বাংলাদেশি সিনেমা নিয়ে ফারুকীর লেখা
পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী আবারও লিখেছেন বাংলা চলচ্চিত্র নিয়ে। শনিবার বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশি সিনেমা লইয়া আমরা কী করিব’ শিরোনামের লেখাটিতে উঠে এসেছে বাংলা চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থার নানা বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণ। গুরুত্বপূর্ণ ণেখাটি বিএমডিবি পাঠকদের জন্য তুলে দেওয়া হলো-
বাংলাদেশি সিনেমা লইয়া আমরা কী করিব
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় লড়াই বোধ হয় ‘বাংলাদেশ’ হয়ে ওঠার লড়াই। এই হয়ে ওঠা কেবল একটা মানচিত্র লাভের মধ্যেই সম্পন্ন হয়ে যায় না। কখনো কখনো মানচিত্র লাভের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মাত্র। এই হয়ে ওঠার সঙ্গে অর্থনৈতিক সক্ষমতা, দেশি ব্র্যান্ডের প্রতি আনুগত্য, দেশীয় আইকনের প্রতি ভালোবাসা, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য- এই বিষয়গুলো জড়িত। এই সবগুলো বিষয় মিলিয়ে একটা জাতির নিজস্ব পরিচয় দাঁড়ায়। কোনো ব্যক্তির জীবনে যেমন মোটা ব্যাংক ব্যালেন্সই শেষ কথা নয়, তার একটা দেওয়ার মতো পরিচয় লাগে। একটা দেশেরও তেমনি স্বতন্ত্র পরিচয় তার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের চেয়েও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই পরিচয়ের সংকটটা এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে আমি দেখি। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে যেমন ভারত-পাকিস্তানের ভূতের আছর দেখি, আমাদের সংস্কৃতির মাঝেও সেটা আছে। এর কিছু কারণ আছে ঐতিহাসিক। আর কিছু কারণ বড় ভাইয়ের ক্ষমতার আছরজনিত হীনম্মন্যতা।
ঐতিহাসিক কারণটা আমরা সবাই জানি। বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান প্রায় কাছাকাছি সংস্কৃতির। ফলে আমাদের অনেক জায়গায় মিল থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু ভয়ের এবং আশঙ্কার জায়গাটা দ্বিতীয় কারণ, বড় ভাইয়ের ক্ষমতার আছরজনিত হীনম্মন্যতা। পাকিস্তান আমলে একটা শক্তি আমাদের মগজ ধোলাই করার চেষ্টা করেছিল এই বলে বলে যে, উর্দু শ্রেষ্ঠ ভাষা, বাংলা যথেষ্ট সম্মানজনক ভাষা নয়, বাঙালির উৎসবগুলোও পরিত্যাজ্য। এসব করে করে আমাদের মাঝে একদল মানুষকে হীনম্মন্য দাশে পরিণত করা হয়েছিল। আর সেই প্রক্রিয়ায় ধর্মকে হাতিয়ার বানিয়েছিল পাকিস্তানিরা। একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে জয়ের মধ্য দিয়ে বাঙালি সেই দাসত্বকে অস্বীকার করেছিল। সেই জীবাণু একেবারেই মুক্ত করতে পেরেছিল- সেটা অবশ্য বলব না।
