Select Page

বক্স অফিস কড়চা : কোনো মুভিকে হিট বা ফ্লপ রায়ের প্রক্রিয়া

বক্স অফিস কড়চা : কোনো মুভিকে হিট বা ফ্লপ রায়ের প্রক্রিয়া

box-office-what-is-bangladeshi-film

যেকোন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিই চলে সেই ইন্ডাস্ট্রিতে মুক্তি পাওয়া মুভিগুলোর আয় থেকে। এই আয়ের একটা বড় অংশ আসে বাণিজ্যিক বা মাসালা মুভি থেকে। হলিউডে যেমন ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস সিরিজ বা এভেঞ্জার্স এর মুভিগুলো আবার বলিউডে যেমন কিক বা দাবাং এর মতো মুভি। অফ ট্রাকের মুভিগুলোও যে ইনকাম করেনা তা নয় তবে তার সংখ্যা খুব কম। মাসালা ছবিগুলোকে অনেকেই গোনায় ধরতে না চাইলেও এসব মুভি ছাড়া ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি অচল। কারণ এগুলো মাস অডিয়েন্স পছন্দ করে বলেই বানানো হয়। আর বেশি ইনকাম হয় মাস অডিয়েন্স টার্গেট করে বানানো ছবি থেকেই।আর মুভির ইনকাম থেকেই রায় দেওয়া হয় মুভিটা হিট নাকি ফ্লপ। হিট বা ফ্লপ ভারডিক্ট দেওয়া হয় সাধারণত মুভির বক্স অফিস কালেকশন দেখে।তবে শুধু বক্স অফিসে অনেক আয় হলেই যে একটা মুভি হিট হবে তার নিশ্চয়তা নেই। বক্স অফিস কালেকশনের পাশাপাশি হিট হওয়ার জন্য আরো কিছু জিনিস প্রভাবক হিসেবে কাজ করে সেটাই বিস্তারিত আলোচনা করবো এই পোস্টে। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আমাদের দেশে বক্স অফিস বলে কোন জিনিস নেই। তাই কোন মুভি হিট না ফ্লপ বা কত আয় করলো সেটার ঠিক ধারণা পাওয়া মুশকিল। পত্র-পত্রিকার নিউজ, নির্মাতাদের মুখের কথা আর ফেসবুকের হিট দেখেই আমাদের ধরে নিতে হয় মুভি হিট না ফ্লপ। তাই বাধ্য হয়ে আমাকে পাশের দেশের বক্স অফিস ভারডিক্ট এর প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে হচ্ছে। যেহেতু আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাশের দেশের জিনিস নকল করা হয় এটাও পাশের দেশের মতোই হওয়ার কথা।আমার আসলে আমাদের ছবির ক্ষেত্রে কিভাবে এটা ফলো করা হয় তার ধারণা নেই। কেউ জেনে থাকলে জানাবেন। যাই হোক এখন আমি আমার আলোচনায় ফিরে যাচ্ছি।

বক্স অফিস বলতে সাধারণত বুঝায় যে স্থানে সিনেমার টিকিট বিক্রি করা হয়। তবে বক্সঅফিস দিয়ে সাধারণত কোন মুভির বাণিজ্যিক অবস্থা ব্যাখ্যা করা হয়। আর এই বাণিজ্যিক দিক বিশ্লেষণ করেই রায় দেওয়া হয় মুভি হিট নাকি ফ্লপ। একটা সিনেমার ইনকাম হয় সাধারণত হলগুলোতে এর টিকিট বিক্রি থেকে। এছাড়া আরো কিছু স্বত্ত্ব বিক্রি করেও আয় করতে পারে।

