লড়িয়ে নায়কের ইমেজ সংকট: উদার জাতীয়তাবাদী সমাজের ডিলেমা
নায়ককে ঘিরে একটা প্রতিকূলতা থাকে। সেই প্রতিকূলতা নানাবিধ, বহুমাত্রিক হতে পারে। প্রতিকূলতার সেই পরিমণ্ডলের বাইরে নায়ককে আলাদা করে চেনার উপায় নেই, নায়কের স্বাতন্ত্র্য প্রতিকূলতার সাথে শর্তযুক্ত…
জন্মশত্রু চলচ্চিত্রের দৃশ্য
রৌদ্রে আহা রুগ্ম আর বাদলে খেয়ে-যাওয়া
উশ্কো-খুশ্কো চুলের ওপর লুণ্ঠিত লরেল,
ভুলেছে তার যুবন দশা, স্বপ্নে তবু ধোওয়া,
দীর্ঘ হাত, অথচ নয় দিগন্ত অঢেল।
হায়রে তোরা, স্বর্গ আর পাতালে বিতাড়িত,
ঘাতক তোরা দুঃসহন দুঃখ পেয়েছিলি,
কেন রে তোরা মায়ের ভ্রূণে রইলি না, যেখানে
মৌন ছিল, এবং বাঁচা, ঘুমের নিরিবিলি।
সে তবু খোঁজে শুকিয়ে-যাওয়া সাগরে খুঁজে যায়
যখন তাকে ভুলে গিয়েছে তারি নিজের মা,
খলহাস্য শাপশাপান্তে কখনো কেঁদে মরে
এমন একটা দেশ যেখানে মাথাটা গোঁজা যায়।
নরকে তার সঞ্চরণ স্বর্গে চাবুক-খাওয়া
নীরব হাসি ব্যঙ্গময় মুখের ঘটে ক্ষয়,
হঠাৎ-হঠাৎ স্বপ্ন দ্যাখে নীল আকাশের ছায়ে
ছোট্ট একটা মাঠের-আর কোনো কিছুর নয়।
(ব্রেশটের কবিতা: Ballade von den Abenteurern, নাটক: Baal; অনুবাদ: আলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত)
এক. বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্[১]
লড়িয়ে একজন নায়ক। বিদ্যমান গল্পের বুনিয়াদ এবং কাহিনির বয়ান প্রণালীতে লড়িয়ে হচ্ছে একজন নায়ক। এটাকে উল্টে বললেই বরং শুনতে সুবিধে হয়, বুঝতেও। তা হচ্ছে, নায়কের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে লড়াই, এমনকি দৃশ্যত মুক্তিসংগ্রাম। যে ধরনের কাহিনিতে জটিল মনজ ও যৌনজ সম্পর্কের সাথে নায়কের লড়াইকে মহিমান্বিত করা হয়ে থাকে, সেই কাহিনি (বা চিত্রের) কথা নয় বরং আপাতঃ জনপ্রিয়[২] চলচ্চিত্রে যে ধারার বয়ান হয়ে থাকে- তার মধ্যকার কথাই হচ্ছে।
স্পষ্টতই কতকগুলো সূত্র মেনে চলে এই ইমেজ নির্মাণ প্রক্রিয়া। প্রথমত, নায়কোচিত প্রত্যাশিত গুণপনার সমাহার ঘটে থাকে পুরুষের বেলায়। পুরুষই নায়ক। যে ‘সাহস’, ‘বীরত্ব’, ‘তীক্ষ্ম বিশ্লেষণ’, ‘স্থিরতা’, ‘নিয়ন্ত্রণ’ ও ‘আত্মপ্রকাশ’ মহিমায়ন প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত তা সর্বাত্মকভাবে পুরুষালি। বিরুদ্ধ-ইমেজ নির্মাণ যে ঘটে থাকে না তা নয়, তবে, বিরুদ্ধ-ইমেজ বিরুদ্ধ-হেজেমনির[৩] ধারাবাহিক ভিত্তি তৈরির নিশ্চয়তা দেয় না, ফলে প্রায়শই সেগুলো পৌরুষের পুনঃপৌনিক অনুলিপি মাত্র, নারী-চেতন্যের স্মারক নয়। দ্বিতীয়ত, নায়ককে ঘিরে একটা প্রতিকূলতা থাকে। সেই প্রতিকূলতা নানাবিধ, বহুমাত্রিক হতে পারে। প্রতিকূলতার