Select Page

আলাদা আলাদা নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ

আলাদা আলাদা নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ

nekabborer-mohaprayan

কবিতা অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র দুলর্ভ না হলেও খুব একটা সুলভ নয়। যা সুলভ নয়, তা নিয়ে উচ্চকিত হবার যথেষ্ট কারণ থাকতেই পারে। নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ নির্মলেন্দু গুণের বিখ্যাত একটি কবিতা। সে কবিতা অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন মাসুদ পথিক, যিনিও একজন কবি। একজন কবি কী করে আরেকজন কবির কবিতাকে ব্যাখ্যা করে সেল্যুয়েডে রূপান্তর ঘটান সেটাও যথেষ্ট কৌতুহলজনক। এটা পাঠকের কল্পনাকে সীমায়িত করে কিনা, সে প্রশ্নও করা যেতে পারে। তবে আমরা করব না।

কবিতাটির মূল দুটি চরিত্র নেকাব্বর আর ফাতেমা। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক এটা আমরা অনুমান করে নিতে পারি। যদিও এই প্রেমে হৃদয়ের বিষয়টা চলচ্চিত্রে ফুটে উঠে নাই। এই দুটি চরিত্রকে কেন্দ্র করে আছে একটা ভূগোলের গল্প। যে ভূগোলের একটা জাতীয়তাবাদী ধারণা আছে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদ এগিয়ে গেছে আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির ধারণা নিয়ে। পরিণতিবাদের দিক থেকে এর অবশ্যম্ভাবী ফলাফল একাত্তর। চলচ্চিত্রেও তার উপস্থিতি ষোল আনা।

নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ শুধু কবিতাকে চিত্রায়িত করে শেষ নয়, বরং যে যে ঘটনা আমরা ঘটতে দেখি তার জন্য একটা বিবেক বা সাক্ষী গোপাল দরকার হয়। কবিতার আত্মগত বৈশিষ্ট্যের স্বভাব জানি। সে স্বভাব ধরে এই চলচ্চিত্রে উপস্থিত কবি নির্মলেন্দু গুণ নিজে, যিনি এই চলচ্চিত্রের একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র। চলচ্চিত্রের শুরু ও শেষ তাকে দিয়ে। এক অর্থে তার চোখ দিয়েই আমরা এই চলচ্চিত্রের ঘটনা পরম্পরায় ঢুকে পড়ি। তিনি অভিনয় করেছেনও দারুণ। তাকে বলা যায় এই কবিতার সেল্যুয়েডায়নের নোঙর। হয়ত একটা জনগোষ্ঠিকে তিনি যেভাবে ভাবতে চান আমরা সেভাবে দেখি। হয়ত না, কারণ মাসুদ পথিকের বিন্যাসে নতুন কিছু হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘটনা যাই হোক কবির সায় আছে তো বটে। কবির মুখে শোনা গেল, এই চলচ্চিত্রের প্রিমিয়ারে উপস্থিত থাকতে সুইডেন সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরেছেন।

নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ আবর্তিত হয়েছে নেকাব্বর নামের চরিত্র নিয়ে। সে চরিত্রে আমরা নানান ধরণের গুণের দেখা পাই। গ্রামে বেড়ে উঠা সহজ একজন মানুষ, তার আছে ধ্যানী রূপ, জীব জগতের সাথে মায়া মমতার যোগাযোগ, কখনো তিনি বিদ্রোহী, আবার একজন প্রেমিক বটে। এত এত রূপ আলাদা আলাদা ঘটনা পরম্পরায় আমরা দেখি। কিন্তু তারা যেন আলাদা চরিত্র, জোড়া লেগে অখণ্ড নেকাব্বর হয়ে উঠে না। ফলে দর্শককে সন্তুষ্ট থাকতে হয় আলাদা আলাদা নেকাব্বরকে নিয়ে। তাই পুরো চলচ্চিত্র জুড়ে আমরা নানান নেকাব্বরের প্রয়াণই দেখি।

তবে খণ্ড খণ্ড করে দেখার বিষয়টিতে একটা ছন্দ থাকতে পারে। থাকতে পারে ফিল্মিক ট্রিটমেন্ট। ব্যাপারটা এমন যে  সবসময় চরিত্র প্রতিষ্ঠা পেতে হবে এমন নয়, তার আলাদা ছন্দ হতে পারে। সে হিসেবে চরিত্রের প্রতিষ্ঠা পাওয়া চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আবার এমনও হতে পারে প্রতিষ্ঠা না পাওয়াটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু পুরোটাতে গাঁথতে কিছু মাল মশলা তো লাগে। আছে কি সেই মাল মশলা!

