
রিভিউ: কাব্যিক বাংলাদেশি চলচ্চিত্র ‘বালুর নগরীতে’
[মাহদী হাসান পরিচালিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘বালুর নগরীতে’ বা ‘স্যান্ড সিটি’। তার নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রে যে সম্ভাবনা, নিরীক্ষা ও অন্তর্দৃষ্টি ঝলক দেখা যায়; স্বভাবতই ‘বালুর নগরীতে’ আমাদের আগ্রহী করে তোলে। সিনেমাটি ফেস্টিভ্যাল জার্নি শুরু হয়েছে চেক প্রজাতন্ত্রের কার্লভি ভেরি উৎসবের মাধ্যমে। সম্মানজনক এ আসরে প্রক্সিমা গ্র্যান্ড পিক্স পুরস্কার জিতে নিয়েছে ‘বালুর নগরীতে’। এর আগেই উৎসবের সুবাদে সিনেমাটির রিভিউ প্রকাশ হয়েছে একাধিক খ্যাতনামা চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকায়। বিএমডিবির জন্য অনূদিত এ রিভিউ নেয়া হয়েছে স্ক্রিন ডেইলি থেকে। ওয়েন্ডি আইডের রিভিউয়ের শিরোনাম ‘টু ডিসপারেট লাইভস আর লিংকড বাই স্যান্ড ইন লিরিক্যাল বাংলাদেশি ফিচার’। বোধগম্য হওয়ার সুবিধার্থে বাংলা শিরোনামে খানিকটা স্বাধীনতা নেয়া হলো।]

ঢাকা শহরের দুই প্রান্তে সমান্তরালে দুজন ব্যক্তির বসবাস, তাদের মধ্যে যোগসূত্র হলো বালু। এমা (ভিক্টোরিয়া চাকমা) নামে এক তরুণী তার ক্যাট লিটার ট্রের জন্য শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতি সপ্তাহে বালু সংগ্রহ করে। কাচ কারখানার শ্রমিক হাসান (মোস্তফা মনওয়ার)। সে কারখানা থেকে সিলিকা বালু চুরি করে বাড়িতেই কাচ তৈরির চেষ্টা করে এবং তার নিজের কারখানা শুরুর পরিকল্পনা করে। বড় শহরে দুজন অপরিচিত ব্যক্তিকে নিয়ে চলচ্চিত্রের শুরু ব্যক্তিক্রমী কিছু নয়, রীতি অনুসারে তারা কোনোভাবে একে অপরকে সাথে পরিচিত হবে। পরিচালক মাহদী হাসান এই ধারণাকে বদলে দিয়ে দুই কেন্দ্রীয় চরিত্রের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখেন। যার ফলে অপ্রত্যাশিত ও কিছুটা বিভ্রান্তিকর চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে ‘বালুর নগরীতে’, তবে মাতিও জোম্বিনির প্রাণবন্ত চিত্রগ্রহণের জন্য ধন্যবাদ, যা আকর্ষণীয়ভাবে সুন্দর।
ঢাকাভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাতা মাহদী হাসান কয়েকটি অফবিট স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করে হাত পাকিয়ে তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ‘আই এম টাইম’ (২০১৬) ও ‘ডেথ অব আ রিডার’ (২০১৮) লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসবের ওপেন ডোরস প্রদর্শনী শাখায় এবং ‘আ বোরিং ফিল্ম’ (২০২০) লোকার্নোর লিওপার্ডস অব টুমরো আন্তর্জাতিক শাখায় প্রদর্শিত হয়। ‘বালুর নগরীতে’ দিয়েও তিনি ওই উৎসবে সংযোগ বজায় রাখেন এবং ওপেন ডোরস জুরি থেকে ডেভেলপমেন্ট ফান্ডিংয়ের জন্য নির্বাচিত হন। এই উৎসবের আয়োজকদের কাছে চলচ্চিত্রটি প্রথার বাইরে ও নতুনত্বের নিরীক্ষণ নিয়ে হাজির হয় এবং কার্লোভি ভেরি’র প্রক্সিমা প্রতিযোগিতায় প্রিমিয়ার হয়।

উইলিয়াম ব্লেক (টু সি আ ওয়ার্ল্ড ইন আ গ্রেইন অব স্যান্ড…) ও টিএস ইলিয়টের উক্তি দিয়ে শুরু হওয়া এ চলচ্চিত্র। এখান যেমন প্রত্যাশা করা যায়, এই চলচ্চিত্রও তেমন কাব্যিক দৃশ্যায়নের দিকে মনোযোগী হয়। দুটি কেন্দ্রীয় চরিত্রের গল্পের মূলভিত্তি বালু, যা বিশ্বের সবচেয়ে জনবসতিপূর্ণ শহরে জীবনের অনিশ্চিত প্রকৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। এই বালু নির্মাণ কাজের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করে, যে নির্মাণ কাজ ঢাকাকে ভেতর থেকে গ্রাস করে যাচ্ছে। আর বালু পরিবর্তনশীল অনিশ্চিত সত্তা যা গোপনীয়তাকে লুকিয়ে রাখে।
এরকমই এক রহস্য হলো বালুর ভেতর থেকে এমার আবিষ্কৃত কাটা আঙুল। সম্ভবত এটি একজন মহিলার হাতের আঙুল, যার নখে রক্তিম লাল রং মাখা আছে। এমা কাটা আঙুল দেখে ভয় পায় না বরং প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং এই ভয়াবহ ও ক্ষয়িঞ্চু মুহূর্তের সঙ্গে তার আবেগঘন সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সম্ভবত এমার প্রতি বৈরি এই পৃথিবীতে এটি একটি মানবিক যোগসূত্র, কারণ তার স্কুটিতে বর্ণবাদী গ্রাফিতি আঁকা হয় ও সে একাকী জীবনযাপন করে।
এর বিপরীতে হাসান বেশ সঙ্গলিপ্সু চরিত্র। কাচ কারখানায় কাজের পর সে শহর জুড়ে ঘুরে বেড়ায় ও নিয়মিত বারে যায়। চলচিত্রের এই অসম্পৃক্ত ও সংযোগবিহীন প্রকৃতি দুর্ঘটনাবশত নয়। নগরের দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রবাহে আটকে থাকা জীবন অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর জন্য সহায়ক নয়। কখনো কখনো একজন মানুষ এই স্রোতে ভেসে থাকতে অপরের সঙ্গে পরিচিত হয়। তবে নির্মাতা গল্প বলার যে পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন, তা যেসব দর্শক গল্পের পরিণতিতে চরিত্রগুলোর মধ্যে সংযোগ দেখতে চান তাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হতে পারে।
সৌভাগ্যবশত জোম্বিনির চিত্রগ্রহণে রংয়ের মিশ্রণ (ডিজিটাল ক্যামেরায় ধারণ করা হলেও সুপার সিক্সটিনের স্যাচুরেটেড হিউ ধরার জন্য কালার গ্রেডিং করা হয়) ও কালাইডোস্কোপিক, ভঙুর ফ্রেম চলচ্চিত্রটিকে দেখতে মনোমুগ্ধকর করে তুলে। ‘বালুর নগরীতে’ অবশ্যই অদ্ভুত ও খাপছাড়া, কিন্তু কাব্যিক একটি চলচ্চিত্র।