কর, [জোস্নার দাদা, দাদিকে] কিন্তু তোমরা কারা?
জোস্না: বাবা, এরা আমার দাদা-দাদি।
দাদা: তুমি তাঁর বাবা? তাহলে কী করে জোস্নাকে আমরা ভেলায় পেয়েছিলাম?
কাজি: কলার ভেলায়?
দাদি: হ, কাজি সাহেব, সাপে কাটছিলো, একটা চিঠিও ছিল।
কাজি: চিঠি? কোথায় সেই চিঠি? একী? এ যে আমার মেয়ে, ওকে সাপে কেটেছিল, শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম। ওরে তুই কি আমার হারিয়ে যাওয়া মেয়ে, আয় মা।
রাজা: বাবা আনোয়ার, আভিজাত্যের মুখে আমি যে অন্যায় করেছি তার শাস্তি আমি পেয়েছি, এবার আমার বুকে আয় বাবা, বউমা তোমাকে আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমাকে ক্ষমা করো মা। খোদার ফজলে প্রাসাদে ফিরে গিয়ে তোমাদের বিয়ের আয়োজন করবো।
কাজি: দাঁড়ান, আপনারা আমার পরম আত্মীয়। বাকি কয়টা দিন এখানে থেকে যান।
স্পষ্টই আমরা দেখছি, কাজি এখানে বুর্জোয়া আইনের রক্ষক এবং বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিভূ। এই আইনের চোখে সবাই সমান। ফলে কাজি তার মেয়ের প্রতি কোনো দুর্বলতা প্রদর্শন থেকে বিরত থাকছেন। অপরদিকে কাজি যখন জানলেন যে, রাজকুমার বঙ্গরাজের পুত্র তখনও তার ওপর বুর্জোয়া বিচারের ন্যায়দণ্ড খাড়া করেছেন। রাজার পুত্রকেও নির্দোষ প্রমাণ করেই খালাস হতে হবে। কারণ বুর্জোয়া আইন ‘রাজা, বাদশা, ধনী, গরিব সকলের জন্য সমান’।
উজিরকন্যা তারা রাজকুমারকে নির্দোষ প্রমাণ করবার জন্য যুক্তি দিচ্ছে তার জন্মসূত্রের। আনোয়ার রাজকুমার, অতএব সে খুনি হতে পারে না, এই হচ্ছে তার যুক্তি। জোস্না তুলে ধরছে তার প্রেমিক স্বভাবের পশ্চাৎভূমি। একটি গরিব মেয়ের হাত ধরে যে ব্যক্তি জীবনের সব সুখ শান্তি বিসর্জন দিয়ে বনবাসে আসতে পারে সে কী করে খুনি হয়? কিন্তু কাজি অটল, কারণ বুর্জোয়া আইনের দৃষ্টিতে আবেগের কোনো মূল্য নেই।
বঙ্গরাজ যখন নাটকে অবতীর্ণ হলেন তখন সামন্তের সঙ্গে বুর্জোয়ার লড়াইটা বেশ চমৎকার জমে উঠল। রাজা তার সামন্তীয় আভিজাত্য নিয়ে কাজির সামনে আস্ফালন করলেন যে, আইন তার হাতেও আছে। কিন্তু কাজি সেই আস্ফালনের জবাব দিলেন এইভাবে যে, সেটা হলো আভিজাত্যের আইন। সেই আভিজাত্যের অহমিকায় বঙ্গরাজা সামান্য বেদের মেয়েকে বিয়ে করার অপরাধে নিজ পুত্রকে হত্যার আদেশ দিয়েছে।
অবশেষে খোদ আসামিকে কাজির দরবারে হাজির করে রাজকুমারকে নির্দোষ প্রমাণ করা হলো।
কিন্তু রাজার আস্ফালনের কোনো প্রত্যুত্তর আমরা কিন্তু পেলাম না। বুর্জোয়া শ্রেণী এই দর্পকে কি আসলে ঐতিহাসিকভাবে খর্ব করেছে? সামন্তীয় আভিজাত্য ও দর্পের পশ্চাৎভূমিতে রাজকুমারকে নির্দোষ প্রমাণ করা হলো। কিন্তু সে দর্পের হুংকার ও আওয়াজ কিন্তু সিনেমার পর্দা থেকে মুছে গেল না। যেমন করে ইতিহাস থেকেও বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব মুছে ফেলতে পারেনি। আমাদের কানে লেগে থাকল অহংকারী সামন্ত কণ্ঠস্বর, ‘আপনি শুধু এই পরগণার বিচারক আর আমি সমস্ত রাজ্যের বিচারক, আইন আমার হাতেও আছে।’
কী আইন সেটা? প্রাক-বুর্জোয়া চিন্তাচেতনা, পশ্চাৎপদ সংস্কৃতি ও জবরদস্তি আইননীতির কথাই কি বলা হচ্ছে এখানে? নাকি বলা হচ্ছে আরো গভীর প্রতীকী অর্থে যে, বুর্জোয়া আইন আর তথাকথিত ‘সাম্য’ আইনের জগতে একটা ‘পরগণার’–একটা সীমাবদ্ধ জায়গার বা আমাদের চিন্তাচেতনার একটা ক্ষুদ্র খোপের উৎকাক্সক্ষা কেবল আর বাকি জগতের অধিকাংশ জুড়ে আছে প্রাক-বুর্জোয়া পশ্চাৎপদতা, আস্ফালন, আভিজাত্যবোধ ও জোর যার মুল্লুক তার ধরনের ‘ন্যায়বিচার’। আসলে ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততন্ত্রের গর্ভে নতুন যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার উন্মেষ ঘটে বুর্জোয়া শ্রেণী তাকে চূড়ান্তভাবে জয়ী করার দিকে নিয়ে যায় না। গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার বিকাশ ফলে প্রতিহত হয়। সামন্ত শ্রেণীর সঙ্গে বুর্জোয়া শ্রেণীর সংগ্রাম কোনো চূড়ান্ত নিষ্পত্তি ছাড়া অমীমাংসিত থেকে যায়।
