সাপলুডু’র ময়নাতদন্ত
শিরোনাম দেখেই হয়তো আন্দাজ করতে চলছেন কী বলতে চলেছি। হ্যা সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত সাপলুডু চলচ্চিত্রটিকে ক্ষত বিক্ষত করে দেখতে চাচ্ছি আসলে কেমন ছিল চলচ্চিত্রটি। আলোচনাটি বেশ বড়, তাই আগেই বলছি গুরুত্বপূর্ণ ফোন থাকলে সেরে নিন তারপর পড়া শুরু করুন।
যাদের এতো বিশাল বকবকানি পড়ার সময় নেই, তাদের জন্য ডিসেকশন শুরু করার আগে আমার এক্স অফিসের বসের একটা কথা বলতে চাই, তিনি কখনো থ্রিলার সিনেমা বা যে সিনেমা দেখে মাথা খাটাতে হয় সে সিনেমা দেখতে চাইতেন না বা দেখলেও ভাবতেন না কি দেখেছেন। তার কথা হল সিনেমা দেখি আনন্দের জন্য, রিফ্রেশমেন্টের জন্য। সে সিনেমা দেখেই যদি আবার ভাবা লাগে, মাথা খাটানো লাগে তাহলে আর রিফ্রেশ হলাম কোথায়? কথাতে কিন্তু যুক্তি আছে ভাই। ভাই এর কথা হল ফিল্মে শুধু ৩ টা জিনিস হয় “এন্টারটেইনমেন্ট, এন্টারটেইনমেন্ট এবং এন্টারটেইনমেন্ট”। এ কথা বলার উদ্দ্যেশ হল, যদি আপনি এই শ্রেণির দর্শক হয়ে থাকেন, মানে ম্যাস অডিয়েন্স তাহলে বলব আপনি সিনেমাটি দেখতে পারেন, ভালো লাগবে।
এবার যারা একটু চলচ্চিত্র বুঝেন বা চলচ্চিত্র মানে শুধুই এন্টারটেইন্ট না সাথে আরো অনেক কিছু থাকে তারা সহ যারা জানতে চান আসলেই কেমন ছিল সাপলুডু, তাদের জন্য এই অংশটুকু। চলুন শুরু করা যাক।
অধিবাসীদের গ্রামে উৎসবের আগে একটা গন্ডগোল হয়, সেখান থেকে পালিয়ে বেঁচে ফিরে পুষ্প চরিত্রের মীম। আশ্রয় নেয় এলাকার এমপির বাসায়। ঠিক তারপরই শুরু পুষ্পকে কেন্দ্র করে একের পর এক খুন। কিন্তু কেন? জানা যায় নেপথ্যে রয়েছে এক মেমরি কার্ড। কি আছে সে মেমরি কার্ডে? মূলত এই কাহিনী ধরেই চলচ্চিত্রটি এগিয়েছে।
পলিটিক্যাল থ্রিলার জনরার চলচ্চিত্রটি পুরো প্রথম অর্ধ ধোঁয়াশার মধ্যে রাখবে। অনেক কিছুই খুঁজতে চাইবেন কিন্তু আবছা আবছা করে কিছু আসবে কিছু আসবে না। তবে আন্দাজ করা যাবে আসল ভিলেন কে হতে পাবে কিন্তু ভিলেন কেন করছে সেটা ধরা সম্ভব হবা না। মূলত যারা বিদেশী থ্রিলার চলচ্চিত্র নিয়মিত দেখেন তাদের এই ধারণার সাথে যখন শেষ দিকে মিলে যাবে তখন তাদের কাছে চলচ্চিত্রটি ঠিক জমে উঠলনা বলে মনে হবে। কিন্তু সাধারণ দর্শক বেশ বড়সড় ধাক্কা খাবে। চলচ্চিত্রের মূল সমস্যাটা ঠিক এখানেই, আসলে এন্ডিং টেনেও টানেননি পরিচালক। পোস্ট ক্রেডিট সীনে যখন নতুন কোন দৃশ্য দেখা যাবে, ঠিক তখন পুরো সমীকরণ উলটো পালটা হয়ে যায়। কাহিনীর নেপথ্যে কে আছেন বা কলকাঠি কে নেড়েছেন এটা নিয়ে ভাবতে গেলে মাথা তখন প্যাঁচ লাগবে। মনে হবে সাপলুডুর মই বেয়ে যতখানি উপরে উঠা হয়েছিল ঠিক ততটাই আবার সাপের মুখে পড়ে নিচে চলে আসা লাগল। পরিচালকের এটা একটা স্বার্থকতা বলা যায়।
কাহিনী বিন্যাসের ক্ষেত্রে যদি এই পার্টকে প্রথম পার্ট হিসাবে ধরি, তাহলে বলব কিছু ত্রুটি আছে। বিশেষ করে একটা চরিত্রের ব্যাকগ্রাউন্ড অবশ্যই রাখা উচিত ছিল। শতাব্দী ওয়াদুদের চরিত্রটি দেখানো যেত কোন বিশাল টেরটিস্টের মাফিয়ার ব্যাকগ্রাউন্ড হিসাবে এবং আদিবাসী সেই গ্রামের গুরুত্ব এ ধরণের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য কতটা ইম্পরট্যান্ট তার একটা সম্যক ধারণা চলচ্চিত্রটির শুরুতে ও মাঝে যোগ করে দিলে বলা যায় মাসলাদার একটা কম্প্যাক্ট থ্রিলার হয়ে যেতো। এখানে বলব পুরোপুরি পাস না করতে পারলেও রহস্যের জাল পরিচালক ভালোই বিছিয়েছেন।
