ফু্ল প্যাকেজ দিতির গল্প
‘যদি কোনোদিন দেখি
নেই তুমি সাথে
তুমি ছাড়া থাকব না
এই দুনিয়াতে’
‘প্রেমের প্রতিদান’ সিনেমার এ প্রিয় গান অাজকের সময়টাতে সত্য।অাজ দিতি ও সোহেল চৌধুরী কেউই নেই অামাদের মাঝে।তাঁদের কাজ রয়ে গেছে, থাকবে।প্রতিদিনই শোনা হয় তবে এবারেরটা ভিন্নরকম।দিতি চলে গেছে আর তাঁর সমৃদ্ধ ক্যারিয়ার বলে দিচ্ছে কীভাবে দিতি এদেশের মানুষের মনে অমর হয়ে রবে চিরকাল।হ্যাঁ, বলছি সেই ফুল প্যাকেজ দিতির গল্প।
আ হা হা, পাকিজা
—————————-
পাকিজা গার্ডেন প্রিন্ট শাড়ি-র বিজ্ঞাপন সেই যে শুক্রবারে বিটিভির ৩:২০ এর পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবির ফাঁকে চলত এ বিজ্ঞাপন। দিতির গ্ল্যামার তখন থেকেই দেখার মত।
নতুন মুখ থেকে লিজেন্ড
———————————–
১৯৮৬ সালে এফডিসিভিত্তিক প্রতিভা অন্বেষণ ‘নতুন মুখের সন্ধানে’-র মাধ্যমে দিতি ও সোহেল চৌধুরী দুজনই অাসে। দিতি সেই নতুন মুখ থেকে পরবর্তীকালে লিজেন্ড হয়ে গেল।
প্রথম অাধুনিক
———————–
দিতি দেশের সিনেমায় তার সময়ের প্রথম আধুনিক নায়িকা।তাঁর সিনেমার কস্টিউম সিলেকশন অাধুনিক ছিল তাঁর সময়ের থেকে। তার পোশাকের উজ্জ্বল বিষয়টি তার সৌন্দর্যের সাথে মিশে আলাদা সৌন্দর্য তৈরি করে। ‘আসামী গ্রেফতার’ সিনেমাতে ‘আমার এ গান তোমারই জন্য’ এ গানটিতে খোপায় ফুলের সাথে লাল ফ্রকে দিতিকে সাক্ষাৎ পরী মনে হয়। ঠিক যেমন ‘অজানা শত্রু’ সিনেমায় ‘তোমার সাথে কিছু কথা আছে’ গানটিতেও দিতির কস্টিউম চোখ ধাঁধানো। স্টারডমে আধুনিকের বৈশিষ্ট্য অাছে দিতির।নেপালে একবার বেড়াতে গিয়েছিল দিতি-সোহেল। সেখানে সাংবাদিকরা জানতে পারে বাংলাদেশ থেকে সিনেমার স্টার অাসছে।সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিল। সে ছবিটা ছাপা হয়েছিল নব্বই দশকের পত্রিকায়। দিতি সেখানেও অসাধারণ লুকে ছিল।
ভিন্ন দিতি
————–
১. দিতির ভিন্নধর্মী সিনেমা ‘প্রেমের প্রতিদান’। সিনেমাটি চমকে দেয় দর্শকদের।এক সিনেমায় তিন রকমের ইমেজ আছে।ইমেজটা হল সিনেমায় দিতি সাধারণ গোটআপ, ওয়েস্টার্ন এবং শাড়ি পরা তিন ধরনের লুকে অভিনয় করেছে।তিনটাই পারফেক্ট।তিন লুকে তার ক্যারেক্টারাইজেশন আছে।এগুলো মূলত বাণিজ্যিক সিনেমার এক ধরনের এক্সপেরিমেন্ট যেখানে অভিনেত্রী নিজেকে নানাভাবে মেলে ধরতে পারে।দিতি তা পেরেছে।
২. নায়িকা-ভিলেন কম্বিনেশনের গান খুব কম আমাদের সিনেমায়।হুমায়ুন ফরীদি-মৌসুমীর ‘বিশ্বপ্রেমিক’ সিনেমার ‘তোমরা কাউকে বোলো না’- গানটি যেমন ইতিহাস পাশাপাশি ফরীদি-দিতির ‘মানুষ’ সিনেমার ‘আজ পাশা খেলব রে শাম’- গানটিও ভীষণ জনপ্রিয়। নায়িকা-ভিলেন কম্বিনেশনে দিতি তাই জায়গা করে নিয়েছে।গানে দুজনের রসায়ন চমৎকার।