শুধু যে যায় তাই নয়। লক্ষণীয় যে, হঠাৎ আমরা আবিষ্কার করি জোস্না কাজির মেয়ে। আর ঠিক তক্ষুনি লক্ষ্য করি যে, জোস্নাকে বউ হিসেবে গ্রহণ করতে বঙ্গরাজার আর আপত্তি থাকে না। সামন্ত শ্রেণীর সঙ্গে বুর্জোয়া শ্রেণীর বৈবাহিক সম্পর্কের আঁতাতটা অতি স্বাভাবিকভাবেই যেন সঙ্গতি পেয়ে যায়। দর্শকরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। বুর্জোয়া কৃষক মহা হর্ষ লাভ করে। তারা বুঝতে শেখে জোস্না আসলে বেদের মেয়ে নয়। সে বুর্জোয়া শ্রেণীরই সন্তান, তাকে বেদেরা লালন-পালন করেছেন মাত্র।
অতএব জোস্নার সঙ্গে রাজকুমারের বিয়ে শেষাবধি বঙ্গরাজা মেনে নেবে এছাড়া সিনেমা আর কীভাবে শেষ হতে পারত? কৃষক তো আসলে রাজার প্রতি তার আনুগত্য ত্যাগ করেনি, সে তার নব উন্মেষিত চেতনার স্বীকৃতি চায় মাত্র। জোস্নাকে রাজা ঘরে তুলুক এটাই সে চায়। রাজা এই কাজটি করলে কৃষক হর্ষোৎফুল্ল হয়ে বাড়ি ফেরে।
পাঠককে শুধু মনে করিয়ে দিই, লেনিনের কাছে আমরা শিখেছি শ্রমিক শ্রেণী যদি নেতৃত্ব না দেয়, সকল বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পরিণতি এটাই হতে বাধ্য–বুর্জোয়া শ্রেণীর সঙ্গে সামন্ত শ্রেণীর বিবাহ। অতএব জোস্না ও রাজকুমারের বিবাহের সানাই বাজছে, আরো কি বহুকাল বাজবে?
শহুরে মধ্যবিত্তের কাছে নিজ শ্রেণীর রুচি ছাড়া আর আর শ্রেণীর রুচি ‘বিকৃত’
বেদের মেয়ে জোস্না টেকনিক বা কলাকৌশলের দিক থেকে কী পরিমাণ শিল্পগুণমণ্ডিত সে বিচারে এক ফোঁটাও এখানে আমরা আগ্রহ প্রকাশ করিনি। যে চৈতন্যকে এ ছবি স্পর্শ করছে তার অনে¦ষণ বরং অনেক বেশি লাভের, তবুও ছবিটির বহু দিক আছে যা বিরক্তিকর আর পীড়াদায়ক। উপরের ইতিবাচক ব্যাখ্যা গ্রহণ করার পরেও ছবিটি ধৈর্য ধরে দেখাটাও অনেকের জন্য কষ্টকর হবে। এর কারণ টেকনিক কী কলাকৌশল সব দিক থেকে ছবিটি সত্যি সত্যিই বাংলাদেশের আর দশটা ছবির মতোই খারাপ। কিন্তু ছবির এই সকল দিক নিয়েই আর্ট ফিল্মে অভ্যস্ত মধ্যবিত্ত বেশি ভাবে। ফলে ছবির বিষয়ে পৌঁছাবার আগেই ছবিকে তারা নাকচ করে দেয়। আমাদের দেশের সিনেমা দর্শকরা এসব নিয়ে অবশ্য উদ্বিগ্ন নয়। এতে আমাদের দেশের সিনেমা খুব আগুয়ান হতে পারেনি এই সত্যটা অবশ্য আমি গলা মিলিয়ে আমার সিনেমা-বোদ্ধা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে স্বীকার করি।
কিন্তু ছবিটিকে যারা কুরুচিপূর্ণ বা ‘বিকৃত রুচি’র বলছেন তাদের সঙ্গে মোটেও একমত হওয়া যায় না। তাদের মত বিনীতভাবে প্রত্যাখ্যান করা একটা কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এ কারণে যে, যারা বিকৃতির অভিযোগ তুলছেন তারা তাদের রুচিকেই অবিকৃত রুচির শাশ্বত আদর্শ ধরে নিয়েছেন, যা আসলে একটি বিশেষ শ্রেণীর রুচি কেবল। শ্রেণীগত কারণে সম্ভবত তারা মনোযোগ দিয়ে ছবিটি দেখেননি। সাধারণত ‘শিক্ষিত’ মধ্যবিত্তরা বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি সিনেমাকেই ‘রিকশাওয়ালাদের ছবি’ মনে করে। ছবিগুলোর প্রতি তাদের শ্রেণীগত ঘৃণা এতো প্রবল যে, একে নিন্দা করবার জন্যই তারা জিহ্বা খোলে, নইলে নয়।
রুচির পার্থক্য বা দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য থাকা শ্রেণীগত কারণে স্বাভাবিক। কিন্তু কখনো এটা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে যখন সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া কিংবা তাদের ভালো লাগাটাও, সচেতন ও প্রগতিশীল বলে নিজেদের যাঁরা দাবি করেন, তাঁদের কাছে ন্যূনতম কোনো অর্থ বহন করে না। সাধারণ জনগণের ভালোমন্দ লাগার প্রতি অহংকারী উপেক্ষার মধ্যে আমাদের সাংস্কৃতিক ভাবনার অন্তঃসারশূন্যতাই প্রমাণিত হয়। এই অন্তঃসারশূন্যতা আতংকের সৃষ্টি করে। অতএব রুচির বিকৃতি বিষয়ে দু’একটি কথা খোলাসা করে না বললেই নয়।
