সালতামামি ২০২৩ : স্টোরিটেলিংয়ে নতুনত্ব ও নতুন ঘরানা নিয়ে নিরীক্ষণ
ব্যবসায়িক বিচারে চলচ্চিত্রের উদযাপনের বছর হতে পারত ২০২৩ সাল। কিন্তু বছরের সফল সিনেমাগুলো ধরলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চলে আসে আমদানিকৃত ভারতীয় সিনেমার নাম। ধারণা করা যায়, সহসা এ পরিস্থিতি কাটছে না। দেশীয় সিনেমার বিচারে দুই সুপারহিট সিনেমার দেখা মিলেছে। এর বাইরে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকের কিছু সিনেমা দর্শকের আগ্রহ জাগিয়েছে। তবে বাণিজ্য বা মনে রাখার মতো সিনেমা একদমই কম। ঘুরে-ফিরে ৭-৮টি সিনেমার নাম হয়তো মুখে নেয়া যায়।
পোস্টার কোলাজ/ বাংলা মুভি রিভিউ
এক নজরে ২০২৩
২০২৩ সালে মোট ৫১টি বাংলাদেশী চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। বছর শুরু হয় ‘ব্ল্যাক ওয়ার: মিশন এক্সট্রিম ২’ দিয়ে। সানী সানোয়ার ও ফয়সাল আহমেদ পরিচালিত ছবিটি ১৩ই জানুয়ারি মুক্তি পায়। এই মাসে আরও দুটি ছবি মুক্তি পায়, সেগুলো হল ২০শে জানুয়ারি মুক্তিপ্রাপ্ত আবু রায়হান জুয়েলের অ্যাডভেঞ্চারধর্মী ‘অ্যাডভেঞ্চার অব সুন্দরবন’ এবং ২৭শে জানুয়ারি মুক্তিপ্রাপ্ত খন্দকার সুমনের উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক ভাষা সংবলিত ‘সাঁতাও’।
ফেব্রুয়ারি মাসে চলচ্চিত্র মুক্তির খরা কিছুটা কাটিয়ে প্রতি সপ্তাহে প্রেক্ষাগৃহে অন্তত একটি করে চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। ৩রা ফেব্রুয়ারি মুক্তি পায় প্রদীপ ঘোষ পরিচালিত প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে নিয়ে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নির্মিত ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’ ও মো: মাহবুবুর রশিদ পরিচালিত ‘ভাগ্য’। ১০ই ফেব্রুয়ারি মুক্তি পায় রকিবুল আলম রকিবের ‘কথা দিলাম’ ও মোস্তাফিজুর রহমান বাবুর ‘মন দিয়েছি তারে’। ১৭ই ফেব্রুয়ারি মুক্তি পায় শামীম আহমেদ রনী ‘বুবুজান’ এবং ২৪শে ফেব্রুয়ারি মুক্তি পায় ইন্দ্রদীপ রায়চৌধুরীর ‘মায়ার জঞ্জাল’।
মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত চারটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। সেগুলো হল ৩রা মার্চ মুক্তিপ্রাপ্ত ফাখরুল আরেফীন খানের ‘জেকে-১৯৭১’ ও খিজির হায়াত খানের ‘ওরা ৭ জন’; ১০ই মার্চ মুক্তিপ্রাপ্ত পঙ্কজ পলিতের ‘একটি না বলা গল্প’ এবং ১৭ই মার্চ মুক্তিপ্রাপ্ত অনন্য মামুনের ‘রেডিও’।
দেশের প্রধান উৎসব ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে প্রেক্ষাগৃহে ৮টি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। সেগুলো হল তপু খানের সামাজিক অ্যাকশনধর্মী ‘লিডার আমিই বাংলাদেশ’, নাদের চৌধুরীর হররধর্মী ‘জ্বীন’, সৈকত নাসিরের রোমান্টিক-অ্যাকশনধর্মী ‘পাপ: প্রথম চাল’, মো. ইকবালের অ্যাকশনধর্মী ‘কিল হিম’, সাইফ চন্দনের রোমান্টিক-অ্যাকশনধর্মী ‘লোকাল’, সোলায়মান আলী লেবুর রোমান্টিক ‘প্রেম প্রীতির বন্ধন’, সুমন ধরের অ্যাকশনধর্মী ‘শত্রু’ এবং আবু তৌহিদ হীরণের নাট্যধর্মী ‘আদম’।
