সাদা-কালো যুগের ক্লাসিক ‘নান্টু ঘটক’
বাংলা সিনেমার সোনালী দিনের পরতে পরতে কত যে বৈচিত্র্য আছে তা অনেকেরই অজানা।গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে সবাই চিনে দেশসেরা একজন গীতিকার হিসেবে যিনি আমাদের বাংলা গানের ভান্ডারকে করেছেন সমৃদ্ধ। অনেকেই জানে না এই গাজী মাজহারুল আনোয়ারই বাংলা চলচ্চিত্রের একজন কাহিনীকার, চিত্রনাট্যাকার, প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবেও বাংলাদেশের বাণিজ্যক চলচ্চিত্রকে করেছিলেনঅনেক অনেক সমৃদ্ধ।‘নান্টু ঘটক’ গাজী মাজহারুল আনোয়ারের তেমনই একটি চলচ্চিত্র।
১৯৮২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘নান্টু ঘটক’ সিনেমাটি আমি দেখেছিলাম পরিবারের সাথে সিনেমা হলে আরও অনেক পরে। ভাসা ভাসা মনে আছে নান্টু নামের এক ১০/১২ বছরের ছেলে যার বাবা আজিম একজন ঘটক। এক দুর্ঘটনায় নান্টুর বাবা মারা গেলে অবুঝ নান্টু বাবার বলা একটা কথা মনে করে যে আরেকটা অর্থাৎ ১০১ নম্বর বিয়ে করাতে পারলেই বেহেস্তে যাবে। নান্টু তার মৃত বাবার আত্নার শান্তির জন্য বাবার অসমাপ্ত সর্বশেষ বিয়ের ঘটকালিটা করার চেষ্টায় এখানে সেখানে ঘুরতে থাকে।
একসময় আশ্রয় পায় সুচরিতার কাছে যার ব্যবসা হলো ফুটপাতে নিম্ন আয়ের মানুষদের ভাতের হোটেল যার নাম ‘’হোটেল গুলশান’’।সুচরিতার প্রতিবেশী হাবাগোবা ওয়াসিম ও তার মা যারা সুচরিতার মতো ফুটপাতে ভাতের হোটেলের ব্যবসা করে।বাবর ফ্রড ও খুনেরআসামী, তার দৃষ্টি পড়ে সুচরিতার দিকে। কারণ নিজের স্ত্রীকে খুন করা পলাতক বাবর সুচরিতার মধ্য তার স্ত্রীর চেহারার মিল খুঁজে পায় আর সুচরিতাকে কাবু করতে পারলেই নিজের স্ত্রী সাজিয়ে খুনের মামলা থেকে রেহাই পেয়ে যাবে।
নান্টু সুচরিতাকে বাবরের হাত থেকে বাঁচায় সেই থেকে সুচরিতার কাছে নান্টু ছোট ভাই হিসেবে আশ্রয় পায়। নান্টুর সাথে পরিচয় হয় কালু মিয়া নামের আলমগীরের সাথে যে পেশায় একজন গাড়ির ড্রাইভার। আলমগীরের গাড়ির মালিক একজন উকিল। নান্টু চায় সুচরিতার সাথে আলমগিরের বিয়ে দেয়ায় সেই সুত্রে আলমগির ও সুচরিতার পরিচয় করিয়ে দেয় এবং নানা খুনসুটির পর দুজনের প্রেম হয়। অন্যদিকে গ্রাম থেকে অঞ্জনা ওয়াসিমের আত্নিয় যার সাথে ওয়াসিমের মা রওশন জামিল চায় বিয়ে দিতে।
…এভাবে নানা ঘটনা দুর্ঘটিনার মাঝে সিনেমার গল্পটি এগিয়ে যায় এবং অবশেষে নান্টু আলমগীর ও সুচরিতার মিলন ঘটাতে সমর্থ হয় কিন্তু ততক্ষণে নান্টুও তার বাবা আজিমের কাছে পরপারে চলে যাওয়ার পথ ধরেছে। নান্টুর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সিনেমাটি শেষ হয়েছিলো। নাম ভূমিকায় শিশু শিল্পী শামীম অসাধারণ অভিনয় করেছে সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। শামীমকে এর আগে দেখেছিলাম আমজাদ হোসেনের ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’ সিনেমায় বুলবুল ও ববিতার সন্তানের ভূমিকায়। যে সিনেমার ‘বাবা বলে গেলো /আর কোনদিন গান করো না’ গানটির মধ্য দিয়ে শামীম দর্শকদের মনে চিরকালের জন্য ঠাই করে নিয়েছিলো।
পুরো সিনেমাটা ট্রিপিক্যাল বাংলা বাণিজ্যিক সিনেমা হলেই সাদাকালো যুগের অন্যতম ক্লাসিক একটা বাণিজ্যিক সিনেমা।গল্পের ভেতর হাস্যরসের মধ্য দিয়ে জীবনের নানা অসংগতি, সুখ দুঃখ ,চাওয়া পাওয়া ফুটে উঠেছে। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লিখা,সুর ও করা গানগুলোও ছিলো চমৎকার যার মধ্য সৈয়দ আব্দুল হাদীর কন্ঠে জন্ম মৃত্যু আর বিয়া/ এই ৩ টি সত্য নিয়া, এন্ড্রো কিশোরের কন্ঠে আমার নাম কালু মিয়া/ বাড়ী আমার করটিয়া ও এন্ড্রো কিশোর ও শাম্মী আখতারের কন্ঠে চলে আমার সাইকেল হাওয়ায় উইড়া উইড়া গানগুলো ছিলো দর্শক শ্রোতাদের মুখে মুখে। সেই ইন্ডাস্ট্রি আজও আছে অথচ নান্টু ঘটকের মতো একটি জীবনঘনিষ্ট বাণিজ্যক চলচ্চিত্র বানানোর মতো মানুষ ও মেধা কোনটাই আজ নেই।