রিভিউ: কেন ভাল লেগেছে ‘সাপলুডু’
প্রথমেই বলে রাখি যে, আমি সিনেমা দেখি এবং সিনেমা নিয়ে লিখি মনের আনন্দে। বাংলাদেশী সিনেমায় দেখার মত কিছুই থাকেনা জেনেও বছরে বেছে বেছে কিছু ছবি প্রথম দিন প্রথম শো- এ ই দেখার চেষ্টা করি এবং সেগুলো নিয়ে ভাল-মন্দ লিখতে ভালবাসি। নিজেদের সিনেমায় ভিন্নতা বা নতুনত্বের স্বাদ পেলে আমি একটু বেশীই এক্সাইটেড হই এবং নিজের মত করে নিজের ভাল লাগা, মন্দ লাগা প্রকাশ করি।
বাংলাদেশী সিনেমার হাজারো দুর্বলতা, ব্যর্থতা জেনে-বুঝেই আমি বাংলা সিনেমাকে ভালবাসি। কারন আমার কাছে বাংলাদেশী সিনেমা একটা আবেগের জায়গা। সিনেমার রিভিউ- এর ক্ষেত্রে তাই আমি তাত্ত্বিক বিশ্লেষক হওয়ার চেয়ে বরং নিজের অনুভুতিটুকুকে প্রকাশ করতেই বেশী পছন্দ করি।
সিনেমা হলে আমি কখনো একটি সিনেমার দোষ-ত্রুটি গুলো খুঁজে খুঁজে বের করতে যাইনা। বরং সব দোষ-ত্রুটি এক পাশে রেখে আমি সিনেমাটাকে কিভাবে আবিষ্কার করি বা কতটুকু উপভোগ করি সেটাই হয়ে উঠে মূখ্য বিষয়। তাই আমার রিভিউতে সিনেমার ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে বিশ্লেষক সাজার চেয়ে বরং মোটা দাগে সিনেমাটি উপভোগ্য, কী উপভোগ্য না, কিংবা সিনেমাটায় কী আছে, কী নেই, সে সব বিষয় নিয়েই আমি বলে যাই।
আমাকে যদি কেউ মুভি ক্রিটিক হিসেবে ধরেন কিংবা স্বঘোষিত ক্রিটিক হিসেবেও বিবেচনা করেন তাদের এও জানা উচিৎ যে, আমি মূলধারার সমালোচক। সিনেমায় মূলধারা বলে একটা বিষয় অবশ্যই আছে, যেখানে সিনেমার বুদ্ধিভিত্তিক বা তাত্বিক দিকের চেয়ে বিনোদনটাই মূখ্য হয়ে উঠে। যারা মূলধারার বাইরে গিয়ে সিনেমার তাত্বিক বা বুদ্ধিভিত্তিক আলোচনায় বিশ্বাসী তাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা রইলো, তবে আমি নিজে তাদের মত তাত্বিক বা বুদ্ধিভিত্তিক আলোচনার সক্ষমতা রাখি না, কিংবা রাখলেও এ ধরনের আলোচনায় আমার আগ্রহ্ খুবই কম।
আমার কাছে হাজারো দোষ-ত্রুটির পরেও একটা ছবি যে কোন বিশেষ কারনে হয়তো উপভোগ্য হয়ে উঠতে পারে, আবার অলমোস্ট ত্রুটিহীন কোন ছবিও বোরিং লাগতে পারে। আমি আমার সৎ অনুভুতিটুকু প্রকাশ করতে পারি কেবল।
সূতারং অমুক ছবি কেন ভাল লাগলো, তমুক ছবি কেন ভাল লাগলো না, এই কৈফিয়ত আমি কাউকে দিবো না।
রিভিউর নামে আমার সৎ অনুভুতির প্রকাশভঙ্গি কারো ভাল লাগলে ভাল, না ভাল লাগলে কিছুই করার নেই। আমি কেবল আমার ভাল লাগা, মন্দ লাগা নিয়েই ভাবি। অন্যের ভাল লাগা, মন্দ লাগার সাথে আমার লেনাদেনা নেই। আশা করি সবাই বুঝতে পেরেছেন। এবার ”সাপলুডু” প্রসঙ্গে আসি-
