রায়হান রাফীর পরিচালনায় এক ভিন্ন শাকিব খান, ‘তুফান’ আসলেই কি নকল
[নো স্পয়লার]
ইতিপূর্বে ‘তুফান’ নিয়ে বহু আলোচনা-সমালোচনা হয়ে গিয়েছে। তাই সবার মতো করে নয় নিজের মতো করেই নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশের ক্ষুদ্র-প্রয়াস এই লেখাটি। তবে সবার আগে বলে নিচ্ছি যারা ১৮ বছরের নিচে কিংবা রক্তারক্তি দেখতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন না কিংবা যারা বুঝেন না কোনটা প্রয়োজনের তাগিদ কোনটা অপ্রয়োজনের তাগিদ! তাঁরা অনুগ্রহ করে এই ফিল্মটি দেখবেন না। এটা শোনার পরেও যারা দেখতে যাবেন তাঁরা অনুগ্রহ করে হাহুতাশ করবেন না!
যাই হোক বলছিলাম মৃতপ্রায় বাংলা ইন্ডাস্ট্রির সিনেমা ‘তুফান’ নিয়ে। মৃতপ্রায় কেনো বললাম? কারণ এই ইন্ডাস্ট্রিতে সিনেমার চাইতে একে অপরকে টানাটানির চর্চা বেশি চলে। তো লাষ্ট কবে এমন সিনেমা বাংলায় তৈরি হয়েছে, আদো কি তৈরি হয়েছিলো কিনা সেটা নিয়ে সন্দিহান তাও আবার শাকিব খানকে নিয়ে। এখন কথা হলো তুফান কি আসলেই কপি। সময় থাকলে থামেন! আমার নিজের কিছু অভিজ্ঞতা শুনায়।
পরিচালনা এবং বাদবাকি
দেশে ভালো পরিচালক বিলুপ্তপ্রায়, সেখানে রায়হান রাফী সাহেব এই ইন্ডাস্ট্রির ঢাল হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। উনার তৈরি যে চোখ জুড়ানো তা এতো দিনে সবাই জানে। ইতিপূর্বে পরাণ, সুড়ঙ্গ, পোড়ামন-২, দহন, দামাল দিয়ে তিনি বেশ সুপরিচিত। অন্য দিকে ওয়েবফিল্মেও সে সমান দ্যুতি ছড়িয়েছেন, যার মধ্যে অন্যতম জানোয়ার, খাঁচার ভেতর অচিন পাখি, ৭ নাম্বার ফ্লোর, টান, ফ্রাইডে ইত্যাদি। রায়হান রাফি একবার বলেছিলেন, ‘তিনি কেজিএফ বানাতে চান’। যার ফলেই হয়তো অনেকে ধরেই নিয়েছেন ‘কেজিএফ’-এর নকল ‘তুফান’। তবে তুফান শতভাগ মৌলিক গল্প যা অসাধারণ ভাবে সকলের কাছে উপস্থাপিত হয়েছে, হ্যাঁ বলা যেতেই পারে কেজিএফ, অ্যানিমেল থেকে অনেক কিছু ইন্সপায়ার্ড তবে গল্প নয়।
যাই হোক রাফীর কাছে আসি, রাফী যে একজন প্রতিভাবান পরিচালক তাঁর ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই ‘সিনেমার এক পর্যায় হিরো রাগ হয়ে তাঁর ঘরের কিছু ছবি ছিড়ে ফেলছিলো সেখানে ছিলো বাংলাদেশে কিছু স্বনামধন্য অভিনেতার ছবি এবং ভারতের একজন সুপারস্টারের ছবি, ছেঁড়া দেখানো হলেও তাঁদের ছবি ছেঁড়া দেখানো হয় নাই’ এতে করেই সে প্রমাণ করে তাঁর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অনেক প্রখর। রাফীর সিনেমার সবচেয়ে ভালো দিক হলো তিনি প্রতিটা চরিত্রকে খুব গুরুত্ব দিয়ে সাজান, তাঁর সিনেমায় অপ্রয়োজনীয় চরিত্র খুব কম দেখা যায়। এতে করে সকল অভিনেতা-অভিনেত্রী তাদের সেরাটা দিতে পারেন। এই সিনেমায় রাফীর আরো একটি ভালো সিদ্ধান্ত হলো, ক্যামেরার পেছনে বেশিরভাগ বাংলাদেশী ‘টেকনিশিয়ান’ দিয়ে কাজ করানো, এতে করে প্রমাণ হয়ে গেলো দেশে ভালো ‘টেকনিশিয়ান’ আছে জাস্ট ব্যবহার করতে হবে।
