Select Page

শনিবার বিকেল: সিঙ্গেল-টেক থ্রিলারে সন্ত্রাসী হামলার বেদনাদায়ক ও আপোষহীন ব্যবচ্ছেদ

শনিবার বিকেল: সিঙ্গেল-টেক থ্রিলারে সন্ত্রাসী হামলার বেদনাদায়ক ও আপোষহীন ব্যবচ্ছেদ

(শনিবার বিকেল (Saturday Afternoon) ছবিটি ১১ থেকে ১৮ই ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে ২৬তম ভেসোল ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব এশিয়ান সিনেমাস-এ প্রদর্শিত হয়েছে। ছবিটি নিয়ে ইস্টার্ন কিকস সাইটে রিভিউ লিখেছেন ওয়ালি অ্যাডামস। বাংলা মুভি ডেটাবেজের পাঠকদের জন্য রিভিউটি বাংলায় উপস্থাপন করা হলো।)

শনিবার বিকেল সিনেমা Saturday Afternoon

কোন এক শনিবারের সাদামাটা বিকেলে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের একটি ছোট দল হঠাৎ একটি ক্যাফেতে হামলা করে। তাদের রিংলিডার পলাশ (পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়), ছদ্ম-বুদ্ধিজীবী সন্ত্রাসী ইনতিশাম (ইরেশ যাকের) এবং সীমান্তবর্তী এলাকার পাগলাটে চিশতি (ইন্তেখাব দিনার) দ্রুত আক্রমণ করে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। কিন্তু আইন প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষ যে এত দ্রুত সেই স্থানে পৌঁছাবে এটি তারা অবমূল্যায়ন করেছিল। তাই তারা “প্ল্যান সি”-এর দিকে ধাবিত হয়। তারা রেস্তোরাঁয় শেষ পর্যন্ত অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেখানে অবস্থানরত জিম্মিদের হাতে তাদের বাঁচা-মরার ভার তুলে দেয়।

জিম্মিদের মধ্যে ছিলেন প্রাইভেট কোম্পানির কর্মকর্তা রাইসা (নুসরাত ইমরোজ তিশা), মেডিক্যাল সামগ্রী বিক্রেতা শহিদুল (জাহিদ হাসান), এবং ফিলিস্তিনি অভিনেতা ইয়াদ হুরানি। পুলিশ ও সামরিক বাহিনী যেভাবে এগিয়ে আসছে এবং চরমপন্থীরা কীভাবে কী করবে তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে, এ দুইয়ের মধ্যে শেষ পর্যন্ত কী হতে যাচ্ছে, তা নিয়ে কারও কোন ধারণা নেই।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর চলচ্চিত্রে সচরাচর দেখা যায় যে সমাজের আধুনিক ও আধুনিকীকরণের উপাদান এবং ভীত বা বাধা দেওয়ার চেষ্টাকারী রক্ষণশীলদের মধ্যে বিরাজমান উত্তেজনা। যা তার পরিচালিত ২০০৯ সালের থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার এবং ২০১৩ সালের টেলিভিশন চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে। প্রথমটিতে একজন স্বাধীনচেতা শিক্ষিত নারীকে সমাজে নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে দেখা যায় এবং দ্বিতীয়টিতে হাস্যরসের পাশাপাশি এমন এক গ্রাম-প্রধানকে দর্শকের সামনে নিয়ে আসা হয়েছে যিনি তার গ্রামে টেলিভিশন ঢুকতে না দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন।

কিন্তু শনিবার বিকেল আরও গভীর ও গুরুতর। এটি ২০১৬ সালে ঢাকা বেকারি হামলার বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত, যা এই দেশে বিদেশিদের/”বিদেশি” প্রভাবকে লক্ষ্য করে নজিরবিহীন বড় রকমের হামলা। ১১ ঘন্টার অচলাবস্থায় ২৪ জনকে হত্যা করা হয় (তন্মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বিদেশি ছিল ইতালি ও জাপানের)। অন্যদিকে, চরমপন্থীরা কয়েকজনকে ছেড়ে দেয় (কয়েকজনকে স্থানীয় নির্দোষ বলে গণ্য করা হয়েছিল), কয়েকজন পালাতে সক্ষম হয় এবং বাকিদের উদ্ধার অভিযানে বাঁচানো হয়েছিল। অভিযানে হামলাকারীদের মধ্যে একজন ছাড়া বাকিদের হত্যা করা হয়।

