Select Page

বাবা কেন চাকর : বাবাদের বাস্তব

বাবা কেন চাকর : বাবাদের বাস্তব

রাজ্জাক একাধারে লিজেন্ডারি অভিনেতা ও নির্মাতা। তাঁর ‘মৌচোর, চাঁপা ডাঙার বউ,জ্বীনের বাদশা, সৎভাই, বাবা কেন চাকর, সন্তান যখন শত্রু’ সিনেমাগুলো এক একটা মাইলফলক। সিনেমাগুলোর মধ্যে সাবজেক্টের ভেরিয়েশন আছে।

‘বাবা কেন চাকর’ পারিবারিক মূল্যবোধের, দায়বদ্ধতার অসাধারণ সৃষ্টি। এ সিনেমা যারা দেখেছে তারা যত শক্ত মনের মানুষই হোক না কেন কোথাও না কোথাও তাদের মন কেঁদেছে। রাজ্জাক পুরো সিনেমাকে অদ্ভুত দক্ষতায় ঢেলে সাজিয়েছেন। একটা সিনেমার গল্প শুরুতেই বেদনার হয় না।সুখী পরিবার ধীরে ধীরে অসুখী বা স্বার্থপরতার দিকে ঝুঁকতে থাকে। তখনই শুরু হয় ভাঙন। এই ভাঙনে একজন বাবা পরিবারের অভিভাবক হিশেবে যে করুণ বাস্তবতার স্বাক্ষী হন তারই গল্প ‘বাবা কেন চাকর।’

রাজ্জাক তার পরিবারে সুখী মানুষ। অবসরপ্রাপ্ত লোকের জীবনে পরিবারে নাতি-নাতনীকে নিয়ে সময় কাটানো, বন্ধুদের সাথে অাড্ডা এসবে ব্যস্ততা থাকে। বড় ছেলে মিঠুনের স্ত্রী প্রথমত তেমন কোনো নেগেটিভ অাচরণ না করলেও ধীরে ধীরে তার মাধ্যমেই পারিবারিক অশান্তি বাড়ে। বাপ্পারাজ পরিবারের ছোট ছেলে। শিল্পীর সাথে তার প্রেম। ছোট মেয়ে কাজলের বিয়ে হয় অমিত হাসানের সাথে। এভাবে একটা অবস্থানে যাবার পর পরিবারে বড় ছেলে মিঠুনের কাজকর্ম বা দায়বদ্ধতা যখন বাড়তে থাকে তার স্ত্রীর হস্তক্ষেপ বাড়ে। সে একা কেন পরিবারে এত দায় সারবে বা সবাইকে দেখার কি দরকার বিয়ের পর নিজেদের চিন্তা করাই বুদ্ধিমানের কাজ এসব বলে। মিঠুন প্রথম প্রথম কানে না তুলতে চাইলেও পরে বাধ্য হয়। বাধ্যতা শেষ পর্যন্ত অভ্যাসে গিয়ে দাঁড়ায়। বাপ্পাকে ট্যাক্সি চালাতে হয়। রাজ্জাকের স্ত্রী ডলি জহুর প্যারালাইজড হয়। অশান্তি অারো বাড়তে থাকে। দেখা যায় বড় ভাইয়ের সাথে যৌক্তিক তর্ক করাতে বাপ্পাকে প্যান্টের বেল্ট দিয়ে পেটাচ্ছে মিঠুন। ছেলেকে রক্ষাও করতে পারছে না মা ডলি জহুর। বিছানা থেকে পড়েও যায়। এত অশান্তির মধ্যে রাজ্জাক সন্তানের সব অবিচার সহ্য করলেও চূড়ান্ত অাঘাতটি পায় যেদিন মিঠুনের জন্য খাবার নিয়ে তার অফিসে যায়। মিঠুন তার ক্লায়েন্টের সাথে কথা বলার সময় ক্লায়েন্ট এক পর্যায়ে বলে- ‘অাপনার বাসার নতুন চাকর বুঝি?’ মিঠুনের কাছে জবাব অাশা করেছিলেন রাজ্জাক তাই তার দিকে তাকায় কিন্তু ছেলে নিশ্চুপ।সেদিনই রাজ্জাক নিশ্চিত হয় বাবার কোনো মূল্য নেই বড়ছেলের কাছে। মা ডলি জহুরের মৃত্যুর পর মিঠুনের চেতনা অাসে এবং সেদিনই স্ত্রীকে শাসন করতে দেখা যায়। সবাই এক হয় ডলি জহুরের লাশ দাফন করতে গিয়ে।