সেই পরিমণ্ডলের বাইরে নায়ককে আলাদা করে চেনার উপায় নেই, নায়কের স্বাতন্ত্র্য প্রতিকূলতার সাথে শর্তযুক্ত। যদি সে অস্বচ্ছল হয় তাহলে প্রতিকূলতার রূপদান করা সহজসাধ্য। সেক্ষেত্রে নায়কের চরিত্র নির্মাণে গ্রহণযোগ্যতা[৪] অর্জন অত্যন্ত অনায়াস। তা যদি নাও হয়, কিংবা হলেও, ঘটনাচক্রের দৈবাৎ অনুক্রমে নায়ক প্রতিকূলতায় আক্রান্ত হতে থাকে। তৃতীয়ত, প্রতিকূলতার মধ্যে যে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে, সে নায়ক নয়। নায়কের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রতিকূলতার চ্যালেঞ্জ সে গ্রহণ করে। সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ না করা তার পৌরুষের জন্য মর্মান্তিক। চতুর্থত, মোকাবিলা করবার প্রক্রিয়াটাই নায়কের জন্য লড়াই। সেই লড়াইয়ে নৈতিক জোর পাবার উৎস নায়ক পেয়ে যায়। গল্পে বা ছবির বুনিয়াদে সে জায়গাটা উন্মুক্ত ও নিশ্চিত থাকে। প্রচলিত চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে ‘দরবেশ’ থাকতে পারে, নাও পারে; তবে নায়িকা এই ভূমিকায় থাকবে তা নিশ্চিত। পঞ্চমত, প্রতিকূলতা নির্মাণের চূড়ান্ত দায়-দায়িত্ব কয়েকজন ব্যক্তির যারা নায়কের হাতে ধ্বংস হবে। নায়কের জীবনকে প্রতিকূল বানিয়ে ফেলবার দুস্কৃতকারীরা নায়কের হাতে বিনাশ হবেই।
মান্না
দুই. ধনবান খল
প্রচলিত ধারার চলচ্চিত্রে খল চরিত্রের পরিবেশন[৫] রীতি খুবই সিধে সরল। এর প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অবশ্যই নায়কের জন্য প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি করা। কিন্তু সেটা খুব সরলভাবেই বলা সম্ভব এবং কাহিনির চরিত্রগুলো যে সামাজিক সম্পর্কে স্থাপিত হয়ে থাকে তাতে খলের সামাজিক গুরুত্ব আরও ব্যাপক। সে যে কেবল নায়কের জন্য প্রতিকূলতা তৈরি করে, সাধারণত তা নয় বরং তার অনিষ্টকারী ভূমিকা গণবিরোধী হয়ে থাকে। প্রধান ধারার চলচ্চিত্রে খল অনিবার্যভাবেই নায়িকার প্রতি যৌন আক্রমণকারী, ধর্ষণকামী। সেই বৈশিষ্ট্য নায়কের সাথে নায়িকার প্রেম-ভালোবাসা ও নায়কের শৌর্য-বীর্যের সাথে কাঠামোগতভাবে বিন্যস্ত এবং এই লেখাতে, পরিষ্কার করা প্রয়োজন, সেই বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করা হচ্ছে না।