৩. দিতি তার অপেক্ষাকৃত অনেক সিনিয়র অভিনেতার সাথে অভিনয় করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছিল ‘স্বামী স্ত্রী’ সিনেমায়।এ সিনেমায় শাবানার মতো মহাতারকার পাশাপাশি দিতির অভিনয়ও অসাধারণ ছিল বিশেষ করে অন্ধের অভিনয়।
৪. নিজের সময়ের থেকে অাধুনিক দিতির কস্টিউম সিলেকশন উঁচুমানের ছিল। তাঁর কস্টিউম সিলেকশনের নমুনার জন্য ফ্যাশনসচেতন কিছু পিক পাওয়া যায় ইন্টারনেটে। ওয়েস্টার্ন কালচারের ফ্যাশন যেভাবে ববিতা, অণ্জনা তাদের মাধ্যমে এসেছিল সেটা দিতির মধ্যেও ছিল। এছাড়া সিনেমার মধ্যেও সেটা অাছে। যেমন-‘প্রেমের প্রতিদান, অজানা শত্রু, অাসামী গ্রেফতার, সমর, লেডি ইন্সপেক্টর, ভাইবন্ধু, পাপী শত্রু’ এ সিনেমাগুলো খেয়াল করলে জানা যায়। অাশির দশকের বিখ্যাত পত্রিকা ‘চিত্রালী’-তে ইলিয়াস কাঞ্চন-দিতি জুটিকে নিয়ে কভার স্টোরি হয়েছিল এবং সেখানে তাদের দুজনকে সময়ের সেরা সন্তান বলা হয়েছে। দিতির অবস্থান কতটা উঁচুতে ছিল ভাবুন তো!
দিতির ভেরিয়েশন
—————————
বিজ্ঞাপন, নাটক থেকে সিনেমা। প্রথম সিনেমা ‘অামিই ওস্তাদ।’ দিতির সিনেমার ভেরিয়েশন প্রচুর। অনেক ক্যাটাগরিতে নিজেকে সূক্ষ্মভাবে প্রমাণ করেছে। গ্রাম-শহর দু’ধরনের ক্যাটাগরিতেই তার জুড়ি মেলা ভার।
চিরকালীন গ্রামীণ সংস্কৃতিতে ‘অামি এক অমানুষ’ সিনেমার দিতি তাঁর শহুরে সংস্কৃতির সিনেমা থেকে সম্পূর্ণ অালাদা। ‘অজানা শত্রু’ সিনেমাতেও গ্রামের মেয়ের চরিত্রে ইলিয়াস কাঞ্চনের বিপরীতে নিজের সহজাত অভিনয়প্রতিভা দেখিয়েছে। ফ্যামিলি ড্রামায় দিতি পেয়েছিল জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ‘স্বামী-স্ত্রী’ সিনেমাতে।স্বামীভক্তি এবং অন্ধ চরিত্রে অসাধারণ পারফর্ম করেছে।অারো অাছে ‘হিংসার অাগুন, সৎ মানুষ, সুখের ঘরে দুখের অাগুন’-এর মতো দুর্দান্ত ফ্যামিলি ড্রামা।মিউজিক্যাল সিনেমা ‘বেঈমানী, প্রেমের প্রতিদান, দুই জীবন, ভাইবন্ধু’ এগুলো অালাদাভাবে গুরুত্বপূর্ণ।অ্যাকশন সিনেমায় ‘প্রিয়শত্রু, লেডি ইন্সপেক্টর, অাজকের হাঙ্গামা, খুনের বদলা, কালিয়া’ সম্পূর্ণ অন্যরকম দিতিকে চেনায়।’অাজকের হাঙ্গামা’-তে শাবনাজের সাথে মিলে গুণ্ডাপাণ্ডা শায়েস্তা করার অভিনয় অনবদ্য।ফোক সিনেমা ‘হীরামতি’ কালজয়ী।এ সিনেমার পরিচালক অামজাদ হোসেন নিজে দিতির অভিনয়ে মুগ্ধ ছিলেন।সিনিয়র অার্টিস্টদের সাথেও দিতি নিজের সক্ষমতা প্রমাণ করেছে।