ফারুকী: স্রোতের বিপরীতে একজন
স্রোতের বিপরীতকে বাক্য সংকোচনে বলে ‘উজান। ‘উজানে নৌকো বাওয়া বেজায় মুশকিল। সবাই পারে না। যারা পারে তারা তো পারলই, যারা পারল না তাদের জন্য কেউ না কেউ বলে ‘কে আছো জোয়ান হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যৎ’। উজানে চলার শক্তি, সাহস নিয়ে যারা চলে প্রচলিত সমাজ তাদের ভালোমত গ্রহণ না-ও করতে পারে।
বাংলাদেশের সিনেমার পথচলায় মোস্তফা সরয়ার ফারুকী একাই আলাদা একটা স্রোত খুঁজে নিয়েছেন তাঁর প্রজন্মের সময়কে কেন্দ্র করে। তিনি সে সূত্রে উজানের নির্মাতা। তার সিনেমার ভাষা বা বলার ভঙ্গি আর পাঁচজন থেকে কীভাবে আলাদা করা যায় সেটা বিশ্লেষণ করতে একটু ভিন্নভাবে শুরু করা যাক।
সাহিত্যে যে কয়েকটি আন্দোলন বাঁক পরিবর্তন করেছিল তার মধ্যে ‘হাংরি আন্দোলন’ সবচেয়ে অ্যাফেক্টিভ ছিল। ষাটের দশকে মলয় রায় চৌধুরী, সমীর রায় চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার এই কবিগোষ্ঠীরা এ আন্দোলন শুরু করেছিলেন। ‘হাংরি’ শব্দটি তাঁরা গ্রহণ করেছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের কবি জিওফ্রে চসারের কবিতা থেকে। এর দর্শন ছিল ‘প্রচলিত নিয়মের বাইরে থেকে লোকজনকে কিছু বলা। লোকজন শব্দটা ব্যবহার করলাম সার্বিক অর্থে যেখানে লেখক, পাঠক, দর্শক, শ্রোতা সবাইকে ইনক্লুড করা সম্ভব। সবার কথা মাথায় রেখে প্রচলিত নিয়মের বাইরে লেখালেখি করাই ছিল লক্ষ্য। Establishment- এর বিভিন্ন ক্ষেত্রকে নাড়িয়ে দিতেই এ আন্দোলনের শিল্পী বা যোদ্ধারা সজাগ ছিলেন। সংস্কৃতি সরলরেখায় চলে না, তার ডালপালা আছে তাই তার গঠন ভিন্ন হবে এবং ভিন্ন ভিন্ন দিকে যাবেই। সেগুলোকে দেখানোই এর কাজ। তো ‘হাংরি আন্দোলন’-এর কথা বলে সেই কবিগোষ্ঠীর যে প্রচলিত স্রোতের বিপরীতে কাজের সাধনা সেটা শিল্পের ক্ষুধা থেকে এসেছিল ভেরিয়েশন দেবার জন্য। এমন একটা প্রচেষ্টায় সিনেমার ক্ষেত্রে ভেরিয়েশন আনতে ফারুকী তার সিনেমা আন্দোলন থেকে শুরু করেছিলেন যেটা চলছে এখনও। ফারুকীর কাজ নিয়ে অনেক ‘স্টেরিওটাইপ’ সমালোচনা চালু আছে। যেমন – উনি সব ক্লাসের জন্য সিনেমা বানান না, বাণিজ্যিক সিনেমা উনি বোঝেন না, সাইনভিত্তিক একঘেয়ে কাজ বেশি করেন ইত্যাদি। সমালেচনা ফারুকী যে হজম করেন না তা নয়। করেন। তবে তার সমালোচকদের জবাব দেবার জন্য তিনি উজানের পথে আরো বেশি হাঁটেন। যাই হোক যা বলছিলাম, ফারুকীর সিনেমার সেই স্রোতের বিপরীতে ‘cinematic language’ কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার কিছু কথা বলছি…
