মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা অথচ কোনো যুদ্ধ নাই, মুক্তিযোদ্ধাও নাই
‘লাল মোরগের ঝুঁটি’। নুরুল আলম আতিকের সিনেমা। মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা অথচ কোনো যুদ্ধ নাই, মুক্তিযোদ্ধাও নাই। এমনকি বাংলাদেশের পতাকাও দেখা যায় না একবারের জন্যও। অপারেশন জ্যাকপটের পর একাত্তরে আগস্টের পর সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে ঘিরে কাহিনি। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত সেই বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণ নিতে ও সংস্কার করতে সেখানে আস্তানা গাড়ে পাকবাহিনী। গ্রামের মানুষদের শ্রমদাসত্বে বন্দী করে সেই বিমানবন্দর সংস্কারে নামে তারা। যদিও সেই ঘটনাতে স্থির না থেকে গ্রাম বা মফস্বলের মানুষদের যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিই প্রধান হয়ে ওঠে এ সিনেমা, শেষ দৃশ্যে গিয়ে সেখানে উপজীব্য হয়ে ওঠে মোরগ লড়াইয়ের মতো গ্রামীণ একটা খেলা।
স্বাধীনতা বা বিজয় দিবসগুলোতে বিটিভিতে মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা দেখে দেখে বড় হয়ে ওঠা। ফলে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের সিনেমাগুলোর চরিত্র তুলনামূলকভাবে অনেকটা এক। তবে ‘মেঘের অনেক রঙ’ (হারুনর রশীদ, ১৯৭৬), ‘মেঘের পর মেঘ’ (চাষী নজরুল ইসলাম, ২০০৪) সিনেমা দুটিতে গল্পের ক্ষেত্রে ভিন্ন স্বাদ পাওয়া যায়। ‘মেঘমল্লার’ (জাহিদুর রহিম অঞ্জন, ২০১৪) দেখেও কিছুটা। মুক্তিযুদ্ধকালীন দমবন্ধ এক বর্ষার দুর্দান্ত একটা আবহ পাওয়া যায় সিনেমাটিতে। ‘মেহেরজান’ (রুবাইয়াত হোসেন, ২০১১) সিনেমাটিতেও মুক্তিযুদ্ধের ভিন্ন একটা ন্যারেটিভ পাওয়া যায় বলে আমরা শুনে থাকি, যদিও বিধিনিষেধের জেরে সেই সিনেমা দেখা হয়নি।
তবে ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ একেবারেই ভিন্ন বলা যাবে। যদিও মুক্তিযুদ্ধের ছবি বলতেই সাতই মার্চের ভাষণ থাকতেই হবে, বিষয়টা ক্লিশে লাগে। সরকারের অনুদান পাওয়া বলে হয়তো এখানেও রাখতে হয়েছে, তেমনটা মনে হলো। যেখানে সিনেমার গল্পই শুরু হয় একাত্তরের আগস্ট থেকে, মার্চের চার মাস পর।
পাকিস্তানি আর্মির নির্যাতনের ভয়াবহতায় সাহেব চরিত্রের আহমেদ রুবেল পাগল হয়ে যাওয়া অনেকটা বাংলাদেশের বর্তমান চিত্রটাই ধারণ করে যেন। আমরা এখনো মানসিক অসুস্থতার সেই সংকট কাটায় উঠতে পারি নাই। পঞ্চাশ বছরের সেই ট্রমা উল্টা বুমেরাং হয়ে স্বাধীন দেশের জনগণের ওপরে নিপীড়নের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
মুক্তিযুদ্ধের সিনেমাগুলোতে সাধারণত মুক্তিযোদ্ধাদের বা পাকিস্তানি হানাদারদের দৃষ্টিকোণ থেকে গল্প দেখে থাকি আমরা। নিপীড়িত জনগণের সেখানে শুধু রক্তাক্ত হওয়ার পরিণতি। তাদের দৃষ্টিকোণ থেকেও যে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলা যায়, সেটাই দেখাল ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’। এ ক্ষেত্রে ‘শ্যামল ছায়া’ (হুমায়ূন আহমেদ, ২০০৪) সিনেমার কথা একটু বলে নিতে চাই, নৌকা করে দেশ ছেড়ে পলায়নরত মানুষদের চোখে মুক্তিযুদ্ধকে দেখি আমরা।
