বাংলা চলচ্চিত্রের সালতামামি ২০১৭
কথায় আছে, “যায় দিন ভাল, আসে দিন খারাপ”। তারপরও সবারই মনে আশা থাকে সামনের দিনগুলো যাতে ফেলে আসা দিনগুলোর চেয়ে ভাল হয়। তেমনি সিনেমাপ্রেমীদেরও কামনা ছিল ২০১৭ সালের বাংলাদেশী সিনেমাগুলো যাতে ২০১৬ সালের চেয়ে ভাল হয়। আসুন দেখে নেই সিনেমাপ্রেমীদের সেই আশা কতটুকু পূরণ হয়েছে, কেমন ছিল ২০১৭ সালের বাংলাদেশী সিনেমার হালচাল। একটা কথা আগেই বলে রাখি, আমি এই সালতামামি’তে শুধু ২০১৭ সালের বাংলাদেশী সিনেমার চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। কোন ছবি বা নায়ক বা নায়িকা শ্রেষ্ঠ ছিল সেটা নির্ণয় করার দায়ভার একান্ত আপনার ব্যক্তিগত ও ঐচ্ছিক।
১. জানুয়ারি:- বছরের প্রথম সিনেমা হিসেবে ৬ জানুয়ারি মুক্তি পায় রকিবুল আলম রকিব পরিচালিত ক্রাইম একশন মুভি “মাস্তান ও পুলিশ“। কাজী হায়াতের সিপাহী (১৯৯১) এর আদলে নির্মিত কাজী মারুফ ও বিন্দিয়া অভিনীত এই ছবিটি বক্স অফিসে মাস্তানি করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। পরের সপ্তাহে অর্থাৎ ১৩ জানুয়ারি মুক্তি পায় ওয়াকিল আহমেদ পরিচালিত রোমান্টিক একশন মুভি “কত স্বপ্ন কত আশা“। বাপ্পী, পরীমনি অভিনীত এই ছবিটিও দর্শকদের স্বপ্ন বা আশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়।
একই দিনে (১৩ জানুয়ারি) মুক্তি পায় শামীম আখতার পরিচালিত সরকারি অনুদানের মুক্তিযুদ্ধ ও রোমান্টিক ঘরানার ছবি “রীনা ব্রাউন”। প্রমা পার্বনী ও বরুন চন্দ অভিনীত এই ছবিটিও মাস অডিয়েন্স এর কাছে পৌঁছাতে পারেনি। ২০ জানুয়ারি মুক্তি পায় মিজানুর রহমান লাবু পরিচালিত ক্রাইম থ্রিলার মুভি “তুখোড়”। শুরুতে তুখোড় রাখঢাক থাকলেও নবাগত শিবলী নোমান ও রাতশ্রী দত্ত অভিনীত এই সিনেমাটিও সফলতার মুখ দেখেনি। একই দিনে (২০ জানুয়ারি) মুক্তি পায় রয়েল খান পরিচালিত রোমান্টিক ড্রামা ধাঁচের মুভি “যে গল্পে ভালোবাসা নেই”। সুমিত ও তানহা মৌমাছি অভিনীত এই ছবিটিতেও দর্শক ভাল কোন গল্প খুঁজে পায়নি। ২৭ জানুয়ারি মুক্তি পায় অভিনেত্রী তানিয়া আহমেদ পরিচালিত রোমান্টিক কমেডি মুভি “ভালোবাসা এমনই হয়”। শুরুতে কিছুটা আলোচিত হলেও ইরফান সাজ্জাদ ও বিদ্যা সিনহা মিম অভিনীত এই সিনেমাটিও তেমন সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হয়।
বোঝা যাচ্ছে ২০১৭ এর শুরুর মাসটা বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের জন্য শুভ ছিল না।