সিনেমার নির্মাণে সূক্ষ্ম প্রয়োগ অাছে। যেখানে যতটুকু দরকার ততটুকুই দিয়েছেন রাজ্জাক। সিনেমায় সুখী পরিবার, প্রেম-রোমান্স, স্বার্থপরতা, দায়বদ্ধতা, স্যাডনেস, মেসেজ সবকিছুর একটা যৌথ মিশ্রণ অাছে।রাজ্জাকের ডিরেকশন সেন্স খুব তীক্ষ্ণ।

সুখী পরিবার যেভাবে অসুখী

একটা যৌথ পরিবার প্রথমত সুখী হয়। তারপর সেখানে যখন একক পরিবারের প্রাধান্য চলে অাসে তখনই পরিবারের সুখটা নষ্ট হতে থাকে। একক পরিবার মানেই একক চিন্তা। বিয়ের পর ছেলে বা ছেলের বউ অালাদাভাবে সংসার দাঁড় করানোর চিন্তা করে যেটা সহজাত বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে একক থাকলেও বন্ধনটা ঠিক থাকে। দেখা যায় এক হাঁড়িতে সবাই খাচ্ছে কিন্তু সেটা বিরল ঘটনাও বটে। একক চিন্তা থাকলে নিজেরা সম্পদ বাড়ানোর স্বাভাবিক চিন্তা করে। সম্পদ বাড়লে অাধিপত্যের চিন্তা বাড়ে তখন শ্বশুর-শ্বাশুড়ি বা অন্যন্য পারিবারিক সদস্যের উপর বিভিন্ন চাপ অাসে সেটা নিজের ভাইদের ক্ষেত্রেও হতে থাকে। পরিবারের সে একক গল্পটা ‘বাবা কেন চাকর’-এ মিঠুনকে দিয়ে শুরু হয়। মিঠুন স্ত্রীর মানসিকতার সাথে খাপ খাইয়ে চলতে থাকে। সেটাই তাকে বিবেকহীন করে। তার অবহেলার কারণে বাবার মতো সেরা অভিভাবককে ‘চাকর’ ভাবতেও তার বাধে না।

দায়বদ্ধতা

দায়বদ্ধতা যখন মিঠুনকে দিয়ে হয়নি সেটার হাল ধরে বাপ্পারাজ। ট্যাক্সি চালিয়ে মায়ের চিকিৎসা করে। রাজ্জাক নিজেও ঠেলাগাড়ি চালায়।তার দায়বদ্ধতার পেছনে বাধ্য হয়ে কাজ করাটাও ছিল।

প্রেম-রোমান্স

বাণিজ্যিক সিনেমাতে প্রেম-রোমান্স স্বাভাবিক বিষয়। অমিত হাসান-কাজলের দেখা হওয়াটা নাটকীয় ছিল। বিয়ে হয় তাদের। এ জুটির ‘অামি বধূ সেজে থাকব তুমি পালকি নিয়ে এসো’ গানটি জনপ্রিয়। বাপ্পারাজ-শিল্পী জুটির রোমান্টিক অংশের পাশাপাশি তুষার খানের কমেডি সিনেমার উপভোগ্য অংশ। প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে পারিবারিক ক্রাইসিস নিয়েও কথা হতে পারে যেটি ছিল বাপ্পারাজ-শিল্পী জুটির সিকোয়েন্সগুলোতে।

