সহজ ও সাবলীল মোস্তফা মনোয়ার
এই সময়ে যে কয়েকজন অভিনেতা নিয়মিতভাবে ভিন্নধর্মী গল্পে কাজ করছেন তাদের মধ্যে আলোচিত নাম মোস্তফা মনোয়ার। তার সহজাত ও নান্দনিক অভিনয় দক্ষতার কারণে নতুন নতুন চরিত্রে তার ওপর ভরসা করতে পারছেন নির্মাতা।
গতানুগতিক ধারার বাইরে এসে নিজেকে ‘মিস্টার জনির’ দয়াল, ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’র সাজ্জাদ বা ‘একাত্তরের’ সেলিম হিসেবে হাজির হয়েছেন এবং অসাধারণ অভিনয় নৈপুণ্য দিয়ে মন জয় করেছেন অবলীলায়। সম্প্রতি আলোচনায় আছে মোস্তফা মনোয়ার অভিনীত ওয়েব সিরিজ ‘ঊনলৌকিক’ ও ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলম্যান’ নিয়ে। সব মিলিয়ে বলা যায়, এখন পর্যন্ত ক্যারিয়ারের অন্যতম সময় পার করছেন।
কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ থেকে পাস করে বের হওয়ার সময় কখনোই কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ না করার আক্ষেপ নিয়ে ভারাক্রান্ত সেই কিশোরটি আজ দেশের গুণী অভিনেতাদের একজন। এক পরিচিত বড় আপুর মাধ্যমে এলাকার এক নাটকে অংশগ্রহণ এবং সেখান থেকেই অভিনয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে প্রাচ্যনাটের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। মনোয়ার ভর্তি হয়েছিলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগে। অভিনয়ের জন্য এক বছর পর সাবজেক্ট পরিবর্তন করে বিবিএতে ভর্তি হন। সেই সময় বন্ধুত্ব হয় অনিমেষ আইচ, বদরুল আনাম সৌদসহ সাংস্কৃতিক জগতের আরও কয়েকজন মানুষের সঙ্গে।
হঠাৎই বন্ধু অনিমেষের অনুরোধে রাত ১টা থেকে পরদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত বসে নানা চিন্তাভাবনার পর কাগজে লিখে শেষ করলেন ‘হলুদ’ নামের নাটক। জীবনের সেই প্রথম লেখা নাটকের জন্য পেলেন সেরা চিত্রনাট্যকার হিসেবে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার। পরবর্তীতে তার লেখা ‘ভূতোগ্রাফার’ নাটকটিও বেশ আলোচনায় এসেছিল। এর মাঝেই অভিনয় করেছেন জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘লাবণ্যপ্রভা’, একক নাটক ‘আগন্তুক’ সহ আরও বেশ কিছু নাটকে। ছোট ছোট চরিত্রে তার অভিনয় তখন থেকেই নজরে আসে অনেকের। তবে রেদওয়ান রনি’র ‘মিস্টার জনি’ তাকে অভিনেতা হিসেবে সবার কাছে জনপ্রিয় করে তোলে।
অন্যদিকে বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম সিনেমাতেও এর মাঝে কাজ করেন তিনি। নাসির উদ্দিন ইউসুফের ‘গেরিলা’ বা রুবাইয়াত হোসেন পরিচালিত ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ফজলে রাব্বির ‘ইতি তোমারই ঢাকা’ তাকে অভিনেতা হিসেবে পরিপক্ব এবং এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজটি করে সফলতার সঙ্গেই।
তবে ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ সিনেমাটি তার ক্যারিয়ারের অন্যতম একটি মাইলফলক। এই সিনেমায় তার অভিনয় দক্ষতা মুগ্ধ করেছে সিনেমাপ্রেমীদের। সাজ্জাদ চরিত্রটি বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য শুটিং শুরুর এক মাস আগে থেকেই স্ক্র্যাচ ব্যবহার করে হাঁটতেন তিনি। ডেডিকেশন লেভেল কতটা হলে একজন অভিনেতা নিজেকে এভাবে তৈরি করেন সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সামনে আসছে নূরুল আলম আতিকের ‘মানুষের বাগান’ সিনেমাটি। জানা গেছে, এখানে তার চরিত্রটা এমন একজন মানুষের, যিনি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে সব হারিয়ে একসময় মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে যান। তারপর সুস্থ হওয়ার পরও তিনি মানসিক ভারসাম্যহীনের অভিনয় করে যান। কারণ, তখন অনেক মানুষ তার কাছে টাকা পায়! এই চরিত্রে অভিনয় একজন অভিনেতা হিসেবে তার কাছে চ্যালেঞ্জিং ছিল বলে জানিয়েছেন তিনি এক সাক্ষাৎকারে।