ছবিটির বিকৃতি রুচির উদাহরণ দিতে গিয়ে কেউ স্পষ্ট-অস্পষ্টভাবে মোটামুটি তিনটে বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। এক: যৌনতা ও শরীর প্রদর্শন; অঞ্জু ঘোষের শরীর সম্বন্ধে একজন সংস্কৃতিবান চিত্র সমালোচকের বেশ কিছু শব্দ এখনো চোখে লেগে আছে। শব্দগুলো শালীন ছিল না। দুই: নকল গান ও বিদঘুটে কথা। তিন: ধেই ধেই নাচ ও ভাঁড়ামি। এই তিনটি বিষয় নিয়ে আমি আলোচনা করব। যদিও আমার ধারণা আমার বক্তব্য বাংলাদেশের সব ছবির ব্যাপারে খাটে কিন্তু সকল ছবির আমি দায় নেবো না। কারণ ছবিমহলের খবর আমি সময়াভাবে খুব একটা রাখতে পারি না।
‘রুচির বিকৃতি’ কথাটা যৌনবিকৃতির সমার্থক হিশেবে ব্যবহৃত হয়। আমি বাংলাদেশের ছবি দেখেছি কম। যে কয়টি দেখেছি তাতে যৌনতা, কাম, রিরংসা প্রভৃতি অবশ্যই ছিল। মানুষের জীবনের খুবই স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার এইসব। তবে যৌনতা-কাম-রিরংসা যতো সহজে আর সরাসরিভাবে বাংলাদেশের সিনেমায় আসে তার কারণে তা অনেকের ‘বিকৃত’ মনে হতে পারে। কিন্তু সরাসরি আসাটাই কি বেশি স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত নয়? এই সরাসরি ভাবটা আসে নায়িকার কটাক্ষে বা অতি প্রত্যক্ষভাবে শরীরের অঙ্গভঙ্গিতে ইত্যাদি। কিন্তু এই স্পষ্টাস্পষ্টি নগদ পাওয়ার মধ্যে যে গ্রামীণ সারল্য আছে তার কারণেই সাধারণ দর্শকরা এসব উপভোগ করে। না, মোটেও বিকৃতভাবে নয়। তাদের চেতনার সারল্যের সঙ্গে এই ভালো লাগাটা জড়িত।
কৃষক চৈতন্যে ব্যক্তিতান্ত্রিক বোধ যখন জেগে উঠতে থাকে তখন সে চৈতন্য দেখতে পায় তার ইচ্ছা বাস্তবায়নের ওপর চেপে বসে আছে প্রাক-বুর্জোয়া সামন্ততান্ত্রিক রীতিনীতি-শৃঙ্খল। ও থেকে বেরিয়ে আসার আকুতিটা তার মধ্যে প্রবল হয়ে ওঠে। তার প্রেম, কাম ও যৌনতার প্রকাশের মধ্যে প্রায় অনিবার্যভাবে একদিকে তার ইচ্ছা আর অপরদিকে সমাজের রীতিনীতির দ্বন্দ¡ থাকবে। কারণ এটা তার বৈষয়িক বাস্তবতা এবং প্রতিদিন এর বিরুদ্ধে তাকে লড়তে হচ্ছে। সে কারণে আমরা লক্ষ্য করি, আমাদের গ্রামীণ প্রেমের গানে সেই অতি পরিচিত থিম বার বার ফিরে আসে। সেটা হলো কালার বাঁশির সুরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসছে নারী–এখন সে কুল রাখবে না পিরিত রাখবে। এই সেই অদ্ভুত কৃষকসুলভ দ্বন্দ¡–নিজের ইচ্ছার পরিতৃপ্তি সে চায়–নিজের ভেতরে জেগে ওঠা ব্যক্তিবোধ প্রতিষ্ঠা পাক সে চায়–কিন্তু প্রাক-বুর্জোয়া বন্ধনের শৃঙ্খল ভাঙতে সে দশবার ভাবে।
কালার জন্য তার প্রেমের মধ্যে কাম ও যৌনতা প্রকাশিত হয় খুবই খোলামেলাভাবে, অতি সরাসরি। যৌবন জ্বালায় আর ঘরে থাকতে পারছে না নারী, তার শরীর জারে জার, ফাল্গুন মাসে পাখি ডাকছে গাছে, সারা গায়ে কামজ্বালা উথলে উঠছে। ঘরে থাকা দায়। ‘জ্বলন্ত কালনাগিনী’ শাশুড়ি শুয়ে আছে পাশে, আর আছে ঘরে ‘দুরন্ত ডাকিনী’ ননদী। এখন ঘর থেকে কী করে বেরুবে প্রেমে কাতর নারী? কামে ও মদনে জ্বলে ওঠা অঙ্গ নারী তো আর সইতে পারছে না। একদিকে শাশুড়ি-ননদীর পাহারা আর অপরদিকে শরীরে জ্বালা–একদিকে সমাজ সংসারের শৃঙ্খল আর অন্যদিকে নিজের ইচ্ছা চরিতার্থের তীব্রতা–এই দুইয়ের দ্বন্দ¡ অনিবার্যভাবে কৃষকের গানে বার বার আসে, আসতে বাধ্য।
লক্ষণীয় যে, এই সকল গানের পশ্চাতের কৃষকচৈতন্য নিজেকে প্রকাশ করবার জন্যই কেবল ব্যাকুল। নিজের ইচ্ছা-কাম-মদনজ্বালাকে নিজে নিজে অবদমন করতে সে জানে না। এখনো শেখেনি। যেমনটি জানে শহুরে বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত শ্রেণী। দেখা যায় যে, আমাদের শহুরে বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্তের সংস্কৃতির মধ্য থেকে অবধারিতভাবে দুটো বিষয় অন্তর্হিত হয়েছে। এক: প্রাক-বুর্জোয়া শৃঙ্খলের উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতনতা ও নিজের ব্যক্তিতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা নিয়ে দ্বন্দ¡ এই শ্রেণীর মধ্যে প্রায় নেই বললেই চলে, এমনকি সে যে সমাজ বাস্তবে হাজির দেখতে পায়, সে সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির দ্বন্দ¡টাও এই শ্রেণীর শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তেমন পরিলক্ষিত হয় না, দুই: সিধাভাবে বা সরাসরিভাবে নিজের ইচ্ছা-কাম-রিরংসা প্রকাশ করবার সাহসও এই শ্রেণীর নেই। অথচ লাম্পট্যমূলক গানগুলোকেও এই শ্রেণী একটা মসৃণ মহিমা দিতে শিখেছে, যাতে দৈহিকতাকে একটা আধ্যাত্মিক ব্যাপার বলে ভ্রম হয়। রবীন্দ্রনাথ থেকে একটা গানের উদাহরণ দিচ্ছি : ‘আমার এই দেহখানি তুলে ধরো/তোমার ঐ দেবালয়ের প্রদীপ করো’, ইত্যাদি।