খল গণবিরোধী হয়ে ওঠে নানান ঘটনা ও ভূমিকার মধ্য দিয়ে গণবিরোধী এই ভূমিকার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক, সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সম্পদের প্রতি তার আকাঙ্খা। সে/তারা নানান রকম পদ্ধতিতে সম্পদ বানায়। নানান রকম পদ্ধতি স্পষ্টতই শ্রমিক-মজুরকে ঠকানো ইঙ্গিত করে। এভাবে ঐশ্বর্য খলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রধান ধারার বাংলা চলচ্চিত্রে বিরাট মাপের ধন-সম্পত্তি, বিত্ত ছাড়া খল চরিত্র ভাবা অসম্ভব। বিত্তহীন খল যারা থাকে তারা পরিপূরক মাত্র। কাহিনির পরিপূরক এবং প্রধান খলের অনুচর। এর মানে এই নয় যে বিত্ত থাকা খলের একমাত্র বৈশিষ্ট্য। খল নির্মম, খল লোভী; ইদানীংকালে ক্রমশই তীক্ষ্ম হয়ে দেখা দেয়া আরেকটি বৈশিষ্ট্য বোধ হয়- খল ‘দেশজ’[৬] সংস্কৃতির বিরোধী। কিন্তু এসবের মধ্যে খলের বিত্তবান হওয়া বৈশিষ্ট্যটি বিশেষ গুরুত্বের দাবীদার। এই লেখাতে খলের অপরাপর বৈশিষ্ট্যগুলি আলাদাভাবে বিবেচিত হবে না। বিত্তবান খলের গণবিরোধী ভূমিকা বুঝতে গেলে, প্রধান ধারার চলচ্চিত্রে, খোদ বিত্তকেই বুঝতে হবে। সম্পদের সাথে মানুষজনের সম্পর্ক নিয়ে একটা কিছু উপলদ্ধি এই সব চলচ্চিত্রে প্রকাশ পায়। সরলীকরণের সম্ভাবনা এড়িয়ে আরও নিশ্চিত করে বলা চলে— সম্পদের সম্পর্ক নিয়ে একটা বিশেষ পাঠ-ইঙ্গিত থাকে জনপ্রিয় চলচ্চিত্রগুলোতে।
তিন. সম্পদের সামাজিক সম্পর্ক এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা
খল বিত্তবান এবং নায়ক বিত্তহীন- দুই পুরুষসত্তার এই বিপ্রতীপতা চলচ্চিত্রে একটা পাচনসূত্র মাত্র, অনিবার্য নয়। খল যেমন বিত্তবান হবেই, নায়কের পক্ষে বিত্তহীন হতেই হবে এমন আবশ্যকতা নেই। বরং নায়ক বা নায়কপক্ষীয় কারো- নায়কের বাবা, অশ্রুসুলভ ‘নায়িকার বাবা’ যে কেউই বিশাল সম্পদবান হতে পারে। কিন্তু, সে বিত্তবান হবে ‘ভালো’। দয়ালু বলে ভালো, শ্রমিক-মজুরকে ঠকায় না বলে ভালো, দেশজ সংস্কৃতির বিপক্ষে যায় না বলে ভালো কিংবা দেশের স্বার্থ রক্ষা করে বলে ভালো। এ সবের মধ্যে ‘ন্যায়’ বা ‘জাস্টিস’ এর ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ন্যায্যতার ধারণার প্রেক্ষিতে ভালো-মন্দ, নায়ক-খল স্থাপিত।
এর মানে এই নয় যে ভালো বিত্তবানদের চতুর্পার্শ্বে দরিদ্র, গরীব মানুষ থাকবে না। দারিদ্র্য সেখানে সম্মতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা একটা সামাজিক সম্পর্ক। অন্যভাবে বলতে গেলে সম্পদের সামাজিক সম্পর্ক সেখানে সম্মতি ভিত্তিক[৭]। খলের বিত্ত এবং খলের বিত্তবান হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া সম্মতিভিত্তিক নয়, তা প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন, গণমানুষের কাছে। এই পর্যায়ে এসে দুটো বিষয় স্পষ্ট করে নেয়া প্রয়োজন:
ক) একটা কালহীন অতলান্ত বিষয় হিসেবে এই সব পর্যবেক্ষণকে সংযোজিত করতে চাইছি না আমি; বরং ঠিক উল্টোটাই। মোটাদাগে একটা সময়কালের মধ্যেই প্রধান ধারার চলচ্চিত্রের কিছু বৈশিষ্ট্যকে চেনার চেষ্টা করা হচ্ছে।
