Select Page

শুনতে কি পাও জীবনের জয়ধ্বনি!

শুনতে কি পাও জীবনের জয়ধ্বনি!

‘ভদ্রা নদীর পারে সুতারখালি গ্রাম। সেখানে প্রায় ১০০ পরিবার সংগ্রাম করে বেঁচে আছে। রাখী ও সৌমেন ঘর বাঁধে এ গ্রামে। তাদের সংসারে আসে রাহুল। ২০০৯ সালের ২৫ মে হঠাৎ প্রলয়ঙ্করী ‘আইলা’ জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় গ্রামের অনেককিছু। সম্পদের ক্ষতি হয়। বসতভিটা নোনাজলে ডুবে যায়। উপকূলবর্তী লাখো মানুষের মতো সুতারখালি গ্রামের মানুষও নামে রাস্তায়, আশ্রয় নেয় ভেড়িবাঁধে। সেখান থেকে রাখী, সৌমেন ও রাহুলের নতুন জীবন শুরু হয়।’

‘শুনতে কি পাও?’ চলচ্চিত্রের শুরুতে এভাবেই বলা হয় সিনপসিস। পরিচালক কামার আহমাদ সাইমন নির্মিত এ চলচ্চিত্রকে সমালোচকরা ‘প্রামাণ্য চিত্র’ বলেছেন কেউ কেউ ‘কাহিনীচিত্র’-ও বলেছেন কিন্তু তিনি এটিকে শুধুই ‘চলচ্চিত্র’ বলে পরিচিতি দেন। আইলা দুর্গত মানুষের বাস্তব জীবন সংগ্রামের একটি চলমান ডকুমেন্টেশন এ চলচ্চিত্রটি। খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার সুতারখালি গ্রাম এ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছেছে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ অনেক কঠিন। দুর্যোগ তো আর মানুষের ইচ্ছামতো হবে না। দুর্যোগের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার জন্য প্রকৃতির উপরই নির্ভর হতে হয়। মোরশেদুল ইসলামের ‘দুখাই’ ছবির কথা যদি বলা হয় তবে এ ছবিতে ঘূর্ণিঝড়ের বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে যা ভয়াবহতাকে তুলে ধরে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার যে তিনটি স্বীকৃত ধাপ আছে ‘দুর্যোগ পূর্ববর্তী ব্যবস্থা, দূর্যোগকালীন ব্যবস্থা, দুর্যোগ পরবর্তী ব্যবস্থা’ এর মধ্যে ‘শুনতে কি পাও? শেষেরটিতে নির্মিত হয়েছে। আইলা দুর্গত মানুষের নতুন করে বাঁচার সংগ্রাম দেখানো হয়েছে। এর জন্য পরিচালক কামার আহমাদ সাইমন আইলা দুর্গত বাস্তব লোকেশন বেছে নিয়েছেন কোনো রকম বানানো সেট এখানে ব্যবহৃত হয়নি। অন দ্য স্পটে ক্যাজুয়্যাল শ্যুটিং হয়েছে। দর্শককে চলচ্চিত্রটি দেখার সময় খেয়াল রাখতে হবে দৃশ্যের পর দৃশ্য একটার পর একটা আসছে। দৃশ্যের ধারাবাহিক সংযোজন করে পরিচালক রিয়েল লাইফকেই তুলে ধরেছেন। সরেজমিনে দেখা বলতে যা বোঝায় সেটাই চলচ্চিত্রে গুরুত্ব পেয়েছে।

পরিচালক কামার আহমাদ সাইমন

দৃশ্যের পর দৃশ্যে কি কি এসেছে বলা যাক :

– রাখী, সৌমেন সাংসারিক কথা বলছে কীভাবে কি করা যায় ঘুরে দাঁড়াতে।

– রাখী, সৌমেনের ছেলে রাহুল তার ছোট বন্ধুদের সাথে খেলছে। তাদের আধো আধো ভাষা শুনতে ভালো লাগে।

– মাটির বানানো চাকায় বাচ্চাদের খেলার আনন্দ।

– সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে গেছে মহিলারা। পানি না পেলে একজন বলে-’পানি না দিলে বিষ দেও।’

– ছেলেমেয়েদের এক জায়গায় পড়ানো হচ্ছে চক, স্লেটের মাধ্যমে।

– মহিলারা নিজেদের মতো গল্প করছে, হাসতে হাসতে নিজেদের ফেলে আসা রঙিন সময়ের স্মৃতিচারণ করছে।