২. ফেব্রুয়ারি:- ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখে মুক্তি পায় আকাশ আশ্চর্য্য পরিচালিত হরর কমেডি মুভি “মায়াবিনী”। জনপ্রিয় একটি তামিল সিনেমার অনুকরণে নির্মিত সাইমন সাদিক ও আইরিন সুলতানা অভিনীত এই ছবিটি মোটামুটি আলোচিত-সমালোচিত হলেও দর্শকদের মনে মায়ার জন্ম দিতে পারেনি। পরের সপ্তাহে অর্থাৎ ১০ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পায় জাকির হোসেন রাজু পরিচালিত রোমান্টিক কমেডি মুভি “প্রেমী ও প্রেমী। একটি আমেরিকান মুভির অনুকরণে নির্মিত আরিফিন শুভ ও নুসরাত ফারিয়া অভিনীত এই সিনেমাটি মোটামুটি সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়।
২৪ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পায় বদরুল আমিন পরিচালিত রোমান্টিক একশন মুভি “সত্যিকারের মানুষ”। নবাগত কংকন বিশ্বাস ও হ্যাপি অভিনীত এই ছবিটিও দর্শকদের সত্যিকারের বিনোদন দিতে ব্যর্থ হয়। একই দিনে (২৪ ফেব্রুয়ারি) মুক্তি পায় খ: মুন্তাহিদুল আলম লিটন পরিচালিত ফ্যামিলি ড্রামা মুভি “শেষ চুম্বন”। সাগর, তন্ময় ও রাইসা অভিনীত এই সিনেমাটির কপালেও সফলতার চুম্বন জুটেনি।
মোটকথা ফেব্রুয়ারিতেও আমাদের সিনেমা আশানুরূপ সফলতা পেয়েছিল না।
৩. মার্চ:- মার্চের ৩ তারিখে মুক্তি পায় সাফি উদ্দিন সাফি পরিচালিত রোমান্টিক একশন মুভি “মিসড কল”। বাপ্পী ও নবাগতা মুগ্ধতা অভিনীত এই সিনেমায় মিশা সওদাগরের অভিনয় প্রশংসিত হলেও দর্শক আশানুরূপভাবে মিসড কল ব্যাক করেননি। একই দিনে (৩ মার্চ) মুক্তি পায় ফাখরুল আরেফিন পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র “ভুবন মাঝি”। পরমব্রত ও অপর্ণা অভিনীত এই ছবিটি ইতিবাচক ফিডব্যাক পেতে সক্ষম হয়। পরের সপ্তাহে অর্থাৎ ১০ মার্চ মুক্তি পায় নাদের চৌধুরী পরিচালিত সোশ্যাল ড্রামা মুভি “মেয়েটি এখন কোথায় যাবে”। ইমদাদুল হক মিলনের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত, জলি ও শাহরিয়াজ অভিনীত এই সিনেমাটির টীমওয়ার্ক ও গান প্রশংসিত হলেও ছবিটি সফলতার ঘরে যেতে পারেনি।
পরের সপ্তাহ (১৭ মার্চ) মুক্তি পায় মনির হোসেন মিঠু পরিচালিত সোশ্যাল একশন মুভি “ভালোবাসা ১৬ আনা”। শাবনীড় ও আদনান অভিনীত এই সিনেমাটি দর্শকমনে ১ আনা ভালোবাসা জন্ম দিতেও সক্ষম হয়নি। পরের সপ্তাহে (২৪ মার্চ) মুক্তি পায় সায়মন তারিক পরিচালিত ক্রাইম একশন মুভি “ক্রাইম রোড”। আনিসুর রহমান মিলন ও শায়লা সাবী অভিনীত এই ছবিটিও সফলতার রোডে হাটতে পারেনি। একই দিনে (২৪ মার্চ) মুক্তি পায় বন্ধন বিশ্বাস পরিচালিত রোমান্টিক ড্রামা মুভি “শূন্য”। দুর্বল গল্প ও নির্মাণশৈলীর কারণে নবাগত তুরাজ খান ও সানজিদা তন্ময় অভিনীত এই ছবিটির ফলাফলও ছিল শূন্য।
