রিয়াজ : সর্বমহলের সর্বশেষ নায়ক
এই লেখাটি যখন লিখছি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সফল সব নায়কের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই লিখছি। এদেশের চলচ্চিত্রে রাস্তা থেকে বহুতল ভবন পর্যন্ত যে নায়কদের মানুষ গ্রহণ করেছে, নিজেদের পছন্দের তালিকায় রেখে তাদের বিনোদনে কাজে লাগিয়েছে, বিভিন্ন সময়ে উদাহরণরূপে ব্যবহার করেছে তারাই ছিল সর্বমহলের নায়ক। গুরুত্বপূর্ণভাবে আরো মনে রাখা দরকার যে নায়ক তার কাজ দিয়ে সব শ্রেণির দর্শকের কাছে পৌঁছে গেছে, সবশ্রেণির দর্শক লালন করেছে এবং যার মধ্যে ব্যক্তিত্ব ও শিষ্টাচারের চমৎকার কম্বিনেশন আছে সেই ইমেজের দিক থেকেও আমাদের চলচ্চিত্রে সর্বমহলে সর্বশেষ গ্রহণযোগ্য নায়ক রিয়াজ।
এ টপিকের অবস্থান পরিষ্কার জন্য বলা দরকার ‘সর্বশেষ’ শব্দটি এখন পর্যন্ত আসা নায়কদের কাজকে বিশ্লেষণ করে তৈরি করা। আগামী দিনে যে নায়করা আসবে তাদের কাজ দিয়ে যদি তারা সবশ্রেণির মানুষের কাছে পৌঁছে যায়, গ্রহণীয় হয় তবে নতুন করে তাদেরকে যোগ করা যাবে। কিন্তু আপাতত সে সুযোগ নেই। রিয়াজই তাঁর কাজ দিয়ে আপাতত সর্বমহলের নায়ক হতে পেরেছে।
চলচ্চিত্রে যেহেতু ‘নায়ক’ বিষয়টাই সবচেয়ে চর্চিত তাই অভিনেতার কথা মাথায় রেখে নায়ক-কেই বেছে নেয়া হয়েছে।
রিয়াজের ক্যারিয়ারে যত ছবি আছে তার একটা ক্লাসিফিকেশন করে যদি বলা হয় তাহলে পরিষ্কার হবে তাঁর ভেরিয়েশন –
* রোমান্টিক/রোমান্টিক ড্রামা –
মনের মাঝে তুমি, নিঃশ্বাসে তুমি বিশ্বাসে তুমি, প্রাণের চেয়ে প্রিয়, হৃদয়ের আয়না, হৃদয়ের কথা, আকাশছোঁয়া ভালোবাসা, পৃথিবী তোমার আমার, বুক ভরা ভালোবাসা, কাজের মেয়ে, স্বপ্নের পুরুষ, বিয়ের ফুল, নারীর মন, মাটির ফুল, মিলন হবে কত দিনে, সাথী তুমি কার, মনে রেখ আমায়, এই মন চায় যে, হৃদয়ের বন্ধন, বস্তির মেয়ে, ও প্রিয়া তুমি কোথায়, রং নাম্বার, মনে পড়ে তোমাকে, না বোলো না। *রোমান্টিক ট্র্যাজেডি –
ভালোবাসা কারে কয়।
* রোমান্টিক অ্যাকশন –
ভয়ঙ্কর বিষু, ক্ষ্যাপা বাসু, প্রেমের তাজমহল, কঠিন বাস্তব, এরই নাম দোস্তী, অন্তরে ঝড়, স্বপ্নের ভালোবাসা, বাধা।
* অ্যাকশন –
সাবধান, দলপতি, মায়ের সম্মান, লাল দরিয়া।
* ফ্যামিলি ড্রামা/ সোশ্যাল ড্রামা – মোল্লাবাড়ির বউ, দুই নয়নের আলো, অজান্তে, মিথ্যার মৃত্যু, ভালোবাসি তোমাকে, এ বাঁধন যাবে না ছিঁড়ে, মন মানে না, জামাই শ্বশুর, মেঘের কোলে রোদ, এবাদত, ধাওয়া, সুন্দরী বধূ।
* কমেডি –
তোমাকেই খুঁজছি, টাকা, টক ঝাল মিষ্টি
* ফোক –
মালেকা সুন্দরী
* সাহিত্যভিত্তিক –
দারুচিনি দ্বীপ, শাস্তি, শ্যামল ছায়া, হাজার বছর ধরে, মেঘের পরে মেঘ, দুই দুয়ারী, খেলাঘর, একজন সঙ্গে ছিল।
* আন্তর্জাতিক
‘it was raining that night’
ছবির উদাহরণ যতটুকুই থাক রিয়াজের ভেরিয়েশনের দিকটা সহজেই বোঝা যায়। একজন দর্শক রিয়াজের এ ছবিগুলো যদি দেখে থাকে বা যারা দেখেছে তাদের সবার কাছে ঐ উত্তরটা আছে কোন ছবি কিভাবে কাদের কাছে পৌঁছে গেছে। কোন ছবির কোন চরিত্রটি কোন কোন শ্রেণির মানুষ পছন্দ করেছে। এভাবে তাঁর অনেক ছবির অনেক চরিত্র বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। শ্রেণিকরণটা একত্রিত করলে সর্বমহলের মানুষের কাছে পৌঁছানোর ঘটনাটা জানা যায়। ধরা যাক ‘মনের মাঝে তুমি’ ছবির রিয়াজের কথা। এই ছবি সর্বমহলের দর্শক পছন্দ করেছে। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ এ ছবিটি বলাকা সিনেমাহলে দেখার পরে হাইলি অ্যাপ্রিশিয়েট করেছিলেন। উনার লেভেলটা আমরা বুঝতে পারি এখন তাঁর থেকে নেমে যদি আমরা আমজনতার কাছে আসি তবে দেখা যাবে ছবিটা মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে গেছে। ট্র্যাক চেন্জ করে যদি ‘হাজার বছর ধরে’ ছবির কথা বলি সর্বমহলের দর্শকের পছন্দের তালিকায় এটাকে পাওয়া যাবে। আবার দেশের তুমুল জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যভিত্তিক ছবির কথা যদি বলি তো ‘দুই দুয়ারী’ তাঁর অসংখ্য ফ্যানবেজ এবং ফ্যানবেজ ছাড়াও অভিনয়কে কদর করা দর্শকরা এ ছবিটিকে লুফে নিয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভারত, আমেরিকা যৌথ প্রযোজনায় মহেশ মান্জরেকার পরিচালিত ‘it was raining that night’ নামের সিনেমায় রিয়াজ কাজ করেছিল সুস্মিতা সেন ও রিয়া সেনের সাথে। মহেশ মান্জরেকার একজন নামকরা ভারতীয় পরিচালক তিনি রিয়াজকে ‘সুপার অ্যাক্টর’ বলেছিলেন যেটা সিনেমাটি সম্পর্কে একটা ডকুমেন্টারিতে ছিল। এভাবে ছবির উদাহরণ যোগ করে নানা দর্শকের মত বিনিময় করলেও জানা যাবে রিয়াজ সর্বমহলের নায়ক।
গান আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক উপাদান। রিয়াজের ছবির অনেক গান সর্বমহলের দর্শকের গান। খুব বেশি দরকার নেই উদাহরণ দেবার। ‘পড়েনা চোখের পলক’, ‘ভালোবাসব বাসব রে বন্ধু’, ‘মনের মাঝে তুমি’, ‘অনেক সাধনার পরে আমি’, ‘মাথায় পরেছি সাদা ক্যাপ’, ‘তুমি সুতোয় বেঁধেছ শাপলার ফুল’ এই গানগুলোকে একযোগে বিশ্লেষণ করলে বিভিন্ন শ্রেণির দর্শকের কাছে তারতম্য অনুসারে তুমুল দর্শকপ্রিয়তা বোঝা যাবে।
এবার আসা যাক নায়কের পাশাপাশি অভিনেতা হয়ে ওঠার গল্পে একজন রিয়াজের গ্রহণযোগ্যতা। রিয়াজের সময়ের যারা ব্যস্ত নায়ক তাদের কথা মাথায় রেখেই যদি বলি একটা টাফ ক্যারেক্টারকে কোনো ছবির জন্য ভাবা হলে তার জন্য পারফেক্ট চয়েজ রিয়াজ। কারণ অন্যদের একটা না একটা ঘাটতি ছিল। তাদের দিয়ে চরিত্রায়ণের বিষয়টা ঝুলে যাবার আশঙ্কা থাকত। তো সেদিক থেকে রিয়াজের অভিনয়দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল না। তাই তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে টাফ ক্যারেক্টারের ছবি যেমন ‘দুই দুয়ারী, হাজার বছর ধরে, শ্যামল ছায়া, মেঘের পরে মেঘ’ এগুলোতে রিয়াজকেই চোখ বন্ধ করে নিয়েছিলেন নির্মাতারা।
টেলিভিশন প্রোডাকশনের বিষয়টা যদিও চলচ্চিত্রের বাইরের কিন্তু সাব-অর্ডিনেট সাবজেক্ট হিশেবে যদি বলি রিয়াজের সর্বমহলে গ্রহণযোগ্যতার অন্যতম মাধ্যম এটিও ছিল। তাঁর ‘জোছনার ফুল’ নাটকের জনপ্রিয়তা গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত সব দর্শকের কাতারে পৌঁছে গিয়েছিল। তাছাড়া নাটকের উদাহরণ দেবার শক্ত কারণ আছে। সেটা হচ্ছে ছোটপর্দার অভিনেতাকেও দর্শক অনেক সময় নায়ক বলে ভালোবেসে।
হিরোইজমের ধারায় আজকের যে স্বঘোষত বিখ্যাত হবার আয়োজন চলছে তার থেকে একেবারে দূরে থেকে নিজের কাজ, ব্যক্তিত্ব, ইমেজ এসব বজায় রেখে রিয়াজ একজন মানসম্পন্ন তারকা বা নায়ক যাকে সব ধরনের দর্শক ভালোবেসেছে। তাঁর সমসাময়িক অন্যদের জন্য সর্বমহলের দর্শকের কোনো না মন খারাপের বিষয় আছে কিন্তু রিয়াজকে নিয়ে গর্বের জায়গাটি উজ্জ্বল। তাই আগামী দিনে এমন ভার্সেটাইল পারফর্মার যতদিন না আসবে ততদিন পর্যন্ত একমাত্র রিয়াজই সর্বমহলের সর্বশেষ নায়ক হয়ে থাকবে।