১. ব্যাচেলর ( ২০০৩) মনে আছে এ সিনেমা রিলিজের সময় একটা দারুণ সমাগম ছিল।তখন স্যাটেলাইট চ্যানেল কম ছিল। এটিএন বাংলা, চ্যানেল আইতে দেখানো হত প্রচারণা।থানা শহরের সিনেমাহলে না লাগাতে সৈয়দপুরে গিয়ে দেখেছিলাম। তখন তো অত বুঝতাম না।রিলেশনশিপ যে কত বিচিত্র সেটা ঐ সময়ের ওপর থিসিস করে ফারুকী সাহসের সাথে দেখিয়েছেন। ‘polygamous relationship’ কে একই সমান্তরালে তিনি দেখান যেটা তখনকার তরুণদের মধ্যে খুব আগ্রহ তৈরি করেছিল। স্কুল, কলেজে আলোচনা হত সিনেমাটি নিয়ে। সিনেমায় অপি করিমের রোলটি ফোকাসিং ছিল। সম্পর্ক একটা শেষ না করে আর একটাতে যাওয়ার যে প্রবণতা এবং তার মাধ্যেমে পারিপার্শ্বিক যে প্রতিক্রিয়া সেটাকে অনবদ্য করেছেন ফারুকী। ক্রাইসিসগুলো একসাথে অনেকের জীবনে ঘটছে যেখানে ‘অপি-রুবেল, অপি-ফেরদৌস, ফেরদৌস-শাবনূর, হাসান মাসুদ-জয়া, ফরীদি-ইলোরা’ এরা আছে। এছাড়া মারজুক রাসেল, মৌটুসি তাদের গল্পে অালাদা অালাদা মোড় ছিল।এভাবে অনেক প্লট জড়ো করে ‘crisis of relationship’ দেখান। সেই বহুগামী সম্পর্ক নিয়ে অাজকের রেদওয়ান রনি ‘আইসক্রিম’ বানালেন অসাধারণভাবে যার শুরুটা ফারুকীর করা।সংস্কৃতি সরলরেখায় থাকেনি। তাই প্রেম নানাদিকে মোড় নিয়ে বয়সকে ডিঙিয়ে গেছে।
২. মেড ইন বাংলাদেশ ( ২০০৭) এ সিনেমা আমার চোখে একটা মাস্টারপিস। বিপ্লব করার চেতনা যদি ভেতরে থেকে থাকে তবে সেটা এভাবেই করা উচিত। সাহস লাগে বা বলা ভালো কলিজা লাগে।যেখানে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক সমস্যাকে সরাসরি ব্যঙ্গ করে বিদ্রোহ করা হচ্ছে। বিদ্রোহের মশাল ছিল জাহিদ হাসানের হাতে। একজন বেকার তার জীবনের মধ্যম পর্যায়ে এসে যেভাবে নিজেকে ঝুঁকির মুখে রেখে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের জিম্মি করে তাদের দুর্নীতির খোলস তুলে ধরলেন সেটা প্রচলিত সমাজ মানতে চায় না। প্রচলিত সমাজ চায় জবাবদিহিতা ছাড়াই সব চলবে। ফারুকী বলতে চাইলেন এ প্রশাসেনর শোষণের বিরুদ্ধে বিপ্লব করতে সাধারণ জনগণই হতে পারে প্রধান শক্তি বা চেতনা।
৩. থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার (২০০৯) প্রচলিত সমাজে মেয়েদের সামাজিক বাস্তবতা এবং সেখানে নিজের জায়গা থেকে প্রতিবাদ করাই স্রোতকে নাড়িয়ে দিল এ সিনেমা। ঐশ্বরিয়ার ‘প্রভেকড’ বা ‘ব্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ সিনেমাগুলোর সাথে এ সিনেমার প্রতিবাদের মধ্যে মিল পাওয়া যায়। মধ্যরাতে বাড়ি থেকে বের হওয়া তিশা অন্ধকার গলির মধ্য দিয়ে যখন যায় ফোনে কথা বলা ছেলেটার সাথে তিশার সংলাপ বিনিময়ে মিলে যায় সামাজিক প্রতিবাদটি –
– আপনি একা একটা মেয়ে এত রাতে এখানে কি করতেছেন? – আপনি একা একটা ছেলে এতরাতে এখানে কি করতেছেন?
সমাজের বৈষম্য বোঝার জন্য আর বড় কোনো ক্লু দরকার পড়ে না। তিশার সামাজিক অস্তিত্ব রক্ষায় তাই পরের দিকটিতে লিভ টুগেদারকে সাপোর্ট করার ঘটনা-ও সমাজ মানে না। তাই সিনেমা শেষে দর্শক ফারুকীকে প্রশ্ন করে ‘আপনি লিভ টুগেদার সাপোর্ট করলেন?’
