লাল মোরগের ঝুঁটি; গল্প চুরির অভিযোগ?
নুরুল আলম আতিকের অনুদানের সিনেমা ‘লাল মোরগের ঝুঁটি‘ নিয়ে গল্প চুরির অভিযোগ এনেছেন এক লেখক। এরপর জানা যায়, নামের মিল ছাড়া কাহিনির কোনো মিল নেই।
ফরিদ কবির বুধবার এক ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন, শহীদুল আলমের শিশুতোষ গল্পে নির্মিত হচ্ছে বিখাত নির্মাতার সিনেমাটি। যদিও আতিকের দাবি নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু থেকে শোনা গল্পে ছবিটি বানাচ্ছেন। এই নিয়ে ফরিদ কবিরের পোস্টে বেশ হইচই’র পর এসে ঘটনাটি পরিষ্কার করেন বাচ্চু।
ফরিদ কবির লিখেছেন –
“লাল মোরগের ঝুঁটি’ কার?
নুরুল আলম আতিকের কোনো ছবি আমি দেখিনি বললে ভুল হবে। তার ‘ডুবসাঁতার’-এর কিছু অংশ টিভিতে দেখেছিলাম। যতোটুকু দেখেছি, তাতে অবশ্য আমি খুব সন্তুষ্ট নই। হতে পারে, ‘ডুবসাঁতার’ তার গুরুত্বপূর্ণ কাজ নয়। দেশি সিনেমা বা টিভি তেমন দেখা হয় না বলে তার কাজ সম্পর্কে কোনো ধারণা আমার নেই।
শুনেছি, তিনি নতুন প্রজন্মের মেধাবী স্ক্রিপ্ট রাইটার ও পরিচালকদের একজন। মেধাবীদের প্রতি সব সময়েই আমার একটু দুর্বলতা কাজ করে।
সম্প্রতি বিডিনিউজের একটি খবর দেখে আমি সত্যিই চমকে গেছি!
তিনি ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ নামে একটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে যাচ্ছেন! সেখানে কাহিনির যেটুকু প্রকাশ পেয়েছে, তাতে আমি নিশ্চিত যে গল্পটি শহিদুল আলমের। সে কারণে খবরটি পড়তে গিয়ে আমি গল্পকার শহিদুল আলমের নামটাও খুঁজছিলাম। না পেয়ে খুবই হতাশ হয়ে আমি শহিদুল আলমের সঙ্গে আলাপ করি। তিনি জানান, বছরখানেক আগেই তিনি শুনেছেন, এ নামে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটা ছবি আতিক করতে যাচ্ছেন। তিনি নিজের উদ্যোগে তখন আতিকের সঙ্গে এ নিয়ে কথাও বলেছেন। শহিদুল আমাকে এও জানান, আতিক নাকি গল্পটি শুনেছেন খ্যাতিমান পরিচালক নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর কাছে!
শহিদুল তখন আতিককে জানিয়ে দেন, এ নামে এবং এ রকম একটি গল্প তিনি লিখেছেন ২০০৩ সালে, যেটি ২০০৬ সালে প্রকাশিত তার ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ বইটিতেও আছে। বইটি প্রকাশিত হয়েছে ‘সংবেদ’ থেকে।
আতিক সে বইটি পড়েছেন কিনা আমার জানা নেই। কিন্তু তার চলচ্চিত্রের যে সামান্য অংশ বিডিনিউজে ছাপা হয়েছে, তাতে স্পষ্ট যে গল্পটি শহিদুল আলমেরই।
তার গল্পটি মুক্তিযুদ্ধের একটি পটভূমি নিয়ে যেখানে যশোরের একটি গ্রামে পাক আর্মিদের হামলার ভয়ে সেখানকার লোকজন পালিয়ে যায়। এদেরই এক দম্পতি আব্বাস ও আমেনা। যাদের আছে বেশকিছু মোরগ ও মুরগী। যার একটির রঙ লাল। এই মোরগটি আব্বাস ও আমেনার খুবই প্রিয়। মোরগটি তাদের সন্তানদের মতোই। তারা এর নামও রেখেছে ‘লাল’! কিন্তু যুদ্ধের ভয়াবহ আক্রমণের ভয়ে তাদেরকে অন্য মুরগীগুলোর সঙ্গে লাল মোরগটিকে ফেলেই জীবন নিয়ে পালাতে হয়।
যশোর শত্রুমুক্ত হলে তারা ফিরে এসে দেখে, তাদের বাড়িঘর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে! লুট হয়ে গেছে সবকিছু। তাদের মোরগমুরগীগুলোরও কোনো চিহ্ন নেই! আব্বাস এই দৃশ্য দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়ে!