ঈদের ছবিগুলোর প্রেক্ষাগৃহে দীর্ঘদিন উপস্থিতির ফলে মে মাসে ছবি মুক্তির সংখ্যা কমে যায়। পাশাপাশি ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘পাঠান’ মুক্তির জন্য দেশীয় চলচ্চিত্র নির্মাতারা তাদের চলচ্চিত্র মুক্তি পিছিয়ে দেয়। এই মাসে মুক্তিপ্রাপ্ত দুটি চলচ্চিত্র হল অরণ্য আনোয়ারের ‘মা’ ও যুবরাজ শামীমের ‘আদিম’। ছবি দুটি ২৬শে মে মুক্তি পায়।
উৎসব ছাড়াও সারা মাস জুড়ে ছবি মুক্তির দিক থেকে এই বছরের জুন মাসে সর্বাধিক ১০টি ছবি মুক্তি পায়। ২রা জুন মুক্তি পায় সৈকত নাসিরের ‘সুলতানপুর’ ও বাবুল রেজার ‘আমি টোকাই’। এরপর ৯ই জুন মুক্তি পায় মনতাজুর রহমান আকবরের ‘যেমন জামাই তেমন বউ’; ১৬ই জুন রোজিনা ‘ফিরে দেখা’ ও আমিনুল ইসলাম বাচ্চু ‘ফুলজান’। ২৯শে জুন ঈদুল আযহা উপলক্ষ্যে মুক্তি পায় হিমেল আশরাফের রোমান্টিক ‘প্রিয়তমা’, রায়হান রাফীর রোমান্টিক-থ্রিলারধর্মী ‘সুড়ঙ্গ’, চয়নিকা চৌধুরীর মনস্তাত্ত্বিক থ্রিলারধর্মী ‘প্রহেলিকা’, বন্ধন বিশ্বাসের রোমান্টিক-নাট্যধর্মী ‘লাল শাড়ি’, ও সৈকত নাসিরের অ্যাকশন-থ্রিলারধর্মী ‘ক্যাসিনো’।
১১ই আগস্ট মুক্তি পায় মাশরুর পারভেজের ‘গোয়িং হোম’ এবং এফ এম শাহীন ও হাসান জাফরুল বিপুল ‘মাইক’। ১৮ই আগস্ট মুক্তি পায় হৃদি হক পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ‘১৯৭১ সেই সব দিন’ এবং মোহাম্মদ নুরুজ্জামান পরিচালিত শিশুতোষ ‘আম কাঁঠালের ছুটি’। ২৫ আগস্ট মুক্তি পায় আসিফ ইকবাল পরিচালিত মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম চলচ্চিত্র ‘এমআর-৯: ডু অর ডাই’।
সেপ্টেম্বর মাসের ১ তারিখ মুক্তি পায় মনতাজুর রহমান আকবরের ‘ঘর ভাঙা সংসার’, ৭ তারিখ মুক্তি পায় দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর ‘সুজন মাঝি’, ২২ তারিখ মুক্তি পায় দীপঙ্কর দীপনের ‘অন্তর্জাল’, এবং ২৯ তারিখ মুক্তি পায় মুশফিকুর রহমান গুলজারের ‘দুঃসাহসী খোকা’ ও এস ডি রুবেলের ‘বৃদ্ধাশ্রম’। অক্টোবর মাসে আবারও মুক্তির সংখ্যা কমে যায়। এই মাসে মাত্র দুটি ছবি মুক্তি পায়, তন্মধ্যে ১৩ তারিখ মুক্তি পায় শ্যাম বেনেগালের জীবনীমূলক ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ এবং ২০ তারিখ মুক্তি পায় রাইসুল ইসলাম অনিকের রোমান্টিক ‘ইতি চিত্রা’।
নভেম্বর মাসের চারটি ছবি মুক্তি পায়। সেগুলো হল ৩রা নভেম্বর মুক্তিপ্রাপ্ত চিত্রনায়িকা অরূণা বিশ্বাসের পরিচালনায় প্রথম চলচ্চিত্র ‘অসম্ভব’ ও ওয়ালিদ আহমেদের ‘মেঘের কপাট’, ১০ই নভেম্বর মুক্তিপ্রাপ্ত আরিফুর জামান আরিফের ‘যন্ত্রণা’ এবং ১৭ই নভেম্বর মুক্তিপ্রাপ্ত মানিক মানবিকের ‘আজব ছেলে’। ডিসেম্বর মাসে দেশজুড়ে নির্বাচনী প্রচারণার জন্য ছবি মুক্তিতে প্রভাব পরে। এই মাসে মাত্র দুটি ছবি মুক্তি পায়, সেগুলো হল ৮ই ডিসেম্বর মুক্তিপ্রাপ্ত উজ্জ্বল কুমারের ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’ এবং ১৫ই ডিসেম্বর বাহারউদ্দিন খেলনের ‘ফ্ল্যাশব্যাক ৭১’।
প্রেক্ষাগৃহের পাশাপাশি টেলিভিশন ও ওটিটিতে প্রিমিয়ার হয় কয়েকটি চলচ্চিত্রের। সেগুলোর মধ্যে ২৬শে জুন থেকে আইস্ক্রিনে ‘কাঠবিড়ালী’ খ্যাত পরিচালক নিয়ামুল মুক্তার ‘রক্তজবা’ ছবির স্ট্রিমিং শুরু হয় এবং ঈদুল আযহার তৃতীয় দিন চ্যানেল আইয়ে মোহাম্মদ রাব্বি মৃধার ‘পায়ের তলায় মাটি নাই’ ছবির টিভি প্রিমিয়ার হয়।
বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের পাশাপাশি আমদানিকৃত ৬টি ভারতীয় চলচ্চিত্রও দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। এই বছরের প্রথম আমদানিকৃত চলচ্চিত্র ‘পাঠান’। এরপর আগস্ট মাসে ‘কিসি কা ভাই কিসি কি জান’, সেপ্টেম্বর মাসে ‘জওয়ান’ এবং ডিসেম্বর মাসে ‘এনিম্যাল’, ‘মানুষ’, ও ‘ডানকি’ মুক্তি পায়।
আলোচিত ও ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র
এই বছর সবচেয়ে আলোচিত চলচ্চিত্র ছিল ‘প্রিয়তমা’ ও ‘সুড়ঙ্গ’। ‘প্রিয়তমা’ মুক্তির আগেই এর প্রধান অভিনেতা শাকিব খানের বৃদ্ধ লুক ও নতুন অভিনেত্রী ইধিকা পালের সাথে তার রসায়নের জন্য আলোচিত হয়। পাশাপাশি ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রটি ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ চলচ্চিত্রের ২৪ বছরের সর্বাধিক আয়ের রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন ইতিহাস গড়ে, এমন দাবি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়। কিন্তু কোনো ফলাফলে গড়ায়নি সে আলোচনা। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের হিসাব অনুযায়ী ছবিটির গ্রস কালেকশন ৪১ কোটি টাকা। অন্যদিকে ‘সুড়ঙ্গ’ ছবি দিয়ে বড় পর্দায় অভিষেক ঘটে টেলিভিশন পর্দার জনপ্রিয় অভিনেতা আফরান নিশোর। ছবিটি নিয়ে দর্শক ও তার ভক্তরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। নিশোও তার স্বভাবজাত অভিনয় দিয়ে সকলের প্রত্যাশা পূরণ করেন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনার ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ মুক্তি নিয়েও দর্শকের আগ্রহ দেখা যায়। বড় বাজেট ও তারকাবহুল চলচ্চিত্রটি কোন উৎসব ছাড়াই দেশের ১৫৩টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। যদিও মুক্তির পূর্বে এর ট্রেইলার নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়, বিশেষ করে ভিএফএক্সের কাজের জন্য। পরবর্তীতে তা সংশোধন করে মুক্তি দেওয়া হয়। ছবিতে মুজিব চরিত্রের জন্য আরিফিন শুভর ডেডিকেশন প্রশংসিত হয়। তবে এর কিছু দৃশ্যায়নের লোকেশন, যেমন – তৎকালীন কলা ভবনের স্থলে বর্তমান কলা ভবন, বেকার হোস্টেলের স্থলে ফজলুল হক মুসলিম হল কিংবা সিনেটের ভবনের ব্যবহার দৃষ্টিকটু লেগেছে।
মনস্তাত্ত্বিক থ্রিলার ঘরানার ‘প্রহেলিকা’ ছবিটি এর গল্প বলার ধরন দিয়ে দর্শকদের আকৃষ্ট করে। ঈদে মাসালা-অ্যাকশন ছবির ভিড়ে স্টোরিটেলিং, অভিনয় ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ব্যবহার দিয়ে অন্য ছবিগুলো থেকে ছবিটি আলাদাভাবে দর্শকমনে স্থান করে নেয়। ঈদুল ফিতরের ছবি ‘লিডার আমিই বাংলাদেশ’ সুপারহিট ব্যবসা করে। সমাজের নানা অসঙ্গতি নিয়ে ছবিটি বেশ কিছু সামাজিক বার্তা দিলেও একই সাথে বহু ইস্যুর আলোকপাতের কারণে নির্দিষ্ট বা প্রধান কোন স্টোরিটেলিং থেকে দূরে সরে যায়। তবে শাকিব-বুবলীর অভিনয়, সেট, লোকেশন, সামাজিক বার্তা – সবমিলিয়ে ছবিটি উপভোগ্য।
