Select Page

মেঘমল্লার : মুক্তিযুদ্ধকালীন এক সাধারণ মানুষের অপ্রকাশিত বীরত্বের গল্প

মেঘমল্লার : মুক্তিযুদ্ধকালীন এক সাধারণ মানুষের অপ্রকাশিত বীরত্বের গল্প

কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘রেইনকোর্ট’ গল্পের ছায়া অবলম্বনে লেখক ও পরিচালক জাহিদুর রহিম অঞ্জন নির্মাণ করেন মেঘমল্লার। গল্পটি শুরু হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন বর্ষার মৌসুমে এবং শেষ হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের মধ্য দিয়ে। মাঝে ঘটে যায় কিছু ঘটনা, যা এই চলচ্চিত্রের মূল বিষয়বস্তু।

এটি ১৯৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালীন এক মফস্বল শহরের গল্প। কলেজ শিক্ষক নুরুল হুদা (শহীদুজ্জামান সেলিম) তার স্ত্রী আসমা (অপর্ণা ঘোষ) ও মেয়ে সুধাকে (মারজান হোসেন জারা) নিয়ে কলেজের স্টাফ কোয়ার্টারে থাকে। তার একমাত্র শ্যালক মিন্টু যুদ্ধে গেছে। সেজন্য তারা সারাক্ষণ উদ্বিগ্নতার মধ্য দিয়ে সময় কাটাচ্ছেন। কলেজের অধ্যক্ষ (জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়) কলেজের গুটিকয়েক যে ক’জন শিক্ষক রয়ে গেছেন তাদের সাফ সাফ বলে দিয়েছেন কোথাও না যাওয়ার জন্য। নুরুল হুদা তা পালন করছেন। কলেজে কোন ক্লাস না হওয়া স্বত্ত্বেও প্রতিদিন হাজিরা দেন। কিন্তু বাধ সাধে যখন কলেজে বোমা হামলায় ট্রান্সমিটার উড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। কলেজের পাহারাদার ইসহাক মিয়া তাকে এই খবর দিয়ে যায়। তুমুল বর্ষণের মধ্যে মিন্টুর রেখে যাওয়া রেইনকোট পড়ে কলেজের দিকে পা বাড়ায় নুরুল হুদা। সেখান থেকে তাকে ও ইতিহাসের প্রভাষককে এই হামলার সাথে জড়িত থাকার অপরাধে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় টর্চার ক্যাম্পে। শুরু হয় মারধোর ও জিজ্ঞাসাবাদ। এক পর্যায়ে ভীতু প্রকৃতির নুরুল হুদা নিজের অজান্তেই সাহসী হয়ে ওঠে কিন্তু তা তার জন্য বিপদ ডেকে আনে।

পূর্বেই বলেছি চলচ্চিত্রটি কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘রেইনকোর্ট’ গল্পের ছায়া অবলম্বনে নির্মিত। পরিচালক জাহিদুর রহিম অঞ্জনের এটি প্রথম চলচ্চিত্র। চিত্রনাট্যও তার। অঞ্জন পড়াশুনা করেছেন ভারতের পুনে টিভি অ্যান্ড ফিল্ম ইনস্টিটিউশনে। জানা যায়, তার শিক্ষকগণের মধ্যে একজন ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের ছাত্র মণি কাউল। সেখান থেকে ফিরে এসে তার এই চলচ্চিত্র যাত্রা। যাই হোক, চলচ্চিত্রে সম্মুখ যুদ্ধ, গোলাগুলি বা যুদ্ধকালীন ধর্ষণ ইত্যাদি ক্লিশে বর্জন করেও তিনি ধীর লয়ের স্টোরিটেলিং দিয়ে যুদ্ধের আবহ, দুর্দশা ও ত্যাগের চিত্র তুলে ধরেছেন। এছাড়া দেখিয়েছেন ভাইয়ের জন্য বোনের স্নেহ ও উদ্বিগ্নতা, বাবা-মেয়ের সম্পর্ক, স্বামী-স্ত্রীর আবেগ-অনুযোগ, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ভাতৃত্ববোধ ও শাসকদের অত্যাচারের চিত্র। ছবিতে আবেগঘন বা উত্তেজিত হওয়ার মত কোন সংলাপ ছিল না। তবে যা ছিল তাই ছবির গল্পকে বর্ণনা করতে যথেষ্ট।

প্রধান চরিত্র নুরুল হুদার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন শহীদুজ্জামান সেলিম। গল্পের খাতিরে তাকে সার্বক্ষণিক ভয়ার্ত চেহারায় দেখা যায়। কিন্তু ভীতু এই মানুষটাকেই পাকিস্তানি অফিসারের জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার চরিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে অসম্ভব সাহসী হয়ে ওঠতে দেখা যায়। এই ভীতু মানুষটাই মৃত্যুভয় তোয়াক্কা করে অফিসারে প্রশ্নের জবাবে কিছু না জানা স্বত্ত্বেও বলে ওঠে “আমি সব জানি। ম্যাঁ সব জানতা হুঁ। জয় বাংলা।” তার পরিণতি ছবিটি শেষ হয়ে যাওয়ার পরও দর্শককে ভাবায়। এটাই এই চরিত্রের সার্থকতা।

