ভাই ও বন্ধুর গল্প
পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি – ভাইবন্ধু
পরিচালক – দারাশিকো
শ্রেষ্ঠাংশে – জাফর ইকবাল, ইলিয়াস কাঞ্চন, সোহেল চৌধুরী, দিতি, সুনেত্রা, তামারা, মঞ্জুর রাহী, সুরুজ বাঙ্গালী প্রমুখ।
উল্লেখযোগ্য গান – ভেঙেছে পিন্জর মেলেছে ডানা, তুমি এলে সমুখে, সত্য কি মিথ্যে কি, অাজকে মাফ কালকে মাফ, অাপনা হাত জগন্নাথ।
মুক্তি – ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৮৬
পৃথিবীতে সম্পর্কের কত নাম দেয়া যায়?এটা মনে হয় না কারো জানা আছে। সম্পর্কই ঠিক করে দেয় তার নামটা কি হবে। দুটি তরুণ তাজা প্রাণের সম্পর্ককে যখন মনের টানে বেঁধে আপন করে নেয়া হলো নাম হয়ে গেল ‘ভাইবন্ধু।’ ছবির এ নামের অর্থটা জানতে বা অনুভব করতে একদম ফিনিশিংটা আগে বলতে হয়। জাফর ইকবাল বলছে-‘আমার ভাইয়ের মতো বন্ধুকে আমি হারিয়ে ফেলেছি সেই বন্ধুকে আমি ফেরত চাই।’ ইলিয়াস কাঞ্চনের সাথে দূরত্ব হওয়াতে যে সম্পর্কের ক্ষতি হয়েছিল সেখানে ভাই ও বন্ধুর দাবি সমানভাবে ছিল। সুন্দর সেই সম্পর্ক যার মধ্যে ‘ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্ব’ একসাথে থাকে। ছবির ‘ভাইবন্ধু’ নামটিতে একটা গভীর আবেগ আছে। উর্দুতে ভার্সনে এ ছবির নাম ‘ডিস্কো দিওয়ানে।’
বন্ধুত্বটা আগে হয়েছিল জাফর ইকবাল ও কাঞ্চনের। কাঞ্চন পুরোদস্তুর মাস্তান। জাফর অন্ধ, গান গায়। লোকে সাহায্য করে। একদিন বৃষ্টির রাতে দিতিকে গুন্ডাদের হাত থেকে বাঁচায় কাঞ্চন। তারপর দিতির সাথে ভাইবোনের সম্পর্ক। ভাইবোনের মধ্যে জাফরকে দেখে কাঞ্চন। পরিবারে কাঞ্চন যখন বাজার করে আনে, দিতিকে শাড়ি কিনে দেয় আর দিতি জাফরকে দেখিয়ে বলে-‘দেখ, ভাইয়া বাদশা ভাই কত সুন্দর শাড়ি কিনে দিয়েছে’ জাফর তখন অপরাধবোধে ভোগে কারণ সে বোনকে কিছু দিতে পারে না। না খেয়ে উঠে যায়। কাঞ্চন তখন জাফরকে বোঝায় তারা ভাই ভাই। জাফরের গানের গলা ভালো দেখে সঙ্গীত প্রতিযোগিতার আয়োজনে যায় তাকে নিয়ে। রাজি করিয়েই ছাড়ে আয়োজকদের। একদম আনকোরা একজনকে দিয়ে গাওয়ানোর চিন্তায় প্রথমে তারা রাজি হয় না। পরে কাঞ্চনের অনুরোধে রাজি হয়। ব্যবস্থা হয়ে গেলে জাফর পর্দার আড়াল থেকে গান গায় আর কাঞ্চন স্টেজে পারফর্ম করে ঠোঁট নাড়িয়ে। জাফর ও কাঞ্চনের বন্ধুত্বটা জমে ওঠে। ভাইয়ের মতো আপন করে বন্ধুত্বটাকে তারা দুজনই অনুভব করে।