যৌনাকাক্সক্ষা প্রকাশের জন্য বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত শ্রেণী এই ধরণের প্রতীকী কায়দার যে বিকাশ ঘটিয়েছে বলা বাহুল্য অন্যান্য শ্রেণী তা পারে নি। যে দিকটা আমাদের আলোচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তা হলো এই শ্রেণী প্রাক-বুর্জোয়া শৃঙ্খল থেকে বৈষয়িক ও চৈতন্যগত মুক্তির দরকারটা আর উপলব্ধি করে না। তদুপরি সেই শৃঙ্খল বহাল তবিয়তে রাখার পুলিশি কাজটা সে নিজেই এখন নিজের ওপর করে। তার ইচ্ছা-কাম-যৌনতার ওপর নিজেই নিজের খবরদারি করার মধ্য দিয়ে তার প্রকাশটা নিজেই সে সেন্সর করে। সেন্সরকৃত এই রাখঢাক প্রকাশটাই সে মনে করে আদর্শ। তার প্রকাশের ‘বিকৃত রূপ’টাই তার কাছে মনে হয় স্বাভাবিক। সোজাসিধা স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশের যে কোনো ধরনই এ কারণে এই শ্রেণীর কাছে ‘বিকৃত রুচি’ বলে ভ্রম হয়।
অথচ এই শ্রেণী বুঝতে পারে না যৌনতা, কাম বা রিরংসা সম্পর্কে তার এই স্বেচ্ছাপুলিশি বা অবদমনটা বিকৃতি ছাড়া মহৎ কিছুর জন্ম দিতে অক্ষম। কারণ এই ব্যাপারগুলো যেহেতু কেবল সাংস্কৃতিক ব্যাপার নয়, শারীরিকও বটে, ফলে তার অবদমন অসম্ভব। একটা ‘বিকৃত’ রূপ নিয়ে এর হামেশা প্রকাশ ঘটতেই থাকবে। কিন্তু সে বিকৃতিকেই এই শ্রেণী আদর্শ হিশেবে প্রতিষ্ঠা করে, রবীন্দ্রনাথের ব্রাহ্ম নিরাসক্তি কিংবা নপুংসক দৈহিকতা সে কারণে একটা আধ্যাত্মিক মর্ম পেয়ে যায় এবং অন্য সকল শ্রেণীর রুচিকে ‘বিকৃত’ ভাবতে আনন্দ বোধ করে।
সে কারণে ‘রিকশাওয়ালাদের ছবি’তে প্রেমের প্রকাশটা খুব সিধা ও স্থূল হলে তা ‘বিকৃত’ রুচির ভাবাটা স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। এই সব সিনেমায় যৌনতা-কাম-রিরংসার প্রকাশের আকুতিটা এতো বেশি যে, নায়িকার কটাক্ষটা খুব চোখাভাবে হাজির না করলে কৃষক চৈতন্য মজা পায় না। প্রেমে পড়ার পর নায়ক-নায়িকা যদি পাহাড়ে, বনজঙ্গলে বা জাহান্নামে কিছুক্ষণ ধেই ধেই করে না নাচে তো এ আবার কীসের প্রেম? কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণী তার বিকৃতির জন্য এগুলোর সরল অভিপ্রকাশের স্বাদ বুঝতে অক্ষম। যদি উপরের ব্যাখ্যা আমাদের ভাবায় তাহলে আমরা বুঝবো যে, ইচ্ছা-কাম-রিরংসার সিধা প্রকাশ কিম্বা ধুমধাড়াক্কা নাচ মোটেও কৃষক চৈতন্যের রুচিবোধের সঙ্গে অসঙ্গত নয়। ‘বিকৃত’ তো নয়ই। এর সবটাই একটা সহজ সরল স্বতঃস্ফূর্ত বৃত্তির প্রকাশ। তবে সিনেমাওয়ালাদের বাড়াবাড়ির কারণে পরিমিতি বোধ যে সবসময় বজায় থাকে সেটা অন্যান্য ছবির ক্ষেত্রে আমি হলফ করে বলতে পারবো না। কিন্তু বেদের মেয়ে জোস্না সে দোষে মোটেও দুষ্ট নয়। অন্তত পরিমিতি বোধের অভাবে ছবিটিকে ‘বিকৃত রুচি’র বলা অন্যায় হবে।
ছবিতে যৌনতা-কাম-রিরংসা প্রকাশের স্বতঃস্ফূর্ত রূপের পক্ষে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে একটি বিষয়ে বিশেষভাবে সাবধান করে দেয়া জরুরি। সেটা হচ্ছে যৌনতা-কাম-রিরংসা বাস্তবায়নের রূপ পুরুষতান্ত্রিক থাকে অনিবার্যভাবেই। এর কারণ নারী প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক ও পুঁজিতান্ত্রিক উভয় সমাজেই নেহাতই উৎপাদনযন্ত্র আর পুতুল মাত্র। ছবিতে একটি ধর্ষণ দৃশ্য কল্পনা করাই এক্ষেত্রে যথেষ্ট হবে। কিন্তু এটা তো পুরো সমাজের কি পুরো দুনিয়ার সমস্যা। এর বিরুদ্ধে লড়তে হবে আরো শক্তভাবে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত কাম-যৌনতা-রিরংসার অভিব্যক্তি শিল্প থেকে ছাঁটাই করে দেয়া হোক এরকম দরবেশ হওয়ার মধ্যে শিল্পের প্রগতি নিহিত আছে বলে আমি মনে করি না।