পরের সপ্তাহে (৩১ মার্চ) মুক্তি পায় হিমেল আশরাফ পরিচালিত রোমান্টিক ট্রাজেডি মুভি “সুলতানা বিবিয়ানা”। মৌলিক গল্প ও সুনির্মাণের কারণে বাপ্পী ও আঁচল অভিনীত এই সিনেমাটি প্রশংসিত হলেও আশানুরূপ ব্যবসাসফল হয়নি। একই দিন (৩১ মার্চ) মুক্তি পায় মিজানুর রহমান লাবু পরিচালিত সোশ্যাল ড্রামা মুভি “নুরু মিয়া ও তার বিউটি ড্রাইভার”। ফজলুর রহমান বাবু ও ক্যামেলিয়া অভিনীত এই সিনেমাটিও তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি। ঐ দিন (৩১ মার্চ) আরো মুক্তি পায় রেশমি মিত্র ও সাহাদাত হোসেনের যৌথ পরিচালনায় বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত রোমান্টিক ড্রামা মুভি “হঠাৎ দেখা”। কবিগুরুর একই নামের কাব্য অবলম্বনে নির্মিত ইলিয়াস কাঞ্চন ও দেবশ্রী রায় অভিনীত এই সিনেমাটিও সাধারণ দর্শকদের মাঝে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়ে হঠাৎ হারিয়ে যায়।
মার্চ মাসে সিনেমার সংখ্যা বেশি হলেও কোয়ালিটি বেশি ছিল না।
৪. এপ্রিল:- ৭ এপ্রিল মুক্তি পায় হাসিবুর রেজা কল্লোল পরিচালিত রোমান্টিক ট্রাজেডি মুভি “সত্তা”। সোহানী হোসেনের “মা” গল্প অবলম্বনে নির্মিত শাকিব খান ও পাওলি দাম অভিনীত এই ছবিটি মোটামুটি দর্শকপ্রিয়তা পায়। বিশেষ করে মমতাজের গাওয়া “না জানি কোন অপরাধে” ও জেমসের “তোর প্রেমেতে অন্ধ” গানদুটো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। পরের সপ্তাহে পহেলা বৈশাখে (১৪ এপ্রিল) মুক্তি পায় শামীম আহমেদ রনি পরিচালিত কমেডি অফ ইরর মুভি “ধ্যাততেরিকি”। একটি পাঞ্জাবি ছবির আদলে নির্মিত আরিফিন শুভ ও নুসরাত ফারিয়া অভিনীত ছবিটি মোটামুটি সফলতা লাভ করে।
পরের শুক্রবার (২১ এপ্রিল) মুক্তি পায় সজল আহমেদ পরিচালিত রোমান্টিক ট্রাজেডি মুভি “তুই আমার”। সাইমন ও মিষ্টি জান্নাত অভিনীত এই ছবিটি চরমভাবে ব্যর্থ হয়। পরের সপ্তাহে (২৮ এপ্রিল) মুক্তি পায় শাহ আলম মন্ডল পরিচালিত রোমান্টিক একশন মুভি “আপন মানুষ”। বাপ্পী ও পরীমনি অভিনীত এই সিনেমা মোটামুটি আলোচিত হয় এবং শ্রাবণ শাহের অভিনয় দর্শকদের আপন করে নেয়।
সব মিলিয়ে এপ্রিল মাসটি ২০১৭ সালের বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের মোটামুটি ভাল একটি মাস ছিল।
৬. মে:- ৫ মে মুক্তি পায় স্বপন আহমেদ পরিচালিত বহুল আলোচিত ও প্রতীক্ষিত সায়েন্স ফিকশন মুভি “পরবাসিনী”। রিত মজুমদার ও ইমন অভিনীত এই ছবিটি চরমভাবে ব্যর্থ ও সমালোচিত হয়। পরিচালক অবশ্য এর জন্য সাফটা চুক্তিতে আমদানিকৃত ভারতীয় সিনেমা প্রদর্শনকে দায়ী করেন। একইদিন (৫ মে) অনেকটা নীরবেই মুক্তি পায় অভিনেত্রী মাহবুবা ইসলাম সুমি পরিচালিত টেলিফিল্ম থেকে সিনেমায় রূপান্তরিত হওয়া রোমান্টিক ড্রামা মুভি “তুমি রবে নীরবে”। রবিঠাকুরের “দুই বোন” গল্প অবলম্বনে নির্মিত কলকাতার ভাস্বর চ্যাটার্জি ও অমৃতা চট্টোপাধ্যায় অভিনীত এই ছবিটির ফলাফলও ছিল যথারীতি নীরব। পরের সপ্তাহে (১২ মে) মুক্তি পায় মিজানুর রহমান মিজান পরিচালিত রোমান্টিক ড্রামা মুভি “মিলন সেতু”। বংশগত দ্বন্দ্বের টিপিক্যাল ফর্মুলায় নির্মিত ফাহিম চৌধুরী ও প্রেমা অভিনীত এই ছবিটি দর্শকদের মনে মিলনের সেতু গড়তে ব্যর্থ হয়।