নুরুল আলম আতিকের সিনেমায় পাক বাহিনীর দোসরদের আলাদা একটা চরিত্র দেখা যায়। ধর্মীয় রাজনৈতিক জায়গা থেকে একাত্তরের দোসরদের আমরা যেভাবে চিত্রায়িত হতে দেখি তার থেকে ভিন্ন। গ্রামের বনেদি পরিবারের ফুটফরমাশ খাটা লোকও সময়-সুযোগ বুঝে রাজাকার হয়ে ওঠে, আতরাফ হয়ে আশরাফদের নিচে থাকতে থাকতে নিজেরও আশরাফ হয়ে উঠার খায়েশ জাগে সেটা দেখা যায় শামসু’র রাজাকার কমান্ডার হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে, নামের সঙ্গে বনেদি পদবি খান যুক্ত করার বিষয়টিও এখানে মনোযোগ রাখে।
আরও পড়ুন: ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ যেন কারবালার ময়দান
গ্রামের মদের কারবার করে বেড়ানো মেয়েই (আশনা হাবিব ভাবনা) এই সিনেমার প্রধান চরিত্র বলা যায়, যার গোপন কাজই হচ্ছে রাতের অন্ধকারে মানুষদের সীমানা পার করে দেওয়া। পাকিস্তানি অফিসারের নিষ্ঠুরতার মুখে সেই কী না আচমকা মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠে শেষ দৃশ্যে। মুক্তিযুদ্ধে বন্দুক না ছুঁয়েও প্রতিরোধী হয়ে উঠার শক্তিশালী ন্যারেটিভ পাওয়া যায় এখানে। মুক্তিযুদ্ধের পুরুষতান্ত্রিক বয়ানের বাইরে গিয়ে এক নারীকে আমরা পাই। গোটা এলাকার প্রত্যেকটা মানুষ বিশেষ করে সংখ্যালঘু মানুষদের ভেতরে একাত্তরের পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল সেটার শক্তিশালী দৃশ্যায়নও দেখা যায় সিনেমাটাতে।
আতিকের সিনেমা হিসেবে তাঁর নির্মাণের মুনশিয়ানার কারণে এই সিনেমা দেখতে যে কারো ভালো লাগবে। এ প্রথম কোনো কাজে ভাবনাকে অভিনয়ে সিরিয়াস মনে হলো আমার। আহমেদ রুবেলের কথাও আলাদা করে বলা লাগে। সেই ‘প্রেত’ ধারাবাহিক থেকে তার ভক্ত। বাকিদের অভিনয়ও বেশ সাবলীল ছিল। অভিনেতারা যে অভিনয় করতেছেন সেইটা উনারা বুঝতে দিতে চান নাই। এটা বেশ ভালো লাগছে। সাদা-কালো কালার গ্রেডিং কারণে মনোযোগ দেওয়া গেছে বেশি। সিনেমাটোগ্রাফি এ সিনেমাকে সিনেমা করে তোলার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে বলতে গেলে। কিছুটা ধীর গতি আর কয়েকটা দৃশ্য অহেতুক মনে হলো। আবার শেষ দৃশ্যটায় কিছুটা তাড়াহুড়োও মনে হলো। লাশ নিয়ে সটকে পড়া ও পাকিস্তানি অফিসারের গুলির বিষয়টা আরেকটু বিশ্বাসযোগ্য করা গেলে গাঁথুনিটা আরও ভাল হতো।
নির্দিষ্ট কোনো লোকেশন বা ঘটনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পর্দায় ওঠা নজির কম। সেদিক দিয়ে এই সিনেমা একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আলাদা করে অনেকগুলো লড়াই ও প্রতিরোধের কথা আমরা জানতে পারি। আছে গোটা জনগোষ্ঠীর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সামাজিক ইতিহাস। যাকে অনেকভাবেই চাইলে সিনেমার পর্দায় তুলে আনা সম্ভব।