তাদের ছোট ছেলেটি ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ির আঙিনা থেকে বুলেটের খোল কুড়াতে গেলে একটা মোরগের ‘কক-কক’ আওয়াজ শুনতে পায়। এবং তাকে সে আবিষ্কার করে আঙিনার কলাফুলের সবুজ ঝাড়ে!
ছেলেটি তখন তার মাকে সেখানে নিয়ে যায়। লাল মোরগটি দেখে তারা যেন সন্তান ফিরে পাওয়ারই বিরল আনন্দ লাভ করে।
আতিকের ছবির গল্প যদি এই হয়, তাহলে তা নিশ্চিতভাবে শহিদুলেরই। আর, এই চলচ্চিত্রের কোথাও যদি শহিদুলের নাম না থাকে তবে, আতিক কিছুতেই চৌর্যবৃত্তির দায় এড়াতে পারবেন না। এ নিয়ে যে বিতর্ক উঠবে, এড়াতে পাবেন না তার দায়ও।
একজন সৃজনশীল লেখকের কোনো গল্পের সম্পূর্ণ অংশ বা গল্পে ভাব বা ছায়া আত্মসাৎ করে আতিক আর যাই হোক বড় পরিচালক বা বড় কাহিনিকার হয়ে উঠতে পারবেন কিনা সে বিষয়ে আমার সংশয় আছে।
ধরা যাক, চলচ্চিত্রের কাহিনি একেবারেই আলাদা, মিল কেবল চলচ্চিত্রের নামের ক্ষেত্রেই, তা হলেও এই নামটি তিনি কৃতজ্ঞতা স্বীকার না করে গ্রহণ করতে পারেন না। কারণ কিছু কিছু শব্দবন্ধ ব্যবহারের কারণেই তা একজন লেখকের হয়ে ওঠে। যেমন, ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনি’ কিংবা ‘পথের পাঁচালী’! এ রকম নাম আপনি চাইলেই গল্প-উপন্যাস বা চলচ্চিত্রের নাম হিশেবে ব্যবহার করতে পারেন না।
চলচ্চিত্রটির শুটিং শুরুর আগেই নুরুল আলম আতিক কথাসাহিত্যিক শহিদুল আলমের সঙ্গে বিষয়টির একটি যৌক্তিক ও সন্তোষজনক ফয়সালা করবেন, সে আশাই করতে চাই। যার যেটুকু স্বীকৃতি প্রাপ্য তাকে সেই স্বীকৃতটুকু দিতে পারার মতো মহত্ব আর নেই। সৃজনশীল মানুষ হিশেবে এটা আতিক না বুঝলে চলবে কেন?”
