সাদাকালো ছকে আটকা পড়েনি যে সিনেমা
কেমন সিনেমা দেখতে চাই, এটা অনেকখানিই নির্ভর করে আমার মুডের ওপর। স্ট্রেসে থাকলে সায়েন্স ফিকশন, হরর বা থ্রিলার ভাল্লাগে। হালকা বিরহ মুডে থাকলে রোমান্টিক কমেডি। হাসির ছবি ভাল্লাগে বিরক্ত হয়ে থাকলে। সিরিয়াস ছবি আমার তখনই ভালো লাগে, যখন আমি একটু স্টেবল। যখন আমার কোনো পাস্ট ট্রমা, কোনো অস্বস্তিকর ইস্যু আমার সামনে এসে পড়লেও সেটা মোকাবিলা করার মত শক্তি আছে।
এখন বাংলাদেশের একজন নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যবয়সী কর্মজীবী নারী হিসেবে, অতটা স্টেবল থাকা আমার পক্ষে একটু কঠিনই। ফলে, সিরিয়াস মুভি আমার বেশিরভাগ সময়েই ভাল লাগে না। আর তাই ছুটির দিনে বিনোদনের উদ্দেশ্যে দেখতে যাওয়া সিনেমা হিসেবে, ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ বেছে নেয়া আমার জন্য খুব বুদ্ধিমানের কাজ হয়নি নিশ্চয়ই।
সিনেমাটা দেখতে গিয়ে আমার অস্বস্তি লেগেছে, অসহায় লেগেছে, দমবন্ধ লেগেছে, কান্না জমে গলা ব্যথা করেছে। তবে সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে এসে মনে হয়েছে, এই যে এত তাড়িত হয়েছি, ভেবেছি…আমি আসলে এটা এনজয় করেছি। যে প্রশ্নগুলো, যে চিন্তাগুলো এড়িয়ে যেতেই চায় সবাই, রেহানার পরিচালক সেই প্রশ্নের মুখোমুখিই করতে চেয়েছেন দর্শককে।
সিনেমা মুক্তির পর থেকেই নানা রকম প্রতিক্রিয়া কানে এসেছে। কেউ কেউ উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছে, কেউ বলেছে সিনেমাটা নিয়ে অযথাই মাতামাতি হচ্ছে। ঘোলাটে নীল স্ক্রিন, ব্লারড ফ্রেম, ক্যামেরার ক্রমাগত নড়াচড়া দর্শকের জন্য পীড়াদায়ক। পয়সা দিয়ে কেন এই পীড়া নেবে দর্শক? পরিচালক যেহেতু ইচ্ছা করেই এই স্টাইলটি বেছে নিয়েছেন, বলাই যায়, আরামপ্রিয়, পলায়নপর দর্শক তার টার্গেট নয়।
কিন্তু আমরা তো এখন সবাই-ই পলায়নপর। যে সমাজে বিচারক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পরামর্শ দেন, ধর্ষণের ৭২ ঘন্টা পর আর মামলা না নিতে, যে সমাজে একজন অভিনেত্রী তার বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ তুললে আমরা তার চরিত্র নিয়েই কাটাছেঁড়া শুরু করি, সেই সমাজের জন্য রেহানা সিনেমাটি এই মুহূর্তে এড়িয়ে যাওয়াই দর্শকদের জন্য সবচেয়ে সুবিধা।
আমরা যেটাকে সচরাচর নারীবাদী ইস্যু বলে থাকি, ছবির গল্প এরকমই একটা ইস্যু নিয়ে। নারীবাদ যেহেতু সাধারণভাবে অপ্রিয় বিষয়, পরিচালক আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ প্রথমেই একটা বড় দর্শককে হারিয়েছেন।
আরও পড়ুন: রেহানা মরিয়ম নূর: শিল্প-দক্ষতা ও সীমিত দৃষ্টিভঙ্গির অনুশীলন
আরও পড়ুন: দর্শককে একই সময়ে দুটি দিক দেখতে বাধ্য করে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’
আবার এই ছবিটি নারীবাদের প্রতিবাদী কোনো চেতনাকেও ধারণ করে না। রেহানা খুব বিপ্লবী নারী নয়, সে কোনো লড়াইয়ে জেতেও না। এমনকি নিজের লড়াই সম্পর্কে সে হয়তো খুব পরিষ্কারও না। তবু, নিজের সাথে সম্পর্কহীন একটি অন্যায়ের ঘটনায় তার যেয়ে রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা, সেটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। মানুষকে আমি এরকমই ভাবি তো, যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে, নিজের ক্ষতি মেনেও। আমরা সেরকম মানবসমাজ গড়ে তুলতে পারিনি, সেরকম মানুষ আমাদের চারপাশে খুব কম, যারা আছে তারাও হেরে যাওয়া… তবু, মানুষের কি এরকমই হতে হতো না? অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীলতা আমাদের মধ্যে এখন আর নাই, ফলে রেহানার সঙ্গে রিলেট করতে পারাটা আমাদের জন্য একটু কষ্টকরই বটে।