যত ভালো সম্পর্কই থাকুক তৃতীয় পক্ষ বা শত্রু কলকাঠি নাড়লে আর রক্ষা নেই। কাঞ্চনের মাস্তানি জীবনের প্রতিপক্ষ ছিল মণ্জুর রাহী। সে চিন্তা করে কিভাবে কাঞ্চনের সাম্রাজ্য ধ্বংস করা যাবে। জাফরের চোখ অপারেশন হয়। চোখ ভালো হবার পরে একদিন মণ্জুর রাহী তাকে বোঝায় আর কতদিন অন্যের নামে চলবে কারণ দর্শক জানে কাঞ্চনই শিল্পী কারণ সে স্টেজে পারফর্ম করে। জাফর চিন্তাটা সিরিয়াসলি নেয়। সে ভাবে সত্যিই তো তার সাম্রাজ্যে সেই রাজা। কাঞ্চনের সাথে দূরত্ব আসে। কাঞ্চন ঘটনা বুঝতে পেরে নিজেই পর্দার আড়ালে থাকা জাফরকে দেখায় দর্শককে। তারপর স্বার্থপরতা ও দূরত্ব।
ফিনিশিং ছিল ছবির সবচেয়ে টাচি এবং ছবিটা ফিনিশিং-এর জন্যই স্মরণীয়। জাফর ইকবাল নিজে ভুল ভাঙিয়ে আবারও মাস্তানি শুরু করা কাঞ্চনকে ফিরিয়ে আনতে যায়। ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার সময় তাকে গুলি করে মণ্জুর রাহী। কাঞ্চনের সাথে ফাইট হয় মণ্জুর রাহীর। কাঞ্চনও মারাত্মক আহত হয়। দিতি অনেক কষ্টে তাকে হাসপাতালে নেয়। জাফর, তার মা কাঞ্চনকে দেখতে গেলে দিতি ভেতরে ঢুকতে দেয় না। জাফরকে কথা শুনিয়ে দেয়। সে অন্ধ ছিল, ভিক্ষা করত, মানুষ করুণা করত। সেখান থেকে কাঞ্চনই তাকে নতুন জীবন দিল অথচ তাকেই সে পর করে দিল স্বার্থের জন্য। সবাই ভেতরে ঢোকে কাঞ্চনের জ্ঞান ফিরে এলে। জাফর আর যেতে পারে না অপরাধবোধের জন্য। দিতির কথাগুলো তার কানে বাজে। নিজেকে শাস্তি দিতে ঢুকে পড়ে অপারেশন থিয়েটারে। পেছন থেকে মা টের পায়। অনেক ডাকার পরেও দরজা খোলে না। দৌড়ে গিয়ে সবাইকে জানায়-‘রাজা অপারেশন থিয়েটারের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।’ কাঞ্চন ‘না’ বলে চিৎকার দিয়ে দৌড় দেয়, পেছনে বাকি সবাই। ততক্ষণে সব শেষ। জাফর তার চোখ দুটো ইনজেকশনের সিরিন্জ দিয়ে অন্ধ করে দিয়েছে। চোখ দিয়ে রক্ত পড়ছে, সানগ্লাস পরা। দুঃসহ সে দৃশ্য সবাই দেখে আর বিস্মিত হয়। কাঞ্চন বলে-‘এ তুই কি করলি রাজা, আমার সব স্বপ্ন এমনি করে নষ্ট করে দিলি!’ জাফর নিজের ভুলগুলো বলতে থাকে যার মধ্যে অন্যতম সংলাপ ছিল এটা-‘আমার ভাইয়ের মতো বন্ধুকে আমি হারিয়ে ফেলেছি। আমার বোন আমার চোখ খুলে দিয়েছে। তার সমস্ত কথা আমার সারা শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দিল। তাই আর থাকতে পারলাম না।’ দিতি ভাইকে জড়িয়ে বলে-‘চুপ করো ভাইয়া, আর বোলো না, আমি আর সহ্য করতে পারছি না।’ কি হবে জাফরের শেষ পরিণতি! সবাই তার পাশে থাকবে তো!
