সত্যিকারের বাংলাদেশের ছবি
‘মেড ইন বাংলাদেশ’ একটি সত্যিকারের বাংলাদেশের ছবি।
আমরা শহরের অলি গলিতে তাদের দেখি। হনহন করে হেঁটে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে হাসছে। তবে তাদের চলা-ফেরায়, অভিব্যক্তিতে ব্যস্ততায়ই ফুঁটে উঠে বেশি। সময়মতো কাজে যাওয়ার ব্যস্ততা কিংবা কাজ শেষে বাড়ি ফেরার তাড়া তাদের শীর্ণ শরীরে স্পস্ট দেখা যায়। তারা আমাদের গার্মেন্টস্ শ্রমিক। যাদের বেশীর ভাগই অল্প বয়সী তরুণী।
এই হনহন করে কাজে যাওয়া আর কাজ থেকে ফেরার মাঝে তাদের যে জীবনসংগ্রাম সেটা আমরা সাহিত্যে, সিনেমায় খুব একটা দেখি না। ইনফ্যাক্ট, তাদের জীবনসংগ্রাম ঘাটাঘাটি না করলেই বরং অর্থনৈতিকভাবে আমাদের লাভ। তাদের স্বল্পমূল্যের শ্রমেই তো চলে আমাদের অর্থনীতির চাকা।
রুবাইয়াত তার নতুন ছবি ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’-এ সে সব নারী শ্রমিকদের সংগ্রামই দেখিয়েছেন, তবে একটু ভিন্নভাবে। নারী শ্রমিকের অসহায়ত্বকেই কেবল পর্দায় তুলে না ধরে বরং নারীর ক্ষমতায়নই যে সমস্যার সমাধান এ বিষয়েই সাজিয়েছেন তার চিত্রনাট্য।
ছবির প্রধান চরিত্র শিমু একজন গার্মেন্টস্ শ্রমিক। প্রতিদিনকার মতো একদিন কাজ করতে ছিল শিমু এবং তার সহকর্মীরা। হঠাৎ তাদের কারখানায় কোন কিছুর বিস্ফোরণ হয় এবং আগুন লাগে। শিমু এবং তার সহকর্মীরা ছোটাছুটি করে বেড়িয়ে আসে। যদিও শিমুর এক সহকর্মী বান্ধবী এই দুর্ঘটনায় মারা যায়। দুর্ঘটনার কারণে তাদের গার্মেটস্ কিছুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বেতনেরও পুরো টাকা পায় না তারা। এছাড়া আরো নানা বৈষম্য তো আছেই।
এরই মধ্যে শিমুর পরিচয় হয় নাসিমা আপার সাথে যিনি নারী শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন।
নাসিমা আপার কাছ থেকে শিমু জানতে পারে শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কিত আইন সম্পর্কে। কিছু টাকার বিনিময়ে শিমু নাসিমা আপার কাজে সাহায্য করতে থাকে। ধীরে ধীরে সে হয়ে ওঠে তার কর্মস্থলের শ্রমিক ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট।
শিমুর বা শিমুর মত নারীদের ক্ষমতায়নের এই প্রক্রিয়া বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুব বেশি সহজ না। বিশেষ করে, যদিওবা সব বাঁধা অতিক্রম করা সম্ভব হয়; সরকারি দপ্তরের ফাইলে আটকে থাকার বাঁধা অতিক্রম করা হয়ে ওঠে শিমুদের মত সাধারণ মেয়েদের সাধ্যের বাইরে। কিন্তু রুবাইয়াত এক্ষেত্রে খুব বেশী জটিলতায় না গিয়ে সহজ উপসংহার দিয়েছেন। নারীর ক্ষমতায়ন যে, যে কোন বাঁধা দূর করতে সক্ষম সেটাই তিনি দেখিয়েছেন ছবির সমাপ্তিতে। ছবির শেষে আমরা দেখি,
মানবাধিকার সম্পর্কে কিছু জ্ঞান আর একটা মোবাইল ফোন শিমুকে তার অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বিজয়ী হতে সাহায্য করেছে।
তবে এদেশে নারী শ্রমিকদের সংগ্রাম আদৌ এতো সহজে শেষ হয় কি?