বর্তমান বাংলা সিনেমার আরও একটি বাজে দিক ছিলো অজায়গায় গানের প্লেসমেন্ট, কিন্তু তুফান সিনেমায় গানের প্লেসমেন্টগুলো ছিলো জাস্ট অসাধারণ, মনে হচ্ছিলো এই সেগমেন্টগুলোয় গানের খুব দরকার ছিলো। এছাড়া গানগুলোও বেশ উপভোগ্য ছিলো। আর তাহসিন সাহেবের সিনেমাটোগ্রাফি বরাবরই দারুণ, খুব আহামরি ফ্রেম ছাড়াই উনি বেসিক ফ্রেমে খুব সুন্দরভাবে চিত্রায়ণ ফুটিয়ে তুলতে পারে, বলা যায় ভবিষ্যতে উনার হাত ধরেই বাংলা সিনেমার চিত্রায়ণ ভিন্নধারায় পৌছে যাবে।
অপর দিকে সিনেমার কালার গ্রেডিং তো চোখের লাগার মতো, বিশেষ করে আউটডোর শটে লেস কন্ট্রাস্ট ফুটেজ দারুণ লাগলো। এছাড়া ফ্রেম চেঞ্জ হবার সাথে কালার চোখে খুব সহজেই সেট হয়ে যাচ্ছিলো, যেটা বাংলা সিনেমায় একটু বিরল। আর এই সিনেমার সবচেয়ে দারুণ ভালো ছিলো আবহসংগীত, যার থেকে কোনো দর্শক বের হতেই পারবে না, প্রতিটা ফ্রেমের সাথে আবহসংগীত মনে হচ্ছিলো জড়িয়ে আছে, অসাধারণ কম্বিনেশন ছিলো। আবার আরেকটা জিনিষ না বললেই নয় যেটা হলো সেট ডিজাইন, চিরাচরিত বাংলা সিনেমার মতো সেট ডিজাইন তুফানে আপনি পাবেন না, অনেক পরিচিত গুলো এই সিনেমায় অসাধারণভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সবশেষে সিনেমার সবচেয়ে অপেক্ষমাণ শট ছিলো ওয়ান টেক শট, যা দেখার জন্য মুখিয়ে ছিলাম, এটার দেখার পরে জাস্ট মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
অভিনয়সংক্ষেপ
🔹গাজী রাকায়েত (তুফানের ত্রাণকর্তা) উনাকে ব্যক্তিগতভাবে বেশ পছন্দ আমার। উনি এমন একজন অভিনেতা, যিনি কিনা যেকোনো চরিত্রে নিজেকে সেঁটে দিতে পারেন। উনাকে জীবন্ত কিংবদন্তি বলা খুব বেশি ভুল হবে না, একটা পার্শ্বচরিত্রে থেকেও কীভাবে সব নজর নিজের দিকে টানা যায় সেটার বড় উদাহরণ হয়ে থাকবেন রাকায়েত সাহেব।
🔹গাউসুল আলম শাওন (অ্যাকশান ডিরেক্টর)
এই টাইপের চরিত্র প্লে করা বেশ কষ্ট সাধ্য। কেননা এখানে সবচেয়ে বড় গুরু দায়িত্ব হল সবাইকে হাসানো, যা বর্তমান জামানায় একদম বিলুপ্তপ্রায়। সুন্দর বাচন ভঙ্গিতে দর্শকদের হাসিয়ে অসাধারণ পারফরম্যান্স করেছেন তিনি, চরিত্রটা আমার কাছে বেশ উপভোগ্য ছিলো।
🔹শহীদুজ্জামান সেলিম (চেয়ারম্যান)
