রান আউটঃ বছরের অন্যতম সেরা ছবি
সজল চট্টগ্রাম শহরের এক অফিসের সামান্য চাকুরে। একদিন রাতে বাড়ি ফেরার পথে তার সামনেই খুন হয় শহরের এক শীর্ষ সন্ত্রাসী। যথারীতি পুলিশ এসে তাকেই খুনি সন্দেহে গ্রেপ্তার করে। খুনি অপবাদ চাপে সজলের ঘাড়ে, বরবাদ হয়ে যায় সামাজিক জীবন। তারচেয়েও ভয়ঙ্কর বিষয়, সে নজরে পড়ে যায় অপরাধজগতের রুই-কাতলাদের। তাদের ফাঁদে পড়ে সজলের জীবনটাই পাল্টে যায়। শুরু হয় তার এক অজানার পথে অবিরাম দৌড়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের গন্তব্যে কি সে পৌঁছাতে পারবে, নাকি তার আগেই রান আউট হয়ে যাবে? এই নিয়েই কাহিনী রান আউটের।
কাহিনীতে উঠে এসেছে আন্ডারওয়ার্ল্ডের নানা দিক। কিছুটা রাজনীতির ছোঁয়াও ছিল। ছিল যৌনতা আর প্রেম ভালোবাসাও। সবমিলিয়ে রান আউট একটি ডার্ক থ্রিলার, যার রয়েছে অসাধারণ একটি কাহিনী। কাহিনীতে মূল প্লটের সাথে সাথে কিছু সাবপ্লটও ছিল। এবং সেগুলোও মূল প্লটের সাথে খুব ভালোভাবেই যুক্ত ছিল। থ্রিলার কাহিনীতে টুইস্ট একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। সেই টুইস্টের বেশ ভালোরকম উপস্থিতিই ছিল। সবসময় যে তারা ছবির কাহিনীতে প্রভাব ফেলতে পেরেছে তা নয়। তবে তারপরও টুইস্টগুলো ভালোই ছিল, শুধু পরিমাণে আরও কিছুটা বেশি আর মানের দিক থেকে আরও একটু প্রভাবশালী হলে ভাল লাগত, এই-ই যা। কিন্তু সবমিলিয়ে একেবারে দেশীয় প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা এই থ্রিলারের কাহিনী অবশ্যই সর্বোচ্চ প্রশংসার দাবিদার।
চিত্রনাট্য ও কাহিনীবিন্যাস ভালো ছিল। প্রথমার্ধে ধীরে ধীরে স্টোরি বিল্ডআপ হয়েছে আর দ্বিতীয়ার্ধে তা সুন্দর পরিশীলিত একটি ক্লাইম্যাক্সের দিকে এগিয়ে গেছে। কাহিনীবিন্যাস নিয়েও অভিযোগের জায়গা কম। কিন্তু এদেশী দর্শকের কথা মাথায় রেখে কাহিনী আরেকটু বেশি গতিশীল হলে ভাল হত। মন দিয়ে যারা ছবিটা দেখবে তাদের কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু অসচেতন অমনোযোগী দর্শক অল্পতেই বিরক্ত হয়ে যেতে পারে।
সংলাপ ভাল, ছবির কাহিনীকে চমৎকারভাবে কমপ্লিমেন্ট করেছে।
গানগুলোকে অসাধারণ বলা না গেলেও, কাহিনীর সাথে যে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল তা মানতেই হবে। গানের দৃশ্যায়ন অনেক সুন্দর ছিল। লোকেশন নয়নাভিরাম। কোরিওগ্রাফি আরও ভাল হতে পারত। প্রতিটা গানেই সজলের অঙ্গভঙ্গি একই রকম ছিল।
ফাইটগুলো অসাধারণ ছিল। এক্ষেত্রে ফাইট ডিরেক্টরের মুন্সিয়ানার পাশাপাশি স্লো মোশন ও গ্রাফিক্স এফেক্টেরও বড় অবদান ছিল। কিন্তু দর্শক যে ফাইটগুলো দেখে আরাম পেয়েছে এটাই বড় কথা। একশন সিনগুলোতে সজল প্রত্যাশার চেয়েও অনেক অনেক গুণ ভাল কাজ উপহার দিয়েছেন।
পরিচালনা অসাধারণ, স্রেফ অসাধারণ। ‘পদ্ম পাতার জল’ এর তন্ময় তানসেনকে এই ছবির তন্ময় তানসেন নিঃসন্দেহে ছাড়িয়ে গেছেন। নির্মাতা হিসেবে যে তিনি কতটা প্রতিভাবান তার প্রমাণ আরও একবার পাওয়া গেছে। কাহিনীতে একাধারে যৌনতা, রোমান্টিকতা, ইমোশন সবকিছুর ছড়াছড়ি ছিল। প্রতিটা দিককেই নিখুঁতভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। কিন্তু ক্যামেরার কাজ স্টেডি হলে ভাল হত। ক্যামেরার প্রতিমুহুর্তে নড়াচড়া এখন আর যেমন ইউনিক কিছু না, তেমনি এটা দর্শকের বিরক্তিরও উদ্রেক করে।