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে, নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার বিষয়টা ৮০ ভাগ মানুষ (নারী ও পুরুষ) ভুলভাবে দেখে, নারীকেই দোষী মনে করে, অপরাধী পুরুষটিকে ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখে। আর বাকি যে ২০ শতাংশ নারীটির প্রতি সহমর্মিতা বোধ করে, তারাও পুরো ঘটনাটা সবসময় ৩৬০ ডিগ্রি আ্যঙ্গেল থেকে দেখতে পারেন না। সাদ পেরেছেন। আমি বেশ অবাক হয়েছি। আনিকা, আরেফিন ও আয়েশার চরিত্রটা এমনভাবে সাদ সিনেমায় এনেছেন, আমি রীতিমত বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেছি। আনিকা কি এর আগেও স্যারের রুমে অপ্রয়োজনে গেছে? আরেফিন যা বলছে, এটাকি সত্যিই একটা ভুল বোঝাবুঝির ঘটনা? আয়েশা শেষ পর্যন্ত তাকে ছেড়ে গেল কোন শক্তিতে? কোন যন্ত্রণায়? সাদ সব প্রশ্নের জবাব দেননি।
এই সিনেমার ক্লাইম্যাক্স অবশ্য রেহানার সঙ্গে আরেফিনের দ্বন্দ্ব নয়, সেই দ্বন্দ্বে রেহানার কতটুকু জয় আর কতটুকু পরাজয় ঘটেছে সেটা বরং আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে রেহানা হেরে গেছে, অভিযোগ তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে চাকরি বাঁচাতে। কিন্ত রেহানা শেষ পর্যন্ত আরেফিনকে স্বীকার করতে বাধ্য করেছে তার দোষ, একজন অপরাধীর এটাই কি সত্যিকারের শাস্তি না?
আরও পড়ুন: কমপ্লিকেটেড ‘রেহানা মরিয়ম নূর’
তাহলে এই সিনেমার ক্লাইম্যাক্স কোনটা? যখন রেহানার শিশুকন্যা তার স্কুলের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে চাইলো। শেষে এসে ছোট্ট ইমুর সঙ্গে রেহানা যে নিষ্ঠুরতা করলো, সেটা আমারও ভালো লাগেনি। রেহানার ভাই রনির মত আমারও কান্না পেয়েছে। কিন্তু রেহানা কারো কাছে ভালো মায়ের সনদ চায়নি। সে শুধু তার মেয়ে ইমু যে অন্যায় করেনি, তার জন্য তাকে ক্ষমা চাইতে দিতে রাজি হয়নি। সিনেমা শেষ হয়েছে ছোটগল্পের অতৃপ্তি নিয়ে।
এই রেহানাকে আমরা নিতে পারব না। সম্ভবই না। রেহানা চরিত্রে যে বাঁধন, আমরা তো এমনকি অভিনেত্রী হিসেবে তার লড়াইটাকেও ভালো চোখে দেখতে শিখিনি। প্রতিবাদের মানসিকতাকে আমরা কাঠামোগতভাবে ধ্বংস হতে দিয়েছি, এরকম চেষ্টাকে আমরা সম্মান দিতেও শিখিনি। এমনকি এইগুলো নিয়ে আমরা আর চিন্তা করতেই চাই না।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সাদ কিন্তু রেহানাকে হিরো হিসেবে তুলে ধরতে চাননি। রেহানা মিথ্যা বলে, রেহানা তার শিশুকন্যার প্রতি চরম নিষ্ঠুরতা করে, তার অনেক আচরণকেই জাস্টিফায়েড করা যায় না। এই জন্যই রেহানা সিনেমার চরিত্র না হয়ে বাস্তব। একই কথা বলা যায় সিনেমার নেগেটিভ চরিত্র আরেফিন সম্পর্কে। সে কিন্তু নিজেকে অপরাধী মনেই করে না, মনে করে আনিকাই তাকে প্রশ্রয় দিয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে সে জনপ্রিয়, স্ত্রী চলে গেলে তার দুঃখটাও খুবই আন্তরিকই মনে হয়।
ভালো-মন্দের সাদাকালো ছকে আটকা পড়েনি সিনেমার মূল চরিত্রগুলো। ভাবতে বাধ্য করলেও, সমাধান দেননি সাদ, সেটা ভেবে বের করার দায়িত্বও দর্শককেই দিয়েছেন।
এরকম একটা সময়ে, রেহানা মরিয়ম নূরের মতো সৎ, সময়ের চেয়েও আগানো, সাহসী সিনেমার জন্য আমরা যদি প্রস্তুতই থাকতাম, তাহলে আমাদের সমাজটাই তো অন্যরকম হতো….