নির্মাতা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর মন্তব্য –
“লাল মোরগের ঝুঁটি” ছবির নামটি আতিকের দেয়া। আমার নয়।ছবির যে কাহিনী আমি আতিককে দিয়েছিলাম তার সাথে ফরিদ কবিরের পোষ্টে মুদ্রিত কাহিনীর কোন মিল নাই।
আমার কাহিনীটি এরকম “১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কতৃক অধিকৃত সৈয়দপুর বিমান বন্দরের রানওয়ে ও ভবনটি উন্নত করার লক্ষ্যে হানাদার বাহিনী চার শতাধিক বাঙালি নারী পুরুষকে গ্রেফতার করে। রানওয়ের একটি অংশে ‘concentration camp তৈরী করে তাদের রাখা হয়।বাধ্যতা মূলক শ্রম দিতে এই অসহায় বন্দীদের ব্যবহার করা হয়। হত্যা, নির্যাতন ও নারী ধর্ষন ছিলো নৈমিত্তিক ঘটনা। রানওয়ের ও ভবনের কাজ শেষে তাদের মুক্তি দেয়ার কথা বলে একটি ট্রেনে ঐ চারশত মানুষকে তোলা হয়। মুক্তির আনন্দে সবাই উৎফুল্ল।ট্রেন কিছুদূর গিয়ে থামে। সামনে ভারত সীমান্ত। সবাইকে ট্রেন থেকে নামানো হয়। এবং তারা মুক্ত, এ ঘোষণা করা হয়। মুক্তির আনন্দে সবাই যখন প্রান্তরের দিকে ধাবমান তখন গর্জে ওঠে পাকিস্তানী হানাদারদের মেশিনগান ও অন্যান্য স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মৃত্যুর কোলে লুটিয়ে পড়ে শতশত নিরপরাধ নারী পুরুষ ও শিশু।” এই হলো কাহিনী সংক্ষেপ।এবং এটি সত্যি ঘটনা আশ্রিত একটি কাহিনী। আতিক যে গল্পটির চলচ্চিত্র করছে সেটি তার নিজের বলে আমার কাছে সে দাবী করেছেএবং আমার কাহিনীর কিছু দৃশ্য স্ক্রিপ্টে যোগ করেছে। শহিদুল আলমের গল্পটি আমার পড়া ছিলো না। তাই আমি কিছু বলতে পারিনি। আশাকরি আমার অবস্থান পরিস্কার হয়েছে।
এবার অন্য প্রসঙ্গ । অনেকে আতিককে না চিনে না জেনে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন তা দু:খজনক। আতিক নতূন প্রজন্মের সবচেয়ে প্রতিভাবান চলচ্চিত্র নির্মাতা ও বোদ্ধা। তার ” চতুর্থমাত্রা” স্বল্পদৈর্ঘ চলচ্চিত্র,এদেশের চলচ্চিত্রের বাঁক বদলের প্রথম সোপান।আমি নিশ্চিত মুক্তির অপেক্ষায় তার নতূন পূর্ণদৈর্ঘ চলচ্চিত্র ” পেয়ারার সুবাস” সবাইকে চমকে দেবে। আতিকের ভুল হতে পারে। সেটার সমাধানও করা যায়। কিন্তু চৌর্যবৃত্তির যে অভিযোগ উথ্থাপিত হচ্ছে তা কোনভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়। টেলিভিশনে প্রচারিত তার একাধিক নাটক রীতিমত বিস্ময় জাগানিয়া।
তাছাড়া এদেশের লিটলম্যাগ আন্দোলনে সে সম্মুখ কাতারের তুর্কি।আতিকের চলচ্চিত্র বিষয়ক নান্দনিক ভাবনা নিয়ে আমি অতিমাত্রায় আশাবাদী।
নিশ্চয়ই আতিক অভিযোগটি অনুধাবন করে ত্রুটি সংশোধন করে নেবে।”
উল্লেখ্য, ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ নামে বিজয় আহমেদেরও একটি গল্পের বই আছে। তবে বাংলা কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক মাত্রই জানেন, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দ ভৈরবী’ নামের কবিতায় ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ শব্দটি ব্যবহার হয়েছে। বাকিরা সেখান থেকে ধার করেছেন মাত্র।
২০১৫ সালে অনুদান পায় ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’। নানা কারণে শুটিং পিছিয়ে যায়, অক্টোবরে আবারও যাচ্ছে লোকেশানে। অভিনয় করছেন জয়া আহসান, আশনা হাবিব ভাবনাসহ অনেকে।