ভালোবাসার এক ডজন সিনেমা
ভালোবাসা চিরন্তন। আর এই রূপটি বাংলা চলচ্চিত্রে এসেছে নানারূপে নানাভাবে। সেই সাদাকালো যুগের সেলুলয়েডের ফ্রেমে কিংবা রঙিন জগত থেকে হালের ডিজিটাল পর্দায় ধরা পড়েছে ভালোবাসা। বাংলা চলচ্চিত্রে ভালোবাসার সিনেমাগুলোর অন্যরকম আবেদন আছে।
৬০ বছরে অসংখ্য ভালোবাসার সিনেমা মুক্তি পেয়েছে ঢালিউডে, গুটি কয়েক ছাড়া বেশিরভাগ সিনেমাই পেয়েছে দারুন জনপ্রিয়তা। সেখান থেকে সেরা ভালোবাসার সিনেমা বের করাও কষ্টসাধ্য। আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে বাংলা চলচ্চিত্রের ভাণ্ডার থেকে অন্যতম সেরা ১২টি সিনেমা—
১. মনপুরা (২০০৯) : সোনাই ও পরীর গল্প। এক নির্জন দ্বীপে খুনের দায়ে পলাতক সোনাইয়ের সাথে মাঝিকন্যা পরীর প্রেমের গল্প। দুরন্ত প্রেম-ভালোবাসার মানুষের জন্য হাহাকার আর শেষে বিয়োগাত্মক পরিনয়। এই নিয়েই ‘মনপুরা’র গল্প।নাট্যনির্মাতা গিয়াসউদ্দিন সেলিমের পরিচালনায় এই ছবিতে মুখ্যভূমিকায় ছিলেন চঞ্চল চৌধুরী ও ফারহানা মিলি।দর্শক মহলে সিনেমাটি দারুন সাড়া জাগিয়েছিল,নাম লিখিয়েছিল বছরের সবচেয়ে বানিজ্যিক সফল হিসেবে।শুধু দর্শক নয় মন ভরিয়েছে সমালোচকদের ও।আর তাই জাতীয় পুরস্কারে সেরা চলচ্চিত্র সহ একাধিক শাখায় পুরস্কার অর্জন করে ছবিটি।এই ছবির মাঝ দিয়ে যেন বাংলা চলচ্চিত্র তাঁর পুরনো রুপ খুঁজে পেয়েছিল। শুধু ভালোবাসার সিনেমা হিসেবেই নয়,এই সিনেমার গানগুলিও জনপ্রিয়তায় এখনো শীর্ষে।
২. হঠাৎ বৃষ্টি (১৯৯৮) : জগতে প্রথম দর্শনে কারো জীবনে ভালোবাসা হয় আবার কেউবা এক সাথে পথ চলতে চলতে ভালোবাসার সাগরে নিমজ্জিত হয় ।কিন্তু কিছু প্রেম-ভালোবাসা থাকে যা গতানুগতিক ভালোবাসা থেকে কিছুটা ভিন্নতর হয় ।তেমনই এক দুষ্ট প্রেমের মিষ্টি ছবি নিয়ে
পরিচালক বাসু চ্যাটার্জি উপস্থিত হলেন ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ নিয়ে।অজিত আর দীপার গল্প,পত্রমিতালীর মাধ্যামে দুটি অচেনা মানুষের ভালোবাসা নিয়ে নির্মিত এই ছবিতে মূল চরিত্রে ছিলেন ফেরদৌস ও প্রিয়াঙ্কা।একটি তামিল সিনেমা থেকে রিমেককৃত এই ছবিটি দুই বাংলার যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হয়য়।ছবিটি আজো দর্শকদের কাছে সমান জনপ্রিয়,মায়াবী সুর ও কথার গানগুলো সিনেমাটিকে দিয়েছে ভিন্নমাত্রা।ভীষন জনপ্রিয়তা পাওয়া এই ছবিটি একাধিক শাখায় জাতীয় পুরস্কার ও পেয়েছিল।
৩. শ্রাবণ মেঘের দিন (১৯৯৯) : নন্দিত কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ নির্মান করলেন ভালোবাসার সিনেমা ‘শ্রাবন মেঘের দিন’।গায়েন মতি,গ্রাম্য কিশোরী কুসুম,জমিদার নাতনী শাহানা,আর শহুরে যুবক সুরুজের মাঝে যে অব্যক্ত প্রেমের মানসিক টানাপোড়ন,তা দর্শকদের মনে ভীষনভাবে নাড়া দিয়েছিল।দারুন সব গান,দুর্দান্ত গল্প,নির্মানশৈলীর কারনে দর্শকমহলে এই সিনেমাটি ভীষন গ্রহনযোগ্যতা পেয়েছিল,হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে জনপ্রিয় সিনেমা হিসেবে এই ছবিটি স্বীকৃত। জাহিদ হাসান,শাওন,মুক্তি,মাহফুজ আহমেদ অভিনীত এই ছবিটি দর্শকপ্রিয়তার পাশাপাশি জাতীয় পুরস্কারেও বেশ জয়জয়কার ছিল।
৪. দেবদাস (১৯৮২) : অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অমর প্রেমের উপন্যাস অবলম্বনে চাষী নজরুল ইসলাম নির্মান করেন ‘দেবদাস’। পার্বতীর সাথে দেবদাসের প্রেম, দুইজনের মধ্যে বিচ্ছেদ,মাঝে বাঈজী চন্দ্রমুখীর আগমন,আর শেষদৃশ্যে দেবদাসের করুন পরিনতি।পুরো উপন্যাস যেন ফুটে উঠেছিল এই সিনেমায়,আর তাই পেয়েছেও দারুন জনপ্রিয়তা।দেবদাস চরিত্রে বুলবুল আহমেদের অনবদ্য অভিনয় এখনো দর্শকদের মনে গেঁথে আছে,সাথে পার্বতী চরিত্রে মিষ্টি মেয়ে কবরী, আর চন্দ্রমুখী হয়ে আনোয়ারা ছিলেন এই সিনেমার অন্যতম প্রান।
৫. মনের মাঝে তুমি (২০০৩) : দুই বাংলার যৌথ প্রযোজনায় মতিউর রহমান পানু একটি সিনেমা বানালেন।ওপার বাংলায় ছবিটা ভালো চলল না,কিন্তু এই বাংলার দর্শকরা ভালো ছবি চিনতে ভুল করে নি।লুফে নিলেন বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম সেরা ভালোবাসার সিনেমা ‘মনের মাঝে তুমি’। ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়া প্রেম আবার খুঁজে পাওয়া,চিনেও ভালোবাসার মানুষের কাছে অচেনা হয়ে ধরা দেওয়া।এ যেন এক অন্যরকম ভালোবাসার বহি:প্রকাশ।একটি তামিল সিনেমা থেকে রিমেককৃত এই সিনেমাটি নাম লিখায় বছরের সর্বোচ্চ ব্যবসাসফল ছবির তালিকায়।এই সিনেমার মূল পাত্র পাত্রী রিয়াজ ও পূর্ণিমা দর্শকদের মনে এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিলেন।দুর্দান্ত নির্মানশৈলীর পাশাপাশি এই সিনেমার গানগুলি বাংলা সিনেমায় এক বিশাল জোয়ার বয়ে এনেছিল।
৬. সুজন সখি (১৯৭৫) : দুই গ্রাম্য যুবক যুবতীর ভালোবাসা,সাথে দুই ভাইয়ের পারিবারিক দন্ধ এই নিয়েই ফারুক-কবরীর জনপ্রিয় সিনেমা ‘সুজন সখি’।খান আতাউর রহমানের কাহিনী,সংগীত,প্রযোজনায় সিনেমার নির্মানের দায়িত্ব ছিলেন প্রমোদকার।ছবিটি সেই সময়ে দর্শকদের মনে সাড়া জাগিয়ে নাম লিখিয়েছিল বাংলা ছবির সর্বোচ্চ ব্যবসাসফল ছবির তালিকায়,এই স্থান প্রায় এক যুগের ও বেশি সময় ধরে ছিল।এই সিনেমার ‘সব সখীরে পার করিতে’ গানটিকে বলা হয় বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রেম নিবেদনের অন্যতম সেরা গান।
৭. ভেজা চোখ (১৯৮৮) : অসুস্থ প্রেমিকের প্রতি প্রেমিকার ভালোবাসা,কাছে আসার আকাঙ্ক্ষা।দুই তরুন তরুনীর এই গভীর ভালোবাসা পর্দায় ধরা দিয়েছিল শিবলী সাদিকের চলচ্চিত্র ‘ভেজা চোখ’ হয়ে।ইলিয়াস কাঞ্চন ও চম্পা অভিনীত অন্যতম এই ছবিটি ছিল তাদের ক্যারিয়ারের অন্যতম মাইলফলক।
৮. কেয়ামত থেকে কেয়ামত (১৯৯৩): দুই পরিবারের দ্বন্দ্ব,তাদের সন্তানদের অবুঝ ভালোবাসা,আর শেষে দুইজনের বিয়োগাত্মক সমাপ্তি।এই নিয়েই সোহানুর রহমানের সোহানের ইতিহাস সৃষ্টিকারী ছবি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’।একটি জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমার এই রিমেক ছবিতে আবির্ভাব ঘটেছিল সালমান শাহ ও মৌসুমীর,যারা পরবর্তীতে দর্শকদের কাছে খুব তাড়াতাড়ি জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে শীর্ষস্থান দখল করেছেন।গানগুলিও পেয়েছে দারুন দর্শকপ্রিয়তা।
৯. লাভ স্টোরি (১৯৯৫) : কাজী হায়াত সাধারনত যে ধারার সিনেমা বানান,সেইখান থেকে এই ছবি বেশ আলাদা। এক মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়েকে তাঁর বাবা শহরে নিয়ে আসে চিকিৎসার জন্য,সেখানে প্রেমে পড়ে এক ডাক্তারি পড়ুয়া ছাত্রের। কাজী হায়াতের দক্ষ নির্মানশৈলী,দুর্দান্ত গল্প পাশাপাশি রোজি সেলিম,পল্লব,আসাদের অভিনয় সিনেমাটিকে করেছে এক কথায় অনবদ্য।সম্ভবত তারকাখচিত না হওয়ায় বানিজ্যিকভাবেও সফল হয়নি,তাই বেশ ভালো সিনেমা হয়েও অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত এই সিনেমাটি।কাজী হায়াতের অন্যতম সেরা ছবি তো বটেই,পাশাপাশি ভালোবাসার সিনেমা হিসেবেও এটি অন্যতম।
১০. অবুঝ মন (১৯৭২) : ‘শুধু গান গেয়েই পরিচয়’ জনপ্রিয় এই গানটি কাজী জহিরের ‘অবুঝ মন’ সিনেমার।যাত্রাপথে দুই অচেনা তরুন তরুনীর পরিচয়,অত:পর প্রেম।কিন্তু দুইজনের মাঝে বাঁধা হয়ে দাড়ায় ধর্ম।এমনেই এক ভালোবাসার গল্পে নির্মিত এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন রাজ্জাক ও শাবানা।এটি ছিলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র।
১১. ঘুড্ডি (১৯৮০) : এই সিনেমা তারুন্যের গল্প,প্রথা ভাঙ্গার গল্প,সর্বোপরি এক ভালোবাসার গল্প।এমনই এক ভিন্নধারার গল্পে রাইসুল ইসলাম আসাদ ও সুবর্ণা মুস্তফাকে নিয়ে হাজির হলেন পরিচালক সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী।এই সিনেমা দিয়েই বাংলা চলচ্চিত্রে প্রেম ও ফ্যাশন জগতে এক ভিন্নধারার সৃষ্টি হয়েছিল। তারুন্যের উদ্যেমে পূর্ণ প্রেমিক প্রেমিকার কন্ঠে ‘চলো না ঘুরে আসি’ গানটি আজো সমান জনপ্রিয়।দর্শকপ্রিয়তার পাশাপাশি ছবিটি একাধিক শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেছিল।
১২. আনন্দ অশ্রু (১৯৯৭) : শহুরে গায়ক খসরু গ্রামে বেড়াতে এসে প্রেমে পড়ে কিশোরী দুলীর।কিন্তু চাচার ষড়যন্ত্রে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে,খসরু হয়ে পড়ে মানসিক ভাবে অসুস্থ,এক পর্যায়ে খসরুকে সুস্থকরার দায়িত্ব এসে পড়ে সেবিকা রুপী দুলীর।কিন্তু খসরু আর দুলীর প্রেম পরিনতি পায় এক বিয়োগাত্মক কাহিনী দিয়ে।পরিচালক শিবলী সাদিকের হাত ধরে নির্মিত হয় সালমান শাহ- শাবনূর অভিনীত অনবদ্য প্রেমের সিনেমা ‘আনন্দ অশ্রু’।সিনেমা হলে আশানূরুপ ব্যবসা না করলেও দুর্দান্ত গল্প,নির্মানশৈলী,সুমধুর গান আর অনবদ্য অভিনয়ে সিনেমাটি পরবর্তীতে হয়ে উঠে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি অন্যতম জনপ্রিয় চলচ্চিত্র।