খ) সম্মতির মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সম্পদের পার্থক্য এবং সম্মতিহীনতার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সম্পদের পার্থক্যের মধ্যে কোনো গুণগত কোনো অর্থনৈতিক ভিন্নতা আছে বলে প্রমাণ করতে চাইছি না। সম্পদের পুঞ্জীভবনের নানা প্রক্রিয়া নিয়ে এই ধারার চলচ্চিত্রে বিদ্বেষ ও বিক্ষোভ না থাকলেও বিশেষভাবে (‘ঠকিয়ে’ বা ‘অবৈধ’ উপায়ে) সম্পদের দখলদারিত্বের প্রতি আক্রোশ প্রকাশ পায় যার মধ্য দিয়ে সম্পদ নিয়ে গড়পড়তা প্রতিদ্বন্দ্বিতার বোধ চেনার চেষ্টা করছি মাত্র।
একটা লম্বা সময় ধরে সম্পদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার বোধ প্রকাশ পেয়েছে নিরন্তরভাবে নায়কসমূহের আর্থিক অসচ্ছলতার মধ্য দিয়ে। এটা একটা ধরন ছিল এবং বিশেষ ধরন। টাকার কারণে বাবা-মায়ের চিকিৎসা সম্ভব হচ্ছে না কিংবা ঘর-বাড়ি সারানো হচ্ছে না কিংবা ইত্যাদি। অথবা নায়ক একটা মোটামুটি চাকরি যোগাড় করতেই নানান দিকে বেসামাল হয়ে যাচ্ছে তার জীবন। পক্ষান্তরে, নায়কের হাতে পতন হবে খলের যে অর্থ জমাচ্ছে নানান উপায়ে। গ্রামের ভূমি মালিক, কারখানার মালিক, আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী নানান পরিসরের খলের এই পরিণতি হতে পারে। সে খলনায়কের জীবন দুর্বিসহ করে দিচ্ছে, একইসাথে সে গণবিরোধী। তার সম্পদ জমানোর প্রক্রিয়া গণবিরোধী। তাকে বধ করা/দমন করায় নায়কের পক্ষে গণসম্মতি কাজ করে এসেছে, নায়কের ভূমিকা সেখানে গণস্বার্থ রক্ষার। সেটাও নায়কোচিত গুণপনা প্রকাশের একটা উপায় বটে, গ্রহণযোগ্য উপায়।
চার. উদার জাতীয়তাবাদ এবং আইনের বেড়াজাল
খুব সাম্প্রতিক সময়ে, একেবারে এই দশকেই, চারপাশে তোড়জোড় করে আইন নিয়ে একটা উদযাপন শুরু হয়ে গেছে। এটার সবচেয়ে সহজ ও স্পষ্ট প্রকাশ ঘটে সবকিছুর বেলায়ই প্রায় ‘বৈধ-অবৈধ’ ঘোষণা দেয়ার মধ্যে[৮]। এর একটা প্রভাব নায়কের চরিত্র চিত্রণে পড়বার অবস্থা তৈরি হয়েছে। শুধু যে রবিনহুডী ধরনের নায়ক ইমেজ বানাবার প্রক্রিয়াই এতে সীমিত হয়ে পড়বে তা নয়, বরং সম্পদের প্রতিদ্বন্দ্বিতাবোধের যে ভিত্তি ছিল গণসম্মতি- সেই সম্মতির ভিতই দুর্বল হয়ে গেছে আইনের এই উদযাপনে।
আইন ‘নিজ হাতে তুলে না নেয়া’র ঘোষণা বহুকাল ধরেই চলচ্চিত্রে রয়েছে। তেমনি পুলিশ চরিত্রের প্রয়োজনীয় কিছু উপস্থিতিও ছিল। যেটা ক্রমাগত বাড়ছে তা হল নায়কই খোদ পুলিশ। কিংবা জোড়া নায়কের একজন পুলিশ। নায়কের পুরুষপনা ও লড়িয়েপনার যাবতীয় বৈশিষ্ট্যের সমাহার করতে গিয়ে ক্রমাগতই পুলিশ আরও গ্রহণযোগ্য সামাজিক স্মারক হয়ে উঠছে।