নুরুল হুদার স্ত্রী আসমা চরিত্রে দেখা যায় অপর্ণাকে। পর্দায় তার প্রথম দৃশ্যে তার ভাই মিন্টুর সাথে কথোপকথনের সময় তার মধ্যে কিছুটা জড়তা দেখা যায়। পরবর্তীতে পর্দায় তার উপস্থিতিতে তা আর দেখা যায় নি। নুরুল হুদা প্রতি বার বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলে তাকে উদ্বিগ্ন দেখা যায়। এই উদ্বিগ্নতার ছাপ প্রকাশ পায় কলেজের ইতিহাসের অপর শিক্ষকের সাথে নুরুল হুদা বেড়িয়ে গেলে যতক্ষণ তাদের দেখা যায় ততক্ষণ তাদের পথের দিকে তাকিয়ে থাকার মধ্যে। কিন্তু সত্যিকারের উদ্বিগ্ন হওয়ার পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র নদীর ঘাটে মাঝির কাছে তার ভাইকে চিঠি দেওয়ার মুহূর্ত বাদে তাকে ততটা উদ্বিগ্ন দেখায় না। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে যায় শেষ দৃশ্যে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময় তার বিহ্বল চাহনি।

বাকি চরিত্রের মধ্যে কলেজের অধ্যক্ষ চরিত্রে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় আর আসমার ভাই মিন্টু চরিত্র ছাড়া বাকিদের তেমন একটা পর্দায় উপস্থিতি ছিল না। নুরুল হুদার মেয়ে সুধা চরিত্রে শিশুশিল্পী মারজান হোসেন জারা তার চরিত্রটিকে খুব উপভোগ্য করে তুলে। তার সারাক্ষণ আঁকিবুঁকিতে লিপ্ত থাকা ও আধ-আধ কথাগুলো শুনতে বেশ মিষ্টি লেগেছে। ছবিটির নান্দনিকতার অন্যতম দিক হল এর চিত্রগ্রহণ। ছবির শুরু থেকেই অপরূপ কিছু দৃশ্য দেখা যায় সুধীর পালসানের ক্যামেরায়। ছবির শুরুই হয় গুল্মজাতীয় ধইঞ্চা গাছে বাতাসের আলোড়ন দিয়ে। পাশাপাশি পরিত্যক্ত রেললাইন, সারাদিন অঝোর ধারার বৃষ্টি, টিনের চাল থেকে চুইয়ে পড়া পানির দৃশ্য, নদী ও নদী তীরের দৃশ্য সব মিলিয়ে চলচ্চিত্রটির নিঃশব্দতা ও ধীর বর্ণনাশৈলীকে প্রাণ দিয়েছে। তবে ঘরের ভিতরকার দৃশ্যে আলোর কমতি চোখে পড়ে। পাশাপাশি সম্পাদনার ক্ষেত্রে অন্ধকার থেকে হঠাৎ প্রচণ্ড আলোতে চলে আসাটা চোখে ধন্দ লাগিয়ে দেয়। এই ব্যাপারে সম্পাদকের একটু সচেতন হওয়া উচিত ছিল। অভিজিৎ বোসের সঙ্গীত প্রাণ দিয়েছে ছবিটিকে। ছবিতে আবহ সঙ্গীতে রাগ ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ব্যবহার ছিল অন্যবদ্য। বিশেষ করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ‘মাগো ভাবনা কেন’ গানের থিম সঙ্গীতের ব্যবহার যুদ্ধের আবহ সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে। সঙ্গীতের পাশাপাশি শব্দগ্রহণে রতন পালের কাজও ছিল ঠিকঠাক। অনবরত বৃষ্টি পতনের শব্দ, এমনকি নুরুল হুদার দাড়ি কাটার শব্দও বাদ পড়ে নি তার অভিজ্ঞ শব্দ ধারণ থেকে। আমরা বীরদের বীরত্ব দেখতে অভ্যস্ত। তাই হয়ত এই ধরনের গল্প আমাদের কাছে একগেয়ে লাগতে পারে। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সবাই বীর ছিল না। নুরুল হুদার মত ভিতু কিন্তু দেশপ্রেমিক মানুষও ছিল। এটা না হয় সেই সকল ভীতু কিন্তু দেশপ্রেমিকদের গল্প। আর জাহিদুর রহিম অঞ্জনের গল্প বলায় একটা হাহাকারের চিত্র ছিল, পাশাপাশি তার নির্মাণের নিপুণতা ছবিটিকে করেছে অনন্য।

ছবিঃ চলচ্চিত্রের অফিসিয়াল ফেসবুক পাতা থেকে সংগৃহীত।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসব – ২০১৭’ থেকে
চলচ্চিত্র – মেঘমল্লার
চিত্রনাট্য ও পরিচালনা – জাহিদুর রহিম অঞ্জন
কুশীলব – শহীদুজ্জামান সেলিম, অপর্ণা ঘোষ, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, আমিনুর রহমান মুকুল, মারজান হোসেন জারা
মুক্তি – ১২ ডিসেম্বর ২০১৪
রেটিং – ৪/৫


Leave a reply