যৌন নিপীড়ন/ জবি থেকে বরখাস্ত ‘জালালের গল্প’ পরিচালক আবু শাহেদ ইমন
ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ওঠার পর সাময়িক বরখাস্ত হলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের প্রভাষক আবু শাহেদ ইমন। ‘জালালের গল্প’ সিনেমা দিয়ে দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছিলেন তিনি। এছাড়া আলোচিত টিভি ফিকশনও আছে তার ঝুলিতে, নির্বাহী প্রযোজক হিসেবে কাজ করেছেন ইমপ্রেস টেলিফিল্মের একাধিক সিনেমায়।
সেইসঙ্গে ওই শিক্ষার্থীকে অসহযোগিতা করায় বিভাগের প্রধান জুনায়েদ আহমদ হালিমকে চেয়ারম্যান পদ থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়েছে।
বিডি নিউজ টোয়েন্টিফোরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বৃহস্পতিবার (২১ মার্চ) বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত হয় বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম জানান।
তিনি বলেন, ‘এটা বিশেষ সিন্ডিকেট। কাজী ফারজানা মিমকে নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। কী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সে গেছে। তাকে দীর্ঘ সময় ধরে অত্যন্ত গ্লানির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।’
ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী কাজী ফারজানা মিম সম্প্রতি অভিযোগ করেন, তার কোর্স শিক্ষক প্রভাষক আবু শাহেদ ইমন ২০২১ সালে অ্যাকাডেমিক কাজে তাকে নিজের কক্ষে ডেকে ‘যৌন হয়রানি’ করেন।
এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করায় বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জুনায়েদ আহমদ হালিম তাকে ‘ফেল করিয়ে দেন’ বলেও মিমের অভিযোগ।
এক শিক্ষক ও সহপাঠীকে দায়ী করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার আত্মহত্যা নিয়ে আলোচনার মধেই মিমের এমন অভিযোগ নতুন আলোচনার জন্ম দেয়।
সিন্ডিকেটের বৈঠকের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে উপাচার্য বলেন, ২০২১ সালের ওই ঘটনা নিয়ে মিম যখন অভিযোগ করেছিলেন, তখন তদন্ত করে প্রতিবেদনও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে বিষয়টি এগোয়নি।
“তার যে রিপোর্টটি ছিল, সে রিপোর্টটি তৎকালীন উপাচার্যের সময় সিন্ডিকেটে উঠেছিল। যেহেতু তিনি দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত ছিলেন, তাই ওইভাবে সেটা আগায়, কিন্তু প্রসিডিউরের কোনো সমস্যা ছিল না। পরবর্তীতে আমি এসে তদন্ত বোর্ড ঠিকঠাক করায় বিষয়টি এ পর্যন্ত এসেছে।
“আমি আসার পর শুনলাম মীমের বিভাগে অনেক সমস্যা। তার রেজাল্ট বের হওয়ার পর দেখি দুটো পরীক্ষায় সে ১০০ এর মধ্যে ৩ করে এবং ৫০ এ ১০ পেয়েছে।”
সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত জানিয়ে অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, “নৈতিক স্খলন হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী সিন্ডিকেটের সকল সদস্যদের সম্মতিক্রমে আমরা ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের শিক্ষক আবু শাহেদ ইমনকে সাময়িক বহিষ্কার করেছি।
