শাকিব খানের বদলে যাওয়া
রাজকুমার; চিত্রনাট্য, সংলাপ, পরিচালনা: হিমেল আশরাফ; অভিনয়ে : শাকিব খান, কোর্টনি কফি, তারিক আনাম খান, মাহিয়া মাহি, দিলারা জামান; চিত্রগ্রহণ : শেখ রাজিবুল ইসলাম; প্রযোজনা : আরশাদ আদনান, ভার্সেটাইল মিডিয়া; মুক্তি: ১১ এপ্রিল, ২০২৪
আমাদের দেশীয় চলচ্চিত্রের রাজকুমার কে? এই প্রশ্ন করলে অবধারিতভাবেই উত্তর চলে আসবে শাকিব খান, সেটা আপনি শাকিব খানকে পছন্দ করেন বা নাই-ই করেন।
প্রায় দুই যুগ ধরে তিনি চলচ্চিত্রে আছেন, তার নামে সিনেমা চলে, তার নামেই বিশাল টেবিল কালেকশন আসে, তার ফ্যানবেইজ মানে শাকিবিয়ানরাই যথেষ্ট তাদের হিরোর যে কোনো সিনেমাকে সফলতা এনে দিতে। এসব তথ্য যেমন সত্যি, তেমনি এটাও সত্যি যে, এত বছরের ক্যারিয়ারে শাকিব খানের বলার মতো সিনেমার সংখ্যা ভীষণ কম বা নেই বললেই চলে। রিয়াজের নাম বললে মাথায় যেমন অটোমেটিক মনের মাঝে তুমি বা হৃদয়ের কথা বা হাজার বছর ধরের নাম চলে আসে, ফেরদৌসের নাম বললে যেমন হঠাৎ বৃষ্টির নাম চলে আসে, মান্নার নাম বললে যেমন আম্মাজানের নাম চলে আসে; সেই জায়গায় শাকিব খানের নাম বললে দ্রুত মাথায় এমন কোনো নাম আসে না, যা কিনা ম্যাস আর ক্লাস দুই শ্রেণিতেই তাকে পরিচিত করায়। এর দায়ভার সিনেমার সঙ্গে জড়িত সবার সঙ্গে সঙ্গে শাকিব খানেরও আছে।
শাকিব খানের দারুণ অভিনয় দক্ষতা ও বিশাল এক জনসমুদ্রকে হলে ডেকে আনার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি দীর্ঘদিন ভুল স্ক্রিপ্ট নির্বাচন করে গেছেন। সেগুলো ব্যবসাসফল হয়েছে অনেক, তবে সেখানে ঢাকা পড়ে গেছে অভিনেতা শাকিব খান। কিন্তু শাকিবের লয়্যাল ফ্যানবেইজ কখনো তাদের সুপারস্টারের হাত ছাড়েনি। তার প্রমাণ হচ্ছে গত বছর হিমেল আশরাফ পরিচালিত সিনেমা প্রিয়তমা। জাস্ট ঈদের এক মাস আগে তাড়াহুড়ায় নির্মিত সেই সিনেমা নিয়ে অভিযোগের অন্তও ছিল না দর্শকদের একটি অংশের মাঝে, তবে দিন শেষে কোনোমতে বেঁচে গেছে সিনেমার শেষের ৩০ মিনিট আর যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী সুড়ঙ্গের সঙ্গে ক্ল্যাশের কারণে। তা ছাড়া ২৪ বছরের ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো শাকিবের বৃদ্ধ লুকও একটি কারণ ছিল আলোচনার।
প্রিয়তমার পরিচালক হিমেল আশরাফের সঙ্গে এবার শাকিব খান নিয়ে আসলেন ‘রাজকুমার’। একই টিম, একই পরিচালক-প্রযোজক জুটি, টেকনিক্যাল টিম ভিন্ন, ভিন্ন এক গল্প, দেশ-বিদেশ মিলিয়ে অনেক লোকেশন, কিন্তু ‘প্রিয়তমা’কে কি ছাড়াতে পেরেছে ‘রাজকুমার’?