এখন একটা মুভিকে ফ্লপ বলা হয় সাধারণত এর বাজেট বা নির্মাণ খরচ তুলে আনতে না পারলে। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় একটা মুভি অনেক ইনকাম করলেও একে ফ্লপ ভারডিক্ট দেওয়া হয়। যেমন শাহরুখ খানের ফ্যান মুভির নির্মাণ খরচ ছিল ৮৫ কোটি রুপি আর প্রচারণায় খরচ ছিল আরো ২০ কোটি অর্থাৎ মোট খরচ ১০৫ কোটি।মুভিটি ভারতে আয় করে ১১৬ কোটি(এই অংক নিয়ে একটু বিতর্ক আছে। এটা সম্ভবত ৮৪ কোটি হবে।তবে আমার পোস্টের ফোকাস অংকের চেয়ে হিট ফ্লপ হওয়ার প্রসেসের উপর।তাই এটা ইগনোর করাই ভালো।) আর ভারতের বাইরে আরো ৬৮ কোটি মোট ১৮৪ কোটি। কিন্তু এর ভারডিক্ট ছিল ফ্লপ।কেন?তাহলে হিট হতে হলে কত আয় করা জরুরি? এটা বুঝতে হলে আগে কিছু জিনিস ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।

প্রযোজক- প্রযোজক হচ্ছেন সেই ব্যাক্তি যিনি মুভি নির্মাণে খরচ করেন। বলিউডের কিছু নামকরা প্রযোজক হচ্ছেন করণ জোহর, রাকেশ রোশন, ফারহান আখতার, ভূষন কুমার প্রমুখ। প্রযোজক কোন ব্যাক্তিও হতে পারেন আবার কোন প্রোডাকশন হাউজও হতে পারে যেমন ইয়াশ রাজ ফিল্মস।

ডিস্ট্রিবিউটার-এখন মুভি শুধু বানিয়ে বসে থাকলে হবেনা  একে হল পর্যন্ত নিয়ে দর্শকদের দেখাতে হবে। প্রযোজকরা সাধারণত তাদের ছবিগুলোকে বিভিন্ন করপোরেট হাউজ বা ইনডিভিজুয়াল ডিস্ট্রিবিউটরদের কাছে বিক্রি করেন। কিছু বড় ডিস্ট্রিবিউটর কোম্পানী হচ্ছে Yash Raj Films,Eros International,Reliance Entertainment etc.ডিস্ট্রিবিউটররা আবার বিভিন্ন অঞ্চলের সাব-ডিস্ট্রিবিউটরদের কাছে ছবি বিক্রি করেন।আবার সাব-ডিস্ট্রিবিউটররা হল মালিকদের কাছে বিক্রি করেন। হল মালিকরা তখন তাদের হলে মুভি চালিয়ে ব্যাবসা করেন। এখন এই হলের ব্যাবসাতে থাকে ডিস্ট্রিবিউটর আর হল মালিকদের পার্সেন্টেজ। তারা যদি তাদের বিনিয়োগ তুলে আনতে সক্ষম হয় তবেই মুভিকে হিট বলা হয়।প্রযোজকরা মুভি বানাতে যে খরচ করেন সাধারণত তার চেয়ে বেশি দামে ডিস্ট্রিবিউটরদের কাছে বিক্রি করে দেন সেফ জোনে থাকতে যাতে মুভি ভালো ব্যাবসা না করলেও তার পকেট ঠিক থাকে। জিনিসটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করলে বুঝতে সুবিধা হবে।

সালমান খানের এখন বলিউডে এত রাজত্বের কারণ তার মুভিগুলো থেকে শুধু প্রযোজকরাই নন ডিস্ট্রিবিউটর হল মালিক সবাইই লাভের মুখ দেখছেন। কিন্তু এতসব মুভির মাঝে তার জয় হো মুভিটা এই জায়গায় মার খেয়ে যায়।জয় হোর প্রযোজক সোহেল খানের মুভি নির্মানে ব্যয় ছিল ৫০ কোটি।তিনি Eros International এর কাছে ৯২ কোটিতে মুভিটি বিক্রি করেন হলে প্রদর্শনের জন্য। এছাড়া সম্প্রচার স্বত্ত্ব আর মিউজিক রাইটস থেকে আরো ৫৭ কোটি আয় করেন। তার মোট আয় ৯২+৫৭=১৪৯ কোটি।অর্থাৎ প্রযোজক হিসেবে তিনি ১৪৯-৫০=৯৯ কোটি রুপি লাভ করেছেন।