সাপলুডু একটি থ্রীলার জনরের ছবি। সাম্প্রতিক সময়ে সারাবিশ্বে থ্রীলার ছবি জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও বাংলাদেশের বানিজ্যিক ছবি এখনো একটা নোংরা ফ্রেমে আটকে আছে। বাংলাদেশী বানিজ্যিক ছবির ফরম্যাটটা পঁচে-গলে এমন কদাকার রুপ ধারণ করেছে যে, কেউ সেখান থেকে বেরিয়ে ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা করলে আমরা তাকে এপ্রিশিয়েট করি। ছবির সার্বিক মান বিচারের চেয়েও মূখ্য হয়ে উঠে ফ্রেম ভেঙ্গে বাইরে আসার চেষ্টাটুকু। আমরা স্বপ্ন দেখি, এভাবেই একটু একটু করে বাংলাদেশের বানিজ্যিক সিনেমা পঁচে-গলে যাওয়া ফরম্যাট থেকে বেরিয়ে এসে একদিন সত্যিকারের মুক্তি লাভ করবে। আর তাই সাম্প্রতিক সময়ের বহুল আলোচিত আয়নাবাজি, ঢাকা অ্যাটাক, পোড়ামন ২ কিংবা দেবীর মত ছবিগুলোর মান পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ না করেই ছবিগুলোকে আমরা সমর্থন করেছি। ছবিগুলোর ব্যাবসায়িক সাফল্যে আমরা নতুন একটা ধারায় বিশ্বাসী হতে শুরু করেছি। আর আমার মতে এই ধারারই নতুন সংযোজন গোলাম সোহরাব দোদুলের ”সাপলুডু”।
সাপলুডুর গল্প রিবিল করতে চাচ্ছিনা বলে গল্পটা নিয়ে কিছু বলবো না। শুধু বলবো বাংলা বানিজ্যিক ছবিতে এই ধরনের গল্প অবশ্যই নতুনত্বের স্বাদ দিয়েছে। তার উপর ছবির প্রথমার্ধে গল্পকার একের পর এক টুইস্ট এন্ড টার্ন রেখে গল্প জমানোর চেষ্টা করে গেছেন। ছবির ন্যারেটিভ স্টাইলেও ভিন্নতা দেয়ার চেষ্টা ছিল। গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন ধারার ন্যারেটিভ স্টাইল, যেখানে কোন একটি গল্প ধরে এগিয়ে যাওয়ার চেয়ে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা এবং চরিত্রকে একসাথে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা ছিল। সেক্ষেত্রে সিনেমার মূল গল্প থেকে ফোকাস এদিক সেদিক হয়েছে বটে, তবে এই ন্যারেটিভ স্টাইল দর্শকদের মধ্যে কিছুটা হলেও টেনশন ক্রিয়েট করতে সক্ষম, যা একটা থ্রীলারের জন্য সহায়ক।
হ্যা, এও সত্য যে, গল্পটা যেভাবে এগিয়ে যায় তাতে সব ঘটনা বা চরিত্রকে মূল ঘটনার সাথে সংযোগ করতে গিয়ে ছবির দ্বিতীয়ার্ধে খেই হারিয়েছেন গল্পকার। এছাড়া ছবির গোটা ন্যারেটিভ স্টাইল কিংবা সর্বশেষ ক্লাইম্যাক্স খুব বুদ্ধিদীপ্ত বা শক্তিশালী হয়নি। আরেকটু বুদ্ধিদীপ্ত ন্যারেটিভ স্টাইল কিংবা আরেকটু শক্তিশালী ক্লাইম্যাক্স হলে ছবি জমে ক্ষীর হতেই পারতো। তবু কী পাইনি তার চেয়েও জরুরী কী পেয়েছি। বাংলাদেশের সিনেমা এখন যে পর্যায়ে আছে, সেখানে দাঁড়িয়ে ইনসেপশন কিংবা দৃশ্যায়ম প্রত্যাশা করতে আমি অন্তত পারছি না।
