Select Page

সালতামামি ২০২৩: যত গর্জে তত বর্ষেনি ওটিটি

সালতামামি ২০২৩: যত গর্জে তত বর্ষেনি ওটিটি

টিভি নাটক নিয়ে আলোচনা এখন তেমন নেই বললেই চলে। এমনকি ঈদ বা ভালোবাসা দিবসের আয়োজনও ফিকে। এর বদলে ওয়েবের কনটেন্ট, বিশেষ করে সিরিজ নিয়ে আলোচনা হয় বেশি। এখন কলকাতার প্লাটফর্মের জন্যও নির্মাণ করছেন ঢাকার নির্মাতারা। তারা ইতিবাচক সাড়াও পাচ্ছেন। সেটা কতটা এগিয়ে ২০২৩ সালে? বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বেশকিছু সিরিজ ও ফিল্ম আলোচনা এলেও শেষ বিচারে ইতিবাচক মার্ক পেতেই বেশির ভাগই ব্যর্থ। অল্প নির্মাণের মাঝেও দু-একটির বেশি কাজ মনে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

চলতি বছরে সবচেয়ে আলোচিত ও ইতিবাচক নাম্বার পেয়েছে আশফাক নিপুণের ‘মহানগর ২’। ওয়েবে অল্প কাজ করলেও হইচই-এর সিরিজটি মোশাররফ করিমকে দারুণ ফর্ম দিয়েছে। প্রথম সিজনের চেয়ে দ্বিতীয় সিজন বেশি ভালোবাসা পেয়েছে। নিপুণের স্ট্রাইকিং ও ফোড়নকাটা চিত্রনাট্য এবং টানটান নির্মাণ, সঙ্গে ছিল জমজমাট নতুন সিজনের আভাস। সব মিলিয়ে ওসি হারুন ছিল বাংলাদেশি নির্মাতাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। এতে আরো অভিনয় করেন আফসানা মিমি, ফজলুর রহমান বাবু, বৃন্দাবন দাস ও তানজিকা আমিন।

দেশীয় প্লাটফর্ম বিচারে সবচেয়ে আলোচিত কনটেন্ট ছিল ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’। শিহাব শহীনের সিরিজটি চরকিতে মুক্তি পায়। এটি তার আগের সিরিজ ‘সিন্ডিকেট’-এর স্পিনঅফ। মূল সিরিজটি যাচ্ছে-তাই হলেও ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ সুসংহত নির্মাণে চমকে দিয়েছে। চমকপূর্ণ গল্পে দর্শককে টেনে ধরার ক্ষমতা ও অভিনয় মিলিয়ে ছিল জমজমাট বিনোদন। দর্শকপ্রিয়তায় চরকির বিগত দিনের সব কন্টেন্টকেও পেছনে ফেলে দেয়। এতে নাম ভূমিকায় নাসিরউদ্দিন খান হৃদয় দিয়ে অভিনয়ে করেছেন। আলোচনায় থেকেছেন রাফিয়াত রশিদ মিথিলা। কম সময়ের উপস্থিতিতেও মুগ্ধ করেন আবদুল্লাহ আল সেন্টু।

মোশাররফ করিমের উপস্থিতি ধরলে বছরের শেষ চমকটি হতে পারতেন তিনি। ডিসেম্বরে হৈচৈ মুক্তি দেয় ‘মোবারকনামা’। কিছু অভিনেতার দারুণ পর্দা উপস্থিতি সত্ত্বেও গল্প ও উপস্থাপনের খামতিতে থমকে গেছে গোলাম সোহরাব দোদুলের সিরিজটি। এই রকম খামতি বছরজুড়েই ছিল। বিশেষ করে ‘মহানগর ২’ ছাড়া হৈচৈ বাংলাদেশ থেকে রিলিজ হওয়া প্রায় প্রতিটি সিরিজই ব্যর্থ। যেমন ইয়াছির আল হকের ‘সাড়ে ষোল’। আফরান নিশো, জাকিয়া বারী মম, ইন্তেখাব দিনার, ইমতিয়াজ বর্ষণ, আফিয়া বর্ণ ছিলেন মূল ভূমিকায়। এ দুটি সিরিজের ব্যর্থতা অনেকটাই হতাশ করে, কারণ জনরার দিকে একঘেয়েমি থেকে মুক্তি দিতে গিয়েও তেমন কোনো পজিটিভ ফলাফল আসেনি। বরং নির্মাতাদের অপরিপক্কতা উঠে এসেছে।