এর পরে রমজান মাস উপলক্ষ্যে মে মাসে আর কোন সিনেমা মুক্তি পায়নি।
৬. জুন:- পবিত্র রমজান মাসের পর ২৬ জুন পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন মুক্তি পায় জয়দীপ মুখার্জী ও আব্দুল আজিজের যৌথ পরিচালনা ও বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত বহুল প্রতীক্ষিত একশন থ্রিলার মুভি “নবাব“। একাধিক হিন্দি সিনেমার ককটেলে নির্মিত হলেও শাকিব খান ও শুভশ্রী অভিনীত এই ছবিটি ব্যাপক সফলতা অর্জন করে বক্স অফিসে নবাবি করে। ঐ ঈদের দিনেই (২৬ জুন) মুক্তি পায় বাবা যাদব ও আব্দুল আজিজের যৌথ পরিচালনা ও বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত ক্রাইম একশন মুভি “বস-২”। জিৎ, শুভশ্রী ও ফারিয়া অভিনীত এই সিনেমাটিও ভাল সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়।
ঈদের তৃতীয় সিনেমা হিসেবে (২৬ জুন) মুক্তি পায় বুলবুল বিশ্বাস পরিচালিত পলিটিক্যাল ড্রামা মুভি “রাজনীতি”। শাকিব খান ও অপু বিশ্বাস অভিনীত এই সিনেমাটি ঈদের অপর দুটো সিনেমার মত ব্যবসা করতে না পারলেও ইতিবাচক মন্তব্য অর্জন করে। ঈদের দিন (২৬ জুন) বিকেলেই চ্যানেল আইতে ওয়ার্ল্ড টিভি প্রিমিয়ার হয় আবু সাইয়ীদ পরিচালিত সুপারন্যাচারাল মুভি “ড্রেসিং টেবিল” এর। তারিন রহমান ও একে আজাদ অভিনীত এই সিনেমাটির দৌড়ও ড্রেসিং টেবিল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল।
মূলত ঈদের কারণেই জুন মাসটি ছিল ২০১৭ সালের সিনেমার সেরা একটি মাস।
৭. জুলাই:- জুনে মুক্তি পাওয়া ঈদের ছবিগুলোর বিপুল দর্শকপ্রিয়তার কারনেই প্রায় এক মাস পর ২৮ জুলাই মুক্তি পায় মারিয়া আফরিন তুষার পরিচালিত সোশ্যাল ড্রামা মুভি “গ্রাস”। অর্ণব ও তমা মির্জা অভিনীত এই ছবিটি বিশেষ শ্রেণীর দর্শকদের মন গ্রাস করলেও তেমন আলোচিত হয়নি। একইদিন (২৮ জুলাই) মুক্তি পায় জসিম উদ্দিন জাকির পরিচালিত রোমান্টিক একশন মুভি “মধু হই হই বিষ খাওয়াইলা”। একাধিক দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার অনুকরণে নির্মিত, জেফ ও রোদেলা তিথী অভিনীত এই সিনেমাটি ভিন্নধর্মী নামের কারনে আলোচিত হলেও এর কপালে মধুর বদলে বিষ জুটেছিল।
মূলত ঈদের সিনেমাগুলোই টিকিয়ে রেখেছিল জুলাই মাসের চলচ্চিত্র ব্যবসা।
