শাবানার প্রযোজক হবার গল্প
অনেকদিন পর একটি সিনেমার পোস্টার দেখে সত্যি সত্যি কেঁদে ফেললাম ঠিক যেমনটি কেঁদেছিলাম ছবিটি প্রথম যেদিন দেখি সেদিন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির সর্বকালের সেরাদের অন্যতম একজন অভিনেত্রী শাবানা। শাবানা ঠিক কতগুলো চলচ্চিত্রে দর্শকদের কাঁদিয়েছেন কিংবা হাসিয়েছেন তার সঠিক কোন হিসাব কারো জানা নেই। শাবানা শুধু একজন জননন্দিত তারকা অভিনেত্রী ছিলেন না, ছিলেন একজন সফল প্রযোজকও। কিন্তু এই শাবানার প্রযোজক হওয়ার গল্পটা মোটেও সুখের ছিল না যার গল্পটা সংক্ষেপে একটু বলছি।
তরুণী শাবানা যখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ঠিক তখনই সিদ্ধান্ত নিলেন যে ব্যবসায়ী স্বামী ওয়াহিদ সাদিককে নিয়ে চলচ্চিত্র প্রযোজনা করবেন। ছবির পরিচালক ঠিক করলেন বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা পরিচালক আজিজুর রহমানকে এবং নায়ক হিসেবে বেছে নিলেন নায়করাজ রাজ্জাককে যিনি শাবানার বিপরীতে অভিনয় করবেন। ছবির মহরতও করলেন, শুটিংও শুরু হলো। কিন্তু মাঝপথে টাকার জন্য ছবির কাজ বন্ধ হয়ে গেলো। নিজের সঞ্চিত টাকা ও পরিচিতজনদের কাছ থেকে ধার করে যতটুকু সম্ভব কাজ চালিয়ে গেলেন কিন্তু তবুও থেমে যেতে হলো। ছবি মুক্তি নিয়ে সংশয় পড়ে গেলো। অবশেষে এগিয়ে এলেন হানিফ পরিবহনের কর্ণধার যিনি শাবানার প্রযোজিত প্রথম ছবিটিতে লগ্নি করলেন বা শাবানাকে টাকা ধার দিলেন।
এভাবেই সেদিন আজিজুর রহমানকে দিয়ে শাবানা ও তাঁর স্বামীর প্রযোজিত যে ছবিটি নির্মাণ করলেন তার নাম ‘মাটির ঘর’ যা মুক্তি পাওয়ার পর দর্শকরা হলে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। ‘মাটির ঘর’ হয়ে গেলো সুপারহিট আর বাংলা চলচ্চিত্র শাবানার হাত ধরে পেলো ‘এস এস প্রোডাকশনস’ এর মতো একটি সফল প্রযোজনা সংস্থা যে সংস্থাটি আমাদের উপহার দিয়েছিল ‘নাজমা’, ‘লাল কাজল’, ‘অশান্তি’, ‘বিশ্বাসঘাতক’, ‘স্বামী স্ত্রী’, ‘রাঙাভাবী’, ‘গরীবের বউ’, ‘অন্ধ বিশ্বাস’, ‘ঘাত প্রতিঘাত’, ‘স্বামী কেন আসামী’, ‘মেয়েরাও মানুষ’, ‘অগ্নিসাক্ষর’-এর মতো আরও অসংখ্য দর্শকপ্রিয় ও ব্যবসা সফল চলচ্চিত্রগুলো।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সোনালি যুগের কত শত চলচ্চিত্র সিনেমা হলে দেখেছি তার হিসাব আমার জানা নেই। তবুও কিছু চলচ্চিত্র সিনেমা হলে না দেখতে পারার দুঃখ আমাকে তাড়িয়ে যার একটি হলো ‘মাটির ঘর’। এই চলচ্চিত্রটি আমি ছোট বেলায় টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছিলাম। এসএস প্রোডাকশনসের প্রথম প্রযোজিত ‘মাটির ঘর’ চলচ্চিত্রটি ছিল তৎকালীন গ্রামীণ পটভূমির উপর নির্মিত দুই তরুন তরুণীর একটি হৃদয়বিদারক প্রেম কাহিনী। ছবির শেষে গিয়ে দর্শকরা নামের সার্থক মর্মার্থ খুঁজে পেয়েছিল। সেদিনের দর্শকদের কাছে আজো ‘মাটির ঘর’ চলচ্চিত্রটি স্মরণীয় হয়ে আছে। দর্শকদের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লিখা ও সত্য সাহার সুরের ‘আমার নায়ে পার হইতে লাগে ১৬ আনা’ গানটিও।
‘মাটির ঘর’ চলচ্চিত্রটি দেখে কাঁদে নাই এমন কোন দর্শক সেদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি। যারা হলে দেখেছিলেন তারা যেমন সিনেমা হল থেকে চোখ মুছতে মুছতে বের হয়েছিলেন ঠিক তেমনি যারা আমার মতো টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছিলেন তারাও কেঁদেছিল। এই ছবিটা প্রথম যেদিন দেখি সেদিন শুধু কাঁদিনি সারারাত ঘুমাতেও পারিনি! কারন ছবির শেষ দৃশ্যটি আমার বালক মনটাকে এমন ভাবে নাড়া দিয়েছিল যে আমি ভেবেছিলাম সিনেমার পরিণতিটি বোধহয় সত্যি!
রাজ্জাক, শাবানা ও পরিচালক আজিজুর রহমান ত্রয়ীর ‘মাটির ঘর’ চলচ্চিত্রটি আজও বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা ক্লাসিক রোমান্টিক ছবি হয়ে আছে। আজো বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা পরিচালক আজিজুর রহমান জীবিত আছেন, জীবিত আছেন কোটি কোটি দর্শকদের প্রিয় অভিনেতা ও অভিনেত্রী রাজ্জাক ও শাবানা যারা জীবিতবস্থায় দেখে গেলেন তাদের মেধা ও পরিশ্রমে তিল তিল করে গড়া উঠা বাংলা চলচ্চিত্র আজ ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে, যেখানে আজ শুধু মেধাহীন ও আলু পটল ব্যবসায়ীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
পোস্টার সহযোগিতায় ও অনেক অনেক কৃতজ্ঞতায়ঃ শানু ভাই (Sanwar Hossain ]