Select Page

কন্ট্রাক্ট: দেখার মত যথেষ্ট জিনিস রয়েছে

কন্ট্রাক্ট: দেখার মত যথেষ্ট জিনিস রয়েছে


কন্ট্র্যাক্ট ভালো লাগেনি? তাকদীরের মত হয়নি, আর? আর কোনটার নাম বলতে পারবেন জোর দিয়ে? বলছেন বই এর ধারেকাছেও হয়নি। তো বই আর সিনেমা কি জিনিস? না পারলে বানাতে বলেছে কে তাই না? ধরুন আপনি সিনেমা বানান, বড় প্ল্যাটফর্ম খুঁজছেন, যারা টাকাও দেবে ইচ্ছামত বানাতেও দেবে। ওরা নিজেরাই এমন একটা ম্যাটেরিয়াল বেছে নিল, যা বাংলাদেশে খাবে। বলতে পারেন যেই স্টারকাস্ট তাতে অন্য যেকোনো গল্প নিয়ে বানানো যেত। কন্ট্র্যাক্ট বা বেগ-বাস্টার্ড সিরিজই কেন? এটা তো আপনার কাছে আ সং অফ আইস অ্যান্ড ফায়ার লেভেলের পূজ্য। বানালে ওটাই বানাতে হবে, না হলে না!

বড় একটা প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশ থেকে ওয়েবসিরিজ যাবে, সব বাংলাদেশী কলাকুশলী থাকবে। এই সুযোগ কয়জন হাতছাড়া করত? কিন্তু কাজটা প্রচন্ড কঠিন। মাত্র ১৮০ মিনিট ৬টা পর্ব, মানে সিনেমার মত গল্প বলা যাবে না। বলতে হবে ওয়েবসিরিজ ফর্ম্যাটে। কয়েক বছর আগে অল্ট বালাজিতে ভারতের সুভাস চন্দ্র বোসকে নিয়ে একটা সিরিজ দেখেছি, বায়োপিক ভেবে দেখতে বসে দেখি ২০ মিনিটের একেক্টা এপিসোড, রাজকুমার রাও লিড। একতা কাপুরের কন্টেন্টে যা হয়, সিরিয়াস একটা ঐতিহাসিক গল্পকে সিরিজে ঢালতে গিয়ে ট্রিটমেন্ট পুরাই পপকর্ন। গোগ্রাসে শেষ করলাম, কিন্তু কিছুই ফিল করলাম না।

৬টা বই এর গল্প, তাও ২য় বই থেকে শুরু করতে হবে। মানে পেছনের গল্পে ফাঁক। শুধু চরিত্রগুলো আর মূল ভাবটা নাও, ১৮০ মিনিটে বলার মত একটা স্ক্রিনপ্লে সাজাও। রাইটিং টিম সেটাই করলো। তবে মাথায় রাখলো সিজন ২ এ শূন্যস্থানগুলো পূরণ করবে। মনে পড়ে গেলো Sacred Games এর কথা। সেখানে সিজন ১ এ বড় একটা ক্লিফহ্যাঙ্গার থাকে, গাইতোন্ডের পেছনের গল্প থেকে শুরু হয় সিজন ২। অনেকগুলো চরিত্র, ননলিনিয়ারভাবে বলা। এটাই হয়েছে এখানে- কন্ট্র্যাক্টে শুরুর ২ এপিসোড লেগেছে আমার কী হচ্ছে ঠিকঠাক বুঝতে। কিন্তু আমি আগ্রহী থেকেছি। কারণ – ১। সংলাপ ২। অভিনয়। বাংলা নাটক/ সিনেমায় সংলাপের চিরাচরিত দুর্বলতা এখানে নেই। এখানে প্রায় প্রতিটা সংলাপ দাঁড়িপাল্লায় মাপা ও অর্থবহ। সাথে চমৎকার ছন্দময়। সমস্যা হয়েছে অনেকে ঠিকমত ডেলিভার করতে পারেনি গুরুগম্ভীর কিছু সংলাপ। ভেঙ্গে ভেঙ্গে বলার এই অভ্যাসটা শুধু বাংলাদেশী অভিনেতাদের মাঝেই দেখি, যা খুবই আন-ন্যাচারাল। বিশেষ করে পুরানো অভিনেতাদের মাঝে এই প্রবণতাটা বেশি দেখলাম।