৮. আগস্ট:- ৪ আগস্ট মুক্তি পায় অনিমেষ আইচের প্রতীক্ষিত সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার মুভি “ভয়ংকর সুন্দর”। মতি নন্দীর “জলের ঘূর্ণি ও বকবক শব্দ” গল্পের অবলম্বনে নির্মিত, পরমব্রত ও ভাবনা অভিনীত এই ছবিটি ভয়ংকরভাবে হতাশায় পর্যবসিত হয়। পরের সপ্তাহে (১১ আগস্ট) মুক্তি পায় ইয়ুল রাইয়ান পরিচালিত রোমান্টিক একশন মুভি “রাইয়ান”। ইয়ুল রাইয়ান ও অর্ষা অভিনীত এই ছবিটি মুখ থুবড়ে পড়ে। একইদিন (১১ আগস্ট) মুক্তি পায় মঈন বিশ্বাস পরিচালিত রোমান্টিক একশন মুভি “মার ছক্কা”। রোহান ও কোয়েল অভিনীত এই ছবিটি হিরো আলমের বড় পর্দায় অভিষেক হওয়া নিয়ে আলোচিত হলেও শেষপর্যন্ত বোল্ড আউট হয়। পরের শুক্রবার (১৮ আগস্ট) মুক্তি পায় এ আর রহমান পরিচালিত রোমান্টিক ড্রামা মুভি “এক পলকের দেখা”। সালমান জাফরি ও সাবনীড় অভিনীত ছবিটি দর্শক যেন এক পলকও দেখতে রাজি হয়নি।
বলাবাহুল্য আগস্ট মাসটিও ২০১৭ সালকে কিছুই দিতে পারেনি।
৯. সেপ্টেম্বর:- ২ সেপ্টেম্বর পবিত্র ঈদুল আজহার দিন মুক্তি পায় শামীম আহমেদ রনি/আব্দুল মান্নান পরিচালিত কমেডি একশন ফিল্ম “রংবাজ”। শাকিব খান ও বুবলী অভিনীত এই অর্ধ মৌলিক সিনেমাটি নিয়ে দর্শকদের অনেক আগ্রহ থাকলেও মানহীন গল্প ও নির্মাণশৈলীর কারনে সিনেমাটি ব্যাপক নেতিবাচক মন্তব্যের সম্মুখীন হয়। একইদিন (২ সেপ্টেম্বর) আরো মুক্তি পায় শাহাদাৎ হোসেন লিটন পরিচালিত সোশ্যাল একশন মুভি “অহংকার”। শাকিব খান ও বুবলী অভিনীত এই মুভিটি দক্ষিণ ভারতীয় একটি মুভির হুবহু কপি বলে সমালোচিত হয়।
ঈদের (২ সেপ্টেম্বর) তৃতীয় সিনেমা ছিল জাহাঙ্গীর আলম সুমন পরিচালিত মিউজিক্যাল ট্রাজেডি মুভি “সোনা বন্ধু”। ডি এ তায়েব, পপি ও পরিমনির ত্রিমুখী প্রেমের এই মৌলিক গল্পের সিনেমাটির থিম ও গান দর্শকদের পছন্দ হলেও মুভিটি আশানুরূপ ব্যবসা করতে পারেনি। ঈদের দিনেই (২ সেপ্টেম্বর) চ্যানেল আইতে ওয়ার্ল্ড টিভি প্রিমিয়ার হয় অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড পরিচালিত নিরীক্ষাধর্মী মুভি “শেষ কথা”র। ভারতের সমদর্শী ও বাংলাদেশের আইরিন অভিনীত এই ছবিটি শুধু “পুরস্কার পাওয়ার আশায়” নির্মাণ করা হয়েছে বলে অনেকে সমালোচনা করেন।
ঈদের দ্বিতীয় দিন (৩ সেপ্টেম্বর) একই চ্যানেলে প্রিমিয়ার হয় ইফতেখার আহমেদ ফাহমি পরিচালিত সোশ্যাল ড্রামা মুভি “টু বি কন্টিনিউড”। ফাহমি ও পূর্ণিমা অভিনীত এই সিনেমাটি দর্শকদের মনে দাগ কাটতে সক্ষম হয়। যার ফলে পরবর্তীতে এটা সিনেমাহলেও প্রদর্শিত হয়। ২২ সেপ্টেম্বর মুক্তি পায় আকরাম খান পরিচালিত পিরিয়ড ড্রামা মুভি “খাঁচা”। জয়া আহসান ও আবুল কালাম আজাদ পরিচালিত এই ছবিটি বাণিজ্যিক সফলতার স্বাদ না পেলেও সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করে। পরের সপ্তাহে (২৯ সেপ্টেম্বর) মুক্তি পায় আলী আজাদ পরিচালিত রোমান্টিক একশন মুভি “১৬ আনা প্রেম”। সাইমন ও তানিয়া বৃষ্টি অভিনীত এই ছবিটি প্রযোজকের ১ আনা টাকাও ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়।
