সত্যজিৎ চেয়েছিলেন হাঙর নদী গ্রেনেড নির্মান করতে
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ পড়ে ব্যাপকভাবে মুগ্ধ হয়েছিলেন ভারতীয় বাংলা ভাষার চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। ইংরেজি অনুবাদে খুব শীঘ্রই উপন্যাসটি ভারত থেকে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। ভারতের প্রথম সারির প্রকাশনা সংস্থা ‘রূপা’ প্রথমবারের মত ইংরেজি অনুবাদে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এ উপন্যাসটি প্রকাশ করতে যাচ্ছে। খবর ডিএনএইনডিয়া’র।
মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছর পর ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি ম্যাগাজিনে প্রথমবারের মত উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। পরে বই আকারেও বের হয় হাঙর নদী গ্রেনেড। সে সময় ম্যাগাজিনে প্রকাশিত উপন্যাসটি পড়ে অনুপ্রাণিত হন আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। ভিন্ন তিনটি চিঠিতে সেলিনা হোসেনকে নিজের মুগ্ধতার কথাও জানান তিনি। আর, উপন্যাসটি নিয়ে একটি ইংরেজি চলচ্চিত্র নির্মাণের আগ্রহ প্রকাশ করেন।
ভারতের সরকারি বার্তা সংস্থা পিটিআইকে (প্রেস ট্রাস্ট অব ইনডিয়া) দেওয়া বক্তব্যে রূপা প্রকাশনী থেকে ইংরেজি অনুবাদে বইটি প্রকাশিত হবার খবর নিশ্চিত করেছেন সেলিনা হোসেন। তিনি জানান, ফরাসি লেখক প্যাসকেল জিংক উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ করছেন।
১৯৭৫ সালের ১৩ আগস্ট সেলিনা হোসেনকে লেখা এক চিঠিতে সত্যজিৎ রায় গল্পটি পড়ে তাঁর ভালো লেগেছে বলে এবং গল্পটিকে একটি ভালো চলচ্চিত্রে রূপ দেয়া যাবে বলে প্রশংসা করেন।
সত্যজিৎ রায় লেখেন, ‘আপনার গল্প আমার ভালো লেগেছে। এবং অনেককে গল্পটি পড়তেও দিয়েছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই গল্প দিয়ে একটি ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যাবে।’ তবে ওই সময় অন্য একটি প্রকল্পে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় হাঙর নদী গ্রেনেড নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে।
জানা গেছে, উপন্যাসটি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যাপারে সেলিনা হোসেনের সঙ্গে দেখা করতে বাংলাদেশেও আসতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ। কিন্তু বাংলাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে সেটিও আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। অনেক পরে এ প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, ‘আমি শুনেছি, ওদিকের পরিস্থিতি ভালো না। তাই পরিকল্পনাটি পাল্টাতে হয়েছিল।’ তবে, শুধুমাত্র বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণেই সত্যজিৎ হাঙর নদী গ্রেনেড বানানোর ভাবনা বাদ দিয়েছিলেন—এমন নয়। জানা যায়, সেলিনা হোসেনের গল্প নিয়ে ছবি বানানোর বিষয়ে কলকাতায় নানামুখী বাধার মুখে পড়েন সত্যজিৎ। বস্তুত, বাংলাদেশের কারও লেখা গল্প নিয়ে সত্যজিতের চলচ্চিত্র নির্মাণের আগ্রহকে ভালো চোখে দেখেননি তাঁর সমসাময়িক অন্যরা। ১৯৭৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি—এ প্রসঙ্গে সেলিনা হোসেনকে লেখা আরেকটি চিঠিতে নিজের হতাশার কথা জানান সত্যজিৎ, ‘এমন পরিস্থিতিতে আমি বুঝতেছি না, কিভাবে আপনাকে গল্পটি নিয়ে কাজ করার ব্যাপারটি স্থগিত রাখতে বলি।’ সত্যজিৎ লেখেন, ‘গল্পটি কারও হাতে চলে গেলে এত সুন্দর একটি গল্প যথাযথভাবে চলচ্চিত্রায়িত করার বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে।’
চিঠিতে তিনি ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’-এর বইয়ের কপি পেয়ে সেলিনা হোসেনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। অবশ্য এ চিঠিতেও তিনি উপন্যাসটির গল্প নিয়ে সিনেমা বানানোর ইচ্ছা অব্যাহত আছে বলে জানান।
সর্বশেষ ১৯৭৮ সালের ১ মার্চ সেলিনা হোসেনকে চিঠি লিখেন সত্যজিৎ। যথারীতি এ চিঠিতেও তিনি গল্পটি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা পুনর্ব্যক্ত করেন। তবে, একইসঙ্গে তিনি কিছুটা উদ্বেগও প্রকাশ করেছিলেন। সত্যজিৎ লেখেন, ‘আমি জানি না, ঠিক কখন এই কাজটি সম্পন্ন করা যাবে।’ এরপর, হাঙর নদী গ্রেনেড নির্মাণের আশা অপূর্ণ রেখেই ১৯৯২ সালে পরলোক গমন করেন সত্যজিৎ রায়। ৫ বছর পর ১৯৯৭ সালে সত্যজিতের সেই আকাঙ্ক্ষাকেই বাস্তবায়ন করেন সদ্য প্রয়াত বাংলাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম। নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র হাঙর নদী গ্রেনেড।