ওদিকে আছে আরেক বড় ভাই ‘ভারত’। তাদের হাতে অস্ত্র হিসেবে আছে নয়া যুগের নয়া ধর্ম বলিউড আর কলকাতাকেন্দ্রিক উচ্চাঙ্গ সংস্কৃতি। বাংলাদেশের শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে একটা সময় পর্যন্ত এ রকম প্রবণতা ছিল- কোনো লেখা লিখে, গান গেয়ে, নাটক করে তারা কলকাতার সার্টিফিকেটের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। এই ধরনের মানসিকতা শিল্প-সাহিত্যের স্বতন্ত্র ধরন তৈরিতে চরম বাধা। আল-মাহমুদ, হুমায়ূন আহমেদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সেলিম আল দীন, আজম খান- এই রকম কিছু শিল্পী-সাহিত্যিকের প্রবল আগমনে সেই ঔপনিবেশিক ‘বাঁধন গেল টুটে’। এরপর মধ্যবিত্তের মাথা ওয়াশ করার জন্য ঢুকে গেল নয়া ধর্ম বলিউড আর তার সহযোগী ‘ভারতীয় স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল।’
বাংলাদেশের টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রি, তার দুরবস্থা, ভারতীয় চ্যানেলের অবাধ আনাগোনা, আমাদের করণীয়- এসব বিষয় নিয়ে দ্বিতীয় আরেকটা লেখা লিখব। আজকের লেখাটা কেবল সিনেমা নিয়ে।
সিনেমাবিষয়ক আলোচনা শুরু করার আগে একটা বিষয় খোলাসা করে নিতে চাই। কলকাতাকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক বলয়, বলিউড কালচার, ভারতীয় টিভি চ্যানেল- এদের কারও বিরুদ্ধেই আমার কোনো অ্যালার্জি নেই। ওগুলো ভারতের অমূল্য সম্পদ, তাদের পরিচয়। আমার আপত্তির জায়গাটা কেবল ওখানেই যখন দেখি এগুলো আমার পরিচয়ের ওপর চেপে বসছে। আমার আপত্তি আরেক জায়গায়- ‘আমাদের হীনম্মন্যতায়’।
আমাদের সিনেমা ঐতিহাসিকভাবেই ভারতীয় ছবির উপনিবেশ। কারণটা খুব সহজ। একটা সময় পর্যন্ত তো আমাদের কাছে পৃথিবী মানেই ছিল ‘ভারতবর্ষ’। ফলে ভারতে যে ঢংয়ের ছবি হতো, আমরা সেটাকেই সিনেমার একমাত্র পথ ভেবে নিয়েছিলাম। যে কারণে আমাদের এখানকার ছবির প্রধান ধারা ছিল এবং আছে দুইটা। এক. মুম্বাই ও কলকাতার জনপ্রিয় স্টুডিওগুলোর বানানো ছবি। ইদানীং এটার সঙ্গে তামিল-তেলেগু যুক্ত হয়েছে। দ্বিতীয় ধারাটি হচ্ছে কলকাতাকেন্দ্রিক আর্ট হাউজ ছবি। সত্যজিৎ রায়, ঋতি্বক ঘটক, মৃণাল সেন অনুপ্রাণিত এই তরিকাটা বাংলাদেশে খুব ক্ষীণ ধারায় হলেও বহমান থাকার চেষ্টা করেছে। ফলে দু-একটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের সিনেমা মোটামুটি ভারতীয় ছবিরই ‘ক্লোন কপি’ হয়ে থাকার চেষ্টা করেছে। এমনিতেই বাংলাদেশিদের মধ্যে যারা দেশের বাইরে যায় তাদের প্রায়ই একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। চেহারা-সুরত এবং ভারতের ব্যাপক পরিচিতির কারণে কখনো কখনো বিদেশিরা আমাদের ভারতীয় মনে করে বসে। তখন সুন্দরভাবে তাদের বুঝিয়ে দিতে হয় ‘নারে ভাই, আমরা বাংলাদেশি’। কিন্তু কথা হচ্ছে, আমাদের বেশির ভাগ সিনেমা দেখে কী মনে হয়? বাংলাদেশের ছবি বলে আলাদা কিছু আছে বা বাংলাদেশ নামে আলাদা কোনো দেশ আছে?