ছবিটি মাল্টিস্টারার। জাফর ইকবাল, ইলিয়াস কাঞ্চন, দিতি, সুনেত্রা, তামারা তারা সবাই আলাদা ক্যারেক্টার প্লে করেছে। জাফরের নায়িকা ছিল এশিয়া মাইরের তাজিকিস্তানের মেয়ে তামারা, কাঞ্চনের নায়িকা সুনেত্রা, দিতির নায়ক সোহেল চৌধুরী। অবাক করা বিষয় দিতি আর কাঞ্চন ছিল ভাইবোনের চরিত্রে। সবার অভিনয় ছিল প্রাণবন্ত। জাফর ইকবাল যখন ইনজেকশনের সিরিন্জ নিয়ে এক্সপ্রেশনটা দেয় ওটা ছিল পুরো ছবির বেস্ট এক্সপ্রেশন। খল চরিত্রে মণ্জুর রাহী দারুণ।
মিউজিক্যাল ছবি ‘ভাইবন্ধু।’ সব কটা গানই হিট। কালজয়ী গানও আছে এর মধ্যে। ‘ভেঙেছে পিণ্জর মেলেছে ডানা’ এ গানটি কালজয়ী। স্টেজ পারফরম্যান্সে গানটি জমকালো। গানের জনপ্রিয়তা সব বয়সের দর্শকের কাছে সমান এটি এমন একটি গান। বিশেষ করে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে বিভিন্ন উৎসবে গাইতে দেখা যায় তরুণ প্রজন্মকে। ‘তুমি এলে সমুখে’ এ গানটি আরো জমকালো। গানের সুর যে কারো মনকে কেড়ে নেবে। গানে পর্দার আড়ালে জাফর ইকবালের গীটারের সাথে নিজস্ব স্টাইলিশ লুকে গাওয়া আর কাঞ্চনের স্টেজে ঠোঁট নাড়ানো অসাধারণ। কাঞ্চনের সাথে আছে সুনেত্রা। ‘সত্য কি মিথ্যে কি’ এ গানটার আয়োজন কমেডি দিয়ে শুরু। কাঞ্চন তো ঠোঁট মেলায় সেটা কেউ জানে না। প্রেমিকা সুনেত্রা গান শুনতে চায় তাও আবার সোজা বাসায় চলে আসে। শেষে জাফর যায় সোফার ওপারে আর কাঞ্চন এপারে তারপর চলে গান। গানের বৈচিত্র্য ছিল ইনডোর+আউটডোর স্যুটে। ‘আজকে মাফ কালকে মাফ পরশু কি হবে’ টাচি এবং অর্থবহ গান। এছাড়া স্টেজ পারফরম্যান্সে আর একটা গান আছে-‘আপনা হাত জগন্নাথ কে কারে ভাবে রে।’ অসাধারণ ওটাও। সুনেত্রা এ গানটা দিয়েই কাঞ্চনের প্রেমে পড়ে।
ছবির লক্ষ্য করার মতো দিক হলো আশির দশকে তখনকার সময়ে বিগবাজেটের কাজ এটা। স্টেজ পারফর্মে জাফর ইকবাল ও কাঞ্চনের কস্টিউম দেখলে বোঝা যায়। জমকালো ছিল।
সম্পর্কের গভীরতা থাকলে সেটি ভাইয়ের মতো মমতার আবার বন্ধুর মতো পাশে থাকার দুটোই এক হয়ে যায় এবং সে সম্পর্কের চমৎকার পরিচয় হয় ‘ভাইবন্ধু।’ আমাদের কৈশোরকালের অন্যতম সেরা স্মরণীয় ছবি যার পেছনে অনেক স্মৃতি আছে অনেকের এটুকু হলপ করে বলা যায়।