nekabborer-mohaprayan-shimla

আগেই আমরা আবহমান বাংলার ধারণাটি এখানে উল্লেখ করেছি। গল্প প্রতিষ্ঠার যে কথাটি আমরা বলেছি সেখানে একটা দৃশ্যের সাথে আরেকটা দৃশ্য জুড়ে দিতে গিয়ে পেয়েছি চমৎকার সব ডিটেইল। সেখানে উঠে এসেছে বাংলার ভূ-প্রকৃতি থেকে শুরু করে নানান অনুষ্ঠান ও কৃত্য। বিশেষ করে প্রকৃতির নান্দনিক উপস্থাপন এই চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রাণ। যা যথেষ্ট ফিল্মিক ছিল, এমনভাবে গ্রাম বাংলাকে চলচ্চিত্রে কমই দেখা গেছে। কিন্তু গল্পের গাঁথুনিতে কী যেন ছিল না, ফলে কাব্যিকভাবে দৃশ্যের পর দৃশ্য এসেছে কেমন যেন একটার সাথে আরেকটা মেলে নাই। এমনকি এই না মেলাটাও চলচ্চিত্রের প্রাণভোমরা হয়ে উঠতে পারে নাই। ফলে কোন চরিত্রের প্রতিষ্ঠা না পাওয়ার সাথে সাথে গল্পকেও সুনির্দিষ্টভাবে ধরা যায় নাই। তারপরও  দৃশ্যের এমন বিন্যাস চিন্তা করতে পারার জন্য মাসুদকে ধন্যবাদ।

এই গল্পের শুরু ঊনসত্তরের গণ আন্দোলনের সময়কালে। সে গণ আন্দোলনের জোয়ার নেকাব্বরের গ্রামে লাগে নাই। তবে সেখান ছিল অন্য আন্দোলন। ফসলের ন্যায্য হিস্যার আন্দোলন। এরপর আসে মুক্তিযুদ্ধ। যা আর শহরে সীমাবদ্ধ থাকে না- নেকাব্বর সেই যুদ্ধে যোগ দিয়ে পঙ্গু হয়। অনেকবছর পাগলা গারদে থাকার পর ফিরে আসে। এই বিয়াল্লিশ বছরের কোন কিছু আমরা দেখি না। শুধুমাত্র বুঝতে পারি অনেক কিছু পাল্টে গেছে। কিন্তু সেটা কি আমরা জানি না। একটা পরিবর্তন বুঝি এইভাবে- একসময় নেকাব্বর চাষ করত লাঙ্গল আর গরু দিয়ে, বিয়াল্লিশ বছর পর সে যখন রাস্তা দিয়ে হেটে যায় একজন মোবাইলে বলছে  ট্রাক্টর কিনেছে। এই ধরনের প্রতীকায়ন চলচ্চিত্রটিতে আরো আছে। যা দেখতে ভালো লাগে। আরো একটি ইন্টারেস্টিং দৃশ্য হলো ধর্ষিতা ফাতেমার পাগল সন্তানের সাথে বার বার দেখা হওয়া। যে কিনা নেকাব্বরকে বার বার মাটি খেতে বলছে। এইসব দৃশ্যে বৃদ্ধ নেকাব্বর দারুন অভিনয় করেছেন।

মাসুদ পথিক নির্মিত ছবিটি দৃশ্যায়নে যথেষ্ট ঝকঝকে তকতকে। সঙ্গীতে ছিল চমৎকার দ্যোতনা। বিশেষ করে শুরুর গানটা ও কৃষ্ণকে নিয়ে গানটা ভালো লাগবে। আবহ সঙ্গীত অনেক ক্ষেত্রে জোরালোভাবে কানে লেগেছে। সাজসজ্জা ছিল স্থান-কাল অনুযায়ী। দৃশ্যগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মার খেয়েছে শুধুমাত্র দ্রুত দিন-রাত্রির পরিবর্তন আর কাহিনীর দিক বদলের জন্য। কাহিনীর অসঙ্গতি দারুনভাবে চোখে পড়ে। নেকাব্বরের মৃত্যুর জন্য দর্শককে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। এটা অবশ্যই ডিসক্রেডিট। তারপরও বলব এই কালের একজন কবির চোখে দেশ মাটি ও মানুষকে দেখতে চাইলে চলচ্চিত্রটি দেখুন।

*২০১৪ সালে নভেম্বরে রিভিউ প্রকাশিত হয় আলোকিত বাংলাদেশে।


Leave a reply