স্যাডনেস

সিনেমার স্যাডনেসটাই প্রধান। নামকরণের বিষয়টাও সেদিক থেকে মূল্যবান। রাজ্জাক বড়ছেলে মিঠুনের অফিসে ‘চাকর’ কথাটা শোনার পর বের হলে তার বাবাজীবনের সবচেয়ে বড় অাঘাতটা পায়। সন্তান যখন বিপথে যায় বা ভালোমন্দের তফাত বোঝার ক্ষমতা যখন সে হারায় তখন তার কাছে যে কোনো কিছু বলা বা সমর্থন করা স্বাভাবিক। সেজন্য ক্লায়েন্টের কথার কোনো জবাব সে দেয় না। রাজ্জাক অফিস থেকে বের হয়ে সিঁড়ি ডিঙাতে ডিঙাতে খালিদ হাসান মিলুর স্যাড ভার্সনের অসাধারণ জীবনমুখী গানটা বাজতে থাকে-

‘অামার মতো এত সুখী নয়তো কারো জীবন
কী অাদর স্নেহ-ভালোবাসায় জড়ানো মায়ার বাঁধন।’

সংসার বা পরিবারে এই ‘মায়ার বাঁধন’ যতদিন ধরে রাখা যায় ততদিন মানুষ থাকে নয়তো অমানুষ হতে সময় লাগে না। ডলি জহুরের মৃত্যুর পরে মিঠুনের ঘরের সামনে লাশটা রেখে রাজ্জাক উচ্চস্বরে যে হাসিটা দেয় সেটা তার সমস্ত রাগ-ব্যথা-বেদনার বহিঃপ্রকাশ। ঐ হাসিটা দেখে সিনেমাহলে দর্শকের চোখে পানি অাটকায়নি।অভিনয় কাকে বলে তিনি দেখিয়েছেন।

অমিত হাসান কাজলকে তার মায়ের প্যারালাইজড হবার খবরটা দেবার অাগে বলে- ‘তোমার মনটাকে শক্ত করতে হবে।’ এটুকু বক্তব্যই দেখায় খারাপ সংবাদ দিতেও সামাজিকতা লাগে। অসাধারণ।

মেসেজ

সিনেমার শেষ সিকোয়েন্সে মিঠুনের ছেলে তার মা-বাবাকে দাদীর লাশের পাশে অাসতে দেয় না। তারা দাদীকে মেরে ফেলেছে বলে। রাজ্জাক অাটকায় নাতিকে। বলেন-‘মা-বাবাকে এভাবে বলতে নেই দাদু। তারা যত অন্যায় করুক তাদেরকে তোমার শ্রদ্ধা করতে হবে।’ মেসেজটা দিয়ে দেন রাজ্জাক এভাবে, পরিবারে সবার শ্রদ্ধা, দায়বদ্ধতা, উৎসর্গ এসব থাকতে হয়।

বাবা হলেন পরিবারের শ্রেষ্ঠ অভিভাবক। তাঁর প্রতি দায়বদ্ধতা কী সেটা জানতে, বুঝতে একটা জীবন অনেক কম সময়। পরিবারকে দাঁড় করাতে বাবার অবদান অসামান্য। তাঁকে তাঁর যোগ্য সম্মান দিতে হবে। যে নারীদের জন্য পরিবারের অনেকদিনের বন্ধন নষ্ট হয় তাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে তারাও একদিন বুড়ো হবে এবং তার পুত্রবধূ কেমন হবে ভাবতে হবে তাহলে সচেতন হওয়া যাবে। এক্ষেত্রে মনে পড়তে পারে সালমান শাহ অভিনীত ঐ গানটির কথা  ‘পুরুষ বড় হয় জগতে নারীর কারণে/ধ্বংস অাবার হয় দেখো ঐ নারীর কারণে।’ বাবাকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দিতে অবদান রাখতে হবে সন্তানদেরই।

পৃথিবীর সব বাবারা ভালো থাকুক।


১ Comment

Leave a reply