যেভাবে ‘মনপুরা’ একুশ শতকের প্রথম হ্যাভোক ফিল্ম
২০০০ সাল থেকে শুরু হওয়া একুশ শতকের প্রথম হ্যাভোক ফিল্ম কোনটি? অনেকের মাথাতেই চট করে নামটি আসবে ‘মনপুরা।’
‘মনপুরা’ গিয়াস উদ্দিন সেলিম পরিচালিত ২০০৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মুক্তিপ্রাপ্ত চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি থেকে উঠে আসা ভালোবাসার গল্পে পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশী চলচ্চিত্র। জনপ্রিয় এ ছবির এক যুগ পূর্ণ হলো আজ। অভিনন্দন পুরো টিমকে। এ ছবিটি ব্লকবাস্টার হয়েছিল। এ শতাব্দীর প্রথম হ্যাভোক সিচুয়েশন তৈরি করা ছবি ছিল এটি। কীভাবে হ্যাভোক হলো ছবিটি কিছু ফ্যাক্ট দেখলে স্পষ্ট হয়ে যাবে।
ফ্যাক্ট ১
‘মনপুরা’ প্রথম টেলিফিল্ম বানানোর কথা ছিল পরে এটাকে পূর্ণদৈর্ঘ্য ছায়াছবি করা হয়। ছায়াছবির ক্ষেত্রে চিরায়ত বাংলার মাটি ও মানুষের গল্পকে বেছে নিয়ে গভীর প্রেম ও বিচ্ছেদের সমানুপাতিক হারে নির্মিত হয়। যার জন্য ছবিটি দর্শক ব্যাপকভাবে গ্রহণ করে কারণ ছবির প্রথমদিকের অসাধারণ প্রেমিক যুগল দর্শককে রোমান্টিক করে তোলে আর শেষে বিচ্ছেদের যন্ত্রণাও দর্শককে আলোড়িত করতে পেরেছিলো।
ফ্যাক্ট ২
ছবির গানগুলো ছিল হ্যাভোক রেজাল্টের জন্য সবচেয়ে বড় প্লাসপয়েন্ট। একেকটা গান একেকরকম ছিল এবং এটা পরিকল্পিতভাবেই করা হয়েছিল। কণ্ঠশিল্পীর ভেরিয়েশনের পাশাপাশি প্রত্যেকটা গানের ভিন্নরকম টেস্ট দেয়া হয়েছিল এবং সবগুলো গান জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ‘যাও পাখি বলো তারে’ গানে চন্দনা মজুমদার ও কৃষ্ণকলি দুই প্রজন্মের মিলন ঘটেছিল এবং তাদের গায়কীতে ছিল দুইরকমের টেস্ট। দর্শক ঐসময় একদম নতুন একটা ফ্লেভার পেয়েছিল। ‘নিথুয়া পাথারে নেমেছি বন্ধু রে’ এ গানটা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে মাঠের কৃষক পর্যন্ত গাইত এতটা জনপ্রিয় হয়েছিল। এ গানের সবচেয়ে বড় প্লাসপয়েন্ট ছিল ফজলুর রহমান বাবু-র কণ্ঠ। লোকসঙ্গীতে তার পরিচিতি আগে থেকেই ছিল। মানুষ তাঁকে অভিনয়ের পাশাপাশি গান দিয়েও চিনত। গানটি এমনভাবে গাওয়া এবং কথা সাজানো হয়েছিল যে কোনো শ্রোতার পক্ষেই গানটির সাথে নিজেকে রিলেট করা সম্ভব ছিল। বাবু-র কণ্ঠে স্যাড ভার্সনে ‘সোনাই হায় হায় রে’ গানটিও আলাদা ফ্লেভার দিয়েছিল। তাঁকে ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি গান গাওয়ানোটাও ছবির প্রচারণার জন্য অনেক বেশি কাজে এসেছিল। ‘আগে যদি জানতাম রে বন্ধু’ এ গানটি মমতাজের কণ্ঠে একটা দরদী ছিল যে এটাও দর্শক ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছিল। নির্দিষ্ট একটা শ্রোতা অর্ণবের ‘সোনার ময়না পাখি’ গানটিতে দারুণ কিছু পেয়েছিল বিশেষ করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শহুরে ছেলেমেয়ে যারা অর্ণবের গানের ভক্ত ছিল তাদের জন্য বিশেষ কিছু ছিল। এভাবে সব ধরনের দর্শককে এক ছাদের নিচে আনতে পেরেছিল ‘মনপুরা’-র গান। যার জন্য ছবিটি দেখতে বিপুলভাবে আগ্রহী হয়েছিল দর্শক।
ফ্যাক্ট ৩
ছবিতে চঞ্চল চৌধুরীর সাথে একদম ফ্রেশ মুখ হিসেবে ফারহানা মিলি ছিল দর্শকের জন্য নতুন কিছু। প্রোমো যেহেতু টিভি চ্যানেলগুলোতে নিয়মিত গিয়েছিল অনেক আগে থেকেই তাই মিলির সম্পর্কে দর্শকের আগ্রহ আগে থেকেই তৈরি ছিল। চঞ্চল-মিলির অভিনব কেমিস্ট্রি ছবি দেখতে গিয়ে দর্শক কড়ায়-গণ্ডায় পেয়ে যায় তাই ছবিটি সফল হয়ে ওঠে। এছাড়া গল্প এবং অন্যান্য চরিত্রের অসাধারণ অভিনয়ের ব্যাপার তো ছিলই।
ফ্যাক্ট ৪
‘ওয়ার্ড অফ মাউথ’ যে কোনো ছবির সাফল্যের জন্য কাজে দেয়। ‘মনপুরা’-র ক্ষেত্রে এটা ছিল মারাত্মক পর্যায়ের। যেই ছবিটি সিনেমাহলে দেখেছি বাড়ি ফিরে আরো পাঁচজনকে দেখতে বলেছে এভাবে দর্শক ক্রমাগত বেড়েছে।
ফ্যাক্ট ৫
বলা হয় ‘প্রচারেই প্রসার।’ ‘মনপুরা’-র প্রচার শুধু দর্শকের প্রচারণায় সীমাবদ্ধ ছিল না। ছবির মুক্তির অনেক আগে থেকেই এর প্রচার শুরু হয়েছিল। টিভি চ্যানেলে প্রোমো প্রচার হতে থাকে আগে থেকেই। প্রাইভেট চ্যানেলের পাশাপাশি বিটিভিতেও ‘আসছে চিরায়ত প্রেমের গল্পে গিয়াস উদ্দিন সেলিমের মনপুরা’ শিরোনামে প্রোমো প্রচার হয়েছিল। পোস্টারিং, মাইকিং এবং বিলবোর্ডেও প্রচার হয়েছিল। এছাড়া গান বিশেষ করে ‘নিথুয়া পাথারে, যাও পাখি বলো তারে, সোনাই হায় হায় রে’ ছবি মুক্তির আগেই সুপারহিট হয়ে যায়। ‘মনপুরা’ লেখা ও প্রতীক সম্বলিত টি-শার্ট, মগ বের হয়েছিল যেগুলো দিয়ে পরিচালককেও পোজ দিতে দেখা গেছে পত্রিকায়।
এই ফ্যাক্টগুলোতে চোখ রাখলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির গল্পে কীভাবে ছবি সফল করা সম্ভব। বিদেশি সংস্কৃতি ছাড়াও দেশীয় সংস্কৃতিতে এখনো যে ছবি সফল করা যায় ‘মনপুরা’ তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। এ শতাব্দীর শুরুর দশকেই যে ছবিটি সেটা করে দেখিয়েছে এটা বিশেষ কিছু। আজও যারা শতভাগ দেশীয় সংস্কৃতিতে ছবি সফল করার স্বপ্ন দেখেন তারা যেন ‘মনপুরা’-কে স্টাডি করেন তাহলে হয়তো নতুন প্রজন্মের মধ্য থেকেও কোনো এক নির্মাতা নতুন ‘মনপুরা’-র জন্ম দিতে পারবেন সাথে দিতে পারবেন নতুন দশকের নতুন কোনো হ্যাভোক সাকসেসফুল ফিল্ম।