মাত্র কয়েক মিনিট স্ক্রিনে ছিলেন, এই অল্প টাইম থাকা নিয়ে আমার বেশ অভিযোগ! এমন শক্তিমান অভিনেতাকে কেনো এতো অল্প স্ক্রিনটাইম দেওয়া হলো! এর চেয়ে মিশার জায়গায় সেলিম সাহেবকে দিলে আরো বেশি উপভোগ্য হতো। তবে এই অল্প সময় সেলিম সাহেব আপনার চোখের বিষ হয়ে যাবেন।
🔹মাসুমা রহমান নাবিলা (জুলি)
নাবিলাকে নিয়মিত কমার্শিয়াল সিনেমায় দেখতে চাই। আয়নাবাজি তে যা অসাধারণ অভিনয় করেছেন, আবার তুফানে এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা চরিত্রে বেশ সাজিয়েছেন নিজেকে, বোঝা যাচ্ছে বেশ আঁটসাঁট বেঁধেই তিনি সিনেমায় নেমেছেন।
🔹মিমি চক্রবর্তী (সূচনা)
আমি মোটামুটি ধরে নিয়েছি যেহেতু গ্লোবাল আর্টিস্ট এনেছে সেহেতু শো-পিস টাইপ কিছু দেখবো! কিন্তু আমার ধারণা ভুল ছিলো, খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে মিমিকে উপস্থাপন করা হয়েছে। বোঝেনা সে বোঝেনা সিনেমায় মিমি চক্রবর্তীর ডায়লগ ডেলিভারি একদম অন্য লেভেলের ছিল, এবং তুফান সিনেমায় বেশ ধীরে সুস্থে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে চাইবো তুফান ২ তে যেন তাকে আরো বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
🔹চঞ্চল চৌধুরী (এসি একরাম)
একবার খালি চিন্তা করেন সাকিন সারিসুরির চঞ্চল চৌধুরী কিংবা হাওয়া সিনেমার চঞ্চল চৌধুরী কেমন ছিলো! আর এই তুফান সিনেমায় এ এক ভিন্ন চঞ্চল চৌধুরীর সাথে আপনাদের দেখা হবে। সত্যি বলতে চঞ্চল চৌধুরী আসার পর থেকে আমি বেশি উপভোগ করেছি। এবং বেশ করে চাচ্ছিলাম তুফান এবং এসি আকরামের একটা মুখোমুখি ক্লাশ ঘটুক, কিন্তু শেষে যা দেখলাম তা দেখার জন্য একদম প্রস্তুত ছিলাম না!
🔹শাকিব খান (গালিব বিন গনি/শান্ত)
বেশ অনেক বছর আগে খুনি শিকদার যখন দেখছিলাম, তখন ভাবছিলাম এই লোকটার রুচিবোধ কি ঠিকঠাক থাকবে সব সময়! না তার রুচিবোধ ঠিকঠাক ছিল না, তিনি মনে হয় একমাত্র প্রতিভাবান অভিনেতা যিনি নিজের মর্ম বুঝতেন না। কিন্তু ‘শিকারি’ দেখার পরে বেশ আশা নিয়েই ছিলাম, উনি উনার মর্যাদাটা বুঝুক, যাক অবশেষে তিনি বুঝতে পেরেছেন, দেরিতে হলেও। বারবার তুফান ভদ্র ভাষা থেকে একটু দুষ্ট ভাষায় চলে আসলেই তখন চোখের সামনে ভেসে আসছিলো সিটি টেররের বুলেট, কিংবা খুনী শিকদারের শাহজাহান। এই সিনেমায় শাকিবকে কে দেখে যে কেউ ফ্যান হয়ে যাবেন, ইভেন যারা শাকিবকে অপছন্দ করতেন তাঁরাও ফ্যান হয়ে যাবেন। তিনি ভালো অভিনেতা এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নাই, উনাকে নিয়ে একটাই ভয়, কবে না আবার মানহীন সিনেমায় নাম লেখায়! তবে এবার বোধহয় তিনি এই ভুল আর করবেন না, যতোটুক সময় আছে, এটা ব্যবহার করলে সর্বকালের সেরা অভিনেতাদের তালিকায় উনিও খোদাইকৃত নামে পরিণত হয়ে যাবেন।