তবে ক্রাইম-ড্রামা ধাঁচের হলেও ‘মোবারকনামা’ বা ‘সাড়ে ষোল’ থেকে এগিয়ে থাকে চরকির ‘গুটি’। পুরোপুরি আকর্ষণ ধরে রাখতে না পারলেও শঙ্খ দাসগুপ্তের নারীপ্রধান (আজমেরী হক বাঁধন) সিরিজটি আশা জাগিয়েছে। একইভাবে চরকির আরেকটি সিরিজের কথা বলতে হয়, ‘ভাইরাস’। অনম বিশ্বাস পরিচালিত ব্যতিক্রমী কাহিনীর এ সিরিজে ছিলেন শ্যামল মাওলা, তারিক আনাম খান, রাশেদ মামুন অপু ও গোলাম ফরিদা ছন্দা। শুরুটা প্রমিজিং হলেও একাধিক জনারার মিশ্রণ ও গল্পের উপস্থাপনায় বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি সিরিজটিকে এগোতে দেয়নি। লেখনির দুর্বলতা চোখে পড়েছে বারবার। অন্যদিকে আবু শাহেদ ইমনের ‘মারকিউলিস’ ও রেজাউর রহমানের ‘ইন্টার্নশিপ’ ছিল প্রতিশ্রতিশীল কাজ।

যতদূর জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে হৈচৈর জন্য নির্মিত কনটেন্টের মধ্যে বেশি আলোচনায় ছিল ‘বুকের মধ্যে আগুন’। মূলত সালমান শাহর প্রতি দর্শক আবেগকে উসকে দেয়া প্রচারণা চালানো হলেও তানিম রহমান অংশুর সিরিজটি প্রশংসিত হতে পারেনি। তবে পুলিশ অফিসারের চরিত্রে জিয়াউল ফারুক অপূর্ব প্রশংসা পেয়েছে। আর পর্দায় সুপারস্টার আরমান শাহ হিসেবে ইয়াশ রোহন ব্যর্থ। এছাড়া একই প্লাটফর্মের ‘অদৃশ্য’ ও ‘মিশন হান্টডাউন’ স্রেফ আসা-যাওয়ার মধ্যেই থেকেছে।

চ্যানেল আই-এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাজারে আসে আইস্ক্রিন। কিন্তু প্রতিশ্রুতিশীল প্লাটফর্ম হিসেবে এখনো ততটা দাঁড়াতে পারেনি। চলতি বছর উদ্বোধনী ওয়েব সিরিজ হিসেবে মুক্তি পায় ‘আমি কী তুমি’। ভিকি জাহেদের পরিচালনায় অনবদ্য অভিনয় করেছেন করেন মেহজাবীন চৌধুরী ও শ্যামল মাওলা। আইস্ক্রিনের জন্য সিরিজটিই ছিল বছরের একমাত্র অর্জন। অন্যদিকে বিঞ্জের জন্য ভিকি বানিয়েছিলেন ‘সাইলেন্স’। থ্রিলারের সঙ্গে ডার্ক ঘরানার মিশেল। তবে কাহিনি বিল্ডআপ একদমই দুর্বল। এবার দর্শককে চমকে দেয়ার বদলে নতুন কিছু নিয়ে ভাবা উচিত ভিকির। চরকির পর বিঞ্জ বানিয়েছে সবচেয়ে বেশি সিরিজ। আরো আছে ‘সদরঘাটের টাইগার ২’, ‘ইনফিনিটি ২’ ও ‘অগোচরা’। কিন্তু কোনোটিই সাড়া ফেলতে পারেনি।

বছরের সবচেয়ে আলোচিত ওয়েব ফিল্ম ছিল রায়হান রাফী ‘ফ্রাইডে’। তমা মির্জা, নাসির উদ্দিন খান, মোহাম্মদ বারী, নীলাঞ্জনা নীল ছিলেন প্রধান চরিত্রে। রাফীর ভায়োলেন্সপ্রীতি এতে ভালোভাবে ফুটে উঠেছে। তবে রাফী নতুন কিছু না করলে যে আগাতে পারবেন না, সেটা ভালোই বোঝা গেছে।

বছরের শুরুতে আলোচনায় ছিল চরকি ‘উনিশ ২০’। ভালোবাসা দিবসের আগের দিন মুক্তি পাওয়া এ ফিল্মের মাধ্যমে দীর্ঘদিন পর পর্দায় ফেরেন আফসানা আরা বিন্দু। তার সঙ্গে পরিচালক মিজানুর রহমান আরিয়ান বেছে নেন আফসান আরা বিন্দুকে। দুই তারকা জুটি দর্শক বেশ পছন্দ করলেও আরিয়ান এখনো টিভি নাটক ও একই রকমের ইমোশন নির্ভর গল্প থেকে বেরোতে পারেননি। ওয়েবের ফরমেটটা যেন বুঝে উঠতে পারেননি তিনি।  ‘ঊনিশ ২০’ খানিকটা প্রশংসা পেলেও বছরের শেষ দিকে একই প্লাটফর্মে আসা ‘পুনর্মিলনে’ হতাশ করে। এতে ছিলেন সিয়াম আহমেদ ও তাসনিয়া ফারিণসহ বড় কয়েকজন তারকা।