৪. টেলিভিশন (২০১২) এ সিনেমা সরাসরি প্রচলিত সমাজকে অাঙুল দিয়ে দেখানো একটা শূল। রুমী যে ক্যারেক্টারটি করেছেন সেখানে ধর্মকে শ্রদ্ধার সাথে তুলে এনে একইসাথে সংস্কারকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। তাই টেলিভিশন দেখার অপরাধে যে তিশাকে ভরা উঠোনে সবার সামনে তওবা করায় সেই রুমী শেষ পর্যন্ত ট্র্যাজেডিতে পড়ে টেলিভিশনে হজ্ব অনুষ্ঠান দেখে নিজের মনের কথা স্রষ্টাকে বললেন। এটা খুব সাহসী কাজ। যে সমাজকে টেলিভিশন না দেখার অনুশাসনে বাঁধলেন শেষ পর্যন্ত সেটাই তার জন্য সান্ত্বনা হলো। এটা দেখানো কোনো কোনো সাধারণ কাজ নয়।
৫. পিঁপড়াবিদ্যা (২০১৪) অনেক অভিযোগ, সমালোচনা অাছে এ সিনেমা নিয়ে যার মূলকথা ছিল, এটা কোনো সিনেমা হয়নি।কিন্তু সত্য এটাই তরতর করে বেড়ে ওঠা উচ্চবিত্তের জীবনে শিক্ষিত বা অর্ধ-শিক্ষিত প্রজন্ম অনেকভাবেই অনুপ্রবেশ করে। সেটা এভাবেই ঘটে এবং যৌনতার দিকে ধাবিত হয়, বিছানা পর্যন্ত গড়ায় এ কালচার। এর উপাদান থাকে সেলসম্যান, ড্রাইভার এদের মতো ব্যক্তিত্বরা। এ বিদ্যা ধীরে ধীরে এগোয়।ড্রইংরুম থেকে বেডরুম।
৬. ডুব (২০১৭) এটা নিয়েও অনেক সমালোচনা হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের বায়োপিক কিনা এ নিয়ে বিস্তর সমালোচনার পর মুক্তি পেয়েছে। এ সিনেমাও অনেকেরই ভালো লাগেনি। তবে ইরফান খানের স্পেশালিটি এ সিনেমাতে ভালোভাবেই ছিল সাথে তিশা, রোকেয়া প্রাচীরাও চ্যালেঞ্জের সাথে অভিনয় করে গেছে তাঁর সাথে। ইরফান খানের মতো একজন বিরল প্রতিভা আমাদের দেশের সিনেমায় কাজ করেছে এবং ফারুকীর হাত ধরে এটাও একটা অর্জন। ছবির নির্মাণে ফারুকীর বৈশিষ্ট্য ঠিকভাবেই ছিল।
‘শনিবার বিকেল‘ সেন্সর বোর্ডে আটকে আছে দীর্ঘ সময় ধরে। এ ছবির ভবিষ্যত এখনো অজানা। নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর মতো আরেক বিরল প্রতিভার সাথে ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’ সিনেমার নামও অনেকের জানা। এ সিনেমার কতদূর কাজ হয়েছে তেমন ডিটেইল কিছু জানা যায়নি। ‘ডুবোশহর’ নামে আরেকটি সিনেমাও হবার কথা। ফারুকীর ফিল্মোগ্রাফি এখন পর্যন্ত এই।
ফারুকী সমালোচনার উর্ধ্বে নন। তবে মনে রাখতে হবে সব নির্মাতা সব সিনেমা বানান না। ফারুকী-রও ‘class wise’ দর্শক আছে এবং তারা তাঁর সিনেমা দেখে যায়, যাবে। কাঁটাছেড়া করে, করবে। আর এর মধ্য দিয়েই ফারুকী থেকে যাবেন তার নিজের ট্র্যাকে। স্রোতের বিপরীতের একজন হয়ে।
আর, অনেক কথার পরেও মানতেই হবে ‘ফারুকী একজনই।
সম্পাদনা: ২ মে ২০২১