Select Page

সব চরিত্রেই দারুণভাবে মানিয়ে নিতেন শওকত আকবর

সব চরিত্রেই দারুণভাবে মানিয়ে নিতেন শওকত আকবর

আমাদের চলচ্চিত্রের সোনালি দিনের সোনালি ছবিগুলোতে দাঁপিয়ে বেড়ানো এক অভিনেতার নাম শওকত আকবর। যিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ২০ বছর আগে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের শুরু থেকে যে কজন মানুষ নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছিলেন এবং আজীবন চলচ্চিত্রকে ভালোবেসেই কাজ করে গেছেন তাদের মধ্য অন্যতম হলেন শওকত আকবর যার পুরো নাম সাঈদ আকবর হোসেন।

পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমানে ১৯৩৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন শওকত আকবর। ছোটবেলা থেকে চলচ্চিত্র দেখতে দেখতে চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসা জন্ম নেয়। হলে সিনেমা দেখা নেশা হয়ে গিয়েছিল। অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকা শুরু হওয়ায় ১৫ বছর বয়সে স্কুল জীবনেই মঞ্চ নাটক ‘দেবদাস’-এ অভিনয় করে সবার প্রশংসা কুড়ান।

১৯৫০ সালে বর্ধমানে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হলে পরিবারের সাথে পূর্ব বাংলার ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৫৩ সালে চিকিৎস হওয়ার আশায় মেডিকেল কলেজে এলএমএফ কোর্সে ভর্তি হন। কিন্তু অভিনয় যার নেশা হয়ে গিয়েছিল সেই শওকত আকবর ১৯৫৭ সালে মেডিকেল কলেজের পড়াশুনা ছেড়ে সৌখিন নাট্যকর্মী হিসেবে যোগ দেন। আর ডাক্তার হওয়া হয়ে উঠেনি।

ভারতের প্রখ্যাত বিধায়ক ভট্টাচার্যের ‘তাইতো’ নাটকে নাট্যকর্মী হিসেবে হাতেখড়ি হয়। এ নাটকে শওকত আকবর সহনায়কের চরিত্রে ছিলেন। মঞ্চে নাটক করাকালীন তার সঙ্গে মঞ্চ অভিনেত্রী মুক্তার পরিচয় হয়। তারপর দু’জনার মধ্যে মন দেয়া-নেয়া হলো। অবশেষে ১৯৬১ সালে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। আকবর –মুক্তা দম্পতির প্রথম সন্তানের নাম মিল্টন আকবর। এই মিল্টন আকবর হলেন বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের স্বর্ণালি সময়ের প্রথম সারির ড্রামার যিনি এলআরবি ও মাইলসে দীর্ঘদিন বাজিয়েছিলেন। প্রিয় ও গুণী এই ব্যান্ডশিল্পী ৬ বছর আগে আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেছেন।

ফিরে আসি অভিনেতা শওকত আকবরের কথায়। ১৯৬৩ সালে ‘তালাশ’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে দর্শকদের সামনে প্রথম আসেন। কিন্তু উনার প্রথম অভিনীত ছবি ছিল ‘এইতো জীবন’ যা মুক্তি পায় ১৯৬৪ সালে। ‘তালাশ’ ছবির পর একই বছরে মুক্তি পায় ‘পয়েসে’ ছবিটি। দুটো ছবিতেই দারুণ অভিনয়ের জন্য শওকত আকবর সবার নজর কাড়েন। সেই সময়ে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা নাদিম, রহমানের সাথে পাল্লা দিয়ে তিনিও নায়ক চরিত্রে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তবে তিনি হাতেগোনা কয়েকটি ছবির নায়ক ছিলেন ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে। সেসব ছবি হলো— দিল এক শিশা, ভাওয়াল সন্ন্যাসী, পুণম কী রাত, জুগনু, আওর গম নেহি।

উর্দু সিনেমা ‘ভাইয়া’, শওকত আকবরের সঙ্গে চিত্রা সিনহা

নায়ক চরিত্র ছাড়াও স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত শওকত আকবরের উল্লেখযোগ্য অন্য ছবিগুলো হলো আগুন নিয়ে খেলা, ভাইয়া, আখেরি স্টেশন, জংলী ফুল, ওয়েটিংরুম, বেরহম, হামদাম, অপরিচিতা, অভিশাপ, শরীফে হায়াত, সাতরং, গৌরী, জীবন থেকে নেয়া, বড় বৌ ও টাকা আনা পাই।

