বিরল ও সার্বজনীন চলচ্চিত্র ‘সাঁতাও’
২১তম ঢাকা চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশী চলচ্চিত্র অতীতের দৃঢ় প্রতিফলন দেখিয়েছে, তন্মধ্যে খন্দকার সুমনের ‘সাঁতাও’ সূক্ষ্ম রাজনৈতিক সমালোচনা ও কাব্যিক উপলব্ধি তুলে ধরেছে। সমালোচক অ্যাক্সেল টিমো পুর চলচ্চিত্রটি কেন এমন মর্মস্পর্শী প্রভাব রেখেছে তার ব্যাখ্যা করেছেন। তার মূল লেখার শিরোনাম ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’–
‘সাঁতাও’ শব্দের অর্থ সাত দিন ধরে চলমান ঘটনা, তবে রংপুরের ভাষায় কথিত সাঁতাও শব্দের অর্থ দাঁড়ায় সাত দিন ধরে টানা বৃষ্টি। খন্দকার সুমনের ‘সাঁতাও‘ চলচ্চিত্রটি দেশের অতীত এবং সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ বর্তমান সময়ের ইতিহাস তুলে ধরে। সজল হোসেন, ইহতিশাম আহমেদ ও খন্দকার সুমনের চিত্রগ্রহণে নতুন দৃশ্যায়ন দেখা যায়, পাশাপাশি পুরনো ধাঁচের দৃশ্যধারণও রয়েছে, এবং এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয়ও দেখা যায়। যেমন – শুরুর দৃশ্যে ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইচ ধীরে ধীরে বিবাহের দৃশ্যে বিলীন হয়। এরকম প্রতিটি দৃশ্যের পরিবর্তন একটি নতুন অবস্থার সংকেত দেয়।
নববধূ পুতুল (আইনুন পুতুল) তার পরিবারকে ছেড়ে এসে নতুন ক্রয়কৃত এক গাভীর সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে। এই সখ্যতা তার স্বামী ফজলুলের (ফজলুল হক) সাথে আন্তরিক ঘনিষ্ঠতা থাকা পরেও হয়ে ওঠে না, কারণ তাকে ধান ফলানোর জন্য পুতুলকে বাড়িতে রেখে ক্ষেতে কাজ করতে যেতে হয়। খন্দকার সুমন এই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনার দায়িত্ব পালন করেন, তিনি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তেমনভাবে নজর কাড়তে না পারা প্রধান দুই অভিনয়শিল্পী এবং কিছু অপেশাদার শিল্পীদের নিয়ে নিপুণভাবে প্রাত্যহিক জীবনের চিত্রায়ন দেখিয়েছেন। এই চিত্রায়নে গভীর ভাবাবেগময় দৃশ্যকল্প এবং মৌলিক ও চিত্তাকর্ষক দৃষ্টিগোচর নান্দনিকতা ছিল, যা মুখ্য চরিত্রে অভিনয়শিল্পীগণ বিক্ষিপ্ত কিছু সংলাপ দিয়ে বর্ণনা করতে পারবে না। গাভীটি হঠাৎ মারা গেলে এবং পুতুলের গর্ভপাত হওয়ার পর বিষণ্ণতার মধ্যে দিয়ে দিনাতিপাত করতে থাকলে সুমন আরেকটি আকর্ষণীয় চিত্রকল্প খুঁজে পান এবং তিনি জীবিত গরু থেকে তার কঙ্কালসার পড়ে থাকার মধ্য দিয়ে জীবনের নির্দয় ক্ষণস্থায়িত্ব দেখান।
একসাথে মাছ ধরা কিংবা মৌসুমী পিঠা বানানোর মূহুর্তগুলোর সাথে ইউরোপীয় কৃষক সম্প্রদায়ের রীতি-প্রথার সাথে মিল রয়েছে, যা ভ্লাদিস্লাভ রেমন্তের “দ্য পিজেন্টস” (১৯০৪-০৯) ও কনুট হামসুনের “ব্লেসিং অব দ্য আর্থ” (১৯১৭) চলচ্চিত্রে প্রাণবন্তভাবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু সুমনের চলচ্চিত্রের মাঝামাঝিতে এই দৃশ্যগুলো সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে ধরা পড়েছে এবং সৌন্দর্য ও নিষ্ঠুরতার ভারসাম্য দেখা গেছে।