– ত্রাণ বিতরণ দেখানো হচ্ছে

– চায়ের দোকানে বিতর্ক হচ্ছে ত্রাণ বিতরণ, বাঁধ নির্মাণে দেরি হওয়াতে। মেম্বারের সাথে তর্কে বেঁধেছে লোকজন। স্থানীয় প্রশাসনের রাজনীতি।

– লোকাল বাজারে মোবাইল, চুঁড়ি, দুল, লেস-ফিতা কেনাকাটা চলছে। ফুটবল ম্যাচ চলছে।

– বাঁধ নির্মাণে নারী-পুরুষ একসাথে কাজ করছে। সবার লক্ষ্য এক।

এসব দৃশ্য একের পর এক আছে চলচ্চিত্রে কালারফুল ডেসক্রিপশনের মতো। সবগুলো দৃশ্য মিলিয়েই একটা পূর্ণাঙ্গ বাস্তব জীবনের চিত্র এঁকেছেন পরিচালক। জীবনের জয়ধ্বনি দেখিয়েছেন। যতই দুর্যোগ আসুক না কেন মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম কখনো শেষ হয় না। এই চলমান সংগ্রামের সমষ্টিই ‘শুনতে কি পাও’ চলচ্চিত্র।

চলচ্চিত্রের সিনেমাটোগ্রাফি অদ্ভুত রকমের সুন্দর। ঢেউ যেন কথা বলে। ঢেউয়ের কলকল শব্দে সঙ্গীতের মূর্ছনা কানে বাজে। গান না থাকলেও যে গানের অনুভূতি দেয়া যায় ঢেউকে দিয়ে পরিচালক সেই কাজটি করেছেন। কোনো তারকা নেই ছবিতে কিন্তু যারা অভিনয় করেছে তাদের প্রত্যেকেই বাস্তব জীবনকে সহজ ভঙ্গিতে সাবলীলভাবে তুলে ধরেছে। সবার কথা, জীবনযাপন খুব কাছ থেকে ক্লোজ শটে দেখানো হয়েছে যাতে রিয়েল জিনিসটা ফুটে ওঠে। আর খুব গভীরভাবে পরিচালক রাষ্ট্রচিন্তাকে দেখিয়েছেন। একটি রাষ্ট্রে জনগণ যেমন শত প্রতিকূলতার মাঝেও ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম করে এবং রাজনৈতিক সমস্যায় পড়ে সেগুলো খুব সূক্ষ্মভাবে উঠে এসেছে। নৃতাত্ত্বিক দিক থেকেও নির্মাতা ফ্রি ইন্টারপ্রিটেশনের সুযোগ রেখেছেন চলচ্চিত্রটিতে।

‘শুনতে কি পাও?’ চলচ্চিত্রের ট্যাগলাইন ‘are you listening?’ দর্শক হিসেবে আপনাকে চলচ্চিত্রটি দেখার আগে মানসিকভাবে প্রস্তুত করবে আপনি দেখার জন্যই দেখবেন নাকি দেখার সাথে সাথে ভাববেন বাস্তবতা নিয়ে। ২০১৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছবিটি মুক্তি পায়। বাণিজ্যিক ছবির সাথে এ চলচ্চিত্রটি এক সপ্তাহের জন্য মুক্তি পেয়ে ভালো সাড়া ফেলে নতুন একটি উদাহরণও তৈরি করে। এর আগে ২৫টি আন্তর্জাতিক উৎসবে আমন্ত্রিত হয়। যার মধ্যে ২০১৩ সালে ইউরোপের অন্যতম চলচ্চিত্র উৎসব ‘দ্যু রিলে’-র ৩৫ তম আসরে সর্বোচ্চ গ্রাঁপ্রি পুরস্কার অর্জন করে এবং ২০১৪ সালে মুম্বাই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘স্বর্ণশঙ্খ’ জিতে নেয়। এভাবে ৯টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতে নেয় চলচ্চিত্রটি।

মানিকগঞ্জে “কাগজের ফুলের” লোকেশনের খোঁজে তারেক মাসুদ ও কামার আহমাদ সাইমন

পরিচালক কামার আহমাদ সাইমন দীর্ঘদিন কাজ করেছেন কিংবদন্তি নির্মাতা তারেক মাসুদের সাথে। তাঁকে তিনি দেখাতে পারেননি চলচ্চিত্রটি এটা তাঁর আক্ষেপ। ‘শুনতে কি পাও?’ তারেক মাসুদকে উৎসর্গ করেছেন তিনি।

শেষ কথায় বললে বলতে হয় ‘শুনতে কি পাও?’ শুধুই একটি চলচ্চিত্র নয় বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বাস্তবতা সম্পর্কে জানতে এটি প্রতিদিনের পাঠ।


মন্তব্য করুন