অ্যাকশন-নির্ভর ছবিগুলোর মধ্যে আলোচনায় ছিল ‘ব্ল্যাক ওয়ার: মিশন এক্সট্রিম ২’, ‘কিল হিম’ ও ‘এম.আর-৯: ডু অর ডাই’। ‘মিশন এক্সট্রিম’-এর সিক্যুয়েল হিসেবে ‘ব্ল্যাক ওয়ার: মিশন এক্সট্রিম ২’ মুক্তির আগে থেকেই আলোচনায় ছিল। ধর্মীয় জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণের পুলিশের কলাকৌশল ও ভূমিকা নিয়ে নির্মিত ছবিটি স্টোরিটেলিং, অভিনয় ও সর্বোপরি নির্মাণ দিয়ে এর পূর্ববর্তী পর্ব থেকে ভালো হয়েছে। এছাড়া, অ্যাকশন ছবি হিসেবে ‘কিল হিম’ জমজমাট হলেও গল্পের অনেক ফাঁক-ফোকর রয়ে গেছে। অ্যাকশন দৃশ্যগুলোতে দুর্বলতা দেখা গেছে। পাশাপাশি এমন একটি অ্যাকশন ছবিতে রুবেলের মত অ্যাকশন হিরোকে নিয়ে তাকে পরিপূর্ণ ব্যবহার না করাও দৃষ্টিকটু লেগেছে। অন্যদিকে, কাজী আনোয়ার হোসেনের জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র মাসুদ রানাকে নিয়ে এবং হলিউডের কলাকুশলীদের নিয়ে নির্মিত ‘এম.আর-৯: ডু অর ডাই’ প্রচুর হাইপ সৃষ্টি করলেও দর্শকের প্রত্যাশা ততটা পূরণ করতে পারেনি।
প্রয়াত অভিনেতা ইনামুল হকের গবেষণাপ্রসূত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি ‘১৯৭১ সেই সব দিন’ যুদ্ধকালীন কয়েকটি পরিবারের গল্পের মধ্য দিয়ে যুদ্ধের উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ সুচারুভাবে চিত্রিত করে। হৃদি হকের পরিচালনা, অভিনয়শিল্পীদের অভিনয় দক্ষতা, চিত্রগ্রহণে আলোর ব্যবহার, শিল্প নির্দেশনা ও সেট নির্মাণ, সম্পাদনা-সহ সব বিভাগেই ছবিটি উৎরে গেছে। এছাড়া দেশের প্রথম সাইবার-ক্রাইম থ্রিলার ‘অন্তর্জাল’, তাঁত শিল্পের লড়াই ও মধ্যস্বত্বভোগীদের নিপীড়ন নিয়ে নির্মিত ‘লাল শাড়ি’ ছবিগুলো আলোচনায় ছিল।
এসবের বাইরে একেবারে গ্রাম-বাংলার নিটোল গল্পে নির্মিত দুটি ছবি ‘সাঁতাও’ ও ‘আদিম’ ব্যবসায়িক দিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও শিল্পগুণে অনেকটাই এগিয়ে থাকবে। রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার ‘সাঁতাও’-এ পরিচালক খন্দকার সুমন এক মর্মস্পর্শী গল্প তুলে ধরেন, যেখানে এক মা তার সন্তানের মৃত্যুর পর একটি বাছুরকে নিয়ে কিছুটা সান্ত্বনা পায় এবং তাদের মধ্যে মা-সন্তানের সম্পর্ক তৈরি হয়। নৌকা বাইচ, বিবাহ বা পিঠা উৎসবের মত গ্রামের ঐতিহ্য চিত্রায়নের মাধ্যমে আনন্দের বিপরীতে খরা-বন্যায় তাদের দুর্ভোগ এবং তা থেকে পরিত্রাণ পেতে শহরে এসে দুর্ঘটনায় সবকিছুর সমাপ্তি দক্ষতার সাথে দেখানো হয়েছে এই চলচ্চিত্রে। অন্যদিকে, ‘আদিম’ ছবিতে বস্তিবাসীদের জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনার সৎ চিত্রায়ন। এতে কোন বাহুল্য নেই, মানুষের সহজাত আদিম প্রবৃত্তিই গল্পকে টেনে নিয়ে গেছে। বস্তিবাসীর প্রাত্যহিক ঝগড়া, মাদকাসক্তি, চুরি-ছিনতাই, লোভ-লালসার পাশাপাশি এই মানবেতর জীবন থেকে উত্তরণের জন্য অপরিচিত একজনের সাথে পালিয়ে যাওয়া – এসব কিছু পরিচালক দক্ষতার সাথে পর্দায় দেখিয়েছেন।
যাদের হারিয়েছি