পরিস্থিতির ভয়াবহতা টের পাওয়া যায় আরেকটু গভীরে তাকালে। ভারতের অনুকরণে ছবি কেন হচ্ছে সেটার বাস্তব কারণ তো আমরা জানি। এটাকে আমি বড় অসুখ মনে করি না। বড় অসুখ হলো সেই ‘ধারণাটা’ যেটা সফলভাবে আমাদের মাথার মধ্যে স্থাপন করা গেছে। সেই ধারণাটা কী? সেটা হলো ছবি দেখতে বলিউড বা নিদেনপক্ষে কলকাতা আর্ট হাউসের মতো না হলে ওটা কোনো ছবিই হয়নি।
আমার ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই যখন আমি এই দুই স্কুলকেই অগ্রাহ্য করে আমার হৃদয়ের স্কুলকে অনুসরণ করলাম তখন থেকে আমি দুই শিবির থেকেই গালি খেয়ে আসছি। কিন্তু আমার শক্তি আর ভরসা ছিল বাংলাদেশের লাখ লাখ মধ্যবিত্ত শিক্ষিত তরুণ। আমি জানতাম পরিবর্তন আসবে এই দর্শকদের কারণেই। ব্যাচেলর থেকে শুরু করে টেলিভিশন পর্যন্ত দর্শক গ্রাফের দিকে যদি তাকাই তাহলে এ কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি- বাংলাদেশের সব দর্শকই কেবল বলিউড বা কলকাতা আর্ট হাউসের কপি দেখতে চায় তা না। বাংলাদেশে একটা বিশাল শিক্ষিত তরুণ দর্শক শ্রেণী গড়ে উঠেছে, যারা দ্বীন-দুনিয়ার সব ছবিরই খবর রাখে। এরা যে কোনো নতুন ঢংয়ের বুদ্ধিদীপ্ত ছবি দেখার জন্য তিন দিন লাইন ধরে টিকিট সংগ্রহ করতে পারে। এরা যে কোনো জেলা শহরে আপনার ‘দলছুট বা প্রথাবিমুখ’ ছবি তিন সপ্তাহ হাউসফুল করে রাখতে পারে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে আমাদের নতুন ছবির দর্শক ক্রমবর্ধমান। তাহলে সিনেমার বিপ্লবের জন্য আর কী লাগে? আর তিনটি জিনিস লাগে- নতুন দিনের ছবির নির্মাতা, সরকারি নীতির পৃষ্ঠপোষকতা এবং গণমাধ্যমের ভূমিকা।
নতুন দিনের ছবির নির্মাতাদের মধ্যে আমি এমন অনেককে জানি যারা ক্ষমতা থাকার পরও সেই ‘কপি ক্যাট’ ধারারই ছবি করতে গেছেন। নিশ্চিত লাভের আশায় এবং শেষমেশ ধরা খেয়েছেন। আবারও বলি, আমি বলছি না একদিনেই বাংলাদেশের ৮০ ভাগ ছবি ভারতীয় আছরমুক্ত হয়ে উঠবে। ইন্ডাস্ট্রি বাঁচিয়ে রাখার জন্য ভারতের অনুকরণে ছবি বানানোও আপাতত অব্যাহত থাকতে হবে। কিন্তু নিদেনপক্ষে ২০ ভাগ ছবি তো হতে পারে নতুন ঢংয়ের। যেখানে রোম্যান্টিক, অ্যাকশন, কমেডি, থ্রিলার, ড্রামা সব রকম ছবিই থাকতে পারে। সেই ২০ ভাগ ছবি হচ্ছে কোথায়? নাকি এই ২০ ভাগ ছবি বানানোর মতো পরিচালক আমাদের দেশে নেই? এখানে বড় কারণটা বোধহয় সাহসের অভাব। আমাদের নতুন পরিচালক ভাইদের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, ‘এসো ভাই, একটু দুঃসাহসী হই। গল্পের ওপর ভরসা রাখি, ফর্মুলার ওপর না।’ আর যারা তথাকথিত মূল ধারার নামে বলিউড আর তামিল-তেলেগু কপি করছেন, তাদের বলতে চাই ‘এসো ভাই, গল্পটা নিয়ে একটু ভাবি।’
এবার আসি গণমাধ্যমের ভূমিকায়। আমার মনে হয় এই মুহূর্তে আমাদের গণমাধ্যম পাল্লা দিয়ে আত্দহননের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। বাংলাদেশের পত্রিকার বিনোদন পাতা পড়লে আপনি বুঝতে পারবেন না এটা বাংলাদেশের পত্রিকা নাকি ভারতের কোনো রাজ্যের। নিজের শিল্পী, নিজের আইকন, নিজের তারকাকে তৈরি এবং লালন-পালন করা একটা দেশের গণমাধ্যমের পবিত্র দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব আজ যেন অন্য কোনো টানে খসে পড়ছে। গণমাধ্যমের সম্পাদক ভাইয়েরা কি একটু ভাববেন? আমাদের সিনেমা ভালোভাবে দাঁড়াতে গেলে আপনাদের ঠিকঠাক ভূমিকা রাখা খুব দরকার।