কেন্দ্রীয় চরিত্রে সজল জাস্ট ফাটিয়ে দিয়েছেন। একদম বাহুল্যবর্জিত, অতি সাবলীল অভিনয় উপহার দিয়েছেন তিনি। বর্তমানে যারা নায়ক আছেন, তাদের যে কারো চাইতেই সজলের স্ক্রিন প্রেজেন্স অনেক অনেক বেশি স্মার্ট। ‘কিশোর’ চরিত্রটাকে যেন একেবারে নিজের মধ্যে ধারণ করেছেন তিনি। কাহিনী অনুসারে তার চরিত্রের প্রতিমুহুর্তেই অতি সূক্ষ্মভাবে রূপান্তর ঘটে চলেছে। আর সেই রূপান্তরের প্রতিটা খুঁটিনাটি উঠে এসেছে সজলের অভিনয়ে। হিরোসুলভ সব ক্যারিশমাই ছিল সজলের অভিনয়ে। এমনকি একশন সিনগুলোতেও তিনি সর্বোচ্চ এফোর্ট দিয়েছেন।
মৌসুমী নাগের অভিনয়ের পারদ প্রথমদিকে কিছুটা ওঠানামা করেছে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তার চরিত্রটাও যতটা উন্মোচিত হয়েছে, তার অভিনয় দক্ষতাও ততটাই খোলতাই হয়েছে। ‘সাহসী অভিনয়’ এর সঙ্গাটাই পাল্টে দিয়েছেন তিনি। অশ্লীলতা বা নগ্নতাই যে সাহসী অভিনয় না, তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি। তাহলে সাহসী অভিনয় কাকে বলে, এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে যাদের মনে তারা ছবিটা একবার দেখে ফেলুন। তাহলেই বুঝে যাবেন।
স্বর্ণাও দারুণ ছিলেন। তার চরিত্রের ব্যাপ্তিকাল বেশি নয়। তবু যতটা সময় পর্দায় ছিলেন, অভিনয়ের পরিমিতিবোধ আর অসাধারণ ফেসিয়াল এক্সপ্রেশনের মাধ্যমে দর্শকমনে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন তিনি। তবে তারিক আনাম খানের অভিনয় অতটা ভাল লাগে নাই। প্রথমদিকে তাকে ভালোই লাগছিল কিন্তু একটা সময়ের পর তার চরিত্রটা একঘেয়ে হয়ে গেছে। বাদবাকি সবার কাজই কমবেশি ভাল ছিল। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ‘রাফসা’ চরিত্রে রূপদানকারী মেয়েটা। সে যতটা কিউট ছিল, তার অভিনয়ও ছিল ততটাই মনোমুগ্ধকর।
পরিশেষে বলব, হ্যাঁ, ‘রানআউট’ সত্যিই ১৮+ ছবি। তারমানে এই না যে ছবিটা রগরগে দৃশ্য আর অশ্লীলতায় ঠাসা। আসলে ছবির কাহিনী আবর্তিত হয়েছে যে সেন্সিটিভ বিষয়গুলোকে ঘিরে, সবার ক্ষেত্রে তা বোধগম্য হবে না। তবে ছবিটা আসলে ‘প্রাপ্তবয়স্কদের’ না, ‘প্রাপ্তমনস্কদের’। কারণ পনের বছর বয়সের ম্যাচিওরড ও শিক্ষিত একটা ছেলে হয়ত এ ছবি দেখে বুঝবে, কিন্তু পঁচিশ-পঁয়ত্রিশ-পঁয়তাল্লিশ বছরের অনেক অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত দর্শকও কাহিনী না বুঝে স্রেফ এডাল্ট সিনগুলোতে শিস বাজাতে পারে। পুরো বিষয়টাই আসলে দর্শকের মানসিকতার ওপর নির্ভরশীল। তবে যদি বিষয়টাকে জেনারালাইজ করে বলতে হয়, তবে বলব ১৮ বছরের কম বয়সীদের ছবিটা না দেখাই ভাল। আর দেখলে নিজ দায়িত্বে দেখবেন।
সবমিলিয়ে গুণগত মানের দিক থেকে ‘রান আউট’ এই বছরের অন্যতম সেরা কমার্সিয়াল ছবি। স্রেফ বিনোদনের উদ্দেশ্যে বা নায়লা নাইমের শরীরের ভাঁজ দেখার লোভে যারা ছবিটা দেখতে যাবেন, তারা নিশ্চিতভাবেই হতাশ হবেন। কিন্তু সত্যিকারের ভাল কাহিনীর, ভাল নির্মাণের একটি ছবি দেখার উদ্দেশ্যে হলে গেলে ভালোলাগা নিয়েই বাড়ি ফিরতে পারবেন।