সম্প্রতি আলোচিত গায়ক জন কবিরের ‘সুখী মানুষের কান্না’ নামক মিউজিক ভিডিওতে মোস্তফা মনোয়ারকে দেখা গেছে। করোনাকালীন সময়ে পরিবারের সদস্যদের মধ্যকার সম্পর্ক এবং ব্যক্তিগত জায়গার নানা উত্থান-পতনের গল্প উঠে এসেছে এতে। এ ছাড়া ‘পায়ের নিচে মাটি নেই’ এবং দক্ষ নির্মাতা গিয়াসউদ্দিন সেলিমের ‘গুনিন’সহ আরও বেশ কিছু কাজ নিয়ে হাজির হবেন তিনি।
বিনোদনের নতুন ও আলোচিত একটি মাধ্যম এখন ওটিটি। এই মাধ্যমেও মোস্তফা মনোয়ার ‘একাত্তর’ ওয়েব সিরিজ দিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন। এলাকার গুন্ডা সেলিম একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে যান দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকে এমন একটি চরিত্রে তার অভিনয় দক্ষতা অসাধারণ অনুভূতির মাঝে নিয়ে যায় আমাদের। সম্প্রতি মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত প্রথম ওয়েব সিরিজ ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলম্যান’ এবং রবিউল আলম রবি পরিচালিত ‘ঊনলৌকিক’-এ ব্যতিক্রমী এবং শক্তিশালী চরিত্রে হাজির হয়েছেন তিনি। প্রথমটি জি-ফাইভে, দ্বিতীয়টি দেশীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘চরকি’তে সম্প্রচার করা হয়েছে।
‘ঊনলৌকিক’ সিরিজের প্রথম গল্প ‘মরিবার হলো তার স্বাদ’ এ কবির রূপে হাজির হয়েছেন মোস্তফা মনোয়ার। শিবব্রত বর্মনের লেখা এই গল্প নির্মাণের মুনশিয়ানা এবং মনোয়ারের অভিনয় দক্ষতা দিয়ে দর্শকদের প্রশংসা পেয়েছে। এখানে তার চরিত্র পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারে ভোগা রোগীর। এ ছাড়া ফারুকীর ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলম্যান’-এ তার অভিনয় ও উপস্থিতি প্রশংসিত হয়েছে।
আপাতত সর্বশেষ সুখবর হলো মোস্তফা মনোয়ারের জন্মদিনে আজ এসেছে নতুন ছবির প্রিমিয়ার ঘোষণা। মোহাম্মদ রাব্বি মৃধা পরিচালিত ‘পায়ের তলায় মাটি নাই’ শিরোনামের ছবিটি প্রদর্শিত হতে যাচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার বুসান চলচ্চিত্র উৎসবে। ছবির প্রধান চরিত্রে আছেন এ অভিনেতা।
ব্যক্তিজীবনে করপোরেট জবের পেশার পাশাপাশি অভিনয়টা করেন নিজের আত্মার খোরাক জোগাতে। মোস্তফা মনোয়ার সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন যে, ‘আমি যদি আর্থিকভাবে অভিনয়ের ওপর নির্ভরশীল হতাম, তাহলে আমাকে অনেক কাজ করতে হতো। আমার সুবিধাটা হচ্ছে, বেছে নিজের পছন্দে কাজ করতে পারি। চাইলে করতে বা ছাড়তে পারি। আর আমার কাছে মনে হয় যে, আমাদের কেবল কাজটা করে যাওয়া জরুরি। কিছু কাজ ভালো হবে, কিছু হয়তো খারাপ। কিন্তু কাজ করতে হবে এটাই দিনশেষে সত্য।’
সংখ্যায় কম হলেও তাই হয়তো মোস্তফা মন্ওয়ারের প্রতিটি কাজই নান্দনিকতা ছুঁয়ে যায় ভিন্নধর্মী গল্প এবং চরিত্রের ওপর ভর করে যা তিনি সেলুলয়েডে তুলে ধরেন অসাধারণ নিপুণতায়। শুভকামনা রইলো এই গুনী অভিনেতার জন্য।