এছাড়া ফিল্মের নাম ভূমিকায় থাকা সালাউদ্দিন লাভলুকে আরো একটু বেশি স্ক্রিনটাইম দিতেই পারতেন। অপর দিকে লোকনাথ দে তুফানের আশপাশে থেকে জানান দিয়েছেন ‘তুফান ২’-তে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় হয়তো থাকবেন। এক কথায় বলা যায় ফিল্মের প্রতিটা কলাকুশলীদের নিজেদের সেরাটাই দিয়েছেন, কেউ কোনো কমতি রাখেন নাই।
এবার চলে যাচ্ছি কিছু বিরক্তিকর দিক!! এই ফিল্মের সবচেয়ে বাজে দিক হলো পুরো কলকাতার ভাইব, আরো আফসোসের বিষয় ৯০ দশকের ঢাকার একটা কাল্পনিক চিত্র না তুলে ধরা, সবাই কেমন কলকাতার লোকেদের মতো কথা বলছে! একমাত্র চঞ্চল চৌধুরী আসার পরেই একটা দেশী ভাইব আসছে, আবার শাকিব খান যখন টুকটাক শাকিব স্টাইলে ডায়লগ দিচ্ছিলো তখন একটু দেশী ভাইব আসছিলো। এছাড়া কিছু কিছু চরিত্র কে চাইলেই আরো বিল্ড-আপ করা যেতো, যেমন: সালাউদ্দিন লাভলু, শহীদুজ্জামান সেলিম ও ফজলুর রহমান বাবু। তবে বাবু সাহেবের আধা বাংলা আধা ইংলিশ বেশ বিনোদন দিচ্ছিলো। গল্পটা আরো একটু জটিল করা যেতো যেহেতু ক্রাইম থ্রিলার টাইপের সিনেমা। দুইটা বড় বড় স্টার ছিলো উনাদের দিয়ে কিছু ডায়লগ ক্ল্যাশ করানো যেতো, এগুলাই কিন্তু কমার্শিয়াল সিনেমার ভিত্তি, এগুলাই অনেকদিন ধরে মনে রাখে দর্শকরা। তবে আর যাই বলেন তুফান সিনেমার গল্প নিয়ে যদি বেশি না আর একটু কাজ হতো কিংবা ‘তুফান ২’-তে যদি এই গল্পে আরো একটু ক্রিটিকাল টুইস্ট আনা যায় তাহলে এই সিনেমা হয়ে দাঁড়াবে বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির বিশাল এক হাতিয়ার।
কাহিনীসংক্ষেপ
চোখের সামনে বাবা হারানো এক ছেলের গ্যাংস্টার হয়ে উঠার গল্প। নিজের জেদের কাছে পশুকেও হার মানানোর গল্প। নিজেকে উঁচিয়ে ধরার এক নেশায় মেতে উঠার গল্প!
পরিশেষে ‘তুফান’ দেখার মতো এবং উপভোগ্য সিনেমা। এ যে এক ভিন্ন শাকিব খান তা বলতেই হয়। খুব চ্যালেঞ্জিং লেগেছে পুরো সিনেমার কাজ। এগিয়ে যাক বাংলা সিনেমা।
আর হ্যাঁ একটা কথা আছে না! ভালোর মাঝে খারাপ না থাকলে ভালোটা চোখে কম পরে! সবাই হলে গিয়ে সিনেমা দেখবেন, পাইরেসি থেকে মুক্ত থাকুন
এক নজরে ‘তুফান’
পরিচালক: রায়হান রাফী; রচয়িতা: রায়হান রাফী ও আদনান আদিব খান; শ্রেষ্ঠাংশে: শাকিব খান, চঞ্চল চৌধুরী, মিমি, নাবিলা, গাজী রাকায়েত, ফজলুর রহমান বাবু, শহীদুজ্জামান সেলিমসহ আরো অনেকে; ধরন: ক্রাইম থ্রিলার; মিউজিক: প্রীতম হাসান ও আরাফাত মহসিন; ব্যাপ্তিকাল: ২ ঘণ্টা ২৫ মিনিট; দেশ: বাংলাদেশ; ভাষা: বাংলা
রেটিং: ৮/১০