আর জুনায়েদ আহমদ হালিম একটা বিভাগের চেয়ারম্যান, তিনি নিরপেক্ষ থাকবেন। শিক্ষার্থী একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে, তিনি চেয়ারম্যান হিসেবে সেভাবে ব্যাবস্থা নেবেন। আমরা দেখেছি তিনি প্রশাসনকে এবং শিক্ষার্থীকে সহযোগিতা করেননি। সিন্ডিকেটের অভিজ্ঞ ও বিজ্ঞ সদস্যরা মনে করেছেন, তাকে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রাখা উচিত হচ্ছে না। এজন্য চেয়ারম্যান পদ থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।”
সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক আবুল হোসনকে ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়ার কথা জানিয়ে উপাচার্য বলেন, “এখন থেকে এই বিভাগের যাবতীয় বিষয়াদি তিনিই দেখভাল করবেন।”
মিম বলেন, প্রভাষক আবু শাহেদ ইমন ২০২১ সালে অ্যাকাডেমিক কাজে তাকে নিজের কক্ষে ডাকেন এবং সে সময় ‘যৌন হয়রানি’ করেন।
“সেদিন তিনি আমাকে কুপ্রস্তাব দেন। কুপ্রস্তাব দিয়েই ক্ষান্ত ছিলেন না। প্রস্তাব দেওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি আমাকে হেনস্তা করার চেষ্টা করেন। আমাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করতে চান। আমি সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে তাৎক্ষণিকভাবে এই আচরণের প্রতিবাদ করি।”
এই শিক্ষার্থীর ভাষ্য, ওই ঘটনা নিয়ে তিনি যখন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন, তখন থেকে তাকে নানাভাবে হেনস্তা করা শুরু হয়।
“অভিযোগ দেওয়ার পর থেকে বিভাগের চেয়ারম্যান জুনায়েদ আহমেদ হালিম ও শিক্ষক আবু সাহেদ ইমন আমাকে সেটি তুলে নিতে নানাভাবে চাপ দিতে থাকেন। এতে আমি রাজি না হওয়ায় তারা আমাকে হাত-পা কেটে হত্যা করাসহ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের হুমকি দেন। আমাকে একঘরে করে দেওয়া হয়। আমাকে বিভিন্ন পরীক্ষায় শূন্য নম্বর দিয়ে ফেল করানো হয়। অনার্সের ফাইনাল ভাইভায় আমাকে ফেল করানো হয়।”
মিম বলেন, “যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছি তারা আমার গ্রামের বাড়িতে পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। আমার বাবা-মা অসুস্থ, তাদের ওপর প্রেশার করেছে অভিযোগ প্রত্যাহার করার জন্য। অভিযোগ প্রত্যাহার না করায় আমাকে বিভাগের রুমে কোনো মহিলা শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে দরজা আটকে জোর জবরদস্তি করা করা হয়েছে।”
অভিযোগ করেও কেনো প্রতিকার না পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি আজীবন পড়াশোনা ছাড়া অন্য কিছু করিনি। কোন সংগঠনের সাথেও আমি জড়িত নই, আমি সাধারণ একজন ছাত্রী। আমি প্রতিবাদ করেছি বলেই আজ অনার্স ফেল।
“কুপ্রস্তাবে রাজি না হয়ে অন্যায় করেছি বলে এখন আমার মনে হয়। আমি হয়ত অবন্তিকার মত সাহসী না, তাই হয়ত আত্মহত্যা করতে পারিনি। কে জানে এর পর আমি বেঁচে থাকব কি না। কিন্তু মূল্যহীন হয়ে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।”
মিমের অভিযোগ ‘পুরোপুরি ভিত্তিহীন’ দাবি করে প্রভাষক আবু শাহেদ ইমন এর আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অবন্তিকার মৃত্যুতে তার সহানুভূতিকে পুঁজি করে সে (মিম) গণমাধ্যমের মনোযোগ পাওয়ার চেষ্টা করছে।”
মিম অভিযোগ করার পর তদন্ত কমিটি আবু শাহেদ ইমনের বিরুদ্ধে প্রতিবেদনও দিয়েছিল। এই শিক্ষক তখন উচ্চ আদালতে যান।
তিনি বলেন, “এরকম একটা বিষয় আদালতের বিচারাধীন থাকা অবস্থা মিম কীভাবে মিডিয়ায় কথা বলতে পারে তা আমার জানা নেই। তবে আমি এ ব্যাপারে বেশি মন্তব্য করতে চাই না।”