Select Page

বালিকা হলো বধূ : অাদর্শ বাণিজ্যিক সিনেমা

বালিকা হলো বধূ : অাদর্শ বাণিজ্যিক সিনেমা

নব্বই দশকের জমজমাট বাণিজ্যিক সিনেমার সফল যাত্রায় উল্লেখযোগ্য এবং অালোচনা সৃষ্টিকারী সিনেমা ‘বালিকা হলো বধূ‘। তোজাম্মেল হক বকুল দেশের সবচেয়ে ব্যবসাসফল সিনেমা ‘বেদের মেয়ের জোছনা’-র পরিচালক। তিনি বাণিজ্যিক সিনেমার ব্যবসাসফলতা এবং সিনেমা নির্মাণের মসলা অসাধারণভাবেই প্রয়োগ করতেন। তাঁর সমসাময়িক নির্মাতারা তাঁকে বাণিজ্যিক সিনেমার মাস্টারমেকার বলেই জানতেন।

‘বালিকা হলো বধূ’ রোমান্টিক ফোক সিনেমা। রোমাঞ্চ ছিল এ সিনেমার স্টোরি টেলিং সূত্র। গ্রামের ক্লাবে ছোটবেলায় এ সিনেমা দেখার পর এরপর টিভিতেই বেশ কয়েকবার দেখি কিন্তু বিস্তর অনুসন্ধানের পরেও ইউটিউবে মেলেনি। অাজ ভাগ্যক্রমে বড়ভাই সানোয়ার সানু-র (সানুভাই) ইউটিউব চ্যানেলে পেয়ে যাই। পেয়ে তো যারপরনাই খুশি। পুরোটা দেখার ভাবলাম অাজই প্রমাণ সাইজের একটা লেখা দাঁড় করালে কেমন হয়। যেই ভাবা সেই কাজ।

সিনেমা অবশ্যই অন্তরাকে কেন্দ্র করে। নব্বইয়ের অনেক নামকরা অার্টিস্টের ভিড়ে অন্তরাকে নিয়ে কাজ করাটা বকুল সাহেবের জন্য নিঃসন্দেহে বড় চ্যালেন্জ ছিল। তিনি সেটা সফলভাবেই পেরেছেন। সিনেমাটি অন্তরার ক্যারিয়ারে অালো ছড়িয়েছিল। খুব যত্নের সাথে পরিচালক তাকে প্রতিভার সদ্ব্যবহার করে তুলে ধরেছেন।

গল্প খুবই সাধারণ। সাধারণের উপস্থাপনা অসাধারণ ছিল। অন্তরা অবুঝ মেয়ে। সমাজ-সংসারের তেমন কিছু সে বোঝে না। খেলার সাথী মেহেদিকে সে অাপন ভাবলেও ভালোবাসা বোঝে না।ছেলেমানুষি তার প্রচণ্ড। সে হাই স্কুলে পড়ে আর মেহেদি কলেজে। দেখা যায় মেহেদির কলেজের ক্লাসে ঢুকে তাকে অবাক করে দেয়। একসময় বিয়ে ঠিক হলে সে অানন্দের সাথে মেহেদিকে জানাতে অাসে কিন্তু বোঝে না মেহেদি তাকে ভালোবাসে। মেহেদি সব শুনে তার সাথে কথা বলবে না বললে মেহেদির হাত কামড়ে ধরে যতক্ষণ সে কথা বলবে না। ব্যর্থ হয়ে বাড়ি এসে তুলকালাম বাঁধায়। দাদুর কথায় অন্তরার রাগ কমে। এরপর পারিবারিক দ্বন্দ্বে জমজমাট হয়ে ওঠে সিনেমা। মিলন হয় নায়ক-নায়িকার তবে মাঝে আরো কিছু ঘটনা থাকে যা এনজয়অ্যাবল।

অন্তরার অভিনয় অনবদ্য ছিল। ছেলেমানুষিগুলো খুব ন্যাচারাল। রাগ, অভিমান, কান্না সবকিছুতে ন্যাচারাল ছিল। একটা সিকোয়েন্স না বললেই নয়। মেহেদি অন্তরার মুখে তার বিয়ের কথা শুনে তারই অানন্দ দেখে ফিরিয়ে দিলে বাড়িতে তুলকালাম বাঁধায়। পরে দাদুকে নালিশ দেয়। দাদু বোঝায় অন্য ছেলের সাথে বিয়ে হবে তাই মেহেদি কথা বলতে বা মিশতে বারণ করেছে। দাদু মজা করে বিয়ের পরে রোমান্টিক সময়গুলো কেমন হবে বলতে থাকে অার অন্তরা ডানেবামে চোখ ঘুরিয়ে মেহেদি ও তার সাথে যার বিয়ের কথা চলছে তাকে মেলাতে থাকে। মেহেদিকে তার বেশি রোমান্টিক মনে হয়। মেহেদি তখন গুড লুকিং ছিল। ঘাড় পর্যন্ত চুলে অনেকটা ওমর সানির অাবহ ছিল। ভালো অভিনয় করেছে।বলতে হবে বকুলসাহেব অাদায় করেছেন। বিশেষ করে অন্তরার যৌবনের লক্ষণগুলোতে পৌরুষের অাকর্ষণে মেহেদির অভিনয় চমৎকার। দিলদার-সাইফুদ্দিন কমেডি দুর্দান্ত।নাসির খান খলনায়কের ভূমিকায় সেরাটাই দিয়েছে। মেহেদির মমতাময়ী মা অানোয়ারা, বাবা প্রবীরমিত্র তাদের চরিত্রে অসাধারণ।