মোটকথা সেপ্টেম্বর মাসের সিনেমা ব্যবসা টিকেছিল শুধুমাত্র ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে।
১০. অক্টোবর:- ৬ অক্টোবর মুক্তি পায় দীপংকর দীপন পরিচালিত বছরের সবচেয়ে প্রতীক্ষিত কপ অ্যাকশন থ্রিলার মুভি “ঢাকা অ্যাটাক“। আরিফিন শুভ ও মাহিয়া মাহি অভিনীত এই ছবিটি দেখতে দর্শকরা যেন দলে বলে সিনেমাহলগুলোতে অ্যাটাক করে। যার ফলে ছবিটি দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ব্যবসায়িক সফলতা পায়। ২০ অক্টোবর মুক্তি পায় মনতাজুর রহমান আকবর পরিচালিত ফ্যামিলি ড্রামা মুভি “দুলাভাই জিন্দাবাদ”। ডিপজলের কামব্যাক এবং মৌসুমী, বাপ্পী ও মিমের মত তারকাবহুল হয়েও ছবিটি দর্শকদের মনে জিন্দা থাকতে পারেনি। ২৭ অক্টোবর মুক্তি পায় মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীর বহুল আলোচিত ফ্যামিলি ড্রামা (আংশিক বায়োপিক) মুভি “ডুব”। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ভারতের ইরফান খান, পার্নো মিত্র ও তিশা অভিনীত এই ছবিটিও ব্যর্থতার নদীতে ডুব দেয়।
অক্টোবর ছিল ২০১৭ সালের অন্যতম প্রতীক্ষিত মাস। কিন্তু “ঢাকা অ্যাটাক” বাদে অন্য ছবিগুলো সেই প্রতীক্ষার মান রাখতে ব্যর্থ হয়।
১১. নভেম্বর:- ৩ নভেম্বর মুক্তি পায় রয়েল খান পরিচালিত ক্রাইম একশন মুভি “গেইম রিটার্নস”। নিরব, তমা মির্জা ও লাবণ্য অভিনীত এই ছবিটি এর প্রথম কিস্তি থেকে অপেক্ষাকৃত ভাল মানের হলেও সিনেমাহলে দর্শক রিটার্ন করাতে ব্যর্থ হয়। একইদিন মুক্তি পায় জুয়েল ফারসী পরিচালিত রোমান্টিক ড্রামা মুভি “কপালের লিখন”। সংগ্রাম খান ও সানজানা অভিনীত এই ছবিটির নামই অনেকে শুনেনি। তাহলে ভাবুন এর কপালে কি জুটেছিল। ১০ নভেম্বর মুক্তি পায় সরোয়ার হোসেন পরিচালিত সোশ্যাল একশন মুভি “খাস জমিন”। সাইমন ও বিপাশা অভিনীত এই ছবিটিও খাস ফ্লপ হয়।
মোটকথা নভেম্বর ছিল ২০১৭ এর আরেকটি ফ্লপ মাস।
১২. ডিসেম্বর:- ১ ডিসেম্বর মুক্তি পায় তৌকির আহমেদ পরিচালিত সোশ্যাল ড্রামা মুভি “হালদা”। তিশা, মোশাররফ করিম ও জাহিদ হাসান অভিনীত ছবিটি প্রত্যাশার চেয়েও বেশি হলে মুক্তি লাভ ও প্রশংসা অর্জন করলেও দ্বিতীয় সপ্তাহেই এর হাল খারাপ হয়ে যায়। একইদিনে (১ ডিসেম্বর) মুক্তি পায় সাজেদুল আউয়াল পরিচালিত সোশ্যাল ড্রামা মুভি “ছিটকিনি”। রুনা খান ও ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত এই ছবিটি সাধারণ দর্শকদের কাছে পৌঁছানোর আগেই যেন দরজায় ছিটকিনি এঁটে যায়।