এটা একটা দিক মাত্র এবং কোনোভাবেই বিযুক্ত নয়। বিযুক্ত নয় হালফিল মুম্বাই ধারা হতে কিংবা আরও স্পষ্ট করে ভাবলে, হলিউড বা আন্তর্জাতিক ছবি বাজারের পুলিশের চরিত্র মহিমায়ন হতে। আবার বিযুক্ত নয় উদরতাবাদের আইনি আনুগত্যের সামাজিক প্রক্রিয়া হতে।
আবার, নায়ক যে এখন পুলিশও- সেটাও বড় ব্যাপার নয়। নায়ক পুলিশ হোক বা নাই হোক, যে সম্পর্ক ও শর্তাবলী তাকে ঘিরে রাখছে তার খুব ভিন্নতা নেই। এই মুহূর্তের উদার জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নানানভাবে দেশের পরিচায়ক চিহ্ন আবিষ্কার করা এবং সেই চিহ্নিত পরিসরের মধ্যেই বসবাস করা। আইন সেখানে গুরুত্বপূর্ণ একটা উপাদান। আইন না মানা নায়কোচিত গুণের মধ্যে পড়ে না।
ফলে প্রায়শই নানান রকম পৌরষময় নায়কোচিত ঘটনার জন্ম দিয়েও কখনো কখনো নায়ককে দেখা যাচ্ছে শুদ্ধিকরণ হতে, একবার আইনের হাতে নিজেকে (স্বেচ্ছায়) তুলে দেবার মধ্য দিয়ে, অন্য নায়কের দৃঢ়তায় (এবং আইনের প্রতি ভক্তি) কিংবা নায়কের মা/বাবার মৃত্যুকালীন বাণীর জোরে। নায়কের এই শুদ্ধিকরণ উদারতাবাদেরই আবিষ্কার। পক্ষান্তরে, আইন মানা দেশপ্রেমের নামান্তর হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে গণমানুষের সামাজিক বস্তুগত সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা নয় দেশপ্রেমে। ফলে নায়কের শত্রু খল খুব সহজেই আইন মানে না এবং দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে কিন্তু তার বস্তুগত অর্থ কী তার স্পষ্টতা নাও থাকতে পারে। স্পষ্ট খলের আর্থিক লাভ কিন্তু তা কীভাবে গণমানুষের কাছ হতে আত্মসাৎকৃত, তা নাও স্পষ্ট হতে পারে। নায়ক নানানরকম তর্জনগর্জন করে কিন্তু গণসম্মতির জোরে খলের উৎপাটন ঘটানো সমস্যাজনক এখন। কারণ গণসম্মতিটা খলের সাথে গণমানুষের সামাজিক সম্পর্কের উদ্ঘাটনের মধ্য দিয়ে অর্জন সম্ভব। উদারতাবাদী সমাজ সেটা অনুমোদনও করে না। সুতরাং নায়কের পক্ষে জনতার শোষক, জালেম শত্রুকে পরাস্ত করা এখন কঠিন; এক নিজের মোজেজা দেখানোর সীমারেখাটুকু ছাড়া।
এটা প্রচলিত চলচ্চিত্র দেখবার একটা পাঠ ইঙ্গিত মাত্র, কোন সাধারণীকরণের প্রশ্নই ওঠে না।
তথ্যপঞ্জী
১. শ্রীমদ্ভাগবৎ গীতা
২. জনপ্রিয় বলতে সাধারণ অর্থে বোঝানো হয়ে থাকে বহু মানুষের পছন্দ হিসেবে। সে অর্থে বোঝা কোনো সমস্যা নয়। তবে গ্রামসীয় অর্থে জনপ্রিয় ধারণাটা ক্ষমতা-সম্পর্কের প্রশ্নকে নিয়ে আসে। গ্রামসীয় চিন্তায় জনপ্রিয়তা একটা বিরুদ্ধ-দাপট তৈরি করে। এই বিরুদ্ধ-দাপট, আরও নিশ্চিত করে বললে বিরুদ্ধ-হেজেমনি, প্রবল ব্যবস্থার সাথে বৈরীতা তৈরি করে। সেই প্রক্রিয়াতে জনপ্রিয়তা নিম্নবর্গীয়দের সাথে সম্পর্কিত।