আমি সিরিজটার ইংরেজি সাবটাইটেল করছিলাম। তাই ২ সেকেন্ডের সংলাপকে বলতে দেখলাম ৪-৫ সেকেন্ড লাগিয়ে ফেলছে। স্ক্রিনে কতক্ষণ একই লাইন দেখিয়ে রাখা যায়। বিরক্তিকর। অথচ লাইনটা এত চমৎকার, ভেঙ্গে দুই ৩ বারে দেখাতে ইচ্ছা করেনা। অভিনেতাদের সংলাপ বলায় এই দুর্বলতা কেন কেউ খেয়াল করেনা জানিনা। সবাই এটা করেনি। অনেকেই করেছে। ন্যাচারালি কেউ এভাবে কথা বলে না। আর বলিউড বেশি দেখি বলে সাবলীল সংলাপের সাথে ডেলিভারি সাবলীল না হলে অভিনয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যায়। …মঞ্চের মত লাগে।

তারপরেও অভিনয় সবাই তাদের সেরাটাই দিয়েছেন। অনেকে মিথিলার কাস্টিং অপছন্দ করেছেন। আমি নিজেও তাহসান- মিথিলা-জন এদের অভিনেতা ধরিনা। কিন্তু আমার এখানে মিথিলার অভিনয় যথেষ্ট ভালো লেগেছে। প্রথম রাজনৈতিক সভার দৃশ্য থেকেই তার ম্যানারিজম আর শক্ত চাহনির ডায়লগ ডেলিভারি দেখেই বোঝা যায় তিনি চরিত্রের উপর কাজ করেছেন, যেটাকে নির্বিকার বলছেন, সেটাকে বলে nuanced acting। চমৎকার ট্রান্সফর্মেশান। সাবটাইটেল করতে করতেই তার সংলাপ বলা, অভিনয় দেখে ভাবানুবাদ করতেও মজা পেয়েছি। আরেকটা বিশেষ ব্যাপার হচ্ছে ইংরেজি বলা। আমাদের অভিনেতাদের মাঝে ইংরেজি বলায় দুর্বলতা প্রবল, এখানেও ভারতীয় অভিনেতারা তুখোড়। স্বাভাবিক – আমাদের অভিনেতারা বাংলা বলতে বলতে সংলাপে ইংরেজি বলতে গেলেই একটা জোরপূর্বক অদক্ষতা চলে আসে। খুব কানে বাজে। একজন পুলিশের চরিত্রে দারুণ সংলাপ বলছেন, শেষে গিয়ে একটা ইংরেজি বলেই মেরে দিলেন।

তবে অ্যাকশন দৃশ্যগুলো বিরক্তিকর ও শিশুতোষ। থ্রিলারে অ্যাকশন সবসময় যে মারামারি হাতাহাতি ঘুষাঘুষি থাকতে হবে এমন না। কিন্তু যৌক্তিক হতে হবে, এবং সম্পাদনা হতে হবে পারফেক্ট। সেজন্য অ্যাকশন কোরিয়োগ্রাফার লাগে, আমার ঘোর সন্দেহ আছে এমন কেউ ছিল কিনা। শুভর একটা গোলাগুলির দৃশ্যে স্টাইল কিছুটা ভালো লেগেছে। বাকিসব অখাদ্য। এবং প্রায় সিরিজের মজাই মাটি হয়ে যাওয়ার মত। ডিটেলিং খুবই নিম্নমানের, কন্টিনিউটি এররগুলা ক্ষমার অযোগ্য।
তারপর চরিত্র হিসেবে শুধু রঞ্জুকে কিছুটা বোঝা গেছে, বাস্টার্ড প্রায় রহস্যময়, যেন সেটাও সিজন ২ তে বের হয়ে আসবে। উমা মেয়েটার সাথে কিছুটা সহানুভুতি তৈরি হয়। আর কারো জন্য কিছুই ফিল করিনি। জানিনা, আমরা মনে হয় ড্রামা লিখতে জানি না আসলেই। সবকিছু যেন থ্রিলের মাঝেই আবদ্ধ। ড্রামা লিখতে গেলে মেলোড্রামা হয়ে যায়।

সবমিলিয়ে কন্ট্র্যাক্ট দেখে মনে হয়েছে কোন সিনেমার সেকেন্ড অ্যাক্ট দেখলাম। প্রথম অ্যাক্ট হয়ত সিজন ২ তে দেখবো। তবে মজা পেয়েছি স্ক্রিনপ্লেতে পরিকল্পনার ছোঁয়া দেখে, কঠিন গন্ডির ভেতরেও প্রায় প্রতিটা দৃশ্যকে তথ্যবহুল বানানোর পাশাপাশি ছোট ছোট সাবটেক্সট ছুড়ে দেয়া হয়েছে। আবেগের দিক থেকে জুড়তে না পারলেও বেশিরভাগেরই মোটিভেশান পরিষ্কার হয়েছে, সবকিছু স্পষ্ট হোক এমনটা চাইও নি। কিছু সিজন ২ এর জন্য জমা থাক।

