বিশ্বপ্রেমিক : মাস্টারপিস কমার্শিয়াল এক্সপেরিমেন্ট
‘I will do anything for love
I’ll never lie to you and that’s a fact’.
– Meat Loaf
ভালোবাসার জন্য সবকিছু করতে পারি আমি। এ মন্ত্র থেকে ভালোবাসা আর ভালোবাসার মানুষকে পেতে সবকিছু করতে রাজি এমন প্রেমিকের সিনেমা বিশ্বপ্রেমিক সিনেমার ট্যাগলাইনে meat loaf এর গানের প্রথম লাইন ব্যবহৃত হয়েছে। বিশ্বে প্রেমিক অনেক আছে, সবাইকে আমরা চিনি না।নিজেদের দেখার মধ্যে আমরা যাদেরকে চিনতে পারি, জানতে পারি তাদের বৈশিষ্ট্য চেনা পরিচিতই লাগে। পরিচিত, অপরিচিত সব প্রেমিকই প্রেম পিয়াসী। সবাই প্রিয় মানুষের জন্য যার যার জায়গায় বিশ্বপ্রেমিক।
কলেজ জীবনে এক ছেলেকে দেখেছিলাম একটা মেয়ের জন্য হাত কেটেছিল। দরদর করে রক্ত ঝরে তার লাল হয়ে যাচ্ছিল মাটি কিন্তু সে এতটুকু আহ, উহ শব্দ পর্যন্ত করছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে নিজের বিভাগের বড়ভাই সবুজের কথা শুনেছিলাম। সবুজ ভাই একদিন গো ধরলেন যে ডায়না আপুকে আজ বলতেই হবে উনি তাকে ভালোবাসেন কিনা। ছুটির পরেও বিভাগের ক্লাসরুমে ছিল সবুজ ভাই। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছিল তাও হলে যাবার নাম নেই। পরে স্যার বিষয়টা জানার পর ডায়না আপুকে ডাকা হয়। ডায়না আপু সব জেনে তার পারিবারিক সমস্যার কথা বলে। স্যার আপুর মা-বাবার সাথে ফোনে কথা বলেন। তারা বলেন-‘স্যার, আপনি যা ভালো মনে করেন তাই করুন। ‘স্যার ডায়না আপুকে বললেন-‘ডায়না, তুমি সবুজের সাথে বন্ধুর মতোই থাকো।কথা বলো। পরে যদি তোমার ভালো লাগে তাকে সেটা তখন ভেবে দেখো। ‘ডায়না আপুকে পরদিনই সবুজ ভাইয়ের সাথে রিকশায় ঘুরতে দেখা গেছে। প্রেমিকের কান্ডের কী আর শেষ আছে! এরকম অনেক জানা-অজানা প্রেমিক মিলিয়ে প্রেমের আলাদা জগৎ রচনা করেই যে যার মতো বিশ্বপ্রেমিক হয়ে গেছে।
শহীদুল ইসলাম খোকন তাহলে একটা নিপাট রোমান্টিক সিনেমা বানিয়েছেন এমনটা ভাববেন যারা অাজও সিনেমাটি দেখেনি। যারা দেখেছে তাদের কথা ভিন্ন। কারণ, তারা একে শুধুই রোমান্টিক সিনেমা বলবে না।রোমাঞ্চের মধ্যে খোকনসাহেব মিশিয়ে দিয়েছেন দুর্দান্ত সাইকোপ্যাথ থ্রিলারের অামেজ। এ আমেজকে ব্যবহার করতে তাঁর দাবার গুটি মাস্টার আর্টিস্ট হুমায়ুন ফরীদি। সাইকোপ্যাথ কিলার অনেক দেখা যায় যাকে বাস্তবে ও সিনেমায় সিরিয়াল কিলাররূপে মেলে। বাংলাদেশে এরশাদ শিকদারের বর্বর সিরিয়াল কিলিং কিংবা নিকট অতীতে নসুর ঘটনাও স্মরণযোগ্য। নসু মেয়েদের ধর্ষণ করত তারপর হত্যা করত। বিশ্বপ্রেমিক সিনেমায় হুমায়ুন ফরীদি সাইকোলজির দিক থেকে হতাশ এক লোক। যার হতাশা তৈরির কারণ হিশেবে তার মা অন্যতম প্রধান কারণ। তার মা তার বাবাকে হুইল চেয়ার থেকে ফেলে দিয়ে মেরেছিল। মাকে তাই শত্রু ভাবে। তার আরো বড় শত্রু আছে। এখানে পরিচালক খোকন ফরীদিকে দিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করেন। সাইকোপ্যাথ কিলিং এ একটা সূক্ষ্ম উপাদান দিয়ে দেন সেটা হচ্ছে মেয়েদের গলার নিচে ‘তিল।’ ফরীদি বলে-‘ঐ তিল থাকা ভালো না। ওতে মেয়েরা নষ্ট হয়ে যায়। ওটা কেটে ফেলতে হয় নইলে পুরুষরা বারবার ঐ তিলের দিকে তাকাবে আর তোমার প্রতি কামবাসনায় পড়বে। ‘বৈজ্ঞানিক দিক থেকে কামবাসনাকে ফ্রয়েডীয় ভাষায় ‘eros’ বলে। এর জন্য নারী-পুরুষের আকর্ষণ হয় পরস্পরের প্রতি। মূলত পুরুষ নারীর প্রতি আকর্ষিত হয় বেশি এবং তা নারীর সৌন্দর্যের জন্য। সৌন্দর্যের একটা উপাদান সিনেমায় ‘তিল’-কে দেখানো হয়েছে আর ফরীদি সেটার জন্যই মেয়েদের ধরে আনে তিল কেটে নেবার জন্য। মেয়েরা বাধা দিলে খুন করে তিল কেটে নেয় তারপর জমায়। এই স্টোরি টেলিংকে যদি কেউ উদ্ভট ভাবে তবে সেটা ভুল হবে আবার ঠিকও হবে। কারণ উদ্ভট বা ‘absurdity’ সাইকোপ্যাথের বিষয়। উদ্ভট আচরণ সাইকোলজির সমস্যা থেকেই আসে। এই সাইকোপ্যাথ থ্রিলিং খোকন সাহসীভাবে করেছেন যার পেছনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। কমার্শিয়াল এক্সপেরিমেন্টে খোকন সেদিক থেকে তাঁর সময়ের থেকে আধুনিক ছিলেন।
হুমায়ুন ফরীদি কলেজের বড়ভাই। টিচারকে সালাম দিলে টিচারই উল্টো লজ্জিত হয়ে বলে-‘কেন লজ্জা দিচ্ছেন বড়ভাই। আপনি অামার দু’বছরের সিনিয়র ছিলেন। ‘এসময় ফরীদি বলে-‘ছোকরার স্মরণশক্তি আছে’। নির্মল কমেডির কাজটাও ফরীদি করেছেন। রোমান্টিক আবহটা রুবেল মৌসুমীকে দেখার পর শুরু হয়। প্রেমের প্রস্তাব দিলে ফিরিয়ে দেয়। রুবেল হাল ছাড়ে না। কলেজ ক্যাম্পাসে, টেলিফোনে বিরক্ত করতেই থাকে।ড্রাইভার সাজে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিশেবে ভেসে আসে ‘i will do anything for love’ গানের লাইন”। মৌসুমীর মন গলে না উল্টো রুবেলকে শায়েস্তা করতে গুণ্ডা ভাড়া করে কিন্তু কাজ হয় না মার্শাল আর্টের দক্ষ নায়কের কাছে। রুবেলের ব্রেইন টিউমারের খবরটা মৌসুমীকে দেয় সোহেল রানা। ছয় মাস আর বাঁচবে শুনে মৌসুমীর মন গলে। তারপর প্রেম এবং বিয়ে।
সিনেমায় রোমাঞ্চ ও থ্রিলারের মাঝে সংযোগটা আনতে শহীদুল ইসলাম খোকন হুমায়ুন ফরীদিকে রাখেন ট্রাম্পকার্ড হিশেবে। ফরীদিকে মৌসুমী মিথ্যে করে বলে যে তাকে বিয়ে করবে, তার বাবার সাথে দেখা করতে। মিষ্টি নিয়ে বাসায় হাজির হয়ে নিজেকে পাত্র পরিচয় দেয়। মৌসুমীর বাবা খলিল মেজাজ করে আর মৌসুমী শুনে হাসিতে লুটোপুটি খায়। ফরীদির শত্রুতা তখন রুবেলের সাথে কারণ মৌসুমীর প্রেমিক আর রুবেল বাঁচবে অল্পদিন সেটা প্লাস পয়েন্ট তার জন্য। এর মধ্যে ফরীদি নিজের চাকর বাবর শেঠের বউকে খুন করে তিল থাকার কারণে।