কাম-যৌনতা-রিরংসার শিল্পগুণানি¦ত উপস্থাপনটা পুরুষতান্ত্রিক বিকৃতির হাত থেকে একে রেহাই দেয় না। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের আগ্রাসনে বুর্জোয়া চৈতন্য হামেশাই শিল্পকলার নামে এই বিকৃতি চর্চা করে যাচ্ছে। এ নিবন্ধের শুরুতে গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেজের ইউ আর দ্য ওয়ান আই অ্যাম লুকিং ফর ছবিটি উল্লেখ করেছি। ছবিটিতে বেশ কয়েকটি কামোদ্দীপক ধর্ষণের চিত্র আছে। এক পর্যায়ে ধর্ষিতা নারী ধর্ষিত হওয়ার মধ্যে একটা আনন্দ পাচ্ছে মনে হয়। সে সন্ধান করে বেড়াচ্ছে সে জান্তব স্বেদ, চামড়ার ঘ্রাণ, ঘোড়ার মুত প্রভৃতি পুরুষতান্ত্রিক কাম পরিতৃপ্তির আদিমতার স্মৃতি। ছবিটি সরাসরি বলেনি কিন্তু এটা স্পষ্ট বোঝা গেছে যে, ধর্ষিত হওয়ার মধ্যে নারী এক প্রকার অনির্বচনীয় সুখলাভ করে। ধর্ষিত হোক এটা তার এক ধরনের ফ্যান্টাসি।
আমি একে বিকৃত চিন্তা হিশেবে শনাক্ত করি। কিন্তু এই ছবিটি আর্ট ফিল্মের নায়কদের চোখে হয়ত শ্রেষ্ঠ একটি সৃষ্টি। সেটা হতে পারে আঙ্গিকে কিম্বা নির্মাণে কিম্বা বক্তব্য উপস্থাপনার চতুরতায়। হোক, কিন্তু এই বিকৃতি, যাকে একটা দর্শনের পর্যায়ে উন্নীত করে ফেলা হয়েছে–তার ক্ষতি অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। বাংলাদেশের ছবিতে পুরুষতান্ত্রিক বিকৃতি সেই তুলনায় কিছুই নয়। এর কারণ নারী ধর্ষিত হবার ইচ্ছা ও বিকৃত সুখ অনুভবের যে কামুকতা শিল্পে দর্শনে বা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠার জন্য পশ্চিমে চেষ্টা চলেছে দেখতে পাই সেটা ঘটানোর জন্য যে পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতি ও অতি বিকশিত অ্যাবসার্ড বুর্জোয়া চৈতন্য দরকার সেটা আমাদের দেশে নেই।
গান সম্পর্কে বিকৃতির কথা উঠেছে কিন্তু হিন্দি গানের নকলে বাংলা গান আমার কুরুচিপূর্ণ মনে হয়নি, স্রেফ নকল মনে হয়েছে। নকল আর কুরুচি সমার্থক নয়। কিন্তু হিন্দি গানের এই সুরগুলো গ্রামীণ মনকে আলোড়িত কেন করে তার উত্তর খুঁজতে গেলে আমরা দেখব তাদের উৎসবের ভিত্তি আসলে লোকায়তিক। সুখের এই গণচরিত্র অনায়াসেই ধরা পড়ে। ফলে সুরগুলো নকল অবশ্যই কিন্তু অযৌক্তিক বা অপ্রাসঙ্গিক নয়। অনেক মধ্যবিত্তমার্কা নাকি কান্নার চেয়েও এই সব ‘নকল’ অনেক অনেক পরিতৃপ্তির।
তবুও আমি নকলের পক্ষ নিচ্ছি না। নকল সমর্থনযোগ্য নয় অবশ্যই। এই গানগুলো ব্যবহারের মধ্য দিয়ে একটা সাংস্কৃতিক অন্তঃসারশূন্যতা ক্ষতের মতো দৃশ্যমান হয়ে আছে। সে ক্ষত শহরের মধ্যবিত্ত ও পাতিবুর্জোয়া সংস্কৃতির পচন ও পতন। এই সংস্কৃতির কৃত্রিমতাই পতন ও পচনের জন্য দায়ী।
আধুনিক ও সংস্কৃতিবান গানের মধ্যে যে কৃত্রিমতা লক্ষ্য করা যায় বেদের মেয়ে জোস্নার একটি গানকেও আমার সে রকম কৃত্রিম মনে হয়নি। বরং অনেক ক্ষেত্রে গানের কথার মধ্যে নগ্ন স্পষ্ট ও নির্ভান উচ্চারণ এমন সব কাঁচা আবেগ, উচ্ছ্বাস ও বাক্যের মধ্যে আমাকে নিপতিত করেছে যে, নিজের শহুরেপনা নিয়ে নিজেই মশকরা বোধ করেছি। গানের কথায় সোজাসাপ্টা ও অসংস্কৃত বাঁধুনি সম্প্রতিকালের সিনেমা গানের একটা লক্ষণ হয়ে উঠেছে। এর ফলাফল কী দাঁড়াবে বলা মুশকিল, তবে ইতোমধ্যেই তার যে চরিত্র বেদের মেয়ে জোস্নায় আমি দেখেছি তাতে মোটেও বিচলিত বোধ করিনি। কাঁচা চেতনা ও অভিজ্ঞতার ঠোঁট থেকে কথা আহরণ করার চেষ্টা মানে পাতিবুর্জোয়া চৈতন্যের চৌহদ্দি ডিঙিয়ে বেরিয়ে আসা। এর ফলাফল হয়তো খারাপ হতে পারে কিন্তু পচনশীল চৈতন্য ও ইন্দ্রিয়বৃত্তি থেকে একটা মুক্তি আমাদের খুবই জরুরি। আমরা আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের গানে ও কবিতায় যদি তা দিতে ব্যর্থ হই তো সিনেমা শিল্পকে একবার চেষ্টা করতে দেয়া উচিত। দেখা যাক কী হয়।
মজা হচ্ছে গানের কথার মধ্যে আমি পাতিবুর্জোয়া রোমান্টিসিজম পাইনি। পেয়েছি এক প্রকার অসংস্কৃত গা-খোলা বাস্তবতা। মুজিব পরদেশীর গাওয়া গানটি দিয়ে উদাহরণ দেই :
মা আমি বন্দি কারাগারে
আছি গো মা বিপদে বাইরের আলো চোখে পড়ে না।
মা আমি বন্দি কারাগারে॥
জেলখানার সম্বল, থালা বাটি কম্বল
এ ছাড়া অন্য কিছু মেলে না, মা
সকাল আর সন্ধ্যায় দুইটি রুটি দেয়
রুটি খেয়ে পেট ভরে না
আমি বন্দি কারাগারে॥
এই ছিল কপালে হাত বাঁধা শিকলে
পিপাসায় বুক ফেটে যায় মা
সকাল আর রাতে চাবুকের আঘাতে
বুকের রক্ত ঝরে পড়ে মা
আমি বন্দি কারাগারে॥
আমি দুঃখে দুঃখী কবে হবো সুখী
মাগো এসে কেউ বলে দাও
আর জ্বালা সহে না, প্রাণে যে মানে না
মশার কামড়ে ঘুম আসে না মা,
আমি বন্দি কারাগারে॥
আছি গো মা…
কারাগারের এই বাস্তবতা বর্ণনা মোটেও কাব্যিক নয়। কানে বাজে এবং আমাদের পাতিবুর্জোয়া ইন্দ্রিয়বৃত্তি বিরক্ত বোধ করে। আর ঠিক এখানেই গানটার মজা। কারণ গানটি গ্রাম্য এবং নিজের গ্রাম্যতা নিয়ে গানটি এক ফোঁটাও লজ্জিত নয়। তার যা বলার সেই গ্রাম্যতাসহ সে ঠিকই বলে যাচ্ছে। অত্যন্ত বাস্তবোচিত এই বলার ধরন। এই গানটি কিন্তু পুরনো ও অতি জনপ্রিয় একটি গান। আমি বিস্ময় বোধ করি গানটির জনপ্রিয়তায় কিন্তু পরক্ষণেই আমার বিস্ময় কেটে যায়। কারণ আমি অবাক হয়ে বুঝি যে কৃষক চৈতন্য রোমান্টিক নয়, তার গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা বাস্তবের সঙ্গে সংলগ্ন। এই গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার বিপক্ষে প্রতিক্রিয়াশীল অভিব্যক্তি হিশেবেই কি রোমান্টিকতার উদ্ভব ঘটে না? রোমান্টিকতা সম্মুখস্থ লড়াইকে ভুলে যায়, বাস্তবের পিঠে পিঠ ফিরিয়ে চালিয়ে দিতে চায় সবার ওপর। অতএব মধ্যবিত্ত বা পাতিবুর্জোয়ার সংস্কৃতি যখন নান্দনিক সত্য হিশেবে প্রতিষ্ঠা করে রোমান্টিকতার, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি কাদামাটি সুদ্ধ গ্রাম্য বাস্তবতাকে তখন টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসে সামনে। এমনভাবে নিয়ে আসে যে লজ্জা পেতে হয়। লজ্জা পেতে হয় আমাদের নিজেদের ভেতরকার প্রতিক্রিয়াশীল রোমান্টিকতা নিয়ে। যারা বিচক্ষণ তারা বেদের মেয়ে জোস্নার গানগুলো থেকে শিখেছেন–অন্তত টের পেয়েছেন সফল হাতে আঁকড়ে ধরে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কোন ধারাটার বিকাশ ঘটালে জনগণ গ্রহণ করবেন, যারা গানগুলোকে নিন্দা করেছেন তাঁদের রেকর্ড প্লেয়ার থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের লং প্লে না নামলে কথা বলাটা বেকার হবে। কারণ গ্রামের খবর তাদের কাছে এখনো পৌঁছায়নি।
সিনেমায় গান ও নাচ কেন থাকে এবং এটা যে খুবই বাজে জিনিস এ সম্পর্কে আমি শহরের পাতিবুর্জোয়া শ্রেণীর নাক সিঁটকানি যথেষ্ট দেখেছি। আসলে শিল্পকলার বুর্জোয়া বোধের সঙ্গে গান-নাচের সংমিশ্রণ মেলে না। বুর্জোয়া শ্রেণী যতোই বিকশিত হয়েছে সে তার জীবনকে বিভক্তিকরণ করতে শিখেছে। আদিম জীবনের যে সামগ্রিকতা–গান নাচ মশকরাসহ জীবনের সর্বব্যাপী যে দিক, বুর্জোয়া শ্রেণী সে দিকটার তাৎপর্য আর স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারে না। সে সিনেমায় কেবল ছবি দেখতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। গান বা মিউজিক যদি থাকেও তবে তা কখনও ছবির ঘটনাকে ছাপিয়ে ওঠে না। অর্থাৎ গান নাচ ও ভাঁড় চরিত্র সব কিছুই ঘটনা ও অভিনয় থেকে বিভক্ত হয়ে যায় এবং বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা ও অভিনয়ই ছবির একমাত্র উপজীব্য হয়ে ওঠে।
কিন্তু গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এখনো তার আদিম চৈতন্যের সীমারেখা অতিক্রম করেনি। সে গান, নাচ আর একটা ভাঁড়ের চরিত্র ছাড়া বাস্তবতা কল্পনা করতে পারে না। পরিশীলিত বুর্জোয়ার মতো তার ইন্দ্রিয়বৃত্তি বিভক্ত নয়। গান নাচ ভাঁড়গিরিকে একসঙ্গে দেখেই সে আমোদ পায়। তাদের একত্র গ্রন্থনাটাই তার কাছে বাস্তব এবং স্বাভাবিক–তাদের বিচ্ছিন্নতা বা আলাদা আলাদা হয়ে যাওয়া নয়। পরিশীলিত বুর্জোয়া ইন্দ্রিয়বৃত্তির সঙ্গে অনাধুনিক চৈতন্যের পার্থক্য অনেকে বুঝতে পারেন না। বুর্জোয়া শ্রেণীর ইন্দ্রিয়বৃত্তিকেই অনেকে শাশ্বত মনে করেন। এই শাশ্বত বোধ থেকে নাক সিঁটকানির জন্ম। এই কারণেই আর দশটা ছবির মতো বেদের মেয়ে জোস্না ও শহুরে মধ্যবিত্তের নাক সিঁটকানি লাভ করেছে।
