যন্ত্রণা : যে জ্বালা অাজও শেষ হয়নি
সিনেমার নামে একটা অার্তনাদ অাছে। সত্তর দশকে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী যে সংগ্রাম সাধারণ মানুষ দেশগড়ার জন্য করেছে অন্যদিকে দেশের সম্পদ লুট করে সুবিধাবাদী বিভিন্ন অাধিপত্যবাদী রাজনৈতিক দল যে চক্র গঠন করেছিল তার একটা স্টেটমেন্ট অাছে সিনেমায়। সেসব সুবিধাবাদীরা মিডিয়ায় নিজেদের দেশের কাজ করা নেতা বলে প্রচার করত। সৎ সাংবাদিকদের এড়িয়ে যেত। বেকারত্ব ভয়ংকর অাকার ধারণ করেছিল। তারই প্রভাবে তরুণ যুবসমাজ এক একটা দল গঠন করে সন্ত্রাসের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছিল। যার কারণে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী আশির দশকে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে বিষিয়ে তুলেছিল সুবিধাবাদী পুঁজিবাদী গোষ্ঠী। এই রাজনৈতিক বাস্তবতায় কাজী হায়াৎ নির্মাণ করেন ‘যন্ত্রণা’ সিনেমা।
বহুল পঠিত একটা কথা অাছে-‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন’। একদম অক্ষরে অক্ষরে সত্য। এ স্বাধীনতার মর্যাদা মূলত একার কাজ না, সম্মিলিত শক্তির কাজ। এর উপর প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে।স্বাধীনতা যখন মূল্য পায় না ব্যক্তির কাছে তখনই ক্ষোভ জন্মায়।যোগ্যতা থাকতেও কাজ মেলে না যখন সবকিছু অর্থহীন লাগে। নিজের স্বাধীনতা অনুযায়ী যে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে কেউ। সিনেমায় মান্না, রাজন, সান্টু, দিলদার চার বন্ধু চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরলেও কোনো লাভ হয়নি। রাজনের কাছে মান্নার প্রশ্ন থাকে ‘আচ্ছা রাজন, চাকরির জন্য অাবেদন করতে প্রতিমাসে তোর কত টাকা খরচ হয়?’ রাজন জানায়-‘কমপক্ষে ৩০০০ টাকা।’ মান্না সব অাশা ছেড়ে হাতে পিস্তল তুলে দিয়ে বলে-‘ওগুলো তোকে কিছুই দেবে না, এটা দেবে।’ তারপর চার বন্ধু মিলে অপরাধজগতে পা বাড়ায়। অাধিপত্য গড়ে। অনেকদিন রাজত্ব চলে।এ র মধ্যে পত্রিকা রিপোর্টার অণ্জু ঘোষ অাসলে তাকে চিনতে ভুল করে চারবন্ধু। অণ্জুকে প্রথমে অাধুনিক মেয়ে হিশেবে সমস্যায় পড়তে হয়। চারবন্ধু জেলে যাবার পর অণ্জু দেখতে যায়।তখন তাদের ভুল ভাঙে। চারবন্ধুর মধ্যে রাজন ও সান্টুর পরিবারের সাথে দূরত্ব বাঁধে।একসময় অণ্জু তাদের ভুল পথটাকে চিনিয়ে দেয়।অণ্জু সুবিধাবাদী রাজনৈতিক নেতা রাজিবের ইন্টারভিউ নিতে গেলে বের হয় নিদারুণ সত্য। হঠাৎ করে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে রাতারাতি নেতা হতে চায় কিনা অণ্জুর এ প্রশ্নের জবাবে থতমত খায় রাজিব।এলাকায় ভোট চাইতে যায় রাজিব। সুবিধা পায় না। অণ্জুকে ধর্ষণ করে রাজিব।এর অাগে মান্নার সাথে অণ্জুর প্রেম এবং তাদের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলে এলাকার চায়ের দোকানদার হাসমত। অণ্জু অাত্মহত্যা করে সবার সামনেই। চারবন্ধু মিলে জনসভায় ভাষণ দেয়া রাজিব ও তার সহকর্মীকে হত্যা করা হয়। ফাঁসির অাদেশ হয় চারবন্ধুর।
এই গল্পের নির্মাণে আর্তনাদটা গভীর।