পুতুল তার মৃত গরুর বাছুরকে নিয়ে কিছুটা সান্ত্বনা পায় এবং এর সাথে আরও গভীর ও মা-সন্তানের সম্পর্ক তৈরি হয়। তবে ফসল ফলানোর জন্য মহাজনের নিকট থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করার সময় আসলে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে এই সম্পর্ক আসলে কিছুই না। এখানে আর বিশ বছর আগে বাঙালি গ্রামাঞ্চলে যা কল্পনাও করা যেত না তা হঠাৎ করেই প্রকট হয়ে ওঠে – দুর্নীতি এখানেও সাফল্য ও টিকে থাকা নির্ধারণ করে। সুমন ঘটনাক্রমে এই রসাতলে যাওয়ার চিত্র সূক্ষ্মভাবে পর্দায় তুলে ধরে। তিনি তার চরিত্রের পরিণতি সম্পর্কে আরও বেশি যত্নশীল যখন আমরা দেখি যুবক কৃষকেরা ঢাকায় কাজ করতে আসে এবং সেখানে কারখানা ধসে তাদের মর্মান্তিক মৃত্যু সংবাদ শুনি। গ্রামাঞ্চলের কৃষিকাজ করা যুবকেরা ধ্বংস হয়ে যায়, জীবন ও সাফল্যের পরিবর্তে এতগুলো মৃত্যু ফিরে আসে গ্রামে। আর পাশাপাশি রয়েছে প্রকৃতির বিরূপ প্রতিক্রিয়া। প্রথমে নদী শুকিয়ে খরার সৃষ্টি হয় এবং এরপর বন্যায় প্লাবিত হয়ে ফসল নষ্ট হয়।
সুমন ভয়ঙ্কর সুন্দর চিত্র খুঁজে পায় এবং কাব্যিক, অর্থনৈতিক এবং গ্রামের মানুষের সাথে জলবায়ুর বিশ্বায়নের মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন করে, তিনি বিশ্বকে দেশের কাছে নিয়ে আসে এবং দেশকে বিশ্ব পরিমণ্ডলে নিয়ে যায়। এই চিত্র ও বর্ণনা একদিকে এক ভেঙ্গে পড়া জগতের কথা বলে, এবং আরেকটি ট্র্যাজেডির কথা বলে যা হল পুতুলের বন্ধ্যাত্ব, যা প্রতীকী শক্তি এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে। চলচ্চিত্রটি আদিবাসী সমাজের ভঙ্গুর কাঠামোর দিকে সূক্ষ্মভাবে প্রশ্ন তোলে এবং এমনকি সাহসিকতার সাথে এবং সার্বভৌমভাবে ঈদুল আযহার মত উৎসবের দিনে ইসলাম ধর্মকে তুলে, যে দিনের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হল লোভকে সংবরণ করা ও প্রতিবেশীর পাশে থাকা। সুমন আবারও আমাদের চমকে দেয় যখন ফজলুর গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় আসে এবং রিকশাচালকের কাজ করে। সুমন এখানে অত্যন্ত সংবেদশীলতার সাথে পরিবার ও ভালোবাসার মত সম্পর্ককে পিছনে রেখে নতুন আশার আলো উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়।
এই বিষয়গুলো সাঁতাও-কে বিরল ও সার্বজনীন চলচ্চিত্রের রূপ দেয়, যা ছোট পরিসরে বিপুল বিষয়াবলি ব্যাখ্যা করে, যা শুধু বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতেই নয়, বরং কীভাবে বিশ্ব পরিচালিত হচ্ছে এবং কীভাবে পশ্চিমা দেশে আমরা আসলে ভবিষ্যতের বাঙালি কৃষক তা প্রত্যেক পশ্চিমা চলচ্চিত্র দর্শকের কাছে ব্যাখ্যা করে।
(কিছুটা সংক্ষেপিত)