প্রগতিশীল শ্রেণীর কর্তব্য সম্পর্কে একটি ইঙ্গিত
যারা এতক্ষণ ধৈর্য ধরে আমার এ প্রবন্ধটি পড়েছেন তাদের মনে ইতোমধ্যে একটি প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। সেটা হলো প্রযোজক ও পরিচালক কি এতো ভেবে ছবিটি বানিয়েছেন? রাঁধুনি যখন পাক করে তখন সে তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় বোঝে যে কোন খাদ্যটা কীভাবে পাক করলে ও পরিবেশন করলে লোকের রুচিসম্মত হবে। বলা বাহুল্য রুচি মানে একটা নৈর্ব্যক্তিক অতি বায়বীয় ব্যাপার নয়। রুচি সবসময়ই কোনো না কোনো বিশেষ শ্রেণীর রুচি। বিশেষ সময়ের রুচি। এখন রাঁধুনিকে যদি প্রশ্ন করা যায় কীভাবে রান্না করেছে, সে তখন চুলা জ্বালানো থেকে শুরু করে কড়াই চাপানো, মশলা দেয়া, হাতা দিয়ে নাড়া, পেঁয়াজ-রসুনের বাগার দেয়া প্রভৃতির অনুপুঙ্খ বর্ণনা দেবে। বলা যায় রান্না সম্পর্কে রাঁধুনির একটা ভাবনা আছে, এর কলাকৌশল সম্পর্কে সে অবহিত থাকে।
আসলে প্রশ্নটি করে আমরা এই ভাবনা বা কলাকৌশলের হদিস নিতে চাই না। আমরা সম্ভবত জানতে চাই, যে রুচির ব্যাখ্যা আমরা করলাম রাঁধুনি কি সে ব্যাখ্যা জেনেই ছবিটি বানিয়েছে? আসলে এই প্রশ্নটা অবাস্তব প্রশ্ন এ কারণে যে রাঁধুনি অভিজ্ঞতা থেকে রুচি সম্পর্কে একটা ধারণা গড়ে তোলে। কিন্তু সে রুচির স্বভাব সে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম নয় এবং সে ব্যাখ্যা তার জানার কথাও নয়।
এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য সচেতনভাবে প্রযোজক বা পরিচালক কী করতে চেয়েছেন তার চেয়ে দর্শকদের অবচেতনে ছবিটি কী মানে নিয়ে হাজির হচ্ছে তার একটা ব্যাখ্যা অনুসন্ধান করা। ছবির মধ্যে প্রযোজক-পরিচালকের চিন্তার প্রত্যক্ষ প্রতিফলন আছে, সেটা আমি আমার আলোচনার বিষয় করিনি। সেটা রাখা দরকার। কিন্তু বিষয় হিশেবে নিয়েছি দর্শকের অবচেতন।
বলা বাহুল্য অবচেতন সম্পর্কে আমরা স্বাভাবিক অবস্থায় কখনোই সচেতন থাকি না। যদি থাকতাম তাহলে তাকে অবচেতন বলা যেত না। তাহলে এ কথা বলাও বাহুল্য হবে না যে, প্রযোজক ও পরিচালক সচেতনভাবে এ ছবিটা তৈরি করেননি। কিন্তু যে কারণে তারা অবচেতনভাবে এইসব গভীরতর মাত্রাগুলো নিজেদের অজান্তে পেয়ে গিয়েছেন, সেটা ‘জনগণের রুচি’র কথা ভেবে ছবি তৈরি করার কারণে। মধ্যবিত্তের ভাষায় যা ‘রিকশাওয়ালার রুচি’ নামে পরিচিত। সিধা কথায় ব্যবসায়িক ছবি করবার তাগিদ তাদেরকে অবচেতন ইশারার দিকে নিয়ে গিয়েছে। আমি একটি পত্রিকায় পড়েছি যে প্রযোজক বলেছেন, বেদের মেয়ে জোস্না তৈরি করেছি পুরোপুরি ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে। দেশের খেটে-খাওয়া মানুষকে আনন্দের খোরাক দিতে পেরেছি–এটা আমাদের সবচেয়ে বড় সফলতা।’ এই মন্তব্য আমার কাছে খুবই সৎ ও অর্থপূর্ণ মনে হয়েছে। ছবিটি যে ব্যবসা করবার জন্য তৈরি করা হয়েছে এই স্বীকারোক্তির সততা আমি প্রশংসা করি। ছবিটি মধ্যবিত্তকে মাথায় রেখে তৈরি হয়নি, যদি হতো তাহলে আর যাই হোক ব্যবসা হতো না।
আমি প্রায়ই আমার আর্ট ফিল্মের আন্দোলন করা বন্ধুদের মুখে শুনি ঢাকার প্রযোজক ও পরিচালক সবাই অশিক্ষিত, মূর্খ ও বিকৃত রুচিতে ব্যাধিগ্রস্ত। কোন রুচিটা তাঁদের রুচিতে বাধে সেটা তাদের আমি হাজার বার প্রশ্ন করেও উত্তর পাইনি। একটা কথাই তাঁরা খালি বলেন যে, এ সকল প্রযোজক-পরিচালকের উদ্দেশ্য কেবল ব্যবসা করা। বেদের মেয়ে জোস্নার প্রযোজক-পরিচালকরা বিকৃত রুচির প্রতিযোগিতায় তাহলে নিশ্চয়ই ফার্স্ট ক্লাস পাবেন। কারণ শুনেছি ইতোমধ্যেই ছবিটি নাকি পঞ্চাশ কোটি টাকা কামিয়েছে। আমি যেটা আসলে বুঝতে পারি না তা হলো পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে ব্যবসার উদ্দেশ্য ছাড়া সিনেমা তৈরি করা যায় কীভাবে? একদিকে অন্য ব্যবসায় টাকা কামিয়ে অন্যদিকে জনগণের রুচি নির্মাণের মহৎ কাজে লেগে পড়া যায়। কিন্তু তাহলে দু’রকম ধান্দা সামাল দেয়া লাগে, সেটা তো মুশকিলের। যারা শুধু ছবিই করতে চান, আর কোনো ধান্দা নয়, তারা দুই ধান্দার প্রস্তাবে গররাজি হবেন অবশ্যই। কী করা?