উত্তরে বলব, শুধু পারেনি বরং ‘রাজকুমার’ নিঃসন্দেহে শাকিবের সেরা ৩ সিনেমার একটি হওয়ার যোগ্য অন্তত অভিনয়ের দিক থেকে।
শামসুল হক ওরফে স্যামের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে আমেরিকা যাওয়া। এ জন্যই ছলচাতুরীর মাধ্যমে নিজের বাবার কাছ থেকে ওয়াদা নিয়ে সে আমেরিকা যাওয়ার অনুমতি আদায় করে। পিতার কাছ থেকে ত্যাজ্য হয়েও আমেরিকা যাওয়ার বাসনা সে ত্যাগ করে না। ঠিকঠাক ইংরেজি না জানার কারণে এর আগে অনেকবার ভিসা সেন্টার থেকে বাতিল হওয়া কারণে এবার টাকা জোগাড় করে আমেরিকা যাওয়ার জন্য সে কন্ট্রাক্ট ম্যারেজের দ্বারস্থ হয়। স্যামের আমেরিকা যাওয়ার কারণ কিন্তু নিজের ভাগ্য পরিবর্তন নয়, বরং আমেরিকায় নিজের মাকে খুঁজে বের করা, যিনি কিনা ছোটবেলায় সংসার ত্যাগ করে বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলেন।
রাজকুমার সিনেমার গল্পটা চমৎকার। গল্পের স্ট্রাকচার ভীষণ চেনা আর কমন একজন সাধারণ মানুষের জার্নি বা যে কোনো কিছুর খোঁজ।
আর সেই জার্নি যদি হয় নিজের মায়ের জন্য, তাহলে উপমহাদেশের বেশিরভাগ দর্শক সেই জার্নির সঙ্গে কানেকটেড হন খুব সহজেই। সম্ভবত জীবনে প্রথমবার শাকিব খান পাবনার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললেন আর চমৎকারভাবেই আয়ত্ত করেছেন তিনি এই ডায়ালেকট। কমিক টাইমিং, ছোট্ট পজ নেওয়া, ইমোশনাল সিনে দারুণ কন্ট্রোলড পারফরম্যান্স সব মিলিয়ে শাকিব খান এখানে শাকিব খান ছিলেন না, প্রকৃতপক্ষেই স্যাম হয়ে উঠেছিলেন। ডুবের পর শেখ রাজিবুল ইসলাম আবারও নিজের চমৎকার ক্যামেরার কাজ দেখালেন রাজকুমারে। অনেক দিন পর কোনো মেইনস্ট্রিম বাংলা সিনেমায় গ্রামের পরিবেশকে এত সুন্দর করে দেখলাম যেন। খেজুরের গাছ, গরুর গাড়ি, মহিষের গাড়ি, পাবনার পাকশী ব্রিজ সবকিছুই ক্যাপচার করা হয়েছে শেখ রাজিবুল ইসলামের দারুণ সিনেম্যাটোগ্রাফির কল্যাণে।
রাজকুমারের যে ব্যাপারটা নিয়ে না বললেই নয়, এই সিনেমার গল্পে এমন একটা ইস্যু ডিল করা হয়েছে, যা কিনা ভীষণ স্পর্শকাতর। গ্রামাঞ্চলের তালাক প্রথা নিয়ে যে ধর্মান্ধতা আজও প্রচলিত আছে, সেটাকে পরিচালক ভীষণ ম্যাচিউডলি ডিল করেছেন। একটু এদিক-ওদিক হলেই হয়তো অনেকের অনুভূতিতে আঘাত লেগে যেত! মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছোট্ট একটা সাবপ্লটে আহমেদ শরীফ সম্ভবত জীবনের সেরা অভিনয়টা করেছেন। সিনেমার বেশ কিছু সংলাপ ভীষণ সুন্দর। একটির উদাহরণ না দিয়ে পারছি না একজন নির্দোষ মানুষ যখন জিজ্ঞাসা করে, আমার দোষ কী? তখন তার চেয়ে ভারী কোনো জিনিস এই দুনিয়ায় নেই। আর সেই ভার আমি বহন করছি গত ৩২ বছর ধরে।
সমালোচনার দিকও কম নেই রাজকুমারে। সমালোচনা সিনেমা মুক্তির আগ থেকেই শুরু হয়েছে। সিনেমা মুক্তির আগেই বিভিন্ন ইন্টারভিউতে পরিচালকের অতি আত্মবিশ্বাসী আলাপ, বুর্জ আল খলিফায় ট্রেলার রিলিজ নিয়ে বিশাল এক আলোচনা আর শেষ পর্যন্ত সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হওয়া, টিজার ট্রেলার কিছুই রিলিজ না হওয়া, সিনেমার গানগুলো প্রিয়তমা লেভেলে না যাওয়া, আমি একাই রাজকুমার নিউট্রাল অডিয়েন্স থেকে শুরু করে শাকিবিয়ানদেরও পছন্দ না হওয়া অভিযোগের কমতি নেই।