বাংলাদেশের সিনেমার লেভেল বিবেচনায় ছবির গল্পকার বা চিত্রনাট্যকার যা দিয়েছেন সেটাই নেহায়েত কম না।বাংলাদেশের সিনেমার লেভেল কিছুটা হলেও উপরে নিয়ে আসতে পেরেছেন তারা। অন্তত ভিন্ন কিছু করার চেষ্টাটুকু চোখে পড়েছে। এখন সেইটুকু প্রাপ্তি নিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলবো নাকি অপ্রাপ্তির ঢালি নিয়ে বসে যাবো সমালোচনা করতে সেটা তর্ক সাপেক্ষ ব্যাপার। আমি আপাতত এইটুকু ভিন্নতাকেও এপ্রিসিয়েট করতে চাই। এভাবে একটু একটু করেই সামনে এগিয়ে চলুক আমাদের সিনেমা। তাতেই আমি খুশি।
বাংলা সিনেমাকে প্যাম্পার করতে যেমন আমি পারিনা, তেমনি একে একেবারে কোল থেকে ছুড়ে ফেলে দেয়াও আমার দ্বারা সম্ভব না। আমাদেরই সিনেমা। শত দুর্বলতার পরও সামান্য ভাল কিছু দেখলে অনেক বেশী খুশি হয়ে যাই এবং প্রান খুলে এপ্রিশিয়েট করতে চাই।
সাপলুডু নিয়ে যে ভয়টা ছিল তা হচ্ছে, ট্রেইলার দেখে এর সিনেমাটোগ্রাফী, কালার কারেকশন কিংবা অন্যান্য টেকনোলজির দিকগুলো নিয়ে সন্দেহ্ তৈরী হয়েছিল।
তবে আশার কথা হচ্ছে, সিনেমাটোগ্রাফী, কালার বা অন্যান্য দিকগুলো ভালই হয়েছে। ছবির লোকেশন ছিল এ ছবির সবচেয়ে বড় প্ল্যাস পয়েন্ট। ঘন জঙ্গলের দৃশ্য ছিল বেশীর ভাগ ছবি জুড়ে যা সিনেপ্লেক্স- এর পর্দায় সত্যিই দুর্দান্ত লেগেছে। এছাড়া ছোট ছোট কিছু পাসিং শট ছিল যা দারুণ লেগেছে।
সেক্ষেত্রে অন্তত এই দিকটা নিয়ে আমি নির্মাতার ভূয়সী প্রশংসা করবো। আগে দর্শনধারী, পরে গুণ বিচারী। ছবি যে দেখতে ভাল হয়েছে এটাই বা সচারচর বাংলাদেশের সিনেমায় পাওয়া যায় কোথায়?
ছবির অভিনয় শিল্পীরা খারাপ করেননি। আরিফিন শুভ সিরিয়াস দৃশ্যে ভাল করেছে। তবে হাসি-ঠাট্টা বা রোমান্সে তার অভিনয় ভাল লাগেনা। এ ছবিতে সে ইম্প্রুভ করেছে বটে। তবু এখনো সন্তোষজনক না। তারপরও ভাল কাজের প্রতি তার ডেডিকেশন প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। বিদ্যা সিনহা সাহা মিম ঠিকঠাক। জাহিদ হাসান গতানুগতিক অভিনয় করেছে। কেন যেন তার অভিনয়ে একটা গা ছাড়া ভাব ছিল। তার চরিত্রের গুরুত্ব খুব বেশী, সে হিসেবে সে সাধারণ মানের অভিনয়ই করে গেছে। সালাউদ্দীন লাভলু কমেডিগুলো খারাপ করেনি। আর ছোট ছোট চরিত্রের অভিনেতারা সবাই ভাল করেছে। বিশেষ করে রুনা খান ছবিতে ছোট্ট চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছে।
বাংলাদেশের সিনেমায় শিল্পীরা কেমন একটা নাটুকে ধারায় অভিনয় করে। মেথড এক্টিং সহজে পাওয়া যায় না। এ ছবিতেও সেই সমস্যা ছিল। রুনা খান, শতাব্দি ওয়াদুদ কিংবা ছোট ছোট চরিত্রের অভিনেতা এক্ষেত্রে ভাল করলেও প্রধান চরিত্রের অভিনেতাদের মধ্যে একটা মেকি ভাব ছিল। এই বিষয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের উন্নয়ন খুব জরুরী এখন।