‘টাকা আনা পাই’ ছবিতে তিনি রাজ্জাকের বাবার চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেন। সেই ছবিতে তিনি ছিলেন একজন অন্ধ বাবুর্চি যে তাঁর ছেলেকে অনেক কষ্ট করে শিক্ষিত করে তোলেন। ছেলে বড় হয়ে চায় না তাঁর বাবা বুড়ো বয়সে বাবুর্চির কাজ করুক তাই সে পিতার অমতে শহরের ধনাঢ্য পিতার একমাত্র কন্যাকে বিয়ে করেন কিছু শর্তে যা দিয়ে তিনি পিতার বন্ধক রাখা জমি ফিরিয়ে দেন। কিন্তু এই নিয়ে চলে পিতা ও পুত্রের মান অভিমান, টানাপোড়েন। ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শওকত আকবর দুর্দান্ত অভিনয় করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশেও শওকত আকবর বহু ছবিতে একটানা কাজ করে গেছেন ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলো নতুন সুর, মেঘ ভাঙ্গা রোদ, ফকির মজনু শাহ, অবুঝ মন, খোকনসোনা, ছুটির ঘণ্টা, তিন কন্যা, আদেশ, ক্ষতিপূরণ, রঙিন রূপবান, সহধর্মিণী, বেদের মেয়ে জোছনা, পদ্মা মেঘনা যমুনা, কাসেম মালার প্রেম-সহ আরও অনেক।

১৯৬৩ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত শওকত আকবর বাংলা ও উর্দু মিলিয়ে আড়াইশ’ ছবিতে অভিনয় করেন। রোমান্টিক নায়ক হিসেবে দেশে তিনি সুমিতা দেবী, রোজী, শর্মিলী, রেশমা প্রমুখের বিপরীতেই বেশি ছিলেন তেমনি লাহোরে গিয়ে তিনি সোফিয়া রানু, রোজিনা, রুখসানা, শামীম আরা, বাহার প্রমুখ নায়িকার বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন।

শওকত আকবর তাঁর অভিনয় জীবনে ভিখারী থেকে রাজা-বাদশা, নিম্নবিত্ত শ্রমিক থেকে অহংকারী শিল্পপতি, যুবক থেকে বৃদ্ধসহ এমন কোন চরিত্র নেই যে অভিনয় করেননি। সব চরিত্রেই দারুণভাবে নিজেকে মানিয়ে নিতেন শওকত আকবর। কোনদিন কোন চরিত্রে শওকত আকবরের অভিনয় দেখে দর্শকদের মনে হয়নি ঐ চরিত্রের জন্য তিনি উপযুক্ত ছিলেন না। দারাশিকো পরিচালিত ‘ফকির মজনু শাহ’ ছবিতে ভবানী ঠাকুরের চরিত্রে অভিনয় করেন, জাতীয় চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ ছবির পদক পাওয়া ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ ছবিতে তাঁর অভিনয় ছিল অনবদ্য। অভিনয় পাগল এই মানুষটি ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অভিমান করেই অভিনয় জীবন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। শওকত আকবর অনেকটা অভিমান করেই ১৯৯৬ সালে লন্ডনে ছেলে মিল্টন আকবরের কাছে চলে যান এবং সেখানেই ২০০০ সালের ২৩ শে জুন মৃত্যুবরণ করেন ।লন্ডনের মুসলিম কবরস্থানে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠার পেছনে যে মানুষগুলোর অবদান রয়েছে শওকত আকবর তাদেরই অন্যতম একজন। অথচ এই গুণী মানুষটার সঠিক মূল্যায়ন আমরা কোনদিন করতে পারেনি যা আমাদের দৈনতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। শওকত আকবর যা দিয়েছেন তাঁর তুলনায় আমরা তাঁকে কিছুই দিতে পারিনি। গুণী এই মানুষটির নাম বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সোনার অক্ষরে চিরদিন লিখা থাকবে ।


Leave a reply