আন্তোনীয় গ্রামসি, Selected Prison Notebooks, কুইন্টিন হোর ও জেফরী নওয়েল স্মিথ, নিউইয়র্ক, ১৯৭১।
৩. বিরুদ্ধ-হেজেমনির ধারণার জন্য গ্রামসি, প্রাগুক্ত। এখানে লিঙ্গীয় আধিপত্যের ক্ষেত্রে বিরুদ্ধ-হেজেমনির কথা বলা হয়েছে।
৪. গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নটি বৈধ-অবৈধ ধারণার সাথে একাকার। ‘বৈধ-অবৈধ’ এর ডাইকোটোমি নিয়ে পরে আলোচনা করছি। আবার, অস্বচ্ছল নায়কের সহজ গ্রহণযোগ্যতার মধ্য দিয়ে ‘সম্পদ’ সম্পর্কে গড়পরতা একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার বোধ পাওয়া যায়।
৫. স্টুয়ার্ট হল সম্পাদিত Representation (সেজ প্রকাশনী, লন্ডন, ১৯৯৩) বইয়ে পরিবেশন রীতি বিষয়ে আলোচনা রয়েছে।
৬. দেশজ সংস্কৃতির একটা সীমারেখা ঠাওর করা যায়, যা চিহ্নিত থাকে প্রধান ধারার চলচ্চিত্রে। সেই সীমারেখার মধ্যকার পরিসর খুবই লিঙ্গীয়। নারীর জন্য স্বামী-সন্তান কামনা, তাদের সাহচর্যে থাকা, থাকবার প্রত্যাশা করা, বিশেষভাবে স্বামীর অনুগত হওয়া ও যৌন শুচিতার ধারণা এই পরিসরের অর্থ। খলের বড়লোকীর একটা অর্থ সে ‘পাশ্চাত্যে’র জীবনধারায় অভ্যস্ত। সেই পাশ্চাত্যের অর্থবহ কিছু রূপকল্প ও প্রতিমূর্তিও (ইমেজ ও আইকন) নির্মিত হয়ে আছে। খল মদ্যপ হতে পারে, খলের আশেপাশের নারীরা যৌন-উদ্দীপক পোশাক-আশাক ও আচরণ ধারণ করতে পারে। তবে নায়ক-নায়িকার আচরণ ও পোশাক আশাক গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে কাম্য একগামী যুগল হিসেবে তাদের রূপান্তরিত হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে: যৌনশুচিতার সামাজিক ধ্যান-ধারণার সেইটেই বড় প্রমাণ।
৭. হেজেমনির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য সম্মতির মধ্য দিয়ে শাসন-সম্পর্কের ক্রিয়াশীলতা। সে ধারণারও ভিত্তিমূল পাঠ পাই গ্রামসিতে। প্রবল শ্রেণীর টিকে থাকার সেইটে একটা বড় উপায়। গ্রামসি, প্রাগুক্ত।
৮. বন্ধু সহকর্মী রেহনুমা আহমেদের সাথে এ বিষয়ে কথা হয়েছিল আমার। কয়েক বছর বাদে তিনি ’৯৬ সালে দেশে ফিরে অনেক স্পষ্টভাবে আবিষ্কার করেছেন যে সর্বত্রই বৈধতার ধারণা অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এমনকি একটা সরকারের অত্যাচারকে চিহ্নিত করবার থেকেও বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে সরকারটি ‘বৈধ’ না ‘অবৈধ’। মিডিয়াতে এই বিষয়টাকে এগিয়েও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
(প্রকাশ: সমাজ নিরীক্ষণ পত্রিকা, সংখ্যা ৭৩, সমাজ নিরীক্ষণ কেন্দ্র, ঢাকা, ১৯৯৯)