মান্না আদালতে দাঁড়িয়ে তার কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার কথাই বলে। সেখানে বেকারত্ব, রাজনীতি, বিচার বিভাগ ইত্যাদি নিয়ে কথা ওঠে। মান্নার টাচি সংলাপটি ছিল- ‘ইওর অনার, একটা স্বাধীন দেশে বিচার বিভাগ যদি সঠিক বিচার করত, অপরাধ কেন হচ্ছে তার কারণ খুঁজত, সবার নিরাপত্তা দিত তবে অপরাধ হত না।’
অণ্জু মান্না ও তার বন্ধুদের প্রশ্ন করেছিল কেন তারা অপরাধী হয়েছে। প্রশ্ন ছিল-‘মুক্তিযুদ্ধের পর একটা দেশে সংকট অনেক থাকবে। তার জন্য ভুল পথে কেন যেতে হবে? দেশ তোমার জন্য কি করেছে সেটা ভাবা জরুরি নাকি তুমি দেশের জন্য কি করেছ সেটা ভাবা জরুরি?’ এ প্রশ্নটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অন্তত অাজকের বাংলাদেশের জন্যও।
হাসমতকে রাজিব যখন বড় দোকান করে দেবার স্বপ্ন দেখায় হাসমত হাসে। রাজিব চলে গেলে বলে-‘তুমি অামারে দোকান দিবা ঘোড়ার অান্ডা অার অামিও তোমারে ভোট দেব মুরগির অান্ডা।’
অসাধারণ সংলাপ। অসৎ সুবিধাবাদী রাজনৈতিক নেতার জন্য ধারালো প্রতিবাদ ছিল।
মান্নার লুক সিনেমাটিতে অন্যরকম। চাপ দাড়িতে আর হালকা গোঁফে অপরাধজগতের উঠতি যুবক চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় ছিল। সান্টু ও রাজন তখনকার সময় অনুযায়ী খুব মনোযোগী ছিল মান্নার বন্ধু হিশেবে। তাদের চরিত্রের স্পেস ছিল কারণ তাদের পারিবারিক জীবনও দেখানো হয়েছে।দিলদারও ছিল মান্নার বন্ধু। কমেডিয়ান রোলের বাইরে অন্য এক দিলদার নিজেকে এক্সপেরিমেন্ট করেছে অপরাধজগতের একজন হিশেবে। সেসূত্রে দিলদারকেও নায়ক ভাবা যায় চার প্রধান চরিত্রের গুরুত্ব থেকে। অণ্জু রিপোর্টার চরিত্রে বলিষ্ঠ। বিশেষ করে তার ভয়েসের ব্যবহার অসাধারণ ছিল।হাসমত বিশেষ চরিত্রে ছিল সিনেমায়। জনগণের প্রতিনিধি হিশেবে অনবদ্য। অানোয়ার হোসেন, গাজী মাজহারুল ইসলাম অসহায় বাবার চরিত্রে নিজেদের মতোই উজ্জ্বল।
সিনেমার ক্লাইমেক্সটি টাচি এবং মেসেজটা মেলে। কাজী হায়াতের সূক্ষ্ম রাজনৈতিক বাস্তবতা তুলে ধরার কৌশল এখানেই। মান্না, রাজন, সান্টু, দিলদারের ফাঁসির অাদেশের পর আদালত থেকে বেরিয়ে সবার কাছে বিদায় নেবার দৃশ্যটি টাচি ভীষণ। যাবার সময় কাজী হায়াৎ তাঁর পক্ষ থেকে বলেন ‘তবুও কি যন্ত্রণার শেষ হলো?’ এ প্রশ্ন অাজকের বাংলাদেশের জন্যও সত্য। ‘futurism’ বলে যে টার্মটি অাছে সেটা ভাবলে এ সত্য অারো গভীর হয়।অাজকের বাংলাদেশের স্বাধীনতা ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় পরিসরে অারো নির্মম। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নেই।বেকারত্ব হু হু করে বাড়ছে যার জন্য সাম্প্রতিক সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় সমস্যা হিশেবে জঙ্গিবাদের অশুভ উত্থান ঘটেছে। নিয়োগ দুর্নীতি বা পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে নোংরামি বাড়ছেই।সুবিধাবাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর অাধিপত্য বেড়েছে।
স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরে আজকের বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের স্বপ্ন দেখা ও স্বপ্ন শেষ হওয়ার বাস্তবতায় ‘যন্ত্রণা’-র শেষ কিন্তু হয়নি।
‘যন্ত্রণা’ সিনেমা এখানেই ক্লাসিক..