আমি ওয়াহিদ তারেকের নাটকগুলো থেকেই নন লিনিয়ার স্ক্রিনপ্লের ভক্ত। কন্ট্র্যাক্ট আমাকে আবেগি না করলেও বিনোদন দিয়েছে, পানিভাত প্রেডিক্টেবল মনে হয়নি। বাংলাদেশী কন্টেন্ট থেকে এটা আমার জন্য বড় পাওয়া।

অভিনেতাদের লেখক ব্যবহার করেছেন গুটি হিসেবে, সবাই যথার্থ স্ক্রিন টাইম ও শাইন করার সুযোগ পেয়েছেন। আমার সবচেয়ে পছন্দ হয়েছে শুভকে। ওর মধ্যে সম্ভাবনা ছিল সবসময়েই জানতাম। এবার ডায়লগ ডেলিভারি দিয়েও মানটা বুঝিয়ে দিয়েছে। এই চরিত্রে আর কাউকে কল্পনা করতে পারিনি। সারপ্রাইজ করেছে চঞ্চল চৌধুরী। সত্যি বলতে, আয়নাবাজিতে ভালো লাগার পর দেবীতে চঞ্চলের মিসির আলীকে মোটেই পছন্দ হয়নি। ওই যে – আবার সেই বই পরে ফেলার ফল। বই পড়লে সিনেমা/সিরিজ মনের মত হওয়া খুবই কঠিন। আমি কন্ট্রাক্ট পড়িনি। পড়বোও না আপাতত। সিরিজ শেষ হোক দেখা যাবে। চঞ্চলের ওপেনিং দৃশ্যটার মত কিছু বাংলাদেশে শেষ কবে দেখেছি মনে পড়ে না, সিনেমাটোগ্রাফি শট প্ল্যানিং পারফেক্ট। ভালো ভালো সংলাপগুলোকে জমিয়ে ডেলিভারও করেছেন। তাকদীরের পর তার সেরা চরিত্র। বেগের চরিত্রে শ্যামল মওলা আমার ব্যক্তিগত পছন্দের। বেগ কেমন জানিনা, তবে শ্যামলের অভিনয় ভালো লেগেছে। কস্টনীড়ের পর তার এই চরিত্রে কাজ দেখে ডেডিকেশানটা পরিষ্কার। ইন্টারোগেশানে ডিমের সংলাপগুলো দুর্দান্তভাবে ডেলিভার করেছেন। আরেকটা যথার্থ কাস্টিং। আশা করি সিজন ২ তে তার ভালো একটা ব্যাক স্টোরি পাবো, যেই বেগ নিয়ে সবার কাছে শুনছি। মাজনুন মিজান ও রওনক দুজনেই অভিজ্ঞতা অনুযায়ী অভিনয় করেছেন। সিনিয়র অভিনেতাদের অভিনয় আমার কেন যেন বাইরের দেশের অভিনেতাদের মতন স্মার্ট লাগে না। আমার ধারণা পরিচালকেরা ওনাদের কিছু বলতেও দ্বিধা করে।

আবহ সঙ্গীত ৬০% ভালো লেগেছে মূল থিম মিউজিকসহ, বাকি অনেকখানেই সৃজনশীলতায় অভাব ও অতি-ব্যবহার মনে হয়েছে। আমাদের এখানে এই ঘরানাটা একদম দুর্বল। অথচ আবহ সঙ্গীত সিনেমায় একেকটা চরিত্রের মত কাজ করে। গানটাকে পুরাতন কোন স্মৃতি বা ভবিষ্যতের কিছুর আভাস দিলেও অপ্রয়োজনীয় লেগেছে।

ভালো লাগুক, মন্দ লাগুক, আমার মনে হয় সিরিজটায় দেখার মত যথেষ্ট জিনিস রয়েছে, অন্তত সুঅভিনয় ও কৌতূহল থেকেও দেখতে পারেন। তবে অ্যাকশন থ্রিলারের চেয়ে পলিটিক্যাল থ্রিলার ভেবে দেখতে বসলে ভালো করবেন। এখানে এখনো অ্যাকশন, ভায়োলেন্স- শিল্পটা আয়ত্ব করা সম্ভব হয়নি।

Zee5 এ ফ্রিতে দেখাচ্ছে, সেখানে অ্যাডের প্যারা নিতে না চাইলে প্রিমিয়াম মাত্র ১৩টাকায় কিনে দেখতে পারেন ৭ দিনের জন্য। রবি বা এয়ারটেল থাকলেই চলে। আরও পেমেন্ট মেথড তো রয়েছেই।
আপনারা না দেখলে বাইরের প্ল্যাটফর্মগুলাকে হারাবো আমরা। আমাদের এই কলাকুশলীদের নিয়েই কিন্তু চলতে হবে। তাই গালি দিলেও সাবস্ক্রাইব করে দেখুন। যাতে ভুল শুধরে সিজন ২ নির্মিত হতে পারে। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো।


Leave a reply