লেখাটা খুব দ্রুত শেষ করতে হবে। তাই সরকার বাহাদুরের উদ্দেশে টপাটপ কয়েকটা পরামর্শ লিখেই আজকে বিদায় নিব।
১। আপনাদেরকে সবার আগে বুঝতে হবে আপনারা বাংলাদেশের সরকার। বাংলাদেশের সিনেমার উন্নতি হয় এমন উদ্যোগ নেওয়াই আপনাদের কাজ। কলকাতার ছবির বাজার তৈরি করা আপনাদের কাজ না। ওটা কলকাতার সরকারের কাজ। দয়া করে ‘প্রতিযোগিতা’ এবং ‘সিনেমা হল বাঁচানোর’ মতো হাস্যকর কথা বলবেন না। এর উত্তর বহু টকশোতে দিয়েছি। নতুন করে আর না পেঁচাই। শুধু এটুকু বলি দুনিয়ার যে কোনো সরকার আপনাদের এই কথা শুনলে হাসবে।
২। নিতান্তই যদি ভারতীয় ছবি আপনাদের আমদানি করাই লাগে তাহলে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যায় সেটা বেঁধে দিতে হবে। যেমন- চীনে এখন বিদেশি ছবি আমদানির সর্বোচ্চ অনুমোদিত সংখ্যা ৩৪। এটা চীনে উৎপাদিত মোট ছবির পাঁচ শতাংশের মতো আর থিয়েটারে মুক্তি পাওয়া চীনা ছবির মাত্র ১০ শতাংশ। উল্লেখ থাকে যে, গত বছর চীনে মোট ছবি উৎপাদিত হয়েছে ৭৪৫টি। এর মধ্যে থিয়েটারে মুক্তি পেয়েছে ৩১৫টি। চীন এখন দুনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম সিনেমার বাজার। কার্যকর অনুদান পদ্ধতি, দেশি ছবির জন্য প্রযোজক এবং হল মালিককে দেওয়া কর-রেয়াত, টিকিট বিক্রি হিসেবে চুরি ঠেকানোর ব্যবস্থা- এসব নানান উদ্যোগ নিয়ে তাদের ইন্ডাস্ট্রিকে তারা গত ১০ বছরের মাঝে সবচেয়ে চাঙ্গা ইন্ডাস্ট্রি এবং বাজারে পরিণত করেছে। আপনারাও একটু উদ্যোগী হন।
৩। ভারতীয় ছবি আমদানির সংখ্যা নির্ধারণের পাশাপাশি উচ্চ করারোপ করা যেতে পারে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে যেমন নিজের ভাষা এবং সংস্কৃতি বাঁচানোর জন্য অন্য রাজ্যের ছবির ওপর উচ্চ করারোপ করে সেটা করতে হবে।
৪। ভারতে আমাদের ছবি চালানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ছবি বিনিময়ের নামে বহরমপুরে একটা হলে একদিন ছবি দেখিয়েই নামিয়ে নিয়ে বলবেন- ‘চালিয়েছি তো, দাদা।’ সেটা হবে না। যদি বলেন ‘কি করব দাদা, লোকে দেখে না আপনাদের দেশের ছবি’, তাহলে আমাদের সরকারের উত্তর হতে হবে ‘তাহলে ছবি বিনিময়ের কী দরকার? আপনাদের বাজার আপনাদের থাকুক। আমাদের বাজার আমাদের থাকুক।’
৫। ভারতে আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো চলছে এটা আমরা দেখতে চাই। শুভঙ্করের অঙ্ক শুনতে চাই না। কলকাতার পত্রিকাগুলোয় আমাদের সংবাদের গুরুত্ব দেখতে চাই। আমাদের পত্রিকার পাতা তো আমরা সঁপে দিয়েছি। এবার কলকাতাকে তার পাতায় আমাদের স্বাগত জানাতে হবে। তবেই না হবে দোস্তি। আমরা দোস্তি চাই। এবার তোমরা যে চাও সেটা বোঝাও।
৬। সিনেমা হলের ওপর কর মওকুফ করা হয়েছে। আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু ছবিটা যে বানাবে সেই প্রযোজকের কর মওকুফ করাটা আরও জরুরি।
৭। সিনেমা হল মনিটর করার জন্য একটা টিম তৈরি করতে হবে। যারা প্রজেকশন, টিকিট, হলের পরিবেশ সব মনিটর করবে। এদের রিপোর্টের ওপর কর মওকুফ নির্ভর করবে। ঢালাও কর মওকুফে ফায়দা হবে না।