শনিবার বিকেল সিনেমার একটি দৃশ্য

চলচ্চিত্রটিতে নাটকীয় বর্ণনার জন্য বাস্তব ঘটনাটিকে অনুসরণ করা হয়েছে এবং অনেকটুকু পরিবর্তনও করা হয়েছে। মোটকথা, অনেকটা মঞ্চের মত খুবই ছোট জায়গায় এই কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। কিন্তু মঞ্চের ল্যান্ডস্কেপ চলচ্চিত্রের ক্ষেত্র ও ব্যপ্তিতে চমৎকারভাবে কাজ করেছে। চলচ্চিত্র জুড়ে ক্যামেরা সমতলে প্রবাহিত হয়েছে, ধীর লয়ে সামনে ও পিছনে গিয়েছে এবং রেস্তোরাঁর বিভিন্ন অংশে ঘোরাফেরা করে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত এবং জিম্মিদের ও হামলাকারীদের প্রতিক্রিয়া ধারণ করেছে। কিছু উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্ত এমন যখন আসলে কিছুই হচ্ছে না, যেমন জিম্মি ও হামলাকারীদের মধ্যে সিগারেট খাওয়ার বিরতি।

চলচ্চিত্রটিতে প্রধান তিন হামলাকারী অভিনেতার দুর্দান্ত অভিনয় না হলে এটি এতটা ভাল হত না। তারা সকলে শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিয়েছে, ফলে দর্শক কখনোই এই পরিস্থিতির গুরুতরতা ভুলতে পারবে না, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তারা অমানুষ হয়ে ওঠেছিল।

হামলাকারীদের অভিনয় বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখতে হবে কে সবচেয়ে খারাপ বা মন্দ। পলাশ একমাত্র ব্যক্তি যে কিনা শান্ত, নম্র ও কর্মে দক্ষ। দলের প্রধান হিসেবে সে বিচক্ষণ ও দায়িত্ববান, যে কিনা ‘মিশন’-এর প্রচারণার মাত্রাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য করে। ইনতিশাম সবচেয়ে ধর্মান্ধ এবং সে সহিংসতার ভাবাদর্শগত ভূমিকাকে সবার উপরে স্থান দেয়। চিশতি সবচেয়ে অস্থির প্রকৃতির, মাঝে মাঝে ভাড়ামিপূর্ণ – সম্ভবত বাস্তব হামলাকারীদের মত যে খোলামেলাভাবে বাঙালি জিম্মিদের কাছে অভিযোগ তুলে কীভাবে বিদেশিরা তাদেরকে পশ্চিমা পোশাক পড়তে, খাবার খেতে বাধ্য করছে।

শনিবার বিকেল সিনেমায় তিশা ও ইন্তেখাব দিনার

জিম্মিদের মধ্যে প্রধান অভিনয়শিল্পীরাও সুন্দর অভিনয় করেছেন এবং হামলাকারীদের প্রতিটি যুক্তি-তর্ক ও সহিংস কর্মকান্ডকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। হামলাকারীরা হিজাব পরিহিতা রাইসা এবং দাঁড়িওয়ালা শহিদুলকে সম্মান করেছে। এমনকি অপেশাদার অভিনয়শিল্পীরাও সন্তোষজনক অভিনয় করেছেন।

চরমপন্থী এবং তাদের মতো অন্যদের সম্পর্কে অনেক অযৌক্তিক বাস্তবতা রয়েছে, যা ছবিটিতে সূক্ষ্ম এবং বিদ্রূপাত্মক উপায়ে সরাসরি তাদের মাধ্যমে স্পট-অন ক্যাপচার করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সংস্কৃতি, শিল্পকলা ও বাণিজ্যের প্রতি তাদের কপট ঘৃণার চিত্র। অথচ বাস্তবে এই তিনটিই ছিল মুঘলসহ বড় বড় ইসলামী সাম্রাজ্যের অপরিহার্য অংশ, যেখানে মুঘলরা ঢাকাকে সংস্কৃতি, শিল্পকলা ও বাণিজ্যের বৈশ্বিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছিল।

প্রকৃতপক্ষে, শনিবার বিকেল ছবিটিতে এত ছোট পরিসর, রেফারেন্স পয়েন্ট ও সেটের মধ্যে অনেক বিষয় তুলে ধরতে হয়েছে। এটি অপ্রসাঙ্গিক বা উটকো কিছু চাপিয়ে দেওয়া ছাড়াই আকর্ষক ও প্রভাব বিস্তারকারী এবং প্রকৃত শহীদ কারা তার মর্মভেদী পার্থক্যের মাধ্যমে নৃশংসতা এবং করুণ পরিস্থিতিকে তুলে ধরে। এটি বাঙালি শিল্পকলার মহান ঐতিহ্যে একটি নতুন ধরনের বাস্তবতার আভাস দেয়।

(ঈষৎ সংক্ষিপ্ত ও পরিমার্জিত)

রেটিং :

Rating: 4.5 out of 5.


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

ব্লগার ও ডেটাবেজ এডিটর: বিএমডিবি

১ টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন