Select Page

‘মহানগর ২’: সিস্টেমের মধ্যে থেকে সিস্টেমকে পরিবর্তনের গল্প

‘মহানগর ২’: সিস্টেমের মধ্যে থেকে সিস্টেমকে পরিবর্তনের গল্প

মহানগর’ হইচইয়ের অন্যতম সেরা ওয়েব সিরিজ। মহানগরের প্রথম কিস্তি কপ-ক্রাইম-থ্রিলার হিসেবে শুরু হলেও দ্বিতীয় কিস্তিতে এসে এই সিরিজকে কোন নির্দিষ্ট জনরাতে ফেলা যাবে না। এতে একাধারে নাটকীয়তা রয়েছে, অপরাধ রয়েছে, থ্রিল রয়েছে, পলিটিক্যাল স্যাটায়ার রয়েছে, এবং এই সব কিছুর পাশাপাশি কমিক রিলিফও রয়েছে।

মহানগরের প্রথম কিস্তি থেকে আমরা ওসি হারুনের (মোশাররফ করিম) সাথে পরিচিত। হারুন একজন ধূর্ত-দুর্নীতিগ্রস্থ পুলিশ অফিসার, আবার অন্যায়ের সাথে আপোষহীন(?) তিনি জানেন আমাদের সিস্টেমের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে ভূত ঢুকে আছে, তা সিস্টেমের মধ্যে থেকেই তাড়াতে হবে। একটা দুর্নীতিকে প্রতিহত করতে আরেকটা দুর্নীতি কাম্য না হলেও ওসি হারুন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলায় পারদর্শী। দুর্নীতি করলেও অন্যায়কারীকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার কারিশমা তার মধ্যে রয়েছে।

যাই হোক, প্রথম কিস্তি যেখানে শেষ হয় তথা সাদা পোশাকে কয়েকজন কর্মকর্তা ওসি হারুনকে গ্রেফতার দেখানোর মধ্য দিয়ে, সেখান থেকেই দ্বিতীয় কিস্তির শুরু। তাকে একটি স্পেশাল ফোর্সের কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়। সেখানে আমরা স্পেশাল ফোর্সের দুজন অফিসারের সাথে পরিচিত হই। দীন মোহাম্মদ বাবরের (ফজলুর রহমান বাবু) নেতৃত্বে দুজনের দল তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা বাবরের সাথে পরিচয়ের পর থেকে বোঝা যায় তিনিও একজন দক্ষ অফিসার এবং জানেন কীভাবে আসামীর কাছ থেকে তথ্য বের করতে হয়। তাকে টেক্কা দিতে ওসি হারুনও প্রস্তুত, কারণ ‘প্রতিপক্ষ প্রত্যক্ষ হোক বা পরোক্ষ, হারুনকে হারানো কিন্তু সহজ নয়!’ এবার শুরু হয় তাদের মধ্যে মেন্টাল গেম।

আগের কিস্তিতে ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর পুত্র আফনান চৌধুরীকে (শ্যামল মাওলা) থানায় আটকে রেখে ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগে তাকে আটক দেখানো হলেও তদন্তকারী কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ থেকে জানা যায় আসলে তাকে অন্য একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে ধরে আনা হয়েছে। দুই বছর আগে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার ফ্ল্যাশব্যাক চলতে থাকে ওসি হারুনের বয়ানে। এই ফ্ল্যাশব্যাকে কতটুকু সত্য বা কতটুকু মিথ্যা আমাদের জানা নেই। এই জিজ্ঞাসাবাদের সাথেই সমান্তরালে চলতে থাকে আফনানের করা অপরাধের প্রমাণ জোগাড়ের ব্যবস্থা, যা ওসি হারুন এই স্পেশাল ফোর্সের অফিসে আটক থেকেই করতে থাকেন তার বুদ্ধিমত্তা ও সোর্স কাজে লাগিয়ে।

অভিনয়ে মোশাররফ করিম বরাবরের মতই সেরা। দুই বছর আগের এবং বর্তমান সময়ের দুটি ভিন্ন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিয়েছেন সাবলীলভাবে। দুই বছর আগে যেখানে তিনি তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন, এখন তিনিই তদন্তের সম্মুখীন হয়েছেন। তদন্তের মুখোমুখি এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও মাথা ঠাণ্ডা রেখে খেলতে পারা খেলোয়াড় তিনি। তদন্তের সম্মুখীন হয়ে তার ট্রেডমার্ক শব্দগুচ্ছ ‘দুটি কথা মনে রাখবে’ ‘দুটি কথা ভুলে যাবেন’-এ পরিণত হয়, কিন্তু সেই পুরনো চার্ম রয়ে যায় এবং ঘটনা বয়ানের পরিক্রমায় প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। তার সাথে পাল্লা দিতে যুক্ত হন ফজলুর রহমান বাবু। তিনি তার ধাঁধা দিয়ে ওসি হারুনকে বিপাকে ফেলতে এবং তার থেকে তথ্য উদ্ধার করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই দুই অসাধারণ অভিনেতা যখন একত্রে স্ক্রিন শেয়ার করেন, তখন তাদের অভিনয় পারদর্শিতা আর কথার খেল পর্দা থেকে বাইরে চোখ রাখতে দেয় না।

আগের কিস্তির শ্যামল মাওলা এই কিস্তিতেও অহংকারী ধনীর দুলালরূপে দৃশ্যমান হলেও এই কিস্তিতে তিনি কিছুটা নিষ্প্রভ। তাকে দিয়ে আগের কিস্তির সাথে যোগসূত্র ঘটানো ছাড়া এই কিস্তিতে তার ভূমিকা তেমন নেই বললেই চলে। এই কিস্তিতে নতুন করে যুক্ত হওয়া অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে বৃন্দাবন দাস তার সহজাত কমিক উপস্থিতির সাথে ওসি হারুনের সহযোগিতায় লিপ্ত ছিলেন। তারই পুত্র দিব্য জ্যোতির রাজনৈতিক ভিক্টিম হিসেবে সুন্দর অভিনয় তার অভিনয়শিল্পী পিতামাতার লিগ্যাসি বহন করে। বাকিদের মধ্যে তানজিকা আমিন ও আফসানা মিমি তাদের চরিত্রগুলোতে যথাযথ নির্বাচন ছিল। রাজনীতিবিদ রজব আলী চরিত্রে অনির্বাণের ক্যামিও প্রেডিকটেবল ছিল। তবে পরের কিস্তি (যদি হয়) তবে ভাল কিছু হতে যাচ্ছে বলে আশা করা যায়।

এবার নির্মাতার প্রসঙ্গে আসা যাক। আশফাক নিপুন ‘মহানগর’ ওয়েব সিরিজ দিয়ে সমসাময়িক সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরার সাহস দেখিয়েছেন। রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় নিরপরাধকে ভিক্টিম বানানো, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপর রাজনীতিবিদদের প্রভাব খাটানো ও তাদেরকে দলের কাজে লাগানো, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অস্ত্র উদ্ধারের নামে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড বা ক্রসফায়ার, ঘুষ-দুর্নীতি, ধর্ষণসহ একাধিক সামাজিক ইস্যু ও আলোচিত ব্যক্তিকে বিভিন্ন রূপক ও ছদ্মনামে চিত্রায়ণ করেছেন। নিপুন ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র ও অপরাধকে একই সুতার গেঁথেছেন ‘নিপুন’ভাবে। তার গল্প বলার ধরন ও নির্মাণশৈলী এই ওয়েব সিরিজটিকে আরও রোমাঞ্চকর করে তুলেছে।

পরিশেষে বলা যায়, ‘মহানগর’ কল্পকাহিনীর আড়ালে আমাদের এই মহানগরের গল্প, এই মহানগরের দর্পণ, যাকে অস্বীকার করা যায় না। ফলে, ‘মহানগর ২’ সিক্যুয়েল হিসেবে চমৎকারভাবে সফল, যেটা সচরাচর সিক্যুয়েলের ক্ষেত্রে হয়ে ওঠে না।

রেটিং:

Rating: 4 out of 5.


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

ব্লগার ও ডেটাবেজ এডিটর: বিএমডিবি

মন্তব্য করুন