অন্যদিকে Eros International ৯২ কোটিতে মুভি কিনে প্রচারণার পেছনে ব্যয় করেছিল আরো ১৫ কোটি রুপি। তাহলে মুভি বানাতে ৫০ কোটি হলেও তাদের খরচ গিয়ে দাঁড়ায় ১০৭ কোটিতে। এখন তাদের লাভের মুখ দেখতে হলে তাদের বিনিয়োগ ১০৭ কোটির বেশি ফেরত আসতে হবে।এখন তাদের কাছে এত আসতে হলে ছবির আয় অন্তত ২০০ কোটি+ হতে হবে। কারণ এখানে হল মালিকদেরও শেয়ার থাকে। এখন জয় হোর ডমেস্টিকে লাইফটাইম কালেকশন ছিল ১১৩ কোটি। ভারতের বাইরে আরো ৪০ কোটি। ৫০ কোটির মুভি ১১৩ কোটি ইনকাম অনেক ভালো হলেও ডিস্ট্রিবিউটরদের জন্য সেটা যথেষ্ট ছিলনা। যে কারণে ডিস্ট্রিবিউটর Eros এর কাছে ফেরত আসে মাত্র ৯০ কোটি। অর্থাৎ তাদের ১৭ কোটি রুপি লস হয়েছে। জয় হোর বক্স অফিস ভারডিক্ট সেমিহিট হলেও ডিস্ট্রিবিউটরদের লস হওয়ায় এটাকে হিট মুভি বলা যায় না। যদিও প্রযোজক অনেক বড় লাভ করেছেন।

এখন দেখি ফ্যান মুভি কেন ফ্লপ হলো।ফ্যান এর প্রযোজক ছিল ইয়াশ রাজ ফিল্মস। প্রচারণাসহ YRF এর নির্মাণ খরচ আগেই বলেছি ১০৫ কোটি রুপি। এখন মিনিমাম  ১০৫ কোটি ফেরত আসতে হলে জয় হোর মতোই ২০০ কোটির উপর ব্যবসা করতে হতো। কিন্তু ভারত এবং ভারতের বাইরে মিলিয়ে ছবিটি ১৮৪ কোটি পর্যন্ত আয় করায় মুভিটি ফ্লপ। জয় হোর প্রযোজক ডিস্ট্রিবিউটরদের কাছে বিক্রি করে তাও কিছু কামিয়েছিলেন কিন্তু এখানে সে সুযোগ ছিলনা কারণ YRF প্রযোজনার পাশাপাশি ডিস্ট্রিবিউশনেও ছিল।

গ্রস কালেকশন আর নেট কালেকশন

হিট ফ্লপ নিয়ে বলার আগে গ্রস কালেকশন আর নেট কালেকশন নিয়ে আলোচনা করাও জরুরি। গ্রস কালেকশন হচ্ছে মুভি বক্স অফিসে যত আয় করে সেটা। এখন আয়ের কিছু পার্সেন্ট সরকারকে এনটারটেনমেন্ট ট্যাক্স হিসেবে দেওয়া লাগে। সেই ট্যাক্স বাদ দিলে যা থাকে সেটা নেট কালেকশন। উপরে যে কালেকশনগুলোর কথা বললাম সবই গ্রস কালেকশন। এই ট্যাক্স দিয়ে থাকে প্রডিউসার/ডিস্ট্রিবিউটররা।

ফ্লপ

যখন ডিস্ট্রিবিউটরদের ইনভেস্টমেন্ট ফেরত আসতে পারেনা তখন একে ফ্লপ মুভি বলা হয়। উপরের উদাহরণ দেখে বিষয়টা বুঝেছেন আশা করি।