এবার সিনেমার সমালোচনায় প্রবেশ করি। শাকিব খানের এন্ট্রিসিন আরও ইউনিক, আরও চমৎকার হতে পারত। সবসময়ই ঘাড় বাঁকা করে স্ক্রিনে প্রবেশ করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। অ্যাকশন কোরিওগ্রাফি একদমই জমেনি সিনেমার, যদিও সিনেমা রিলিজের আগে সিনেমার অ্যাকশন সম্পর্কে অনেক বড় বড় কথা শুনেছিলাম। কোর্টনি কফিকে শুরুর দিকে ভালো লাগলেও পরের দিকে ক্যামেরার সামনে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্য লাগেনি। আরশ খানের দাড়ির মেকআপ ভীষণ দৃষ্টিকটু লেগেছে। সিনেমার সেকেন্ড হাফে কিছু দৃশ্য চাইলেই বাদ দেওয়া যেত।
‘মা’ ও ‘বরবাদ’ গান দুটোই ভালো লেগেছে শুনতে, তবে মা গানটি আগে মুক্তি পায়নি (পেলে স্পয়লার হতো, তবে লিরিকাল সং হিসেবে রিলিজ দেওয়া যেত) আর বরবাদের মূল সমস্যাটা হয়েছে গায়কীতে। তবে সবচেয়ে বিরক্ত লেগেছে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের অতিব্যবহার। প্রতিটি সিনেই কেন বিজিএম লাগাতে হবে? অনেক ডায়লগ পর্যন্ত শোনা যায়নি লাউড বিজিএমের জন্য। নীরবতা যে একটা সিনেমার ভাষা হতে পারে, সেটা আমাদের ডিরেক্টর আর দর্শকরা কবে বুঝবেন আমার জানা নেই।
সিনেমা হিসেবে চাইলে ‘রাজকুমার’-এর আরও অনেক সীমাবদ্ধতা খুঁজে বের করা যাবে। যেমন শাকিবের ভিসা সেন্টার থেকে এতবার রিজেক্ট হওয়ার কিছু সিন যদি দেখানো যেত, সে ক্ষেত্রে তার আমেরিকা যাওয়ার অতি আগ্রহ আরও প্রকাশ পেত। কিংবা প্রথমবার আমেরিকা যাওয়ার সময় প্লেনে চড়ার বা আমেরিকায় নামার পর শাকিবের কোনো রিঅ্যাকশন থাকা দরকার ছিল। দিলারা জামানের সঙ্গে শাকিবের আরও কিছু দৃশ্য থাকলে দাদি-নাতির সম্পর্কের বন্ধন আরও দারুণভাবে আবিষ্কার করা যেত। তবে ‘প্রিয়তমা’র সঙ্গে তুলনা করলে শাকিব খান ও হিমেল আশরাফ তাদের ক্যারিয়ারের অন্যতম দারুণ সিনেমা উপহার দিয়েছেন দর্শকদের। ‘প্রিয়তমা’র চেয়ে কমার্শিয়াল উপাদান কম, ধুমধাড়াক্কা মারামারি নেই শাকিবের অন্য সিনেমার মতো, ভিলেনের সঙ্গে ডায়লগবাজি নেই শাকিবের (যদিও ভিলেন চরিত্রে ডিজে সোহেল স্বল্প সময়েই দারুণ করেছেন), গল্পের খাতিরে নায়িকা বিদেশি দেখে আর তার বেশিরভাগ ডায়লগ ইংরেজিতে দেখে হয়তো শাকিবের অনেক দর্শক কানেক্টেড ফিল করেননি, সিনেমার উপসংহার ‘অতঃপর তারা সুখে-শান্তিতে বাস করিতে লাগিলো’ টাইপ হয়নি দেখে শাকিবের ফ্যানেরা আর নিয়মিত কমার্শিয়াল বাংলা সিনেমা দেখা দর্শকরা কীভাবে রাজকুমারকে গ্রহণ করবে, সেটা গবেষণার বিষয়।
সিনেমা যে খারাপ চলছে সেটা না, তবে প্রিয়তমার মতো হাইপে নেই। সব সিনেমাই যে প্রিয়তমার মতো ব্যবসা করবে, এমন কোনো কথা নেই। আবার ব্যবসা করা মানেই কোনো সিনেমা ‘ভালো’ এমন শিশুতোষ ভাবনা রাখাও উচিত নয় ২০২৪-এ এসে। দীপু নাম্বার টু কত ব্যবসা করেছিল কারও মনে নেই, তবে সিনেমাটা সবার মনে আছে।
দর্শকের রুচি যা চাইবে তাই হবে, এর জায়গায় রুচি বদলানোর দায়িত্বও নিতে হবে পরিচালক আর সুপারস্টারের। সেই জায়গায় রাজকুমারের মতো ভালো একটা প্রচেষ্টা বাংলা চলচ্চিত্রে নিঃসন্দেহে প্রয়োজন ছিল।
/লেখাটি দৈনিক দেশ রূপান্তরের সাপ্তাহিক আলোজন ধ্রুপদিতে পূর্বপ্রকাশিত