Select Page

রূপসী বাংলার এক ‘কাঠবিড়ালী’

রূপসী বাংলার এক ‘কাঠবিড়ালী’

‘দাও ফিরে অরণ্য, লও এ নগর’ কবির এ বাণী আমাদের ভাবায়। আমরা আধুনিকতার জোরে যতই নগর সভ্যতার কথা বড়মুখ করে বলি না কেন আমাদের ভেতর গ্রামীণ চেতনা কাজ করে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে গ্রামেই ছুটে যাই কিংবা যাই সবুজের কাছাকাছি। দেশীয় চলচ্চিত্রের নাগরিক নির্মাণের আধিপত্য থেকে বেরিয়ে নতুন বছরের প্রথমেই দেখা মিলল নিটোল গ্রামীণ গল্পের ছবি ‘কাঠবিড়ালী।’

রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় রূপসী হয়ে ওঠা বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন এ ছবিতে জীবন্ত হয়ে থাকল।

২০২০ সালের প্রথম মানসম্মত সুনির্মিত ছবি ‘কাঠবিড়ালী।’ পরিচালক নিয়ামুল মুক্তা-র প্রথম ছবি। নিজের সিগনেচার রেখে নিজেকে চিনিয়েই নির্মাণ করলেন প্রথম ছবি।

‘কাঠবিড়ালী’ নামটি শুনলে মূলত চোখে ভাসবে গাছে গাছে ছুটে চলা দুরন্ত এক প্রাণির ছবি। চঞ্চল হয়ে ছুটে বেড়ানোই তার কাজ। কিন্তু গ্রামের ষোড়শী মেয়ের বৈশিষ্ট্যকে মাথায় রেখে যখন তাকে বলা হবে ‘কাঠবিড়ালী’ নামটি পাবে বিশেষত্ব। ছবির নাম নির্বাচন তাই সৃজনশীল।

কত মেয়ের গল্প ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে। তার মধ্য থেকে একজনের গল্প উঠে এসেছে এ ছবিতে। ‘ছবির সব চরিত্র কাল্পনিক’ জাতীয় লাইন যখন নিয়ম রক্ষার খাতিরে বলা হয় তারপরেও কারো না কারো সাথে মিলে যায় কারণ জীবনের গল্পই তো ছবিতে থাকে। ‘কাঠবিড়ালী’-র গল্পও তাই।

– আপনি বড় হইবেন কবে? আমার যে সংসার করতে ইচ্ছা হয়
( স্পর্শিয়াকে সামনে বসিয়ে)
– বউ, এই যে বাজার রান্না করো
– রান্না কেমন হইছে
– রান্না মজা হইছে
– আমার জন্য কি আনছ? স্বর্ণের দুল?
– আমার কি আর সেই সামর্থ্য আছে? তোমার জন্য এক টুকরো ভালোবাসা আনছি
স্পর্শিয়া-আবীরের চমৎকার রসায়নের চিত্র এটি। দুটি ছেলেমেয়ের নিষ্পাপ ভালোবাসার সাক্ষী যেন আকাশ ভরা সূর্য তারা। তারা হেসেখেলে বোড়ায়, প্রেমে ডুবে যায় একান্তে, মাথার উপর দিয়ে ট্রেন যায় আর তারা পুলের নিচে যুগল হয়ে যায়। এত ভালোবাসা কি সফল হবে না! নাকি জীবন তাদের জন্য রেখেছে অন্যকিছু!