এই প্রথম কোন চলচ্চিত্রের কালার গ্রেডিং দেখে মনে হয়েছে চলচ্চিত্র দেখছিলাম, টেলিফিল্ম ভাবটা আসেনি। কালার গ্রেডিং আসলেই আপ টু দ্যা মার্ক। ময়না ধুম এবং কিছু স্বপ্ন দুটো গানকে কাহিনীর এলিমেন্ট হিসাবে প্লেস করার ব্যাপারটা দারুণ, তৃতীয় গানটা সো সো টাইপ।
স্ক্রিনপ্লেতে কিছু ঝামেলা ছিল, তবে কিছু ড্রোন শট দেখার মত। পরিচালক চাইলে মার্ডার দৃশ্যগুলোর কথা মুখ দিয়ে না বলিয়ে ফ্ল্যাশব্যাকে দেখালে বা এটাকে আগে ব্যক্তিকে আড়াল করে দৃশ্যগুলো পর্দায় আনলে আরো বেশি ভালো হত।
চরিত্রের কথা বলতে গেলে, একমাত্র জাহিস হাসান, আরিফিন শুভ এবং কিছু ক্যামিও ক্যারেক্টার ছাড়া আর কারো চরিত্রকে খোলাসা করেন নি পরিচালক। পোস্ট ক্রেডিট সীন সমাধান করতে গেলে সবার আগে খোলাসা করতে হবে মীম এবং সালাউদ্দীন লাভলুর চরিত্রকে। তবে পার্ট ওয়ানে কিছু ক্যারেক্টার বিল্ডাপ হলে উত্তেজনার মাত্রা বেশি ছড়াতে পারতেন পরিচালক কিংবা এটাই শেষ কিস্তি হলে ক্যারেক্টার বিশ্লেষণ করেই হয়তো ওপেন এন্ডিং এ চলচ্চিত্রের রহস্য অনেকটাই উন্মোচিত হত।
অভিনয়ে আরিফিন শুভ এই প্রথম ন্যাচারাল অভিনয় করল। পরিচালক গোলাম সোহরাব দোদুল তার থেকে একদম ন্যাচারাল অভিনয় বের করেছেন। ভাড়ামো ছেড়ে মেইড ইন বাংলাদেশের পর ফ্লোলেস অভিনয় করে গেছেন জাহিদ হাসান। বিদ্যা সিনহা মীম ও সালাউদ্দিন লাভলুর অভিনয়ে আসলেই রহস্য রয়ে গেছে। তবে নেগেটিভ রোল কিংবা কপের ভূমিকায় লাভলু যে বেস্ট চয়েজ হতে পারে তা লাল সবুজ চলচ্চিত্রের রাঙ্গা মামা চরিত্রের পর আবারো দেখা গেলো। তারিক আনাম খানের চরিত্রটি স্পেস পায়নি তেমন।
পরিচালক গোলাম সোহরাব দোদুল সব থেকে বড় যে অসাধ্য কাজটি করেছেন তা হল তিনি প্রেমের দৃশ্য বা মূল কাহিনীতে প্রেম-রোমান্স ছাড়া চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। এজন্য বাহবা পাবেন তিনি।
সব মিলিয়ে যদি বিচার করে তাহলে এই সিদ্ধান্তে আসা যায়, সিনেমার এন্ডিং ধরে নিয়ে যদি সিনেমা শেষ করেন তাহলে মিলে গেলে আপনি মজা কম পাবেন এটাই স্বাভাবিক। যদি এই সিনেমার সিক্যুয়াল না আসে তাহলে এই সিনেমা আরো কিছু দৃশ্য ডিম্যান্ড করে খুব ভালো মানের চলচ্চিত্র হওয়ার জন্য। বাংলাদেশি চলচ্চিত্র হিসাবে সাপলুডু প্রেম ছাড়া থ্রিলারের পথ প্রদর্শক এবং ভালো সিনেমা। ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড হিসাব করলে এটা এভারেজের থেকে একটু উপরের দিকে থাকবে তার কাহিনীর জন্য তবে কোভাবেই একদম অখাদ্য কিছু না। ম্যাস পিপলের কাছে এই সিনেমা ভালো লাগবে।
রেটিং টা দেওয়া ঠিক হবে কি না জানি না। যদি পার্ট টু বের না হয় তাহলে যা ভাবছি সেটা হয়ে থাকলে চলচ্চিত্রটি ৬.৫/১০ রেটিং অনায়েসে পাবে। তবে পার্ট টু বের হয়ে গেলে অনেক কিছু উলটাপালটা ও হয়ে যেতে পারে। সো যারা সিনেমা দেখে ভাবতে ভালোবাসেন তাদের কাছে কিছু প্রশ্ন থেকে যাবে তারপরেও আপনি ভাবতে বাধ্য হবেন, আসল অপরাধী কে? ভাবার জন্য হলেও চলচ্চিত্রটি দেখতে পারেন। কারণ ইসপেসশনের লাটিমটা কি আদৌ পড়েছিল? জানি না আমরা, ঐ একটা দৃশ্য নিয়েই আমরা কতই না তর্ক করে গেলাম। এটা কোনভাবেই ইনসেপশন লেভেলের চলচ্চিত্র নয় তবে বাংলাদেশের থ্রিলারের সম্ভবনাময় একটি চলচ্চিত্র বলা যায়। তাই সে চলচ্চিত্রটি নিয়ে আপনি আলোচনা করতেই পারেন !!!