৮। সিনেমা হলগুলোতে বিদেশি ছবির প্রদর্শনী সংখ্যা একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আনতে হবে। ধরা যাক নূ্যনতম ৭০ ভাগ দেশি ছবির জন্য বরাদ্দ থাকতে হবে। অন্যথায় নগদ জরিমানা।
৯। বাজার অর্থনীতির দেশ মানে সরকারের হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা না। এশিয়ার অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বাজার অর্থনীতির দেশ দক্ষিণ কোরিয়ার একটা উদাহরণ দিতে চাই। কোরিয়া সরকারের উদ্যোগে সারা দেশে ‘ইন্ডি প্লাস’ নামে একটা থিয়েটার চেইন গড়ে তোলা হয়েছে যেখানে তারা ভালো ভালো সব ছবি দেখায়। এমন কি কোরিয়ান সমাজ এবং সরকারের সমালোচনামূলক ছবিও সেসব থিয়েটারে বিনা বাধায় প্রদর্শিত হয়। আমাদের সরকারের উদ্যোগে ৬৪টি জেলায় এ রকম মাল্টিপ্লেঙ্ গড়ে তুলতে হবে। এগুলোর মালিকানা সরকারের হাতে থাকবে কিন্তু অপারেশন দরপত্রের মাধ্যমে বেসরকারি কোম্পানির হাতে তুলে দিতে হবে। তবে সে ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে কোনো ধরনের মনোপলি বা এক কোম্পানির হাতে যেন না পড়ে। কারণ ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউশন চেইনের ক্ষেত্রে মনোপলি হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জিনিস। এসব থিয়েটারে জনপ্রিয় এবং আর্ট হাউস সব ধরনের ছবিরই প্রদর্শনীর ব্যবস্থা রাখতে হবে।
১০। দুনিয়া এখন চলে যাচ্ছে অনলাইনে। অনলাইন আইন কঠোর করে এবং আইন ভঙ্গকারীদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করে ‘অনলাইন স্ক্রিনিং’ বা ‘ভিডিও অন ডিমান্ড’ সাইটের প্রসার ঘটাতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে হলে অনলাইনে কন্টেন্টের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে আমাদের সিনেমার শক্তি এবং বাজার আরও বাড়বে। ধরা যাক, বাংলাদেশে আমার ছবিটা মুক্তি পেল যেদিন সেদিনই অনলাইনে নির্দিষ্ট ফি দিয়ে আমেরিকা-কানাডা-অস্ট্রেলিয়া-লন্ডন-মধ্যপ্রাচ্য সব জায়গা থেকে বাঙালির ছবিটা দেখতে পাবে। আমি জানি এই পদ্ধতিতে কীভাবে পাইরেসি হতে পারে। পাশাপাশি এটাও জানি এটার সম্ভাবনা কমানোরও উপায় আছে। আমাদের তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক একজন আধুনিক তরুণ মানুষ। উনি, তথ্য মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশি তথ্য প্রযুক্তিবিদ এবং সিনেমা-সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটা কার্যকরী কমিটি করলে এটা খুব সহজেই বাস্তবায়ন সম্ভব এবং এতে আমাদের সিনেমার বাজার অনেকগুণ প্রসারিত হয়। সারা দুনিয়াতেই অনলাইন স্ক্রিনিং একটা বড় ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ কি এই জিনিস ছাড়া সম্ভব হবে? কিছু দিন আগে আল-জাজিরা ইংলিশ চ্যানেল আমার ওপর একটি প্রতিবেদন প্রচার করেছে। সেখানে তারাও নিউওয়েভ বাংলাদেশি সিনেমার কথা বলছিল। আমাদের সব সম্ভাবনা থাকার পরও এসব ওয়েভ হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে যদি সরকার বাহাদুর সঠিক নীতিমালা তৈরি না করে।