অালমগীরের সাথে ‘স্বামী-স্ত্রী’ জসিমের সাথে ‘রাজা গুণ্ডা’ এ সিনেমাগুলো তারই উদাহরণ।ক্যারিয়ারের শেষদিকে দিতি মায়ের চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে অালাদা পারফেকশনে প্রমাণ করেছে যেমন – ‘অাকাশছোঁয়া ভালোবাসা, পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী, অাইসক্রিম’।কমেডি ভূমিকায় ছিল ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’-এ।’কাল সকালে’ সিনেমায় শাবনূরকে পাল্টে দিতে দিতির ভূমিকা স্মরণীয়।সবার সাথে ভালো সম্পর্ক রেখে সামাজিকতার দিক থেকেও দিতির তুলনা দিতি।ইন্ডাস্ট্রিতে ছোট-বড় সবার প্রিয় মুখ ছিল দিতি।
জুটির দিতি
—————–
দিতি-সোহেল চৌধুরী, ইলিয়াস কাঞ্চন-দিতি অবধারিতভাবেই ঢালিউডে কালজয়ী।এ দুটি জুটির সিনেমা, গান জনপ্রিয় এবং অনুসরণীয়।
গানের দিতি
—————–
দিতির কালজয়ী গানের অভাব নেই।স্মৃতিতে অাসে এগুলো-
* এ সুখের নেই কোনো সীমানা – স্বামী-স্ত্রী
* ভালোবাসা যত বড় – চরম অাঘাত
* কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো – উসিলা
* তুমি অাজকে যাও বন্ধু – সৎ মানুষ
* ও মেমসাব – সৎ মানুষ
* যদি কোনোদিন দেখি – প্রেমের প্রতিদান
* অাজ বড় সুখে দুটি চোখে – বেঈমানী
* অামি ভালোবাসার সুখে – বেঈমানী
* চিঠি কেন অাসে না – প্রিয়শত্রু
* তোমাকে অামার কিছু বলার ছিল – প্রিয়শত্রু
* স্বর্ণালী সঙ্গিনী গো – হিংসার অাগুন
* যোগী ভিক্ষা লও – হীরামতি
* অামি হৃদয় চিরিয়া দেখাব – হীরামতি
* তোমার সাথে কিছু কথা অাছে – অজানা শত্রু
* অামার এ গান তোমারই জন্য – অাসামী গ্রেফতার
* তুমি অাজ কথা দিয়েছ – দুই জীবন
* অামি একদিন তোমায় না দেখিলে – দুই জীবন
* চিরদিন এ দুনিয়ায় হয়েছে হায় প্রেমেরই জয় – অাত্মবিশ্বাস
* তুমি একটা ধোঁকাবাজ – অাত্মবিশ্বাস
* এইদিন সেইদিন এলো ফিরে – স্নেহের প্রতিদান
* তোমার জন্মদিন – সুখের ঘরে দুখের অাগুন
* অাজকে মাফ কালকে মাফ – ভাইবন্ধু
* অাজ পাশা খেলব রে শাম – মানুষ
* দাঁড়াও বন্ধু বহুদিনে – কাল সকালে
এছাড়া নিজ কণ্ঠে কিছু গান করেছে দিতি তার মধ্যে ‘মাগো তুমি বিনে’ গানটি উল্লেখযোগ্য।
দিতি বাংলাদেশের মেইনস্ট্রিম কমার্শিয়াল এবং অফট্র্যাক সিনেমার অন্যতম প্রধান জনপ্রিয় অভিনেত্রী। তাঁর ক্যারিয়ার বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং বৈচিত্র্য দিয়েই সুপারস্টার। তাঁর সিনেমা থেকে উঠতি প্রজন্ম শেখার মতো অনেককিছু পাবে। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।