সরলতার প্রতিমা, খালিদ-তরুণ মুন্সী ও অজানা কথা
ইউটিউব-ফেসবুক কেন্দ্রিক ডিজিটাল প্রজন্ম নিয়ে আছি এক মহাঝামেলায়! এরা বাংলাদেশ সম্পর্ক যতটুকু জানে-বোঝে তারও চেয়ে বেশি বোঝা ও জানার ভাব নেয়। ইউটিউব-ফেসবুকে হুটহাট ভুল তথ্য দিয়ে কনটেন্ট আপলোড ও শেয়ার করে। এরা যা জানে সেটাকেই মনে করে সঠিক কিন্তু সেটা ভুল কি শুদ্ধ?
২০২২ সালেও যখন ইউটিউবে খালিদের ‘সরলতার প্রতিমা’ গানের গীতিকার ও সুরকার প্রিন্স মাহমুদ দেখি, তখন এই প্রজন্মের জন্য খুব কষ্ট হয়। এরা আজও নিজের দেশ সম্পর্কে ভালো করে জানতে পারলো না।
মোবাইল কোম্পানিগুলোর ওয়েলকাম টিউনের কল্যাণে ডিজিটাল প্রজন্মের কাছে নব্বই দশকের জনপ্রিয় ব্যান্ড সংগীতের কণ্ঠ খালিদের ‘সরলতার প্রতিমা’ ব্যাপক জনপ্রিয়। সে কারণে তারা খালিদ বলতেই একটি গানকে চিনে কিন্তু খালিদের যে এরচেয়েও আরও অনেক জনপ্রিয় গান আছে এবং তিনি আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই ব্যান্ড সংগীতের শ্রোতাদের কাছে পরিচিত— সে সম্পর্কে ওদের ধারণা নাই; এ কথা বাদই দিলাম।
‘সরলতার প্রতিমা’ নব্বই দশকের শেষ দিকে প্রকাশিত হওয়ার পরপরই সে সময়কার শ্রোতাদের কাছেও জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। শুধু ‘সরলতার প্রতিমা নয়’ ওই একই অ্যালবামের (মেয়ে) আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, হাসান, মাকসুদ, টিপু ও পার্থসহ প্রায় সবার গানই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কিন্তু আইয়ুব বাচ্চুর ‘মেয়ে’, জেমসের ‘আমাকে দেখে যা’, হাসানের ‘একাকী প্রহর’ ও খালিদের ‘সরলতার প্রতিমা’ গানগুলো শ্রোতাদের মুখে মুখে বেশি ফেরে।
অসংখ্য জনপ্রিয় গানের জন্য ডিজিটাল প্রজন্ম নব্বই দশকের শ্রোতাদের মুখে ‘প্রিন্স মাহমুদ’ নামটি খুব বেশি শুনেছে। প্রচার বিমুখ এ মানুষটির নাম মিডিয়ায় যতটা না প্রচার হয়েছে তারও চেয়ে বেশি প্রচার হয়েছে শ্রোতাদের মুখে মুখে। এর একটাই কারণ— একের পর এক দুর্দান্ত গান উপহার। তাই এ প্রজন্মের অনেকে মনে করছে ব্যান্ড গ্রুপের সলো অ্যালবামের বাইরের কোন ব্যান্ড তারকার জনপ্রিয় গান মানেই প্রিন্স মাহমুদের লেখা ও সুর করা গান। যা স্বয়ং প্রিন্স মাহমুদের জন্য বিব্রতকর আবার গানটির গীতিকার ও সুরকারের প্রতি অবিচারও। কারণ শিল্পীকে চিনতে পারলেও গানের পেছনের দুই কারিগরকে আমরা চিনতে বা জানতে পারিনি।
খালিদের ‘সরলতার প্রতিমা’ গানটির গীতিকার হলেন তরুণ মুন্সী। আর সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবে তখন জুয়েল-বাবু নামের দুজনের নাম থাকলেও পরবর্তীতে কোন এক বিশ্বস্ত সূত্রের মাধ্যমে জানতে পারি যে সুরকারও ছিলেন তরুণ!
তরুণ ছিলেন তৎকালীন সময়কার খুবই মেধাবী একজন কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার ও সুরকার। যার লেখা জেমসের কণ্ঠে পদ্ম পাতার জল, বর্ষা, বৃষ্টির জলে ভিজেছে, কিছুটা আশা, আরও কিছুক্ষণ রবে কি বন্ধু, মাকসুদের কণ্ঠে মনের অন্তরালে, টিপুর কণ্ঠে কী করে তোমাকে ভুলে যাবো, জুয়েলের নীলা-সহ আরও অনেক গান আজও শ্রোতাদের মনে গেঁথে আছে। ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবামের দারুণ সময়ে সংগীত পরিচালক জুয়েল-বাবুর অডিও ইন্ডাস্ট্রিতে জনপ্রিয়তা পাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান তরুণের। কারণ জুয়েল-বাবুর সুর করা সবচেয়ে জনপ্রিয় গানগুলো তরুণের লেখা ও সুর করা; কিন্তু গীতিকার হিসেবে তরুণের নাম থাকলেও ক্যাসেটের কভারে সুরকার-সংগীত পরিচালক হিসেবে নাম থাকতো অন্য দুজনের।
খালিদ
ওই দশকে আমরা এতো বেশি অসাধারণ সব মেধাবীদের পেয়েছিলাম যে সবাইকে ঠিকমতো জানার বা চেনার সময় পাইনি, উনাদের প্রচার বিমুখতার বৈশিষ্ট্যর কারণে। তখন অডিও ক্যাসেটের কভারে গীতিকার-সুরকারদের নাম ছাড়া তাদের অনেকের চেহারা পর্যন্ত দেখিনি; কিন্তু অচেনা সেই মুখগুলোর বহু গান আমাদের মুখে মুখে ফিরতো।
এখন দেখি একটা গান ভাইরাল হয়ে গেলেই একেকজন গীতিকার সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী নিজেকে বিরাট বড় সেলিব্রেটি ও বিরাট মেধাবী মনে করে, নিজেকে সুপারস্টার মনে করে। আমাদের সময়ে প্রচারবিমুখ গীতিকার তরুণ যতগুলো শ্রোতাপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন, এ ডিজিটাল প্রজন্মের সব তথাকথিত সুপারস্টার শিল্পী, গীতিকার ও সুরকারদের সবগুলো জনপ্রিয় গান এক করলেও তার সমান হবে না।
প্রকৃত মেধাবীরা বেঁচে থাকে মানুষের মনে তাদের কর্মগুণে যুগ যুগ ধরে, হুজুগে সুপারস্টার হয়ে নয়। নিজের দেশ ও মানুষগুলো সম্পর্কে জানার চেষ্টা করুন তখন নিজের দেশকেই ভালোবাসতে শিখবেন। যদি না নিজের দেশ সম্পর্কে না জানেন অন্য দেশের সবকিছু জেনে বিশ্বপন্ডিত হয়েও কোন লাভ নেই।