ছবির আরেকটা অপ্রাপ্তির দিক হচ্ছে মিউজিক। গানগুলো তেমন ভাল হয়নি, আবার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকও ভাল কিছু দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়া টুকটাক প্লট হোল, মোবাইলে তোলা ফুটেজকে পরিস্কার ভাবে দেখানো (যদিও আজকাল যুগে মোবাইল ক্যামেরার ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে, তবু গ্রামের দোকানদারের মোবাইলে তোলা ফুটেজ এতো পরিস্কার দেখা গেলে সেটা হজম করা কষ্টকর)এবং সবচেয়ে বড় করে, দুর্বল ক্ল্যাইম্যাক্স এবং ছবিতে গভীরতার অভাব থাকায় ছবিটি পারফেক্ট বা নিয়ার পারফেক্ট কোন ছবি হতে পারেনি। কিন্তু এতো অপ্রাপ্তির পরও অন্য দশটা বাংলাদেশী সিনেমার মত প্রাপ্তির ঝুলি একেবারে শূন্য করে দেয়নি এ ছবিটি। আর এখানেই ছবিটি আমাকে তৃপ্তি দিয়েছে। ছবির চমৎকার লোকেশন, সুন্দর কাস্ট, একের পর এক টুইস্টে ভরা গল্প, ভিন্ন ধারার ন্যারেটিভ স্টাইল এবং সর্বোপরি ভাল কিছু করার সৎ চেষ্টা দেখে আমি ব্যাক্তিগতভাবে বেশ মুগ্ধ হয়েছি।
আমার কাছে সবমিলিয়ে এ ছবি ঢাকা অ্যাটাক কিংবা দেবীর মত ছবিগুলোর চেয়ে বেশী ভাল লেগেছে।অন্তত এ ছবিতে কোথাও বোর হওয়ার কোন সূযোগ রাখেননি নির্মাতা যা একটা বানিজ্যিক ছবির জন্য অনেক বড় বিষয়।
সাপলুডুর মত ছবিই পারে বাংলাদেশের বানিজ্যিক ছবিকে একটু একটু করে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে। তাই আমি চাই সকল বাংলাদেশী সিনেমাপ্রেমী এ ছবি দেখুক এবং ছবিটিকে নিজ নিজ জায়গা থেকে সমর্থন করুক। বাংলাদেশের সিনেমার স্বার্থে এ ধরনের ছবি হিট হওয়া খুব জরুরী।
তবে কারো যদি পকেটের টাকা এবং সময়ের মূল্য খুব বেশী হয়ে থাকে, এমনকি বাংলাদেশের সিনেমার প্রতি আবেগ বা ভালবাসার চেয়ে বেশী, তাহলে তার শুধু এই ছবি না, বাংলাদেশের কোন ছবিই দেখা উচিৎ না! এটা খুবই লেইম লাগে দেখতে যে, কেউ কেউ বাংলাদেশের ছবি দেখে এসে টাকা বা সময়ের জন্য কান্নাকাটি করে, এমনকি নির্মাতার কাছে টাকা ফেরত চায় কিংবা নির্মাতার নামে মামলা করতে চাইয় (কেউ কেউ গালি গালোজও করে!) সিরিয়াসলি, এতো টাকা আর সময়ের মূল্য যার থাকে, তার কোন ক্রমেই উচিৎ না সিনেমা হলের পাশ দিয়েও হাঁটা। সিনেমা দেখে সময় ও টাকার অপচয় না করে নিজের জীবনকে ক্যাশ করার কাজে লেগে পড়ুন। তাতে শুধু আপনার না, দেশ ও দশেরও উপকার হবে।
সিনেমা আমাদের মত নির্বোধ, আবেগীদের জন্য ছেড়ে দিন। আমরা সাপলুডুর মত অপেক্ষাকৃত ভাল বাংলাদেশী সিনেমার জন্য হাসিমুখে নিজের সময় এবং টাকা অপচয় করতে দুই বার ভাববো না।