সিনেমায় বালিকা অন্তরার বধূ হবার পর্যায়কে পরিচালক বকুল একটি মানসিক বিকাশ হিশেবে দেখিয়েছেন। প্রতিটি মেয়েই বালিকা থেকে বধূ হয়।কিন্তু সবার গল্প এক হয় না। গ্রামীণ মেয়েদের ম্যাচিউর হবার আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় সেই বাস্তবতার জন্য সিনেমাটি সামাজিকভাবে সচেতনতামূলক ক্ষেত্রও বটে। রোমান্টিক সিনেমার দাবি মানতে সিনেমায় অাছে দারুণ উপভোগ্য গান-‘জোছনা রাইতে যাইও না গো চলিয়া ছাড়িয়া, কেমনে থাকি বলো’। ফোক অাবেদনে গ্রাম, নদী, ঘাট, গ্রামের চিরকালীন বাড়িঘর, মানুষদের সরল অাচরণ এসব অসাধারণ। মাঝির ছেলে মেহেদির নৌকার দাঁড় বাওয়ার সময় কোমরে বাঁধা গামছা বা কাছা মারা লুঙ্গি এসব গ্রামীণ চিরন্তন অভ্যাস যা ফোক লাইফস্টাইলের অংশ। অন্তরার ছেলেমানুষিকে গ্রামীণ উচ্ছল বালিকার অাদর্শ দৃষ্টান্ত বলা যায়। সিনেমার শেষে পরিচালক স্ক্রিনে বলে দিলেন ‘বালিকা হলো বধূ-র সমাপ্তি’। এ কৌশলটি সবাই ব্যবহার করেননি তাঁর সময়। তিনি দর্শককে তাঁর সিনেমার মধ্যে ব্যস্ত রাখতে এবং মনোযোগী করাতে নিজের উপস্থিতি জানান দেন। এটা ব্যতিক্রমী।

সিনেমার অফিসিয়াল পোস্টারে অন্তরার বালিকা ও বধূর শারীরিক ও সামাজিক অবস্থানে দেখানো হয়েছে। যেভাবে দাঁড়িয়ে অাছে সেটাও একটা এক্সপেরিমেন্ট ছিল বকুলসাহেবের। দেখে সিনেমাটি না দেখা কোনো এক দর্শক ধরে নেবে বোধ হয় অন্তঃসত্ত্বা অন্তরাকে বালিকা থেকে বধূর পার্থক্যে দেখিয়েছেন পরিচালক। কিন্তু না এটা একটা এক্সপেরিমেন্ট। সাদা চোখে যেটা মনে হবে তার বাইরে গভীর অর্থটা হলো একটা মেয়ে জ্ঞান হবার পর থেকে যে পর্যায়ে বড় হয় সেখানে বয়ঃসন্ধি অবধারিত অধ্যায়। সে অধ্যায় পেরিয়ে তাকে একদিন কারো জীবনসঙ্গী হতে হয়। তখন সে হয় বধূ।বধূর কোল জুড়ে অাসে সন্তান। সেই বাস্তব জীবনটাকে বোঝাতে পোস্টারে একটি মেয়ের বালিকা থেকে বধূ হবার পর্যায়কে এক্সপেরিমেন্ট করা হয়েছে।কিন্তু সিনেমার গল্পটা অালাদা আর চমকটা সেখানেই নির্মাতার।

তোজাম্মেল হক বকুল ব্যালেন্স করতেন অাশ্চর্যভাবে। গল্প, গান, সংলাপ, অভিনয়, দ্বন্দ্ব, ক্লাইমেক্স সব নিয়ে ভাবতেন। সেজন্য প্রস্তুতি থাকত তাঁর। ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ সিনেমাটি একজন দর্শক সূক্ষ্মভাবে দেখলে তাঁর পরিচালনার দক্ষতা জানতে পারবে। ফাঁকফোকর রাখতেন না সিনেমায়। বাণিজ্যিক সিনেমায় অাজকের নির্মাতারা সেই জায়গাটি বকুলসাহেবের কাছে শিখতে পারেন যেখানে অাছে বাণিজ্যিক সিনেমা কীভাবে দর্শকের সাথে জমজমাট করে connectivity তৈরি করতে পারে।

‘বালিকা হলো বধূ’ সেই বাণিজ্যিক সিনেমার দর্শক অাকর্ষণের একটা অাদর্শ।


Leave a reply