মিয়া ভাই খ্যাত অভিনেতা ফারুক এ বছর ১৫ই মে মারা যান। ১৯৭১ সালে ‘জলছবি’ দিয়ে তার ঢাকাই চলচ্চিত্রে অভিষেক হয়। তিনি ১৯৭৬ সালে প্রবর্তিত প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ‘লাঠিয়াল’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা বিভাগে পুরস্কার পান। এছাড়া তাকে ২০১৬ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আসরে আজীবন সম্মাননা দেয়া হয়। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হল – ‘সুজন সখী’, ‘নয়নমনি’, ‘সারেং বউ’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সখী তুমি কার’, ‘মিয়া ভাই’, ‘এখনো অনেক রাত’ প্রভৃতি।
পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান ১৩ই সেপ্টেম্বর নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। তার উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হল – ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, ‘স্বজন’, ‘আমার ঘর আমার বেহেশত’, ‘অনন্ত ভালবাসা’, ‘কথা দাও সাথী হবে’, ‘সে আমার মন কেড়েছে’ প্রভৃতি। তার পরিচালনায় অভিষেক হয় অকালপ্রয়াত জনপ্রিয় অভিনেতা সালমান শাহ, প্রিয়দর্শিনী অভিনেত্রী মৌসুমী, বুনো সুন্দরী পপি, বর্তমান শীর্ষ তারকা শাকিব খান ও ইরিন জামানের।
‘ঘুড্ডি’ খ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সালাউদ্দিন জাকী ১৯শে সেপ্টেম্বর মারা যান। তিনি ‘ঘুড্ডি’ ছাড়াও ‘আয়না বিবির পালা’, ‘লাল বেনারসি’ ও ‘যা হারিয়ে যায়’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ‘ঘুড্ডি’ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। এছাড়া শিল্পকলায় অবদানের জন্য তিনি ২০২১ সালে একুশে পদক লাভ করেন।
চলচ্চিত্র নির্মাতা শফি বিক্রমপুরী ১৮ই অক্টোবর ব্যাংককে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের পূর্বে ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, ‘ডাকু মনসুর’, ‘বাহাদুর’, ‘সবুজ সাথী’ প্রভৃতি ছবির প্রযোজক-পরিবেশক হিসেবে কাজ করেছেন। তার নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘রাজদুলারী’। তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হল ‘দেনমোহর’, ‘অবুঝ মনের ভালবাসা’ প্রভৃতি।
খ্যাতিমান নৃত্য পরিচালক মাসুম বাবুল দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভোগে ৬ই মার্চ মারা যান। চার দশকের ক্যারিয়ারে তিনি ‘বেদের মেয়ে জোসনা’, ‘বিক্ষোভ’, ‘স্বপ্নের ঠিকানা’, ‘তোমাকে চাই’, ‘বিয়ের ফুল’, ‘ভালবাসি তোমাকে’, ‘ভালোবাসলেই ঘর বাঁধা যায় না’সহ অসংখ্যা চলচ্চিত্রে নৃত্য পরিচালনা করেছেন। পাশাপাশি ‘ওরে সাম্পানওয়ালা’ নামে একটি ছবিও পরিচালনা করেছেন। তিনি ১৯৯৩ সালে ‘দোলা’, ২০০৮ সালে ‘কি জাদু করিলা’ ও ২০১৮ সালে ‘একটি সিনেমার গল্প’ সিনেমার জন্য নৃত্য পরিচালক বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন।
সর্বোপরি, এই বছরের চলচ্চিত্রে গল্প বলার ধরনে নতুনত্ব, সামাজিক বার্তা প্রদান, নতুন বিষয় ও ঘরানার নিয়ে কাজ করার প্রয়াস, সম্পূর্ণ দেশীয় মৌলিক গল্প, নতুনভাবে মুক্তিযুদ্ধের গল্প-বলা, চলচ্চিত্রের গানের জনপ্রিয়তা, স্টারডাম থেকে বেরিয়ে আসা – এই সকল কারণে এই বছরটি দর্শকদের আবারও প্রেক্ষাগৃহে ফেরাতে পেরেছে।