তাই ‘মেড ইন বাংলাদেশ’কে নারীর ক্ষমতায়নের ছবি হিসেবে দেখলে যতটা ভাল লাগে নারী শ্রমিকদের সংগ্রামের গল্প হিসেবে দেখলে ততটা সম্পূর্ণ মনে হয় না। ‘মেড ইন বাংলাদেশ’-এর দুর্বলতা এইটুকুই।
কিন্তু রুবাইয়াতের নির্মান বেশ বাস্তবসম্মত। গার্মেন্টসের নারীদের দৈনন্দিন জীবনের টুকিটাকি খুব সুন্দরভাবে তুলেছেন তিনি। তাদের চলা-ফেরা, সাজ-পোশাক, কথা বলার ধরণ দারুন বাস্তবসম্মত। একইসঙ্গে তাদের বাসস্থান, ঢাকার গিঞ্জি রাস্তা, আবর্জনা, মানুষের কোলাহল, বাস, ট্রেনের শব্দ, কিংবা সেলাই মেশিনের শব্দ সবকিছু বেশ বাস্তবসম্মত।
গার্মেন্টসকর্মী চরিত্রে রিকিতা নন্দিনী শিমু দারুণ ন্যাচারাল অভিনয় করেছেন। তাকে এর আগে গৃহকর্মীর চরিত্রে ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’-এ দেখেছিলাম কিন্তু এ ছবিতে সে আরো অনেক বেশি ন্যাচারাল। পুরো ছবি তাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এবং প্রধান চরিত্রে এতো ভালো অভিনয় শেষ কবে দেখেছি মনে করতে পারছিনা। অমিতাভ রেজার ‘রিকশা গার্ল’ ছবির নায়িকা নভেরা রহমান করেছেন ডালিয়া চরিত্রটি। তিনিসহ্ গার্মেন্টস্-এর শ্রমিক চরিত্রে প্রত্যেকে ভালো অভিনয় করেছেন। সাহানা গোস্বামী, যিনি ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’ ছবিতে প্রধান চরিত্রে ছিলেন- এ ছবিতে বেশ সাদামাটা চরিত্র করেছেন। তবে ছবির ছোট-বড় সব চরিত্রের সকল অভিনয়শিল্পী ভালো করেছেন।
ছবির ডায়লগ দারুণ বাস্তবসম্মত এবং সিনেমাটোগ্রাফিও সৌন্দর্যের চেয়ে বাস্তবতার প্রতি বেশি নিবেদিত।
সব মিলিয়ে, ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ গল্পে আরেকটু শক্তিশালী হলে ভালো হতো, বিশেষ করে ক্ল্যাইম্যাক্সে। গার্মেন্টস্ শ্রমিকদের সংগ্রাম আরো স্পস্টভাবে আসলে ভালো লাগতো। তবে নির্মাতা শ্রমিকদের সংগ্রামের চেয়ে নারীর ক্ষমতায়নকে বেশি গুরুত্ব দিয়েই ছবিটা বানিয়েছেন। সেক্ষেত্রে গল্প ঠিকঠাকই আছে।
অবশ্য গল্পকে ছাপিয়ে গেছে নির্মাতার বাস্তবসম্মত নির্মাণশৈলী এবং অভিনয় শিল্পীদের অভিনয়।
‘মেড ইন বাংলাদেশ’ বাংলাদেশের গল্পের একটা খাঁটি বাংলাদেশি ছবি হয়েছে।
কেমন হওয়া উচিৎ বাংলাদেশের ছবি? জানতে চাইলে দেখুন।