রুবেলের অপারেশনের সময় মৌসুমীর গলার নিচে তিল দেখতে পায় ফরীদি। অতঃপর ফাইনাল টার্গেট মৌসুমী।ঘরে আটকে রেখে তিল কাটতে চায়। ফরীদির মা মৌসুমীকে ছেড়ে দিলে মাকে খুন করে। মাকে খুন করার মাধ্যমে সাইকোপ্যাথের কিলিং মিশনে চূড়ান্ত দিকটা ধরা পড়ে যে এরা যে কাউকে খুন করতে পারে। মৌসুমীকে খুনের চেষ্টা করলেও সোহেল রানা সবাইকে জানায় ফরীদি মানসিক রোগী। রুবেল উদ্ধার করে মৌসুমীকে আর ফরীদি আত্মহত্যা করে।সাইকোপ্যাথরা নিজেকে শেষ করে নতুবা অন্যকে।
এ সিনেমার শক্তিশালী প্রেজেন্টেশন হলো ভিলেনকে নায়কের চেয়ে প্রেজেন্টেবল করা এবং খোকনসাহেব তা পেরেছেন। হুমায়ুন ফরীদিকে দিয়ে তাঁর কমার্শিয়াল সিনেমার অন্যতম সেরা অভিনয় আদায় করে নিয়েছেন। তিল কাটার সময় ফরীদি যেমন নৃশংস আবার মৌসুমীর বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে ততটাই রোমান্টিক। রোমাঞ্চে ডুবে গাওয়া বিখ্যাত সেই গান ‘তোমরা কাউকে বোলো না’ একটা মাইলফলক গড়েছে বাংলাদেশের টোটাল সিনেমায়।এরকম গান আর একটাও নেই। গানে ফরীদির ঘাড় পর্যন্ত লাল চুল, মনোহর নাচ আর অসম্ভব সুন্দর সব রোমান্টিক এক্সপ্রেশন মুগ্ধ করে।মুগ্ধ করে তার কো-আর্টিস্ট মৌসুমীর অনবদ্য কস্টিউম, গ্ল্যামার অার স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয়। গ্রেট প্রেডাক্ট তৈরিতে এ গানে ভিলেন-নায়িকার ব্যতিক্রমী কেমিস্ট্রি সিনেমাটিকে অনেকদূর এগিয়ে দিয়েছে এবং অাজ পর্যন্ত স্মরণীয় করেছে। মৌসুমী-রুবেলের খুনসুটি জমজমাট ছিল। প্রেম ও বিয়ের পর রুবেল একদিন অনেক রাতে জেগে থাকা মৌসুমীকে শুয়ে পড়তে বলে।মৌসুমী বলে -‘তুমি ঘুমাবে না?’ রুবেল বলে-‘আমি তো গভীর ঘুমে তলিয়ে যাব।’ মৌসুমী চমকে ওঠে। এভাবে স্যাড ভার্সনের পার্টও সিনেমায় বড় ভূমিকা রেখেছে। ফরীদি, রুবেল ও সহশিল্পীদের পারফর্ম করা ‘এ কী কথা শুনাইলি রে’ গানটি এনজয়অ্যাবল। এছাড়া ‘শিখা আমার শিখা’ অসাধারণ আর একটা রোমান্টিক গান। মৌসুমী হেলিকপ্টারে করে রুবেলকে প্রপোজ করতে আসার সিকোয়েন্সটি দুর্দান্ত। পরিচালক রোমাঞ্চ, সাইকো থ্রিলিং এবং কমার্শিয়াল সিনেমার অন্য সব দিক ব্যালেন্স করে সিনেমাটিকে ওভারঅল উপভোগ্য করেছেন। স্পেশালিটি থেকে এক্সপেরিমেন্টের বিষয়গুলো উপভোগ্য ফুল প্যাকেজ করেছে এবং সেভাবেই বিশ্বপ্রেমিক কমার্শিয়াল মাস্টারপিস।
বিশ্বপ্রেমিক মনে মনে সবাই।সবাই চায় প্রিয়জন ভালো থাকুক। তাই বলা কর্তব্য ‘পৃথিবীর যাবতীয় প্রেমিক-প্রেমিকারা ভালো থাকুক।’
পোস্টার কৃতজ্ঞতা : সানোয়ার সানু ও মো. সাইফু্ল