এভারেজ

যখন কোনরকম ডিস্ট্রিবিউটরের টাকা ফেরত আসে তখন একে বলা হয় এভারেজ। অর্থাৎ ডিস্ট্রিবিউটর যত খরচ করেছেন তার সমান বা খুব বেশি ফেরত পাননি।

কমিশন আর্নার এবং ওভারফ্লো

যখন কোন মুভি ডিস্ট্রিবিউটরের বিনিয়োগের ২৫% এর বেশি আয় করে তখন সেটাকে কমিশন মার্ক বলা হয়। আর কমিশন মার্ক ক্রস করলে সেখানে প্রযোজকদের একটা শেয়ার থাকে। প্রডিউসার-ডিস্ট্রিবিউটর শেয়ার সাধারণত ৫০-৫০ হয়। যেমন কোন ডিস্ট্রিবিউটরের খরচ ১০০ কোটি হলে তিনি ১২৫ কোটির পর যত বেশি ফেরত পাবেন তার ৫০% প্রযোজককে দিতে হবে। তিনি যদি ১৭৫ কোটি ফেরত পান তাহলে কমিশন মার্ক ১২৫ এর চেয়ে ৫০ কোটি বেশি ফেরত পেয়েছেন। এখন তাকে ৫০ কোটির অর্ধেক মানে ২৫ কোটি প্রযোজককে দিতে হবে।

সেমিহিট, হিট, সুপার হিট

যখন ডিস্ট্রিবিউটরের বিনিয়োগের দ্বিগুণ ফেরত আসে তখন একে সেমিহিট বলা হয়। তখন প্রযোজক ডিস্ট্রিবিউটরের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা পান। যখন দ্বিগুণের বেশি হয় তখনই ভারডিক্ট হয় হিট। আর যখন দ্বিগুণের অনেক বেশি যেমন ২.৫ গুণ থেকে ৩ গুণ ফেরত আসে তখন বলা হয় সুপার হিট মুভি।

ব্লকবাস্টার, অলটাইম ব্লকবাস্টার

যখন ডিস্ট্রিবিউটরের বিনিয়োগের তিন গুণ ফেরত আসে তখন সেটা ব্লকবাস্টার। আর তিন গুণের বেশি হলে অলটাইম ব্লকবাস্টার।

তাই দেখা যাচ্ছে মুভির বাজেট বা নির্মাণ ব্যায়ের চেয়ে ডিস্ট্রিবিউটরের খরচই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মুভি হিট বা ফ্লপ হওয়ার জন্য। এজন্যই দেখা যাচ্ছে কোন মুভি ১০০ কোটি+ ইনকাম করেও ফ্লপ আবার কোন মুভি ৫০-৬০ কোটি ইনকাম করেই হিট। অনেকের আবার ধারণা মুভি যত বেশি স্ক্রিনে রিলিজ হবে তত বেশি হিট হবে। এই ধারণাও ভুল।সম্প্রতি রুস্তম আর মহেঞ্জোদারো মুভি দুইটি একইসাথে রিলিজ হয়েছিল। ভারতে রুস্তম রিলিজ হয়েছিল ২৩০০ স্ক্রিনে আর মহেঞ্জোদারো ২৭০০ স্ক্রিনে। রুস্তম হয়েছে সুপার হিট আর মহেঞ্জোদারো বক্স অফিস ডিজাস্টার।

পোস্টটা লেখা বক্স অফিস কালেকশন নিয়ে আমার নিজের কিছু কনফিউশন থাকার কারণে। কারণ মুভির বাজেট তুলে আনার পরও একটা মুভি কিভাবে ফ্লপ হয় সেটা বুঝতে পারছিলাম না। তাই এটা নিয়ে কিছুদিন একটু খোঁজাখুঁজি করছিলাম। আমার মতো আরো যারা কনফিউজড আছেন তারা লেখাটা পড়লে কিছুটা কনফিউশন দূর হবে আশা করি।

 


Leave a reply