আমি মনে করি না পুঁজিতান্ত্রিক সিনেমার হাত থেকে রেহাই পেতে হলে ঢালাও ভাবে একে ‘বিকৃত’ বলে গাল দিলে নিস্তার পাওয়া যাবে। আমাদের সমাজে পুঁজিতান্ত্রিক রূপান্তরটা ঘটছে খুব বেশিদিন থেকে নয়। এই রূপান্তরের ফলে নতুন যে গ্রামীণ বুর্জোয়া শ্রেণী গড়ে উঠছে–র কৃষক চৈতন্য ও নারীবাদী অভিক্ষেপের প্রতি আমি দৃষ্টি ফেরাতে চেষ্টা করেছি–তার কথা যদি কণামাত্রও সঠিক হয় তাহলে আমি মনে করি এই শ্রেণীর ইচ্ছা আকাক্সক্ষা প্রত্যাশা মেটাবার দিকে নজর রেখে একটা শক্তিশালী সিনেমা আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব। বেদের মেয়ে জোস্নাতার একটা ইঙ্গিত মাত্র।
কিন্তু সেটা ইঙ্গিত কেবল। কারণ আমাদের আরো ভাবতে হবে। কিন্তু ভাবতে হবে ঘরে বসে নয়। ছবি তৈরি করতে করতে ভাবতে হবে। নতুন পুঁজিতান্ত্রিক রূপান্তরের ফলে যে নবতর চেতনার লক্ষণগুলো বেরিয়ে আসছে, তাকে যদি আমরা অকর্ষিত রেখে দেই তবে তা অচিরে বুর্জোয়া বিকৃতির পথ ধরবে। পক্ষান্তরে এক গণতান্ত্রিক ও নারীবাদী উপাদানগুলোর বিকাশের কাজটা যদি আমরা কর্তব্য আকারে গ্রহণ করি তাহলে আমাদের সমাজের পুঁজিতান্ত্রিক পর্যায়কে খুবই সংক্ষিপ্ত করে আনা যাবে বলে আমার বিশ্বাস। অন্তত এর নির্মম স্বেচ্ছাচারিতার ওপর লাগাম টেনে ধরবার মতো সাংস্কৃতিক জোরটা আমরা অর্জন করতে পারব এবং চিন্তার ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের যে বিকাশ না হলে পুঁজিতন্ত্রের বিলয় অসম্ভব তার কাজটা ত্বরান্বিত করতে পারব।
বেদের মেয়ে জোস্নার জনপ্রিয়তা এক নতুন গ্রামীণ কৃষক বুর্জোয়ার উপস্থিতি ঘোষণা করে এবং সঙ্গে সঙ্গে এই শ্রেণীর হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় যে নয়া চেতনা ও সংঘাতের জন্ম হচ্ছে ও হতে থাকবে তা এক নয়া শ্রেণী মেরুকরণের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। তবে তার ইতিবাচক পরিণতি নির্ভর করবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারার এই নতুন শ্রেণীর বৈপ্লবিক সম্ভাবনা সম্পর্কে উপলব্ধি ও তাকে নেতৃত্ব দানের ক্ষমতার ওপর। সন্দেহ নেই যে, গত দুই দশক ধরে আমাদের সমাজের–বিশেষত গ্রামীণ সমাজের বদল ঘটেছে দ্রুত বেগে। এই বদল যে নয়া গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার সৃষ্টি করছে তাকে অবচেতন থেকে সক্রিয় চেতনার স্তরে নিয়ে আসার জন্য প্রথমেই যা দরকার তা হলো জনগণের ভালো লাগা মন্দ লাগাকে মূল্য দিতে শেখা এবং কোনটা বিকৃতি আর কোনটা স্বাভাবিক এই বিচারে নামবার আগে নিজেদের অভ্যাস ও বদ্ধমূল ধারণাকে ক্রমাগত প্রশ্নের মুখে ফেলা।
বলা বাহুল্য, এই কাজটি প্রগতিশীল শ্রেণীর কাজ।
বইপত্রের হদিস
কার্ল মার্কস: Captial, tr. Ben Fowkes, Vintage Books, New York 1976
সিগমুন্ড ফ্রয়েড: Moses and Monotheism, London 1951
নরমান ও ব্রাউন: Loves Body, Vintage Books, New York, 1996.
*লেখাটি প্রথম প্রকাশ হয় প্রতিপক্ষে। এরপর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরে ছাপা হয়।