রিভিউ/ নায়ক হয়ে রাজীবের ‘পরাণ পাখী’
ভিলেন হিসেবে খ্যাতি পাওয়ার আগে নায়ক চরিত্রে চেষ্টা করেছিলেন রাজীব। সাইদুর রহমান মানিক পরিচালিত ‘পরাণ পাখী’ তারই প্রথম। ১৯৮৩ সালে মুক্তি পাওয়া সেই ছবিতে নায়িকা ছিলেন সুচরিতা। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় সিনেমাটির রিভিউ করেছিলেন মাহমুদা চৌধুরী। পড়ুন তবে।
মধু-মালতী, সুজন-সখী ইত্যাদির ধারাবাহিকতায় লেটেস্ট বোস্তানী ‘পরাণ পাখী’। বলা বাহুল্য, আখ্যান ভাগ গ্রাম কেন্দ্রিক। ওসমান ফকীর তার রাঙা বৌকে জোয়ান মদ্দ ছোটভাই পুতুলের কারিগর পরাণের কাছে গাঁচছত রেখে গ্রাম-গ্রামান্তরে গান ফেরী করে বেড়ায়। স্বামী জীবন উদাসী-ঘরে দারিদ্রের হতশ্রী থাকলেও রাঙাভাবীর কিন্তু সাজপাটের অভাব হয় না। পাড়া মাথায় করে দেবরের সঙ্গে। নাচ-গান-জড়াজড়ি করলেও তাদের মধ্যে নাকি মা-সন্তানের সম্পর্ক!
অবশেষে তালুকদারের গেছো মেয়ে পাখির উদয় হয়। পরিচয় পর্বে ঝগড়া, মান-অভিমানের খুনসুটি। ফর্মুলা মতো প্রেম। বেলা দ্বি-প্রহরে ক্ষেতের ধারে বসে তারা চাঁদ দেখে। গান গায়। আর এই প্রেমের যাদু স্পর্শেই পুতুলের কারিগর পরাণের পদোন্নতি ঘটে ভাস্করে। সে মাটি দিয়ে আবক্ষ প্রিয়ারূপ গড়ে ফেলে। কিন্তু মোড়ল তালুকদারের মন ভেজে না। সে এক কথায় পরাণ পাখির বিয়ের প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। ওসমানের বাপেরকালের দোতারা লাথি মেরে ভেঙে ফেলে। পাখিকে ঘরে বন্দী করে রাখে। নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাত তুঙ্গে তুলতে গিয়ে চিত্রনাট্যকারের মাথায় ‘চাপা ডাঙার বৌ’-এর ভূত (নাকি পেত্মী) এসে ভর করে। অতএব, রাঙা বৌ ঘরের দরজা বন্ধ না করে ঘুমিয়ে পড়ে। অজ্ঞাতজন রাঙা বৌকে আক্রমণ করলে সে চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় তোলে।
গ্রামের কুটনীবাড়ী ফুলীর দাদী মোড়লের টাকা খেয়ে এসে ঘরের দাওয়ার পরাণের একপাটি সেন্ডেল ও রাঙাবৌয়ের গলায় মাফলার আবিষ্কার করে ফেলে। অতএব ফর্মুলামত গ্রামের লোকদের বিবেকের চোখ বন্ধ হয়ে যায়, ঘোট পাকিয়ে ওঠে মোড়ল আয়োজিত বিচার সভার। পরাণের অননুপস্থিতিতেই পরাণের বিচার শুরু হয়। শুধু, তাই নয় রাঙা বৌয়ের চরিত্রেও অসতী বলেও কলঙ্ক লেপে দেয়া হয়। (বাড়িতে বাড়ির ছেলের সেন্ডেল পাওয়ার অভিনবত্বের কী আছে? আর