বিঞ্জের আরেকটি কাজ ছিল শিহাব শাহীনের ‘বাবা, সামওয়ান ইজ ফলোয়িং মি’। আজকালকার বহুল চর্চিত ‘সত্য কাহিনী অবলম্বনে’ এটি নির্মিত। বর্ণবৈষম্যের গল্পে বাবা-মেয়ের চরিত্রে ছিলেন শহীদুজ্জামান সেলিম ও তাসনিয়া ফারিণ। ততটা টানটান না হলেও মাঝারি মানের সাড়া পেয়েছে। বছর শেষে আরেকটি সাড়া জাগানো কাজ ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’। চরকিতে মুক্তি পাওয়া এ ফিল্মে পরিচালনার পাশাপাশি অভিনয় করেছেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, সঙ্গে ছিলেন নুসরাত ইমরোজ তিশা। বুসান ও মামি ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শনসহ ভ্যারাইটিসহ নামি পত্রিকায় ছবিটির প্রচার হয়েছে। অবশ্য দেশে প্রচারের জন্য নির্মাতা বেছে নেন জায়েদ খানের ডিগবাজি। পরে আনিসুল হকের কান্না সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রল আইটেম হয়। এর আগে ভারতীয় প্লাটফর্মে রিলিজ হওয়া ‘শনিবার বিকেল’ পাইরেসির মাধ্যমে দেখেন দর্শকরা। ওই ছবি ঘিরে সৃষ্ট হতাশা কাটাতে সাহায্য করেছে ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’। আগের দিনে সিনেমায় দর্শক যেমন শাবানার কান্নার সঙ্গে রিলেট করতে পারতেন, সে ধরনের আবেগী প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে সামাজিক মাধ্যমে। রাজনৈতিকভাবেও বেশ শার্প ছিল এ ফিল্ম। যা নির্মাতা হিসেবে ফারুকীর প্রতি আগ্রহ আরেক ধাপ উসকে দিয়েছে।

এছাড়া হতাশাজনক সাড়া পেয়েছে কয়েক বছর আগে সিরিজ হিসেবে শুরু হওয়া ‘পাফড্যাডি’। কনটেন্টটি ফিল্ম আকারে মুক্তি পায় বঙ্গবিডিতে। পরিচালকও পাল্টে গেছে ফরমেটের সঙ্গে। যার প্রধান চরিত্রে ছিলেন আবুল কালাম আজাদ, আব্দুর নূর সজল ও পরীমণি। এছাড়া একই প্লাটফর্মের কাজল আরেফিন অমির সিরিজ ‘হোটেল রিল্যাক্স’ ব্যাপক দর্শক ফেলেও সামগ্রিকভাবে এর প্রভাব সীমিত।

বছরের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ওটিটি প্লাটফর্ম হিসেবে আবির্ভাব হলেও সিনেমা হলে ভূমিকা রাখা শুরু করেছে চরকি। গত বছর তারা ‘গুণিন’ মুক্তি দেয়, যদিও সেটি শুরু থেকে সিনেমা হলের জন্য ছিল না। তবে এ বছরের অন্যতম হিট ‘সুড়ঙ্গ’ ছিল বড় একটি প্রয়াস। সম্প্রতি শাকিব খানকে নিয়ে ‘তুফান’-এর ঘোষণা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি। এটি বছরের বড় একটি খবর।

সংখ্যার হিসাবে সীমিত সামর্থ্য ও দর্শকের মাঝেও সম্বিলিতভাবে দেশে নির্মিত ওয়েব কনটেন্টের সংখ্যা কম নয়। বিষয়ের নিরিখে এসেছে বৈচিত্র্যও। তবে কেন জানি না দু-একটি কনটেন্ট ছাড়া কোনোটিই সব দিক থেকে সফল হয়ে উঠতে পারছে না। নির্মাণে অপরিপক্কতা থেকে যাচ্ছে। এদিকে প্রযোজক-পরিচালক সবাইকে আরো গভীরভাবে ধ্যান দেয়া উচিত। এছাড়া তারা যেভাবে পেইড রিভিউর ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছেন, তার ক্ষতিকর প্রভাব আরো ব্যাপক হতে সময় নেবে না।


মন্তব্য করুন