পরিচালক ছবিকে বুদ্ধিমত্তার সাথে সাজিয়েছেন। প্রথমার্ধ্বের নিটোল প্রেমকাহিনীর সাথে বিরতির পরের দুর্দান্ত থ্রিলার ছবির গল্পকে স্ট্রং করেছে। প্রথমার্ধ্বের সবুজ গ্রামজীবনের সাথে বিরতির পরে রাতের দৃশ্যের সাথে ভয়, টেনশন, থ্রিলিং-এর যে সম্পর্ক তিনি বুঝিয়েছেন এটা প্রশংসনীয়। রেদওয়ান রনি-র সহকারী ছিলেন পরিচালক নিয়ামুল মুক্তা ‘কাঠকুড়ালী’-র গল্পের প্যাটার্ন সাজানোর কাজে সেই ছাপ আছে। নির্মাণে আরো সচেতন তিনি। তাঁর নির্মাণের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক পয়েন্ট আউট করে বলা যাক –
১. প্রেম ও বিশ্বাসের গভীরতা এবং দূরত্ব দেখিয়েছেন।
২. বন্ধুত্বের ইতিবাচক-নেতিবাচক দুই দিকই তুলে ধরেছেন।
৩. দিন ও রাতের ভিন্ন মিনিং তুলে ধরেছেন গল্পের প্রেক্ষাপটে। কখনো কখনো দিনেই নেমে আসতে পারে রাতের অন্ধকার যদি জীবন জটিল হয়ে যায়। এটা ছিল চমৎকার অবজারভেশন।
৪. সংস্কৃতি তুলে ধরেছেন। যেমন – শৈশবের বিভিন্ন উপকরণ, নারিকেলের খোলে করে টেলিফোন বানিয়ে প্রেমের কথা বলা, মার্বেল খেলা, কুস্তি, গ্রামের মেলায় জিলাপী খাওয়া ঘূর্ণি ওড়ানো, রুমালে প্রেমিক প্রেমিকার নাম সেলাই করা, যাত্রা দেখানো, বিয়েবাড়ির গেট তৈরি, খুর্মা বিতরণ ইত্যিদি।
৫. প্রথম দৃশ্যেই ছবির আকর্ষণ তৈরি করতে পেরেছেন আর শেষ দৃশ্যটি পুরস্কার পাবার যোগ্য।
৬. গল্পকে এনজয় করতে তিন-চারটা শক্ত টুইস্ট রেখেছেন। দর্শককে কনফিউজড করতে পারবেন এটা বলা যায়।
৭. ক্লাইমেক্সের দৃশ্যায়ন ও সংলাপ স্ট্রং।
৮. মূল চরিত্রের পরিণতির সাথে অন্যান্য চরিত্রকে পরিণতি দিয়েছেন লজিক্যালি।
৯. যৌনশিক্ষার অভাব চলচ্চিত্রে আমাদের এখানে আছে। এ ছবিতে গল্পের ডিমান্ডে আছে এবং অ্যাডাল্ট করেই দেখিয়েছেন পরিচালক।
১০. ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, দৃশ্যধারণ (ড্রোন) প্রশংসনীয়। বিশেষ করে পুকুরে এক নাগাড়ে ডুব দেয়ার লং শটের সাথে মানুষের সাইকোলজি (রাগ, ঘৃণা) দেখানোটা ইউনিক ছিল।
দর্শকভেদে বিরতির পর ছবির থ্রিলিং মেজাজে তারতম্য থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু এনজয় করার মতো অবশ্যই ছিল।

অর্চিতা স্পর্শিয়া নামভূমিকায় ছবির প্রাণ। নিজেকে নতুন করে চেনানোর মতো অভিনয়টা করে গেছে। তার ক্যারিয়ার সামনে আরো উজ্জ্বল। নতুন মুখ আসাদুজ্জামান আবীরও ইম্প্রেসিভ। শেষের আধঘণ্টায় নিজেকে ঢেলে দিয়েছে প্রথমদিকের ক্যাজুয়ালি অভিনয়ের তুলনায়। নায়কের চোখের ব্যবহার দর্শককে কানেক্ট করতে দেরি করাতে পারে তবে তার চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। এ দুজন ছবির সহকারী পরিচালকের কাজও করেছে এবং এটা বাড়তি যোগ্যতা ছিল তাদের। সৈয়দ জামান শাওনের অভিনয়ও প্রশংসনীয়। শিল্পী সরকার অপুর তুলনা তিনি নিজে। আজগর চরিত্রের অভিনেতা কিছুটা লাউড অ্যাকটিং করাতে ওভারঅল একইরকম ছিল। একজন অভিনেতার মুখে ‘ছেলেমেয়েকে ভালো রাখা মা-বাবার দায়িত্ব, দেশের পুলিশের নয়’ সংলাপটি ভালো ছিল।

ছবির গান ‘সুন্দর কন্যা’ বেস্ট। গানের কথা, গায়কীতে বাউল ধাঁচ আকর্ষণীয়। ‘পতি’ শিরোনামের গানটি একটু ভিন্ন।

আর হ্যাঁ, আমাদের দেশ যে কতটা সুন্দর ‘কাঠবিড়ালী’ ছবি আরেকবার প্রমাণ করল।

রেটিং – ৮/১০


Leave a reply