পরাণ বড় ভাবীর ঘরে প্রবেশ করলে বড় ভাবী চেঁচিয়ে লোক জড় করবে কেন? গাইয়ে বাছুরে মিল থাকলে ক্ষেতে গিয়েও দুধ দিতে পারে।) সংসার বিবাগী ওসমান পত্নী প্রেমে বিশ্বস্ত বলে সে প্রতিবাদ জানিয়ে সভাত্যাগ করে। কিন্তু দেবর ভাবীকে বাড়ির আঙিনায় আলিঙ্গনাবস্থায় দেখে তার মন ঘৃণায় বিষিয়ে ওঠে। তবে রক্ষা যে সে তৎক্ষণাৎ তালাক দেয় না বা স্ত্রীর গায়েও হাত দেয় না। এটুকু ভারসাম্য রক্ষা করে ওসমান রাঙা বৌকে গৃহত্যাগের নির্দেশ দেয়। এমতাবস্থায় কাহিনীর বিদূষক – ঘইনা, যে মোড়লবাড়ির চাকর- পরাণের কাছে সব রহস্য ফাঁস করে দেয়। মোড়লের লাঠিয়াল বাহিনীর সঙ্গে স্যামসনের মত শক্তি পরাণের তোলে। যুদ্ধ বাঁধে। সে একাই একশ। অবশেষে বারে বারে ‘ঘুঘু তুমি খেয়ে যাবে ধান’ বলে হবু শ্বশুর তালুকদারকে আচ্ছামত ধোলাই দেয় পরাণ। পরাণের কর্মসূচী সফলান্তে সুখের শইলতা’ রাঙাভাবীর বিয়োগ ব্যথা-বিষাদের সুর আনে। সমাজের চাপিয়ে দেয়া কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে অবহেলিত নারীর পক্ষে বেঁচে থাকায় কোন সম্মান তো নেই-ই, সান্ত্বনাও নেই। ছবির সবচেয়ে সমৃদ্ধ অংশ সংলাপ। আলোক নিয়ন্ত্রণ খুব বাজে। ঘরের ভিতর দীপের আলোয় ওসমানের ক্লোজশট একমাত্র ব্যতিক্রম। গ্রামবাংলার মায়াবী সৌন্দর্য ক্যামেরায় ধরা পড়েছে বটে তবে সম্পাদনার সাহায্যে তা সিনেমার ভাষা হয়ে ওঠেনি। (গান গেয়ে ওসমানের ফেরার সময় রাঙা বৌয়ের আকুলতা ও খুশির শটগুলো এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য।)
বাণিজ্যিক ছবির রোমান্টিক ভাবাবেশ রাজীবের চোখে মুখে ফোটেনি। এছাড়া ফারুকের প্রভাবও তিনি এড়াতে পারেননি। গ্রামের পটভূমিকায় তার ডিসকো মার্কা নর্তন কুর্দন ছিল বেখাপ্পা। অবশ্য এ জন্য দায়ী পরিচালকই। শহরের মার্জিত ভঙ্গী, চুলের ছাঁট, কপালের টিপ, বিলাসী শাড়ি সুচন্দার গ্লামার বৃদ্ধি করলেও চরিত্রটিকে বাস্তব চ্যুত করেছে। সুচরিতা ও শিশুশিল্পীর সহজ প্রগলভ অভিনয় ভালো লাগে। গানের সুর গুরুচণ্ডালী দোষে কষ্টে। তবে বিপুল ভট্টাচার্যের কণ্ঠে মরমীয়া সঙ্গীতগুলো চমৎকার লেগেছে। শেষ পর্যন্ত তার গাওয়া গানগুলোর টানেই দর্শক প্রেক্ষাগৃহে বসে থাকে।
প্রসঙ্গতঃ পরান পাখীর ইংরাজী নাম ‘My Soul’।
*মূল রিভিউতে শিরোনাম ছিল শুধু ‘পরাণ পাখী’। বর্তমান শিরোনামটি বিএমডিবির দেয়া।