৭ ডিসেম্বর মুক্তি পায় দেবাশীষ বিশ্বাস পরিচালিত রোড থ্রিলার মুভি “চল পালাই”। একটি ভারতীয় সিনেমার অনুকরণে নির্মিত শিপন মিত্র, তমা মির্জা ও শাহরিয়াজ অভিনীত এই ছবিটি দর্শকদের বিনোদিত করতে না পারলেও পরিচালক দাবি করেছেন মুক্তির আগেই সিনেমাটির মূলধন উঠে এসেছে।
১৫ ডিসেম্বর মুক্তি পায় মালেক আফসারি পরিচালিত সোশ্যাল ট্রাজেডি মুভি “অন্তর জ্বালা“। একটি তামিল সিনেমার অনুকরণে নির্মিত ও একটি বিতর্কিত গানের কারণে সিনেমাটি নিয়ে সমালোচনা হলেও জায়েদ খান ও পরীমনি অভিনীত এই সিনেমাটি রেকর্ড ১৭৫টি সিনেমাহলে মুক্তি পায়। যদিও ছবিটি আশানুরূপ সফলতা পায়নি তবে এর টিমওয়ার্ক প্রশংসিত হয়। ২২ ডিসেম্বর মুক্তি পায় অপূর্ব রানা পরিচালিত রোমান্টিক ড্রামা মুভি “ইনোসেন্ট লাভ”। পরীমনি ও জেফ অভিনীত এই ছবিটি আশানুরূপ সাড়া ফেলতে ব্যর্থ হয়। একইদিন (২২ ডিসেম্বর) মুক্তি পায় মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত শিশুতোষ এডভেঞ্চার মুভি “আঁখি ও তার বন্ধুরা”। মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই সিনেমাটিতে নাম ভূমিকায় জাহিন নাওয়ার হক ইশা ছাড়াও একঝাঁক কিশোর-কিশোরী অভিনয় করেন। সরকারি অনুদানে নির্মিত এই ছবিটির সমালোচকরা ভূয়সী প্রশংসা করেন।
বছরের শেষ ছবি হিসেবে ২৯ ডিসেম্বর মুক্তি পায় বদরুল আনাম সৌদ পরিচালিত রোমান্টিক ট্রাজেডি মুভি “গহীন বালুচর”। নবাগত তানভীর, মুন ও নীলাঞ্জনা অভিনীত ছবিটির গল্প, নির্মাণশৈলী সমালোচকদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়।
মোটকথা ডিসেম্বর মাসে এসে দর্শক বিভিন্ন ঘরানার বেশকিছু সিনেমা উপহার পায়।
সবমিলিয়ে বলতে গেলে ২০১৭ সালটি বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের জন্য বিশেষ কোন বছর হয়ে না থাকলেও, এতটুকু প্রমাণিত হয়েছে দর্শক ভালমানের বাণিজ্যিক সিনেমা দেখতে চায়। পরিবার নিয়ে সিনেমা দেখতে চায়।
এ বছরের আরেকটি প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে প্রায় প্রতিটি ছবিতেই এক বা একাধিক শ্রুতিমধুর গান ছিল। নির্মাতা ও শিল্পীদের উচিৎ ২০১৭ এর ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা এবং সফলতা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে ২০১৮ সাল থেকে পরবর্তী বচরগুলোতেও দর্শকদের চাহিদার প্রতি সম্মান জানিয়ে সিনেমা করা। আর দর্শক হিসেবে আমাদের উচিৎ তাদের শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন করা।
সিনেমা হলে গিয়ে দেখুন নিজ দেশের সিনেমা। আপনার আমার হাত ধরেই এগিয়ে যাক প্রাণের বাংলা সিনেমা।